

বাল্মীকির কুটির : সমকালীন বাংলা কবিতার উজ্জ্বল সম্পদ
মজনু শাহের কবিতাসমগ্র ‘বাল্মীকির কুটির’ সমকালীন বাংলা কবিতার এক উজ্জ্বল সম্পদ। এখানে আছে আনকা মেঘের জীবনী, লীলাচূর্ণ, মধু ও মশলার বনে, জেব্রামাস্টার, ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না, আমি এক ড্রপআউট ঘোড়া এবং বাল্মীকির কুটির কাব্যগ্রন্থের কবিতা। এর মধ্যে কোনোটি বোধ হয় অপ্রকাশিত এবং অগ্রন্থিত ছিল।
মজনু শাহের কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতা ভিন্ন স্বাদ দেয়। এই ভিন্নতা অনুভব করার সময় মনে হয় কবিতা অনেক রকম। তাঁর কবিতায় বিমূর্ততা, অদ্ভুতরূপ, অস্পষ্টতা ইত্যাদি মগজে ঘোরের সৃষ্টি করে। কবিতার বহিরঙ্গে দেখি নতুন শব্দবন্ধ তৈরি করে নিজের কবিতা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথরেখা।
মজনু শাহ যে ধরনের কবিতা লেখেন তার পক্ষে সুদৃঢ় বক্তব্যও দেন কোনো বইয়ের ভূমিকায় এবং ফেসবুক পোস্টে। কবিতার প্রতি তাঁর দাবি অনেকের চেয়ে ভিন্ন। তিনি মনে করেন, কবিতা শুধু কবির কাজ না। পাঠকের মেধাবিনিয়োগ ছাড়া কবিতা সম্পূর্ণ হয় না।
বিষয়টা বোঝার জন্য আমরা বিমূর্ত চিত্রকলা এবং এবসার্ড নাটকের উদাহরণ দিতে পারি। বিমূর্ত চিত্রকলা সরাসরি কোনো বক্তব্য দেয় না। দর্শক এবং শিল্পরসগ্রহীতার যোগ্যতা অনুসারে সেই শিল্পবস্তু পুনঃনির্মিত হয়। সহজেই প্রশ্ন ওঠে, সারাবিশ্বে চিত্রকলা যেখানে বিমূর্ত হয়ে যাচ্ছে। এমনকি বুদ্ধ আর চিকন বাঁশপাতা আঁকা ছেড়ে চীন- জাপানের শিল্পীরাও ইদানিং পাশ্চাত্যের বিমূর্ততার দিকে ঝুঁকছে, তাহলে কবিতায় বিমূর্ততাকে, ইঙ্গিতময়তাকে গ্রহণ না করার যুক্তি কী?
মজনু শাহের কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতা ভিন্ন স্বাদ দেয়। এই ভিন্নতা অনুভব করার সময় মনে হয় কবিতা অনেক রকম। তাঁর কবিতায় বিমূর্ততা, অদ্ভুতরূপ, অস্পষ্টতা ইত্যাদি মগজে ঘোরের সৃষ্টি করে। কবিতার বহিরঙ্গে দেখি নতুন শব্দবন্ধ তৈরি করে নিজের কবিতা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথরেখা।
মজনু শাহ ‘ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না’র ভূমিকায় তাঁর কাব্যপ্রকরণের পক্ষে ইরানের কবি জালালউদ্দিন রুমির যুক্তি তুলে ধরেছেন। এধরনের যুক্তি বাংলাসাহিত্যেও আছে। চর্যাপদে দেখি, “রুখের তেন্তিলী কুম্ভীরে খায়”—এমন কথা আছে। গাছের তেঁতুল কুমিরে খায়! এ বড় অদ্ভুত কথা। আমাদের জীবনে এমন অনেক অদ্ভুত কথা ছড়িয়ে আছে। সোনার পাথর বাটি, ডুমুরের ফুল, অমাবশ্যার চাঁদ, কানাছেলের নাম পদ্মলোচন ইত্যাদি বাগধারা, প্রবাদ-প্রবচন যে জাতির মধ্যে প্রচলিত থাকে সে জাতি শুধু সরল বাক্যেই কথা বলে না, ইঙ্গিতময়তা সে জাতির মধ্যে বড় একটি অবস্থান নেয়।
বাংলা ভাষার জন্মের আগে, বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির আগেই এই অঞ্চলের আলঙ্কারিকরা রসবিচারে অদ্ভুত রসকে গুরুত্ব দিয়ে গেছেন।
অদ্ভুত কথা, ইঙ্গিতময় ভাষা, বাগধারা ইত্যাদি আমাদের জাতির এক ভিন্ন পরিচয়। ছোটবেলায় বাড়ির সামনে মনাই ফকিরের মাজারকে কেন্দ্র করে ভেলা ভাসানো উৎসবে বয়াতি গানের আসরে এমন অনেক অদ্ভুত রসের পংক্তি শুনতাম। যেমন এক গানে শুনতাম,
“পঞ্চরসের রসিক যে জন তারাই পাইবে নিমন্ত্রণ
জলের নিচে কালীপূজা দেখছনি রে মন।”

প্রচ্ছদ: Van Gagh এর Almond Blossoms অবলম্বনে বিধান সাহা
বইমেলা-২০১৮ । প্রকাশক: চৈতন্য
জলের নিচের কালীপূজা এখনো বুঝি না। এমন অনেক কথা আছে, ইশারা আছে, গানের কলি আছে, পংক্তি আছে। এগুলো বিদেশ থেকে আসেনি। আমাদের লোকেরাই সৃষ্টি করেছে।
মজনু শাহ আমাদের সেই ধারায় কবিতা লেখেন। তিনি আগ্রহী পাঠকের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে কবিতা পূর্ণ করতে চান।
আমি মজনু শাহের ভাষায় কবিতা লিখি না। সরল ভাষাতেই লেখি। তবে অদ্ভুত পংক্তি আমার হাতেও মাঝে মাঝে এসে যায়। সেদিন পুরনো কবিতার খাতায় দেখলাম, ১৯৯৬ সালে ১৯ বছর বয়সে এক কবিতায় লিখেছিলাম, “আসমানে ঘোড়া ছুটায়া জংগলের ঘাস খায়।”
তখন তো সাহিত্যের তেমন কিছুই জানতাম না, তাহলে আমার হাত দিয়ে এমন কথা কেন এসেছে? আমার ধারণা অদ্ভুত রস সৃষ্টি করা সর্বদা সচেতন প্রয়াস নয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবেও আসে।
মজনু শাহের কবিতায় আমরা সেই ঘোরের মধ্যে চলে যেতে পারি। এর মধ্যেই মাঝে মাঝে দ্যুতির মতো জ্বলে ওঠে কোনো কোনো কাব্যসম্পদ।
সত্যিই এক আশ্চর্য ভ্রমণ মজনু শাহের কবিতা।
তাঁর একেকটি গ্রন্থের কবিতা একেক রকম। ‘আমি এক ড্রপ আউট ঘোড়া’য় ছোট ছোট কথায় লিখেছেন। আবার ‘ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়নায়’ প্রশ্নোত্তরে সাজিয়েছেন কাব্যকথা। ‘লীলাচূর্ণ’তে নিয়েছেন সনেটের ফর্ম।
মজনু শাহের কবিতা অনস্বীকার্য সাহিত্যকর্ম, তা স্বীকার করতে হবে।
১৮. ০৬. ২০১৯