জীবননামা - ২
শ্যামলের জীবন
আমি মনে করি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ধাতের দিক থেকে খুব মিল। যদিও দু-জনের বয়সের তফাত ৩৪ বছর। একই পাড়ায় দু-জনে থেকেছেন ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪। অর্থাৎ জীবনানন্দের ৪৯ থেকে ৫৪ আর শ্যামলবাবুর ১৬ থেকে ২১।
জীবনানন্দ যে বাড়ি ভাড়া আর বাকি দোকানের চালের দাম মেটাতে পারতেন না, এটা শ্যামলবাবু জানতেন।
জীবনানন্দ দিনে দু-বার হাঁটতে বেরোতেন। বিকাল ৫ টা ও রাত ১০ টা। রবীন্দ্র সরোবর লেকের ধারে। বিকালে কবিবন্ধু শংকর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দিনের পর দিন শ্যামলবাবু জীবনানন্দের পাশাপাশি হেঁটেছেন। জীবনানন্দ কথা বলতেন অসম্পূর্ণ বাক্যে।
প্রেমেন্দ্র মিত্র জীবনানন্দকে খুব অবহেলা করতেন। অথচ জীবনানন্দ প্রেমেনকে বড়ো কবি মনে করতেন। বেতারে কবিতা পড়তে গেলে প্রথমেই খোঁজ নিতেন, ‘প্রেমেন আছেন, প্রেমেন এসেছেন।’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অভদ্র নন, খুবই রুচিসম্পন্ন মানুষ, বলতেন, ‘জীবনানন্দ দাশ কোনও কবি নন।’ অশ্রদ্ধা নয়, গভীর বিশ্বাস থেকেই বলতেন। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এইসব ঘটনার সাক্ষী।
শ্যামলবাবু নিজের চোখে দেখেছেন, জীবনানন্দ বেলা ৩ টার সময় খালি গায়ে লুঙ্গি-পরা অবস্থায় রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড়ের রাস্তার কল থেকে দুই বালতিতে জল তুলে বাড়ি ফিরছেন।
জীবনানন্দ ট্রামে চাপা পড়েন শ্যামলবাবুর বাড়ির কাছে ‘দি মজুমদার’ নামে একটি ব্লাউজের দোকানের সামনে। এরপরই শ্যামলবাবুর মন্তব্য, ‘কলকাতায় গরুও ট্রামচাপা পড়ে না’।
প্রেমেন্দ্র মিত্র জীবনানন্দকে খুব অবহেলা করতেন। অথচ জীবনানন্দ প্রেমেনকে বড়ো কবি মনে করতেন। বেতারে কবিতা পড়তে গেলে প্রথমেই খোঁজ নিতেন, ‘প্রেমেন আছেন, প্রেমেন এসেছেন।’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অভদ্র নন, খুবই রুচিসম্পন্ন মানুষ, বলতেন, ‘জীবনানন্দ দাশ কোনও কবি নন।’ অশ্রদ্ধা নয়, গভীর বিশ্বাস থেকেই বলতেন। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এইসব ঘটনার সাক্ষী।
একটা সংশোধন অযোগ্য ‘পাপ’ করেছেন বলে ভাবেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৭৯। তখন তিনি ‘অমৃত’ পত্রিকার সম্পাদক। সুদূর জার্মানির বন শহর থেকে ফিরেই মঞ্জুশ্রী দাশ তাঁর বাবার ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসটি শ্যামলবাবুকে ছাপানোর জন্য জমা দিতে গিয়েছিলেন। ‘রগরগে’ নয় এই ওছিলায় উপন্যাসটি তিনি ফেরত দিয়েছিলেন। মালিকপক্ষর চাপ তো ছিলই।
স্বচক্ষে দেখেছেন, ১৯৫৩-তে সেনেট হলে জীবনানন্দ কেমন কাঁপতে কাঁপতে কবিতা পড়েছিলেন।
একদিন একই বাসে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ও জীবনানন্দ। দুজনেই দাঁড়িয়ে। ৭ নম্বর বেহালার বাস। খদ্দরের ধুতি-খদ্দরের পাঞ্জাবি-পামশ্যু পায়ে জীবনানন্দ দরদর করে ঘামছেন। শ্যামলবাবুর মন্তব্য, ‘আমি জানি, তিনি জীবনানন্দ দাশ। অন্য লোক তা জানে না’।
ছেলে সমরানন্দ দাশ মারা গিয়েছেন একটি পাগলা গারদে, (মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশ মারা যাবেন একটি মনোচিকিৎসা কেন্দ্রে) শ্যামলবাবু আমাদের তা মনে করিয়ে দিতে ভুলেন না।
জীবনানন্দের কালচেতনার সঙ্গে বিভূতিভূষণের ‘ইচ্ছামতী’র কালচেতনার মিল আছে বলে মনে করেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। ‘রাক্ষুসে দরজা’ পার হয়ে কোনও পুরস্কার জোটানো জীবনানন্দের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
জীবনানন্দকে বিষয় করে একটা অদ্ভুত গল্প লেখেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। ‘মাছের কাঁটার সফলতা’।সেই গল্পে লিখছেন, ‘…পাঞ্জাবির নীচে দেবেশের নিজের বুক কচ্ছপের কাটা হৃৎপিণ্ডের মতোই একবার চমকে থেমে গেল। ঠিক শীত নয়—শীতের চেয়েও গাঢ গরমে ঘামে ভিজে উঠে তার ভেতরটা শীতল হতে থাকল—অথচ তা শীত নয়। শীতের চেয়েও শীতল।’ ‘মুদ্রাদোষ’-এ আক্রান্ত জীবনানন্দের গল্প!
একজন মারা যান ১৯৫৪ ও অন্যজন ২০০১। আমি মনে করি ধাতের দিক থেকে বড্ড কাছাকাছি ছিলেন তাঁরা।
২ বৈশাখ ১৪২৬