:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
গৌতম মিত্র

কবি, প্রাবন্ধিক

বালি বইয়ের নশ্বর একজন কারিগর

The Book of Questions

বালি বইয়ের নশ্বর একজন কারিগর

কাফে কিংবা মেট্টো হোক, হাঁটতে হাঁটতে বা রাতের খাবার খেতে খেতে হোক, কাগজের টুকরো বা দেশলাই বাক্স বা ন্যাপকিন হোক, এমনকি স্মৃতির পটে হোক, এডমণ্ড জেবস দ্রুত লিখে চলেছেন। কেননা জীবন এমন এক গ্রন্থ যে প্রতিটি মুহূর্তে লিখন দাবি করে। আর একজন লেখক এভাবে সারাজীবন ধরে যেন যেন মৃত্যুর সাধনা করেন। প্রতিটি গ্রন্থের সমাপ্তিবিন্দু তো আসলে একেকটি মৃত্যুই, যেখানে লিখন লেখককে বাতিল করছে, লেখক চলে যাচ্ছেন ঝরা পাতার দলে। জেবস যখন লেখেন: ‘লেখক কেউ নয়’, আমরা একজন লেখকের অনুপস্থিতময় উপস্থিতিতে শিহরিত হই। জেবসের মতো বুঝি, ক্ষতই সকল সৃষ্টির প্রেরণা।

এডমণ্ড জেবস তাঁর ‘বুক অফ কোশ্চেন’ গ্রন্থের শুরুতে লেখক সম্পর্কে লিখছেন ‘তুমি এমন একজন যে যুগপৎ লিখছ ও লিখিত হচ্ছ’। কী লেখেন একজন লেখক? কিছু শব্দ বিদ্যুৎবাহী, যোগাযোগের কারুতন্ত্রে ঘরে ঘরে সন্ধ্যার পর বাতি জ্বেলে যায়। সেই কোন সুদূর অতীতে হেরাক্লিতোস লিখেছিলেন: ‘আমাকে নয়, আমার শব্দকে অনুধাবন কর’। তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি এডমণ্ড জেবস ঈশ্বর, বিধি, নয়ন, নাম, গ্রন্থ ও সমাধি শব্দসমষ্টির অনন্ত সম্ভাবনায় বিশ্বাস করেন, যেখানে অর্থ কোনওদিন ফুরোয় না।

কী লেখেন সেই লেখক?

‘চারটি সমাধি, তিনটি দেশ। মৃত্যু কী সীমান্ত চেনে, কাঁটাতার চেনে? একটি পরিবার। দুইটি মহাদেশ। চারটি শহর। তিনটি নিশান। আর একটি ভাষা। শূন্যতা। একটি ব্যথা’।

মা, বাবা, ভাই ও নিজেকে নিয়ে এমন এপিটাফ লিখন বিশ্বে বিরল, প্রতিটি শব্দ এখানে অশ্রুপাত সক্ষম।

উতরোল ও নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে শব্দ তার গ্রন্থ বুনে চলে। শব্দ যেন আয়নার ক্ষতমুখ। শব্দের ভেতরে আমাদের মানুষ থেকে মানবে পৌঁছানোর পথচলা। এডবণ্ড জেবস হাঁটছেন। ধীরে ধীরে। হাতদুটো আড়াআড়িভাবে পেছনে। যাযাবরের মতো দৃঢ় পদক্ষেপ। আমিত্ব থেকে আমার জীবনের দিকে গুনে গুনে পা ফেলা। অপর হয়ে ওঠার সাধনা। প্রশ্ন ও প্রতিপ্রশ্নের ছন্দে তিনি আলোড়িত। উত্তরের মধ্যে প্রশ্ন ভাসিয়ে দাও। ‘মানুষ থাকবে না। ঈশ্বর থাকবে না। একাকী পৃথিবী শুধু মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্য দিয়ে পথ করে খোলা বই হয়ে থেকে যাবে’

উতরোল ও নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে শব্দ তার গ্রন্থ বুনে চলে। শব্দ যেন আয়নার ক্ষতমুখ। শব্দের ভেতরে আমাদের মানুষ থেকে মানবে পৌঁছানোর পথচলা। এডবণ্ড জেবস হাঁটছেন। ধীরে ধীরে। হাতদুটো আড়াআড়িভাবে পেছনে। যাযাবরের মতো দৃঢ় পদক্ষেপ। আমিত্ব থেকে আমার জীবনের দিকে গুনে গুনে পা ফেলা। অপর হয়ে ওঠার সাধনা। প্রশ্ন ও প্রতিপ্রশ্নের ছন্দে তিনি আলোড়িত। উত্তরের মধ্যে প্রশ্ন ভাসিয়ে দাও।

এই মনীষা তিনি অর্জন করেছেন। তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব একটি সত্তা। জন্ম ১৯ এপ্রিল ১৯১২, মিশরের কায়রো শহরে। ১৯৫৭ থেকে ফ্রান্সে। ১৯৬৭-তে সেই দেশের নাগরিক। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফরাসি লেখকদের একজন। ১৯৬৩ সালে সাত খণ্ডে ‘লিভ্র দে কেন্তিয়োঁ’(বুক অফ কোশ্চেন বা প্রশ্ন পুঁথি)-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মরিস ব্লাশো ও জাক দেরিদার মতো সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৭৭-এ একজন সমালোচক লিখেছেন, ‘বিগত দশ বছরে ফ্রান্সে এমন কিছু লেখা হয়নি যা কোনও না- কোনওভাবে জেবসের রচনার কাছে ঋণী নয়’। দেরিদা তাঁর ‘রাইটিং অ্যাণ্ড ডিফারেন্স’ গ্রন্থে জেবসকে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।

পঞ্চাশ দশকে কায়রোর প্রথম সারির কবিদের একজন জেবসের ধর্মের ব্যাপারে কোনও অনুরাগ ছিল না। কিন্তু ১৯৫৬-র সুয়েজ সংকট মিশরবাসী ইহুদিদের শুধু শঙ্কিত করেই তুলল না, প্রাণ সংশয় দেখা দিল। কবি পাড়ি দিলেন ফ্রান্সে। অতঃপর ‘বুক অফ কোশ্চেন’ রচনার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ইহুদি সত্তা আবিস্কার করবেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, ‘ইহুদি হয়ে জন্মাবার জন্য নতুন করে প্রশ্নার্ত হতে হল আর এখান থেকেই আমার গ্রন্থ রচনার শুরু’

‘বুক অফ কোশ্চেন’-এর সাতটি খণ্ড ও ও ‘বুক অফ রিজেমব্লেন্স’-এর তিনটি খণ্ড, মোট এই দশটি খণ্ডকে একটি গ্রন্থ হিসেবেই ভাবেন জেবস। এই মহাগ্রন্থকে সাহিত্যের কোন জাঁর-এ রাখব ভেবে দিশেহারা হতে হয়। এই গ্রন্থ উপন্যাস-নাটক-কবিতা-প্রবন্ধ নয় বরং এই চারটি ঘরানার মিলিত শৈলিতে রচিত কারুকার্যময় বিচ্ছিন্নলেখ, অ্যাফোরিজম, গান, ভাষা ও শব্দলীলা (ওয়ার্ড-প্লে)। এই গ্রন্থের কেন্দ্র থেকে পরিধি অবধি শুধুমাত্র একটি বিধুর প্রশ্ন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়:

যা বলা যায় না তা কেমন করে বলব?

The Book of Questions [Vol 1] By Edmond Jabès
Translated by Rosmarie Waldrop
Publisher: Wesleyan University Press; Rev. ed. Trans. from the French edition (September 15, 1991) Language: English. Paperback: 404 pages.

ফরাসি সাহিত্যের আর এক অগ্রগণ্য পথিক মালার্মে বিশ্বাস করতেন যা কিছু শুদ্ধ, যা কিছু চিরকালীন পবিত্র, তাকে এক রহস্য আড়াল করে রাখে। ইহুদি ধর্মের দুটি দিক জেবসকে ভাবিয়েছে। ব্যক্তিগত নির্বাসন ও ইহুদিবিনাশ। জেবসের সাফল্য তিনি ইহুদিধর্ম, ঈশ্বর, বাইবেল, নির্বাসন ও মৃত্যুর কথা লিখতে লিখতে পক্ষান্তরে কবিতা, ভাষা ও লিখনের কাছে পৌঁছেছেন। সব থেকে অবাক হই এই ভেবে, যে মহাগ্রন্থের পরতে পরতে তিন ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তালমুদ, তোরা ও কাবালার উল্কাচিহ্ন তা তিনি পড়েছেন প্রথম চারটি খণ্ড সমাপ্ত হওয়ার পর। দিনে দিনে তিনি আত্মগত হয়েছেন। তালমুদ ঘরানায় বিশ্বাসী জেবস মনে করেন, প্রথাগত গল্পে গল্পত্বের বিনাশ ঘটে। জীবনানন্দর ভাষায়, ‘চোখও অনুভব করে যেন ছন্দবিদ্যুৎ’

‘বুক অফ কোশ্চেন’-এর প্রথম তিনটি খণ্ড ইউকেল ও সারা নামে দুই প্রেমিক প্রেমিকাকে নিয়ে। নাৎসি -বাহিনীর ধ্বংসলীলার পটভূমিকায় প্রেম, বিচ্ছেদ ও পরিসমাপ্তি আত্মহত্যায়। পরবর্তী দুটো খণ্ড ‘ইয়েল’ ও ‘এলিয়া’-র বিষয় লেখক ও শব্দ। শেষ খণ্ড ‘এল’। অর্থ বিন্দু। কাবালায় যিনি ঈশ্বর। এই ঈশ্বর একাধারে আলো, শূন্যতা, অনন্ত, শব্দ, প্রশ্ন, অক্ষর ও ঈশ্বর। কাবালিষ্টদের পথ শব্দের মধ্য দিয়ে। এটি শব্দের ঘুম ভাঙাতে পারবার অর্থ একটি গ্রন্থকে জাগানো। জেবস লিখেছেন:

তুমি কোন বইয়ের কথা বলছ
আমি বইয়ের ভেতরে বইয়ের কথা বলছি।

এই বই মরুভূমির মতো অসীম। বোরখেসের ভাষায়, ‘এল লিব্রো দে অ্যারেনা’ (বালির বই)।

‘আমার সমস্ত বই ভাগ ও বিয়োগের’। বেলাশেষে এমন ভাবনায় আক্রান্ত লেখক। ভীরু শিখার মতো তিরতির করে কাঁপতে থাকা কোনও শব্দের দৈবাৎ যদি খোঁজ মেলে, সেজন্যই তো কোন সকালে পথে নামা। একজন উত্তর আধুনিক লেখকের নিয়তি তো এই। চারপাশে যখন হানাহানির রাজনীতি, চাপচাপ অন্ধকার, এডমণ্ড জেবসের মতো লেখকই তো পারেন পথ দেখাতে।

দরজার আড়ালে কী ঘটে চলেছে গো?
একটা বই তার পাতা ঝরাচ্ছে।

এই দুর্লভ উচ্চারণ যে লেখকের মৃত্যুর মতো তুচ্ছ ঘটনা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে? আবার তাঁর জন্ম হবে। সে অন্য বৃত্তান্ত!

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.