কবিতাগুচ্ছ
গাছের এমন বিপদ জেনেও আব্বা গাছ হতে চাইলেন
গরিবের কবিতা
যারা কাঁদতে কাঁদতে ভাত খায়
চোখের পানি খাওয়ার অপরাধে
তারা চিরদিন গরিব থেকে যায়।
নো ম্যানস ল্যান্ডের কবিতা
আমরা যে গাছের নিচে দাঁড়ায়েছিলাম
তাতে শুধু ফুল ধরতো। ফল ধরতো না।
ক্ষুধার জ্বালায়
ফল গাছের দিকে একবার দৌড় দিছিলাম
পায়ে গুলি করে দিছিলো কে বা কারা
ফলে আমরা ঐ ফুল গাছের নিচেই থেকে যাই
প্রথমে চেষ্টা করছিলাম ফুলের গন্ধ খেয়ে বাঁচবো
দেখি বাঁচা যাবে না।
মানুষের ক্ষুধার সঙ্গে ফুলের গন্ধের সম্পর্ক নাই
পরে পাতা খেয়ে
পরে বাকল খেয়ে
পরে ফুল খেয়ে
পরে গাছ খেয়ে
বাঁচার চেষ্টা করে
আমরা মরে যাই।
আমাদের মরা নিয়ে ফল গাছের তলের লোকেরা খুব নাকি হাসাহাসি করছিলো
হাসতে হাসতে নাকি আমাদের লাশ তাদের কুকুরদের
খেতে দিছিলো
কুকুরগুলো খায় নাই
আমাদের টেনে টেনে নিয়ে কবর দিছিলো।
আম্মা গত বিশ হাজার বছর ধরে হাসেন না
আম্মা আমাদের রেখে যেতে চেয়েছিলেন
বনের পাশের বাড়িতে
যে বনটি নো ম্যান্স ল্যান্ড
ফুল ও পাকা ফলের গন্ধে উন্মাদ
আমরা যাতে লম্বা হায়াত পাই
আর গান গাই
আর ডাকাতি না-শিখি
মিথ্যা বলা না-শিখি
এজন্য আম্মা আমাদের রেখে যেতে চেয়েছিলেন
সেই বনের কাছের বাড়িতে
যে বনটি নো ম্যান্স ল্যান্ড
ফুল আর ফলের গন্ধে উন্মাদ
কিন্তু আমরা এমন একটা বাড়িতে
যার ধারেকাছে কোথাও বন নেই
ফল নেই ফুল নেই
শুধু সেনানিবাস
পুলিশ ফাঁড়ি
কারাগার
এই ব্যর্থতার দায়ে
আম্মা গত বিশ হাজার বছর ধরে হাসেন না
তার মুখে কলঙ্কের মতো কালো ছায়া
ছেলেমেয়ের মুখ দেখা ছাড়া
পৃথিবীতে তার আর কোনো ইচ্ছা নাই।
খোঁপায় ফুল আর ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে
সাগরে বেড়াতে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না
গাছের এমন বিপদ জেনেও আব্বা গাছ হতে চাইলেন
গাছের ঘর থাকে না
গাছের মাথায় বাজ পড়ে
কাঁদতে পারে না
চোখ নাই
বাজ-পড়া শরীর নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে
দাঁড়িয়ে থাকে
গাছের লজ্জা নাই
মানুষ তারে কাটে
কিছু বলে না
গাছের মুখ নাই।
গাছের এমন বিপদ জেনেও আব্বা
গাছ হতে চাইলেন
ফুল, এইভাবে ফুটতেছ কেন
পাগল হয়ে যাচ্ছি
সামনে-পিছে
ডানে-বামে
ফুল ফুটতেছো
খয়েরি
সাদা
হলুদ
নীল
লাল
চোখ পুড়ে যাচ্ছে
ফুল, থামো
এইভাবে ফুটতেছ কেন
বুকের ওপর লিপস্টিকের গাছ
আমি সভ্য মানুষ।
আগে অসভ্য ছিলাম
অসভ্য থাকার সময় লিপস্টিক
সাবান শ্যাম্পু ইত্যাদি লাগতো না
এখন লাগে
সভ্য মানুষের সভ্যতা লাগে
ঘড়ি/সোফা/ফ্রিজ/তালা/টিভি/টুথব্রাশ
এবং আরো ৭ লাখ ৭০ হাজার ৪৯২টা জিনিস
ভাবছিলাম এগুলো গাছে ধরে
গাছ লাগানোর জন্য জমি পাই নাই
সব বিক্রি হয়ে গেছে
(কার জমি কে বিক্রি করলো কে জানে)
দেখি জিনিসগুলো দোকানে আছে
কিনতে টাকা লাগে
আমার টাকা নাই
ফলে আমি মলম পার্টিতে যোগ দিই
একদিন ধরা পড়ি
এখন অবস্থা এমন যে উঠে দাঁড়াতে পারি না
কিন্তু জিনিসগুলো আমার চাই-ই
ভাবছি আমার সাড়ে তিন হাত শরীরই আমার জমি
বুকের ওপর একটা লিপস্টিকের গাছ
পেটের ওপর একটা ফ্রিজের গাছ
মুখের ভিতর একটা টিভির গাছ
হাঁটুতে দুইটা সোফার গাছ লাগাবো…
শরীরের যা অবস্থা
গাছগুলো বাঁচবে কি না, ভাবছি।
ভাবছি, ফল ধরবে কি না
পাগলের মা
পাগলের মা নাই।
পাগলের পৃথিবীতে মা থাকে না।
পাগলের পৃথিবীর বাইরে
পাগলের মা পাগলরে খোঁজে
পাগলের পৃথিবীর ভেতর
পাগল তার মাকে খোঁজে
এক পাগলরে খুঁজে পায় আরেক পাগলের মা
এক পাগলের মাকে খুঁজে পায় আরেক পাগল
ফলে পাগলের সাথে মায়ের
মায়ের সাথে পাগলের
দেখা হয় না। দেখা হলে,
পৃথিবীতে পাগল থাকতো না
পাগলাগারদ থাকতো না
মা হাতে পায়ে ধরে
পাগলরে বাড়ি নিয়ে যেতো
বলতো, ‘বাবারে, আমি তোর মা।
যা-ইচ্ছা পাগলামি তুই আমার সাথে কর
মানুষের সাথে করিস না
মানুষ ‘পাগলের মা’ ডাকলে
শরম লাগে, ভালো লাগে না।’
মা তো পৃথিবীর প্রথম পাগলাগারদ
ছোটো থাকতে
মায়ের সব ছেলে পাগল থাকে
সব ছেলে আগুন খেতে চায়
মা আগুন খেতে দেয় না
মরতে দেয় না
বাঁচতে দেয়
বড় করে তোলে
যাতে ছেলে আর পাগল থাকে না
কিন্তু পাগলের মায়ের ছেলে
আরো বেশি ছোটো হয়ে যায়
আরো বেশি আগুন খেতে চায়
মায়ের একটু ঘুম পায়
আর ছেলে হারিয়ে যায়
আর সে ঘরে থাকে না, বাইরে
আর সে জামা পরে না, নগ্ন
আর সে ইশকুলে যায় না, মূর্খ
আর সে বিয়ে করে না, একলা
আর সে নাগরিক না, ভোট নাই
আর সে চাকরি করে না, গোলাম না
আর সে মিথ্যা বলে না
ফলে তার দুশমন বা বন্ধু বা প্রেমিকা নাই
এবং সে মায়ের কাছে যেতে যায়
আগুন খেতে ভালো লাগে না
মা থাকলে আগুন খেতে দিতো না
মায়ের অভাবে তার আগুন খেতে হয়
পৃথিবী মানুষে ভরা, কেউ তার মা না
সকলেই আগুন খেতে দেয়, নিজেরা খায় না
পাগল পুড়ে গেলে হাসে।
মা হাসতো না, কাঁদতো
ফলে কোনো কোনো রাতে
যেকোনো কবরের কাছে বসে
পাগল তার মায়ের জন্য কাঁদে
কোনো কবর তারে নেয় না
ফলে সে আরো বেশি পাগল
আরো বেশি নগ্ন ও ভোটহীন হয়ে যায়
মানুষ তারে বেঁধে ফেলতে চায়
পাগল পালায়
ফলে মা ছেলেরে, ছেলে মাকে
চিরতরে হারায়
মরা মানুষ কেন ভালোবাসা পাবে না
এত সহজে আমি মরে গেছিলাম যে তাদের বিশ্বাস হয়নি।
আমার মরা শরীরের দিকে তাকিয়ে তারা ভেবেছিলো
এখনো আমার মরা অনেক বাকি।
ফলে তারা মরার পর মরার পর মরার পর মরার পর মরার পর
মরতে মরতে মরতে মরতে
যখন আমি আর মরতে পারি না
যখন আমার আর কিছু থাকে না
যখন মাটিতে মিশে যাই
নিশ্ছিন্ন হয়ে যাই
তখনো ভাবে আমি মরি নাই
তারা চাঁদের দিকে তাকায়
দেখে চাঁদ আমার দিকে অবিকল আমার পুত্রের মতো তাকিয়ে আছে
চাঁদের চোখে পানি
তারা চাঁদকে হত্যা করতে চায়।
গাছ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে অবিকল আমার স্ত্রীর মতো
গাছের চোখে পানি
তারা গাছকে হত্যা করতে চায়
বিলবোর্ডের সুন্দরী নারী আমার দিকে তাকিয়ে তাকে
অবিকল আমার কন্যার মতো
বিলবোর্ডের চোখে পানি
তারা বিলবোর্ডকে হত্যা করতে চায়
আসলে আমার দিকে কেউ তাকায়নি
তারা সকলেই নিজের দুঃখে কাঁদছিলো
কিন্তু নির্বাক গাছ, চাঁদ ও বিলবোর্ড হত্যা করে
চাঁদের নরম আলো, গাছের সবুজ ছায়া
আর বিলবোর্ড থেকে ফ্রি ঝরতে থাকা চিত্তবিনোদন
হারিয়ে
তারা নিঃস্ব হয়ে যায়। একলা গরিব হয়ে যায়।
এবং একদিন আমার কথাও তাদের মনে পড়ে
আমার হাসি
আমার চিৎকার
আমার অহংকার
আমার চোখের পানি
আমার মুখ চুল চোখ হাত আঙুল দাঁত
তাদের মনে পড়ে
তাদের চোখে পানি চলে আসে
কিন্তু তারা গাছ বা চাঁদ বা বিলবোর্ড হত্যার মতো
নিজেদের হত্যা করতে পারে না
সন্তানের মুখ
মায়ের মুখ
স্ত্রীর মুখ ইত্যাদি তাদের মরতে নিষেধ করে
তারা পারে না
ফলে তারা আমাকে ভালোবাসতে চায়
আমি তাদের ভালোবাসা পেতে চাই
যেমন মরার আগে মরতে চাই নাই
কিন্তু তারা আমাকে ভালোবাসতে পারে না
আমি তাদেরকে ভালোবাসার সুযোগ দিতে পারি না
মরা মানুষকে কেন ভালোবাসা যায় না?
মরা মানুষ কেন ভালোবাসা পাবে না?
পৃথিবীতে আমি কিছুদিন রাজা ছিলাম
বলার আগেই আমার পায়ে জুতা পরিয়ে দিতেন
বলার আগেই জুতা খুলে দিতেন
একজন মহিলা
একজন পুরুষ
এদের আমি আম্মা ও আব্বা বলে ডাকতাম।
আমি যখন রাজা ছিলাম তখন আমি জানতাম না
আমি রাজা
ফলে একদিন আমি নিজেই
ভাত খেতে চাইলাম
জুতা পরতে চাইলাম
এবং সেদিনই আমি নিজের গোলামে পরিণত হলাম।
নিজের গোলামি করতে করতে
গোলামির দিকেই হেলে পড়েছে আমার জীবন
আমি বুঝতে পারি নাই।
একদিন মাঝরাতে আমার মনের ভিতর দেখি
একটা ফুলগাছ
তাতে পাখিও ডাকছে
মানুষের মনে গাছ বা পাখি তো বাস্তবে থাকার কথা না
অবাস্তবে থাকে
আমি অবাস্তব সেই ফুলগাছের ফুলের গন্ধ পেলাম
পাখির ডাক শুনলাম মন দিয়ে
পরে জেনেছি এই অবাস্তব ফুলের গন্ধ আর পাখির ডাকের
নাম প্রেম
অর্থাৎ আমি প্রেমে পড়লাম
মনে হলো এই জীবন আমি তুলে দেব
অন্য কারো হাতে
সে নিয়ে যা-ইচ্ছা করুক
আমি কিছু জানি না
জানার দরকার নাই।
কিন্তু সত্যিকারার্থে আরেকজন মানুষের ওপর
আমি আমার জীবনের ভার ফেললাম
তার জীবনের ভার পড়লো আমার ওপর
এখন আমি বহন করি দুইটা জীবন
সেও বহন করে দুইটা জীবন
অর্থাৎ আমরা একজন আরেকজনের জীবনকে
বানিয়ে ফেললাম একটা জ্যান্ত ইনফার্নো
এর মধ্যেই আমাদের ঘরে ছেলে-সন্তান হলো
এবং জীবনকে ইনফার্নো মনে না করে
একটা ফুলবাগান মনে হলো।
আমরা দুইজন বাগানের মালি হয়ে গেলাম
মনে হলো জীবনের যে একটা গভীর অর্থ আছে
আমরা তা জেনেছি
জেনে খুব ভালো লাগছে।
আমরা আমাদের সন্তানের জুতা পরিয়ে দেই
জুতা খুলে দেই
ভালো লাগে।
জন্মের পর আমরা রাজা ও রানি থাকি
মৃত্যুর আগে আমরা গোলাম থাকি।
ইন্ডিয়া আম্মার নানা বাড়ি
আম্মার কাছে শুনেছি যে
ইন্ডিয়া বড় দেশ, কত বড় যে তার কোনো ঠিক নাই।
মনে হতো পৃথিবীর চেয়েও বড়।
কলিকাতা যাইতে লাগতো সাত দিন।
তাজমহল যাইতে সারাজীবনই লেগে যাইতো মনে হয়
মাটির তল দিয়া পথ
কী লম্বা
কী ভয়ানক
এই সব গল্প শুনে বড় হতে হতে
বড় হতে হতে দেখি ইন্ডিয়া ছোটো হয়ে যাইতেছে
যে কেউ তাজমল
যে কেউ কলিকাতা
যে কেউ দিল্লি যাইতে পারে
ইচ্ছা করার আগে চলে যায় দেখি
এই ইন্ডিয়া সেই ইন্ডিয়া না মনে হয়
আম্মার ইন্ডিয়াতে আমি একদিন যাব
পৃথিবীর চেয়ে বড়
ঘুরে এসে আম্মাকে জানাবো
সব ঘটনা
আম্মা আমারে ছুঁয়ে দেখে ফেলবেন অসম্ভব এক ইন্ডিয়া
ততদিনে আম্মার চোখ অন্ধ করো না খোদা
আর মাত্র ২০০ বছর পর আমি পাসপোর্ট পাবো
চলে যাব ইন্ডিয়া
আর মাত্র ১০টা টাকা হলে আমি কিনে ফেলবো
ভিসা
আম্মা আমারে আগে পাখি ডাকতেন
সেটাও মিথ্যা না। কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করে না।
যদি বিশ্বাস করতো
এখনই চলে যেতাম ইন্ডিয়া
উড়ে
ভিসা কেনার টাকা লাগতো না।
খোদা আর মাত্র ২০০টা বছর, তুমি, আম্মারে
অন্ধ করো না।
ছোটো পাখি উড়ে যায় বড় আকাশের দিকে
সোনার পেয়ালা হয়ে নদী বসে থাকে
পাখির ছোটো ঠোঁটের কাছে।
বসে বসে ভাবে, পাখি তারে পুরোটাই গিলে নেবে।
পাখি আর কতটুকু পারে?
সাত ফোঁটা জল খেয়ে ছোটো পাখি
উড়ে যায় বড় আকাশের দিকে।
আকাশ ভাবে, পাখির ডানায় বসে উড়বে সে অন্য কোনো আকাশে।
পাখি আর কতটুকু পারে?
১০০ গ্রাম আকাশ নিয়ে পাখি চলে যায়।
মাটিতে কাঙাল নদী আর আকাশে কাঙাল মহাকাশ
পাখির ছোটো চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে
যথাক্রমে বাষ্পাকুল হয়, মেঘাচ্ছন্ন হয়।