:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি, চিত্রশিল্পী

আমার সৈয়দ হক এবং আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

আমার সৈয়দ হক এবং আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি

সৈয়দ হকের সঙ্গে আমার বিশেষ কোনো স্মৃতি নেই। আবার হাজার হাজার পৃষ্ঠা স্মৃতি আছে। সব থেকে বড় বিষয় হলো ছোটোবেলা থেকেই তার পাঠক। প্রথমে কবিতা, তারপর গদ্য। তার যে কবিতাটা আমাকে তার লেখার প্রতি আগ্রহী করেছিলো সেটা, ‘এক আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি’ সিরিজের প্রথম কবিতা—

‘বারান্দায় বসে আছি আমরা। রাত ১১-৩০।
ছাইদান রাখো না ঘরে, তাই পিরিচ দিয়েছিলে।
ছাই উড়ছে মৃত জোনাকির মতো।
লোকে যা জানে না, মেলে ধরছি প্রণয়ের ক্ষত;
যেন তুমি চিকিৎসক জোছনার ক্লিনিকে আজ, তোমার সমুখে।
থামের অন্ধকারে, হাতের চাঁদনামা চিবুকে
কী সাবধানে ধারণ করে আছো মমতা
যা তোমার। কিন্তু অক্ষমতা যেন পাথর,
তা দিয়ে দেয়াল উঠছে প্রতিমুহূর্তে
আমি আর চাই না পুড়তে।
তুমি তো সোনার মতো। তোমাকে বললাম, ‘কী আমার নাম?’
‘কেন, তা জানো না? তুমি নিজেই বলো।’
এত কষ্টে চোখে জলও আসে না। বললাম, আমি দুঃখ, শোক।’
তুমি মাথা নাড়ো। বললাম, ‘আমি সেই লোক
যে বুনেছিল গাছ, যার উপহার বিষ।’
তুমি মাথা নাড়লে তবু। চাঁদের বার্নিশ
দাঁতে হাসলে তুমি। ‘চেষ্টা করে দ্যাখো না আবার।’
‘পরাজিত, রিক্ত, নষ্ট, প্রতারিত, হাহাকার,
ফসিল, কামুক, বুঝি না তো কী নাম আমার।’
জঙ্ঘার নিচে গুটিয়ে সনখ সুন্দর দুটো পা,
বাম হাতে খুলে দিলে খোঁপা—
যেন এক জাহাজডুবির পর নোনাজলে ভাসছি সারারাত,
সুদীর্ঘ চুলের রশি ছুঁড়ে দিলে তুমি অকস্মাৎ
তারপর দুচোখে সাগর ডেকে বললে,
‘অ-বি-রা-ম তোমার জন্ম হয়। তুমি কবি।’

প্রতিটি নারীসঙ্গমের পর আমার কেবল এই কবিতাই মনে হয়েছে, আর নিজেকে কবি মনে হয়েছে। সৈয়দ হক আমাকে এই কবিতা দিয়েছেন বলেই এখনো আমার প্রতিটি সঙ্গমই আশ্চর্য সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকে, আর নিজেকে কবি বলে মনে হয়। তার যে দুটি লাইন আমার জীবনে পরম সত্য হয়ে আছে তা হলো—‘মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর/নিতান্ত মাটির মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর…’

প্রতিটি নারীসঙ্গমের পর আমার কেবল এই কবিতাই মনে হয়েছে, আর নিজেকে কবি মনে হয়েছে। সৈয়দ হক আমাকে এই কবিতা দিয়েছেন বলেই এখনো আমার প্রতিটি সঙ্গমই আশ্চর্য সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকে, আর নিজেকে কবি বলে মনে হয়। তার যে দুটি লাইন আমার জীবনে পরম সত্য হয়ে আছে তা হলো—‘মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর/নিতান্ত মাটির মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর…’

প্রায় ১৬/১৭ বছর আগে তার একটা উপন্যাস পড়েছিলাম, নাম ‘খেলারাম খেলে যা।’ উপন্যাসের একটা চরিত্রের নাম ছিলো জাহেদা। যাকে নিয়ে বাবর আলী নামে এক মাঝবয়েসি আপাত লম্পট এবং মানসিক সমস্যায় জরজর এক লোক উত্তরবঙ্গের দিকে কোথায় বেড়াতে গিয়ে একটা গেস্টহাউজে ওঠে। এবং জাহেদাকে মাঝরাতে যৌন সুরসুড়ি দেয়। জাহেদা ঘুমুতে পারে না। সবার যেমন বাবর আলীর প্রতি ঘেন্না জন্মে, আমার ক্ষেত্রে তা হয় নাই, আমি বাবর আলীর মানসিক যন্ত্রণার দিকটি ধরার চেষ্টা করছিলাম মনে আছে, যুদ্ধে যার বোন ধর্ষিত হয়, যে স্মৃতি তাকে তাড়া করে। তারপর তার ‘রক্তগোলাপ’ চোখে লেগে আছে। সল বেলো’র ‘হেন্ডারসন দ্য রেইন কিং’ এর অনুবাদ ‘শ্রাবণরাজা’ পড়ে আমি অনেকদিন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সৈয়দ হক নানাভাবে আমাকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে গেছে।

তিনি ‘চারবেলা চারদিক’-এর জন্যে একটা কবিতা আমাকে সামনে বসিয়েই লিখে দিয়েছিলেন একবার। সেই কবিতা কম্পোজ না করে স্ক্যান করে, আমি ইলাস্ট্রেশন করে সরাসরি তার হাতের লেখাই মেকআপ করেছিলাম।

সৈয়দ হক অনেক শক্তিমান লেখক ছিলেন। যথা অর্থে সব্যসাচী। ফলত কারো সঙ্গে কোনো বিষয়ে আপোষ না করলেও তিনি শক্তিমানই থাকতেন। তার নানাবিধ আপোষকামিতা ছাড়া তার সবকিছুই আমার ভালো লাগে, তার কথিত লাম্পট্য, প্রেম সবকিছু। তিনি ছিলেন আমার দেখা বৃদ্ধদের মধ্যে সব থেকে স্মার্ট এবং হ্যান্ডসাম মানুষ। সিগারেট ছিলো তার প্রধান লাইফ স্টাইল। তারপর জিন্স।

আমি কখনো ভাবিও নাই যে তার সঙ্গে দেখাটেখা হবে, বাসনাও রাখি নাই। উনার সঙ্গে প্রথম পরিচয় বাঙলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের ক্লাসে ২০১০ সালে। তিনি আমাদের কয়েকটা ক্লাস নিয়েছিলেন। ক্লাসে কী বলেছিলেন মনে নাই, মনে হয় গল্প-টল্প করেছিলেন। তখন তাকে হকভাই ডাকতাম অন্যদের মতো। পরে ২০১৩ থেকে উনার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উনাকে ভাইটাই ডাকি নাই। স্যার ডাকতাম। তার সঙ্গে নিয়মিতই দেখা হতো সপ্তাহে ২/৩ দিন। তিনি বাম পাশে আমার ডেস্ক থেকে ১ মিটার দূরে একটা কাচের ঘরে বসতেন। খুব মাঝে মধ্যে তিনি আমার হাতে একটা পেনট্রাইভ দিয়ে বলতেন প্রিন্ট করে দিতে। আমি উনার পাণ্ডুুলিপি প্রিন্ট করে দিতাম। কিন্তু তিনি আমাকে চিনতে পারেননি, আমিও পুরনো পরিচয় ঝালিয়ে নিতে যাইনি। আমি যে টুকটাক লেখালেখি করি, কবিতাটবিতা লেখার চেষ্টা করি সেটা উনাকে কোনোদিন বলতে ইচ্ছে করেনি (অবশ্য কাউকেই বলতে ইচ্ছে করে না)। কখনো বলিনি যে নেন স্যার আমার একটা বই নেন। প্রায় সময় তরুণ কবিদের দেখতাম উনার সঙ্গে দেখা করতে আসছে। ছবি ওঠাচ্ছে। বই দিয়ে চলে যাচ্ছে। আর সেই বই তিনি টেবিলের তলায় চালান করে দিচ্ছেন। মলাটও খুলে দেখছেন না। হিহিহিহি। কখনো তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি ওঠানো, বা একটা সেল্ফি ওঠানোরও ইচ্ছা হয়নি। ফলত তার সঙ্গে আমার কোনো ফটো নাই (অবশ্য খ্যাতিমান তেমন কারো সঙ্গে আমার কোনো ফটো নাই)।

তারপর তিনি লন্ডনে চলে গেলেন। তারপর তিনি মরার জন্যে দেশে চলে এলেন। আর আমি মনে মনে তার মৃত্যুর দিন গুনতে লাগলাম। কারণ তিনি মরে গেলে ‘কালি ও কলম’ সৈয়দ হক স্মরণসংখ্যার প্রচ্ছদ করতে হবে আমাকে। তার কোন ছবিটা দিয়ে প্রচ্ছদ করবো, আমাদের খোকা ভাইয়ের কাছ থেকে ছবিও নিয়ে রাখলাম কয়েকটা। একটা খসড়া মলাটও বানিয়ে রাখলাম। তারপর তিনি মরে গেলেন।

তো তিনিও আমাকে নতুন করে চিনলেন, আমিও তাকে। উনি আমাকে লেখক হিশেবে চিনলেন না, চিললেন খানিকটা আঁকিয়ে ও খানিকটা ডিজাইনার হিশেবে। তিনি ‘চারবেলা চারদিক’-এর জন্যে একটা কবিতা আমাকে সামনে বসিয়েই লিখে দিয়েছিলেন একবার। সেই কবিতা কম্পোজ না করে স্ক্যান করে, আমি ইলাস্ট্রেশন করে সরাসরি তার হাতের লেখাই মেকআপ করেছিলাম, আমার সম্পাদকও না বলেননি। তার সেই হাতে লেখা আমি ‘ভাই খ্যাপা বাউল’ কবিতাটা এখনো আমার কাছেই আছে। উনার রুমে গিয়ে কখনো আলাপজুড়ে দিতেও ইচ্ছা করেনি। উনার বেশ কয়েকটা গল্প-কবিতার জন্যেও ইলাস্ট্রেশন করেছিলাম। আর তার পূর্ব প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ৫টা উপন্যাসের একটা সংকলনের গেটআপ-মেকআপ থেকে শুরু করে, এডিটিং, প্রেসে পাঠানো পর্যন্ত সব আমার হাতে হয়েছে। ওইটার জন্যে ইলাস্ট্রেশন করেছিলাম। উনার সোনিয়া আমিনকৃত ‘পরানের গহীন ভিতর’-এর অনুবাদের গেটআপ-মেকআপ, প্রচ্ছদও আমার করা। এইসব আমি পরম আনন্দ নিয়ে করেছি। তিনি খুব প্রসংশা করেছিলেন। আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ভদ্রতাসুলভ হিহিহি করে হেসেছিলাম।

তারপর তিনি লন্ডনে চলে গেলেন। তারপর তিনি মরার জন্যে দেশে চলে এলেন। আর আমি মনে মনে তার মৃত্যুর দিন গুনতে লাগলাম। কারণ তিনি মরে গেলে ‘কালি ও কলম’ সৈয়দ হক স্মরণসংখ্যার প্রচ্ছদ করতে হবে আমাকে। তার কোন ছবিটা দিয়ে প্রচ্ছদ করবো, আমাদের খোকা ভাইয়ের কাছ থেকে ছবিও নিয়ে রাখলাম কয়েকটা। একটা খসড়া মলাটও বানিয়ে রাখলাম। তারপর তিনি মরে গেলেন। রেখে গেলেন তার অসমাপ্ত ধারাবাহিক ‘নদী কারো নয়।’

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.