রাত্রি মা
আমি অনেকদিন ভুলে গিয়েছিলাম আমার মায়ের নাম রাত্রি। আমার নানার কবরের বুকে পুঁতে দেয়া খেজুরের ডাল যখন হলুদ হতে হতে একদিন সজীব হয়ে উঠলো সেদিন মনে পড়লো আমার মায়ের নাম। রাত্রি জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে চিরদিন। শুয়ে থাকে গাঢ় কুয়াশার ভিতর। নানার কবরের ওপর বেড়ে ওঠা খেজুরের ডাল যখন একটা গাছ হয়ে ওঠে তখন শীতের রাতে বড় মামা একটা মাটির কলসি খেজুরগাছের গলায় বেঁধে দেয়। ভোরবেলা তা গরম রসে পূর্ণ হয়। প্রতিটি ফোঁটায় রাত্রির কান্না মিশে থাকে। আর বড় মামা শেষ সম্বল একটা কড়ই কাঠের দরোজা কাঁধে নিয়ে পার হয়ে যায় সাতপাহাড়। সাতপাহাড়ের ওপারে যে শাদাপরী থাকে সে মামার দরোজার দুইটা কপাটকে বানিয়ে দেয় শাদা দুইটা ডানা। তারপর বড়মামা আর ফেরে না, আমার রাত্রি মা সুরা ইয়াসিন পড়তে পড়তে সুর করে কাঁদে, তার কান্নায় কুরানশরিফের কালো অক্ষরগুলি শাদা হয়ে যায়। রেহেল কেঁপে কেঁপে ওঠে। এর আগের দিন আমার নানি স্নান করতে করতে মরে গিয়ে পুকুরের জলে ভেসে ওঠে দুইটা শাপলা আর একটা পদ্মফুলের পাশে, তখনো পদ্মপাতায় টলোমলো করছিলো জীবনদাশের বিলাপ।
আমার রাত্রি মাকে একদিন তিনটা ডাকিনী নাকি স্বরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো নদীর পাড়ে। মা ভেবেছিলো জরিনা ডাকছে। অথচ জরিনা তখনো ঘুমিয়ে। আমার মা তাহাজ্জুদ নামাজ ভাঙতে ভাঙতে কলসি কাঁখে ডাকিনীদের সঙ্গে জল আনতে গেলো নদীতে। তখনও ফজরের আযান হয়নি, মা বুঝতেই পারলো না। তখনো আমি হয়তো মায়ের স্বপ্নের ভিতর ছিলাম বীজাণু। নানা টের পেয়ে তিন ডাকিনীকে খুন করে মাকে কুড়িয়ে নিয়ে এলো নদীর চর থেকে। তখনো ম্লান জোছনা ডুবে যাচ্ছিলো ঘন বাদাম ক্ষেতের আড়ে। এইসব কথা আমি তোমাকে বলছি কেনো জানতে পারবে না কোনোদিন। কেননা তুমিও কুয়াশার ভিতর শুয়ে শুয়ে তোমার পাখিশিশুদের উড়িয়ে দাও প্রতিদিন। এই রকম অনেক গল্প আমার মাকে নিয়ে আমি লিখে রেখেছি কোথাও শালের পাতায়, কোথাও মেঘের ভাঁজে, কোথাও ঝর্ণার তলে ক্ষয়ে যাওয়া প্রাচীন পাথরে, কোথাও আমার হাতের রেখায়, আকাশের তারায়, কোথাও দিগন্তের গায়ে, কোথাও তোমার চোখের উল্টোপিঠে। তার মানে তুমিও জানো সব গল্প।
শৈশবে আমার রাত্রি মা’র মুখ ভুলে গেছি। আমার মা ছিলো শৈশবের পাহাড়। আমরা পাহাড়ে থাকতাম, পাহাড়ের পায়ের পাতায় একটা টলটলে পুকুর। পুকুরে স্নান করতে নেমে দুপাটি ঝিনুক তুলে আনতাম প্রতিদিন। মা বলতো, ‘এর বুকে মুক্তো থাকে, জানিস!’ প্রতিদিন খুলতাম, বালি থাকতো, মুক্তোর দেখা পাইনি একদিনও।
কখনো তুমিও রাত্রি, আমার মায়ের মতো। বসো রাত মুখোমুখি বসো রাত্রির মতন। বসো ঘুম, চোখজুড়ে বসো স্বপ্নের গোপন। শিশির বসো, ভিজিয়ে দাও বামপাশে খরা আকাশ। ঝড় এসো, ছুঁয়ে যাও রাত, ছুঁয়ে থাকো প্রভাত, কাঁপো দিগ্বিদিক। ঝড় এসো, জানলায় হানো। ঝড় এসো, দরজায় টানো, খুলে যাক দ্বার অবারিত পথ। আসো রাত মুখোমুখি বসি, রাত্রি হও তারপর। খোলো চপল হরিণ। ক্লান্তি তুমি জরির গন্ধে এসো। এই বিষবাষ্পে বাঁধো ভোর। শুধু বিষাদ আসে আনন্দের পাশে, আর পাশে আনন্দ জুয়াচোর। আর রাত্রি মা কুয়াশার মশারির ভিতর শ্যাওলারং রাজহাঁস হয়ে ডুবে থাকে স্মৃতিরহিত।
আমার আর ঘোর ভাঙে না। যারা পাহাড়ে গান বানায়, যারা ঘোর পূর্ণিমায় আজলা ভরে নদী এনে ভিজিয়ে রাখে উঠান আর বারান্দার কারুকাজ, যারা দুরন্ত ঝড়ে বনে বনে ঘুরে ঘুরে জ্বালায় চোখের বৃন্ত, যারা গাছ আর আগাছার নিবিড় রাখীবন্ধন—আমি তাদেরই একজন। আমাকে যদি চিনতে না পারো তবে ফিরে যাও অলিখিত গুহার ভিতর। ওখানে সূর্য গিয়ে তোমাকে ডেকে নেবে একদিন ভোরের বেলা। ভোরের অবসান হয়, অন্ধকার পুড়ে ছাই হলে আমরা প্রত্যেকে সিসিফাসের নিয়তি মেনে নিই দুইহাতে। মা আমার চিরদিন জননী ধরিত্রী হয়ে উদাস চোখে আমাদের আরোহণ আর অবরোহণ দেখে। আর স্মৃতিমগ্ন চোখে হাসে। মায়ের হাসিতে ম্লান হয়ে যায় উদ্ধত সূর্যের দিন।
শৈশবে আমার রাত্রি মা’র মুখ ভুলে গেছি। আমার মা ছিলো শৈশবের পাহাড়। আমরা পাহাড়ে থাকতাম, পাহাড়ের পায়ের পাতায় একটা টলটলে পুকুর। পুকুরে স্নান করতে নেমে দুপাটি ঝিনুক তুলে আনতাম প্রতিদিন। মা বলতো, ‘এর বুকে মুক্তো থাকে, জানিস!’ প্রতিদিন খুলতাম, বালি থাকতো, মুক্তোর দেখা পাইনি একদিনও।
এইসব রূপকথা ভেবে তুমি যদি জানলার ওপারে দেখো শ্যাওলারং রাজহাঁস দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে তাকে সত্য ভেবো না। তোমার কণ্ঠে তখন হংসধ্বনি। তুমি ভুলে আছো গতকাল। ভুলে আছো দীর্ঘ চুলের নদীতে ডুবে যাওয়া প্রেমিক মাছের যন্ত্রণা। তার ঘুমহীন নিষ্পলক চোখের আশ্চর্য বিভা সূর্যকে করে দিলে ম্লান তুমি বিজয়ী। আমার মা তোমাকে চিনবে স্মৃতিরহিত চোখে। রাতে এসো। এইখানে কুয়াশার মশারি জীবনদাশের বিলাপ হয়ে আছে। আমার মা তোমাকে চিনে নেবে সত্যি; আমার মায়ের নাম রাত্রি।