আমার ৯০ দশক পাঠ : প্রথম লীলা চূর্ণ
খুব ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, আমাদের বাড়িতে বাবার ছোট্ট পাঠাগারের পাশে একটা কবিতার মন কেমন করা পরিবেশও ছিল। কারণ, হয়তো বাবা কবিতা লিখতেন বলে। ফলত আমি কবিতা পড়ি সেই শৈশব থেকেই। যা-ই হোক এইবার ভূমিকা বাদ দিয়ে আসল কথা বলি—
৫০ দশক পর্যন্ত আমার কলেজই মোটামুটি পড়েছি। ৬০-৭০ দশক ইউনিভার্সিটির শুরুতে। তারপর যখন পড়া শুরু করেছি ৯০ দশক দিয়েই। ৮০ দশক পেপার-পত্রিকা, লিটলম্যাগের বাইরে তেমন পড়ি নাই, বিশেষ কারও বইপত্র জোগাড় করে পড়ি নাই। ৮০ বাদ দিয়ে ৯০ দশক আমি পড়া ধরেছিলাম ‘লীলা চূর্ণ’ দিয়ে।
২০০৫ সাল। খুব সম্ভবত এপ্রিলের মাঝামাঝি। একদিন নিজাম ভাইয়ের বাসায় গেলাম, ‘আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’ সিনেমাটা দেখলাম। উপন্যাসটা আগে পড়া ছিল বলে সিনেমা দেখতে সুবিধে হলো। আর সিনেমাটা উপন্যাসের চেয়ে বেশি ভালো লেগে গেল। হয়তো জুলিয়েট বিনোশের কারণে।
রাত্রি ১টা পর্যন্ত আমরা দুজনে মিলে কেরু অ্যান্ড কোং বিরচিত মল্টেড হুইস্কি পান করলাম। ১০ পেগের অধিক গলাধঃকরণের ফলে হল্লা শুরু করে দিলাম। নিজাম ভাই বলল, ‘হল্লা করিস না। আম্মা জেগে যাবে।’
হল্লা বাড়িয়ে দিয়ে আমি বললাম, ‘নেহি, তিনি জাগিবেন না। আই লাভ হার।’
নিজাম ভাই খুব সম্ভবত ‘লাভ’ শব্দের জায়গায় অন্য কিছু শুনেছিলেন। তিনি ধাম করে আমার গালে চড় মেরে বসলেন। আমি একটুও ব্যথা পেলাম না। আমার মাথাটা স্প্রিংয়ের মতো কাঁপতে লাগল। খুবই আরাম পেলাম, আর প্রবল আনন্দ হলো প্রাণে। কিন্তু আমি হড়হড় করে নিজাম ভাইয়ের পায়ের ওপর বমি করে দিলাম, ঘরের মেঝেও ভেসে গেল।
পড়তে পড়তে নিজাম ভাইয়ের বুকশেলফে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টের ভাঁজ থেকে পেয়ে গেলাম একটা পাইট বোতল, ভদকার। ওইটাও দর্শনার মাল। যা-ই হোক ভদকা-মাতা আমার একলার লীলাকে চূর্ণ করতে করতে মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দিলো ফকির মজনু শাহর একটা লাইন, ‘আমাকে বলো না নিতে আর শশী-কুসুমের ভার’। আজও সেই লাইন আমার মাথার ভেতর সশব্দে ঘুরে বেড়ায় নমরুদের মাথার ভেতর মহামহিম সেই পরাক্রমশালী মশার মতো।
নিজাম ভাই খুব যত্ন করে ঘরটর মুছে, আমার মুখটুক গামছা দিয়ে মুছে দিলেন। তারপর স্নান সেরে শুয়ে পড়লেন। আমিও শুয়ে পড়লাম। আমার শৈশব থেকে ঘুমের সমস্যা। তখন তো আরও ইনসোমনিয়ার কাল। ওই সব দিনে আমি টানা ১৪ বছর রাতে ঘুমোতে পারতাম না। তন্দ্রামতো আসত, পিন পতনে ঘুম ভেঙে যেত।
সে রাতে হয়তো ঘুমটা হতো যদি বমিটা না হতো। তো তন্দ্রামতোই এসেছিল। হঠাৎ করে তন্দ্রা ছুটে গেল। দেখি নিজাম ভাইয়ের পায়ের পাতা আমার গালের সঙ্গে লেগে আছে। আর তিনি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। নিজাম ভাইয়ের আবার গভীর ঘুম।
তো আমার একবার ঘুম ছুটে গেলে আর ঘুম আসে না। আমি বাথরুমে গিয়ে স্নান করে ফেললাম। গলা জ্বলছিল, আর মাথাটা খুবই পলকা লাগছিল। কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা। রুমে এসে ভাবলাম বইটই পড়ি। বুকশেলফের দিকে যেতে গিয়ে নিজাম ভাইয়ের মাথার পাশের টিপয়ের ওপর দেখি একটি বই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বইয়ের নাম ‘লীলা চূর্ণ’। কবি মজনু শাহ।
বইটা সংগ্রহের ইচ্ছা বের হওয়ার পর থেকেই ছিল। তো পেয়ে গেলাম। আর প্রায় হামলে পড়ে বইটা নিয়ে বিছানায় উঠে গেলাম। তো আর কি? পড়া শুরু করলাম মাঝখান থেকে স্বভাবত। পড়তে পড়তে নিজাম ভাইয়ের বুকশেলফে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টের ভাঁজ থেকে পেয়ে গেলাম একটা পাইট বোতল, ভদকার। ওইটাও দর্শনার মাল। যা-ই হোক ভদকা-মাতা আমার একলার লীলাকে চূর্ণ করতে করতে মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দিলো ফকির মজনু শাহর একটা লাইন, ‘আমাকে বলো না নিতে আর শশী-কুসুমের ভার’। আজও সেই লাইন আমার মাথার ভেতর সশব্দে ঘুরে বেড়ায় নমরুদের মাথার ভেতর মহামহিম সেই পরাক্রমশালী মশার মতো।
ভোরবেলা নিজাম ভাইকে না জাগিয়ে বইটা পেছনে শার্টের ভেতর আমার প্যান্টের খাঁজে গুঁজে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম আমার অরণ্যের বিদ্যালয়, ক্যাম্পাসের দিকে।
এখনো যখন খুব মধ্যে মধ্যে সেই চুরি করে আনা বইটা ওল্টাই, সেই লাইনে আমার চোখ আটকে যায়, ‘আমাকে বলো না নিতে আর শশী-কুসুমের ভার’…