:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
রবিউল আলম নবী

কবি, গল্পকার

স্বপ্নগ্রস্ত
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

স্বপ্নগ্রস্ত

ঘুমোতে খুব ভালো লাগে। কয়েকটা বছর ঘুমিয়েই কাটিয়েছি। ঘুম এক অবিনশ্বর বেঁচে থাকা— কথাটা একজন কবির। আমি ঘুমের ভেতর অবিনশ্বর বেঁচে থাকতে চাই। বাঁচতে বাঁচতে একদিন টুপ করে মরে যাবো— পরিকল্পনাহীন; এটাই জীবনের একমাত্র ব্রত এখন।

একটা মজার কথা বলি। আমার স্ত্রী; যাকে আমি প্রচণ্ড ঘৃণা করি— হাতে দা থাকলে যাকে অনর্গল কোপাতে দ্বিধাবোধ করবো না একটি মুহূর্ত, কী আশ্চর্য কাল তার হাত ধরে, নদীকে সাক্ষী রেখে যদিও বাস্তবে এখানে কোনো নদী নেই তবুও নদীটির নাম ময়ূরপঙ্খী না ময়ূরাক্ষী মনে নেই, আমি পুরোটা সূর্যাস্ত মহাস্থানগড়ের প্রাচীন ইটের উপর বসেছিলাম। আমাদের রক্তের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল লখিন্দরের সুতানলী সাপ। চোখে তার বেহুলার স্বামীতৃষ্ণা— রক্তে তার সিগমুন্ড ফ্রয়েড— নাচছে মিনিটে বায়াত্তর বার। অথচ তিনি চুমুর সাথে বিষ মিশিয়ে আমাকে হত্যা করতে আপত্তি করবেন না একটিবার। মহাস্থানগড়ের প্রাচীন ইটে জমে থাকা শ্যাওলার উপর তার দুটি উদোম পা; টকটকে লাল নেইলপলিশ কাঁচা রক্তের মতো টলমল করছিলো নোখের উপর, সেই পা, যখন মেলে ধরলেন, আমার ইচ্ছে হচ্ছিল বাসর রাতের মতো আবার পায়ে চুম্বন দিয়েই একটা ঐতিহাসিক মিলন করি এই শ্যাওলা-ধরা-মৃত্তিকার ভেতর দেবে যাওয়া শতাব্দী প্রাচীন ইটের কঙ্কালের প্রসাদে। এমনটা ঘুম ছাড়া সম্ভব হতো কিনা— কেবল প্রশ্নসাপেক্ষ নয়, প্রশ্নোর্ধও বটে।

এই যেমন ধরুন আজ দুপুরে— ভাতঘুমে মাত হয়ে আছি। দুপুরপোড়া ঘুম। কবে বিদ্যুৎ গুটিয়ে নিয়েছে ইলেকট্রিক ফ্যানের গতি জানা নেই। আমি একটা মানচিত্র ধরে হাঁটছি। স্পষ্টতই দেখছি— বর্তমান-অতীত-ভবিষ্যত এলুভেরা, জ্যোৎস্না আর কুয়াশার মিশ্রণে ঘোলা হয়ে আমার চারপাশে কোলাহল শুরু করেছে। তার ভেতর শৈশবের বান্নিতে গিয়ে পয়সার অভাবে কিনতে না পারা মাটির ষাঁড়টা কোথা থেকে রশি ছিঁড়ে এসে তেল চকচকে শিঙ বাগিয়ে মাটির গহীন থেকে তুলে আনছে— আমার ব্যর্থতা, এক দুপুরের কান্না, আম্মার শাসন ইত্যাদি ইত্যাদি। এরা সকলে একেকটা ক্যারেক্টার হয়ে মঞ্চনাটকের কুশীলবের মতো আমাকে শোনাচ্ছে আমারই শৈশবের হাহাকার আর ব্যর্থতার রোদন। ষাঁড়ের গজ ধরে বসে আছে আমার শিশুকাল— লাগাম নেই তবুও কী এক অদৃশ্য লাগাম ধরে ওকে ঘোড়ার মতো দৌঁড়াচ্ছি কোনো এক পৌরাণিক অশ্বের মতো। ষাঁড়ের ক্ষুর থেকে ছিটকে বের হওয়া ধূলার ভেতর গোধূলিদৃশ্য— আর গোধূলিদৃশ্য ফেড়ে টগবগ করে বেরিয়ে আসছে সোলেমানের খোয়াবনামা, আরব্য রজনীর দৈত্য, দাদির কিচ্ছার প্রেত আর রাক্ষস, আলসাম ও গুলরায়হানের পুঁথিগন্ধী লোকায়ত জীবন।

পৃথিবীতে সিদ্ধার্থ আমার প্রিয় চরিত্র। সিদ্ধার্থের সাক্ষাৎ পাবো না— এ ব্যর্থতা আমৃত্যু আমাকে পীড়িত করবে। আহা! এমন চোখ না দেখে মরে যাবো! আহা! এমন মোলায়েম মুচকি হাসি কে হেসেছে ধরণীতে! আমি দেখতে পাবো না? অথচ সেদিন সিদ্ধার্থকে দেখলাম, কপিলাবস্তুর রাস্তায়। সিদ্ধার্থ-সুজাতা শুদ্ধোদনের ধমক অমান্য করে, রাহুলের আকুতি-কাকুতি উপেক্ষা করে কপিলাবস্তুর রাস্তায় হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি দৌঁড়ে কাছে গিয়ে বললাম—
— আপনি সিদ্ধার্থ?
— জ্বি।
— আপনি একটা পূর্ণিমারাতে জন্মেছিলেন?
— অনেকেই জন্মায়।
— আপনি লুম্বিনী কাননে শালবৃক্ষের নিচে প্রসব হয়েছিলেন?
— লোকে বলে।
— আপনার মধ্যে মহাপুরুষোচিত বত্রিশটি সুলক্ষণ দেখতে পাওয়া গিয়েছিলো?
— পণ্ডিত, যাঁরা আমার জন্মপঞ্জিকা তৈরি করেছিলো তাঁরা বলেছেন।
— আপনি হয় রাজচক্রবর্তী রাজা নয় পূর্ণজ্ঞানী মহাপুরুষ হবেন এমন ভবিষ্যদ্বাণীও আছে।
— পণ্ডিতরা বলেছেন। কিন্তু আমি মুক্তি চেয়েছিলাম। অনুপম প্রাসাদ থেকে, রাজ-কালচার আর অসংখ্য স্থুল ভবিষ্যদ্বাণীময় বন্দী জীবন থেকে।
— পেয়েছেন?
— না।
— একটা বিষয় জানার খুব ইচ্ছে ছিলো। ধ্যানমার্গের সাধনায় মার-বিজয় দিয়েই তো আপনি বুদ্ধত্ব পেলেন। ঘটনাটা খুলে বলবেন কি?
যে হাসি দেখার জন্য আমি উদগ্রীব ছিলাম— সেই হাসি দিয়ে, পদ্মপাপড়ির মতো বড় দুটি চোখের পাতায় পলকের ঢেউ তুলে বললেন— সে আমার মিথ্যাবাদী অনুসারীদের জিজ্ঞেস করো আর করো কাশ্মিরী-কবি ক্ষেমঙ্করকে যে ‘ললিতবিস্তর’ লিখেছিল।
— আপনি যেমন সুজাতার অন্নগ্রহণ করে বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন তেমনি চুন্দের অন্ন গ্রহণ করেই কি পরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন?
— সুজাতার অন্ন আমাকে বুদ্ধত্ব দিয়েছে কীনা জানি না তবে চুন্দ যে বিষ মিশিয়ে পরিনির্বাণ দেয়নি আমায়— তার গ্যারান্টি তোমাকে কে দিল?
বললাম— বুঝেছি।

একটা মজার কথা বলি। আমার স্ত্রী; যাকে আমি প্রচণ্ড ঘৃণা করি— হাতে দা থাকলে যাকে অনর্গল কোপাতে দ্বিধাবোধ করবো না একটি মুহূর্ত, কী আশ্চর্য কাল তার হাত ধরে, নদীকে সাক্ষী রেখে যদিও বাস্তবে এখানে কোনো নদী নেই তবুও নদীটির নাম ময়ূরপঙ্খী না ময়ূরাক্ষী মনে নেই, আমি পুরোটা সূর্যাস্ত মহাস্থানগড়ের প্রাচীন ইটের উপর বসেছিলাম। আমাদের রক্তের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল লখিন্দরের সুতানলী সাপ। চোখে তার বেহুলার স্বামীতৃষ্ণা— রক্তে তার সিগমুন্ড ফ্রয়েড— নাচছে মিনিটে বায়াত্তর বার।

তাই ঘুমোতে ভালো লাগে আমার। জেগে থাকা এক বিরক্তিকর অধ্যায়। বাস্তবে সব দুষ্প্রাপ্য। জেগে থাকাটা একটা বাস্তবতা। ঘুম মৃত্যুর সহোদর না হলেও বৈমাত্রেয় ভ্রাতা। জঠরযন্ত্রণাহীন এক আদিভৌতিক জীবন। যাপিতজীবনের অপূরণীয় সমস্ত আবদার ঘুমের কাছে রাখা যায়। আর বাস্তবের অপূর্ণতা স্বপ্নে স্পর্শের জন্য চাই সাধনার মতো চর্চা যা অব্যাহত রাখলে কল্পনাকে টেনে স্বপ্নের ভেতর এনে তার মধ্যে ইচ্ছামতো ও ইচ্ছাতীত অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দেয়া যায়। যেমন— আমার স্ত্রীকে আমি পাই না। কিন্তু ঘুমের ভেতর স্বপ্নে পাই। মহাস্থানগড়ের প্রাচীন ইটের উপর জমে থাকা শ্যাওলার উপর বসে তিনি আমাকে চুমু খান— পাশ দিয়ে বয়ে যায় কোত্থেকে উড়ে আসা একটা ময়ূরপঙ্খী না ময়ূরাক্ষী নদী; এমন করেই পাই।

ঘুমের আদিভৌতিক জগতে আমাকে আমি স্বাগতম জানাই। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়— আকাশটাকে দু’ভাঁজ করে— পরে আরো চারটা ভাঁজ দিয়ে পকেটে ভরে রাখি। আকাশের ভাঁজে ভাঁজে উড়বে খেচর-বিমান-হেলিকপ্টার। একটা হেলিকপ্টারের সাথে একটা ফড়িঙের দুর্ঘটনা ঘটাবো— একটা খেচরের সাথে একটা বিমানের দৌড় প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দেবো। সমস্ত নক্ষত্রকে একসাথে করে পকেটের ভেতর ঝুমঝুমি বাজাবো— নক্ষত্রের আলোয় ঝলমল করবে আমার বুকপকেট। আহা! মেঘে মেঘে ঘষা লেগে হাজারটা ঝর্ণা বেরিয়ে আসবে পকেট থেকে। তা আর হলো কৈ? কিন্তু স্বপ্নে হয়। স্বপ্নে আমি আকাশটাকে জমিয়ে এনে— ডিটারজেন্টে ধুয়ে— ছাদে শুকোতে দিই। বৈশাখী মেঘ আর ঘূর্ণিবায়ুকে তুমুল নাচাই সমুদ্র সৈকতে। নদীগুলোকে টেনে টেনে তুলে এনে সাজিয়ে রাখি টেবিলের উপর। চায়ের কাপে সমুদ্র ঢেলে তাতে তিন চামচ চিনি মিশিয়ে চুমুকে চুমুকে পান করি অনর্গল।

স্বপ্নের ভেতর হাঁটাচলা মানুষের অন্য এক ভুবন থাকে। সে ভুবনের ভুবনেশ্বর সে নিজে। আমার স্ত্রী সেদিন আমাকে এক গ্লাস মৃত্যু এনে দিলো। স্পষ্ট দেখছি গ্লাসভরা অন্ধকার। অন্ধকারের ভেতর ঝলমল করছে মৃত্যু। স্ত্রীর চোখভরা প্রতিশোধ। আঙুলের নোখ শেকড়ের মতো লকলক করছে হত্যার লোভে। যেন এখুনি আমার গলা চেপে পুরো গ্লাসটা ঢেলে দেবে গলনালি দিয়ে। তিনি আমার মৃত্যুদৃশ্য দেখার বাসনায় এমনি উন্মুখ যে— তার মুখের প্রতি রেখায় ফুটে উঠছে ক্রোধের আগুননকশা। অথচ আমি কী চমৎকার— সেই গ্লাস হাতে নিয়ে ঢগঢগ গিলে ফেলি শেষবিন্দুসমেত। আমার কোনো মৃত্যু নেই। মৃত্যুকষ্ট নেই। যেন একগ্লাস অমৃতশরবত খেলাম। আঙুরের কিংবা মাল্টার।

একবার ইচ্ছে হলো প্রথম প্রেমিকার কাছে যাই। গেলামও। দেখি— স্বামীর সাথে সঙ্গম করছে সে। পুরনো প্রেমিকার নগ্নশরীর আমার ভেতর কোনো অনুরণনই তুলছে না। সে বন্দী হয়ে আছে অন্য এক পুরুষের বিশাল শরীরের কারাগারে। একদিকে সুখে মরে যাচ্ছে অন্যদিকে নিস্তারের জন্য ছটফট করছে। এক চোখে হাসি তার অন্য চোখে কান্না। বুঝলাম এখনো ভোলেনি আমায়। এও বুঝলাম সাম্প্রতিক সুখকেও অবজ্ঞা করছে না একটিবার। কী অদ্ভুত দ্বৈত হতে পারে রমণীমন, ঘৃণায় মুখ ফেরালাম আমি। চলে আসতে চাইলাম। পা ফেলতেই দেখি— সে একটা কঙ্কালের বেষ্টনে বন্দী— কোনো মানুষ নয়— স্বামী নয়— আর আমাকে চিৎকার করে বলছে— যেও না আনোয়ার, যেও না। কিন্তু আমি দৌড়াচ্ছি। এতো যে দৌড়াচ্ছি— প্রাণপণ— আমি এক পাও এগুতে পারছি না। আর ফাতেমা– আমার প্রথম প্রেমিকা সেও কঙ্কালের অত্যাচার থেকে বেরুতে পারছে না।

দ্বিতীয় প্রেমিকাকে দেখেছিলাম বটেশ্বর নামক প্রত্নগ্রামের কয়রা নদীর পার। বাস্তবে যদিও সে জামালউদ্দিনের কন্যা কিন্তু স্বপ্নে সে অসম রাজার মেয়ে। কয়রা নদী এখন ধানী জমি। অথচ স্বপ্নে সে নদীর সে কী ঘোলাস্রোত। আর কী পারভাঙা গর্জন তার। সেই পারে দাঁড়িয়ে আছে জামালউদ্দিন ওরফে অসম রাজার কন্যা। হাতে-কানে মাটির অলংকার। গলায় কাচের পুতির মালা। পায়ে জলতরঙ্গ মল। সেই জলতরঙ্গ মল বাজিয়ে দূর্গ-নগরী-কন্যা আমার জন্য ছুটে এসেছে পরিখার পাড়। পেছনে অসমের সৈন্যদল— তাদের হাতে পোড়ামাটির চাকতি, পোড়ামাটির নিক্ষেপাস্ত্র, হস্তকুঠার, বল্লম, লৌহ কিরিচ। পরিখার দুই পাড়ে আমরা দুজন। যেই অসমের কন্যা পরিখায় ঝাঁপ দিলো অমনি পোড়ামাটির চাকতি আঘাত করলো আমার হাঁটুতে, পোড়ামাটির নিক্ষেপাস্ত্র পড়লো আমার স্কন্ধে, হস্তকুঠার বিঁধলো বুকে, পেটে বিঁধলো বল্লম আর লৌহ কিরিচ আমার উরু ভেদ করে বেরিয়ে গেল। সমস্ত শরীরে এত এত অস্ত্রের আঘাত নিয়েও আমি অসমের কন্যাকে নিয়ে কয়রার পার পর্যন্ত আসতে পেরেছিলাম। তারপর কী এক ধাতব অস্ত্রে শরীর থেকে মাথাটা নেমে গেল কয়রার জলে। আর জল থেকে আমার মৃত চোখ তাকিয়ে আছে অসমের কন্যা নাসরিনের দিকে। নাকি জামালউদ্দিনের কন্যা নাসরিন। স্বপ্নে সবই এলোমেলো।
স্বপ্ন যে সবসময় সাধু হবে তা না— এমন ভয়ঙ্করও হয় কখনো-সখনো।

একবার ইচ্ছে হলো প্রথম প্রেমিকার কাছে যাই। গেলামও। দেখি— স্বামীর সাথে সঙ্গম করছে সে। পুরনো প্রেমিকার নগ্নশরীর আমার ভেতর কোনো অনুরণনই তুলছে না। সে বন্দী হয়ে আছে অন্য এক পুরুষের বিশাল শরীরের কারাগারে। একদিকে সুখে মরে যাচ্ছে অন্যদিকে নিস্তারের জন্য ছটফট করছে। এক চোখে হাসি তার অন্য চোখে কান্না। বুঝলাম এখনো ভোলেনি আমায়।

সেদিন— দিন তিনেক আগে হবে হয়তো— সন্ধ্যের পর কাজ নেই কোনো। কাজ না থাকলেই আমি মশারি টাঙিয়ে ঘুমাই। মশা আমার কাছে খুব বিরক্তিকর প্রাণি। মশারি টাঙালে এক নিটোল ঘুম হয়। স্বপ্নের পথটাও মসৃণ হয়। কোনো বাধা-বিঘ্ন থাকে না। স্বপ্নে দেখছি— আমি বিস্তর দৌলতের মালিক। একটা মফস্বল শহরের ভেতর দশটি বাড়ি আমার। এ বাড়ির নাম ক্রোধবাড়ি। এর পাঁচটি কামরা। একটা কাম, একটা লোভ, একটা মোহ, একটা হতাশা ও একটা মাৎসর্যের। ক্রোধবাড়িতে একজন নার্স ও এক ডাক্তারকে অপহরণ করে নিয়ে আসি। ল্যাপটপে তাদের দেখাই যে— তাদের পরিবার আমার হাতে বন্দী। মাস তিনেক তাদের এখানে রেখে ছেড়ে দেবো৷ শর্ত— কোনো রকমের চালাকি করা যাবে না।
কিছুদিন পর আমি একটা বৃদ্ধকে অপহরণ করি। ক্রোধবাড়ি জুড়ে থমথমে শূন্যতা। অপার নীরবতা। বাড়িটার এমনই বৈশিষ্ট্য যে— এখানে কেউ কখনো আসে না। হরর পরিবেশ। ক্রিসমাস রডোড্রেনড্রন ও ইউক্যালিপটাস ভরা গুরুগম্ভীর বাড়ি। মূল গেইটে দুটো সরাইল্যা কুকুর। হিংস্র। কেউ জানে না— আমি এদের কাঁচা মাংস খাওয়াই। যে কোনো প্রাণির— এমনকি মানুষেরও।
ক্রোধবাড়িতে এই বৃদ্ধকে ডাক্তার-নার্স দেখে কিছুটা বিস্মিত হলো বুঝলাম। বৃদ্ধকে বন্দী করি মাৎসর্যের কক্ষে। কামকক্ষ থেকে নার্স আর মোহকক্ষ থেকে ডাক্তার নিয়ে আমি মাৎসর্য কক্ষে প্রবেশ করি। আমার চোখে-মুখে একঝাঁক লাল পাতলা আগুন জ্বলজ্বল করছে। ঘামের সাথে আগুন মুছে বৃদ্ধকে বেঁধে ফেলি একটা চেয়ারে যে চেয়ারটা উনত্রিশ বছর ধরে বুকের ভেতর কাঁচা আগুনের দাপাদাপি করেছে হিসহিস শব্দে।

ঘুমের ভেতর সবই সম্ভব। বাস্তবে এ চেয়ারটাকে কোথায় পেতাম আমি? আমার মাকে ধর্ষণ করে এই চেয়ারটাতেই তো বসেছিলো জানোয়ারটা। আমার বোনকেও ধর্ষণ করে এই চেয়ারেই বসেছিলো এই জানোয়ার।
একটা প্লাস দিয়ে বৃদ্ধের কনিষ্ঠা আঙুলের নোখটা তুলে ফেলি। বৃদ্ধের চিৎকার শুনে আমার কান আনন্দে লাফায়। গড়িয়ে পড়া রক্ত দেখে চোখ মুগ্ধ-অভিভুত। ডাক্তার-নার্সের অমানবিক চিৎকার শুনে আমার ভেতরের মানুষ তাদের ধমকাতে থাকে। আমি আরো অতিমানুষ হয়ে ওঠি। আমার ভেতরের সমর্থ মানুষটা একে একে প্লাস দিয়ে তুলতে থাকে বৃদ্ধের ডানহাতের পাঁচটি নোখ। বাহ্! কী চমৎকার চকচকে নোখ। নোখগুলো হাতে নিয়ে ডাক্তার-নার্সকে হুংকার ছাড়ি— দেখতে পারছেন না লোকটা ব্যথায় চিৎকার করছে। ব্যান্ডেজ করুন। ডাক্তার-নার্স তুলা-গজে মত্ত হয়ে ওঠলো। কাঁচা লাল পাঁচটি নক্ষত্র-ঝনঝন নোখ নিয়ে আমি বেসিনে চলে আসি— ঝুমঝুমি বাজাতে বাজাতে। বেসিনটাকে রক্তের রঙে রাঙা করে শাদা নোখ ধুয়ে বৃদ্ধের সামনে আসি। বৃদ্ধের চিৎকার আর বৃদ্ধের নোখের ঝনঝন শব্দে আমার আত্মার প্রশান্তি পুরো মাৎসর্যকক্ষটাকে ডাক্তার-নার্সের বিচলিত কথোপকথনের ভেতর মুখরিত করে দিলো।
পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি নিয়ে আমি চলে আসি আমার লোভকক্ষে।

তিনদিন পর অসহায় বৃদ্ধের সহায়হীন মুখটা দেখে আমার চিত্ত প্রফুল্ল হয়ে ওঠলো। মানবজন্মের সার্থকতা খুঁজে পেলাম এ দৃশ্য অবলোকন করে। আমার হাতের যাঁতাটার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ যেন আমারই আনন্দের সশব্দ প্রকাশ। বৃদ্ধকে চেয়ারে বেঁধে নার্স-ডাক্তার ডেকে আনি। ব্যান্ডেজ খুলে নোখশূন্য আঙুলগুলোতে জোরে জোরে চাপ দিতে থাকি। বৃদ্ধ চিৎকার করে আর আমার মন খুশিতে ঝলমল। সমস্ত চোখে-মুখে আনন্দের বিদ্যুৎ রৌদ্রকরোজ্জ্বোল দিনের মতো ঝিলিক মেরে ওঠে। কনিষ্ঠা, অনামিকা, মধ্যমা, তর্জনী, বৃদ্ধা— আহা কী মনোমুগ্ধকর আঙুলের নাম— ব্যথার রকমফের।
যাঁতা দিয়ে কেটে ফেলি কনিষ্ঠার মাথা। ডাক্তারকে বলি ব্যান্ডেজ করুন। যাঁতা দিয়ে কেটে ফেলি অনামিকার মাথা। নার্সকে বলি ব্যান্ডেজ করুন। যাঁতা দিয়ে কেটে ফেলি মধ্যমার মাথা। ডাক্তারকে বলি ব্যান্ডেজ করুন। বৃদ্ধের চিৎকার-হাহাকার-আর্তনাদ আমার ভেতরের সুন্দর মানুষটাকে আরো অগ্নিসুন্দর করে তোলে। বৃদ্ধের তর্জনী কাটার সময় আমার অগ্নিসুন্দর মানুষটার ভেতর একটা হিংস্র সরাইল্যা কুত্তা তেড়ে এলো। আমি কুকুরের গর্জন দিয়ে ধীরে ধীরে তর্জনীর মাথা কাটতে থাকি। নার্স-ডাক্তার-বৃদ্ধের রোদনে মাৎসর্যরুম ফেটে যাচ্ছে। আমার চোখে-মুখে হালকা অথচ তেজস্বী আগুনের তাপে অসহ্য হয়ে ওঠে আমি বৃদ্ধাঙ্গুলের মাথাটাও আঙুলস্কন্ধ থেকে নামিয়ে ফেলি। পাঁচটি আঙুলের মাথা হাতে নিয়ে ডাক্তার-নার্সকে হুংকার ছাড়ি— দেখতে পাচ্ছেন না লোকটা ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, আরো দুটো আঙুল বাকি আছে ব্যান্ডেজ করুন।
তুলা-গজে মত্ত ভীতকম্পিত ডাক্তার-নার্সকে রেখে আঙুলের অংশগুলো নিয়ে চলে আসি আমার কুকুরগুলির কাছে। ওদের পরম তৃপ্তি নিয়ে খাইয়ে প্রবেশ করি সেই তৃপ্তিময় লোভকক্ষে।

দিন দশেক পরে একটা চাপাতি নিয়ে মাৎসর্য কক্ষে যাই। চাপাতির ধার মনের ক্রোধের চেয়ে বেশি। চাপাতির ধার দেখে মনে হলো অস্ত্র বড় হলেই শাস্তি বড় হতে পারে না। তুচ্ছ অস্ত্রেও শাস্তিদৃশ্যকে নান্দনিক বীভৎস করে তোলা যায়। অস্ত্রের ভার রেখে অস্ত্রের ধারের কাছে নিজের পৈশাচিক-মানবদৃষ্টিকে গুটিয়ে আনি। পুরোটা চোখজুড়ে ঝিকঝিক করছে সুপারম্যাক্স ব্লেডের ক্রোধ। বৃদ্ধের বাবা-সোনা রোদন, তার অসহায় আস্ফালন, তার সুপারম্যাক্স ব্লেডভীতি আমার ভেতরের আনন্দকে দৌপুরিক রোদের উজ্জ্বল উস্কানি দিচ্ছে। ব্লেডের হালকা টানে তার পিঠে রক্তের নকশি আঁকছি। শীতল পাটির নকশি, কাঁথার নকশি, নকশি পিঠার নকশি তুচ্ছ এর কাছে। জলরঙের মতো রক্তের ভেতর রক্ত মিশে পিঠময় যে নকশিশিল্প ফুটে ওঠছে— তার আনন্দ আঁকিয়ে পাবে কোথায়? সমস্ত পিঠ ফালাফালা করে ডাক্তার নার্সকে বলি, দেখতে পাচ্ছেন না তার পিঠটার অবস্থা কী করুণ। ব্যান্ডেজ করুন।

স্বপ্নের ভেতর নার্সের চেহারা ধীরে ধীরে আমার ঝগড়াটে, হিংসুটে স্ত্রীর চেহারা নিচ্ছে। সে কামকক্ষে যায় আর লোভকক্ষে বসে আমার একটা অতিকায় জিভ তার সারা শরীর চেটে আসে। চেহারা স্ত্রীর মতো হলেও আচরণে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্ত্রী ছাড়া কোনো নারীর দিকে আমার চোখ যায়নি কখনো। কিন্তু বিষয়টা এমন— স্বপ্নে সে আর নার্স থাকে না— আমার স্ত্রী হয়ে ওঠে।

স্বপ্নের ভেতর নার্সের চেহারা ধীরে ধীরে আমার ঝগড়াটে, হিংসুটে স্ত্রীর চেহারা নিচ্ছে। সে কামকক্ষে যায় আর লোভকক্ষে বসে আমার একটা অতিকায় জিভ তার সারা শরীর চেটে আসে। চেহারা স্ত্রীর মতো হলেও আচরণে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্ত্রী ছাড়া কোনো নারীর দিকে আমার চোখ যায়নি কখনো। কিন্তু বিষয়টা এমন— স্বপ্নে সে আর নার্স থাকে না— আমার স্ত্রী হয়ে ওঠে। অনেক চেষ্টায়ও তাকে স্ত্রীসত্তা থেকে নার্সসত্তায় রূপ দিতে পারি না। তাই কামকক্ষে আমার মানসিক উপস্থিতি নিয়মিত চলে।

বৃদ্ধের পিঠময় ব্যান্ডেজকাফন দেখার একটা উদগ্র বাসনা পেয়ে বসলো কিছুটা পরেই। মাৎসর্যকক্ষে গিয়ে দেখি লোকটা গোঙাচ্ছে উপুড় হয়ে শুয়ে। আমি স্মাইলিং ফেইস নিয়ে তার কাছে যাই।
আসসালামু আলাইকুম শুয়োরের বাচ্চা।
বৃদ্ধ কোনো উত্তর দেয় না। বলি—
সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব, জানেন না কুত্তার বাচ্চা?
বলি— কেমন আছেন বানচোত?
বৃদ্ধ : আমি আপনার কী ক্ষতি করলাম বাবা?
আমি : আমি আপনার নুনু কাটবো, পেট লাগানির পুত।
বৃদ্ধ : আমাকে ছেড়ে দিন।
আমি : আমি আপনার সমস্ত শরীর পিস পিস করে কেটে আমার কুকুর দুটোকে খাওয়াবো, বাস্টার্ড।
বৃদ্ধ : আমাকে ছেড়ে দিন— আল্লাহর দোহায়, ছেড়ে দিন।
আমি : আমি আপনাকে অনেক যত্ন করে হত্যা করবো— জানোয়ারের বাচ্চা।
বৃদ্ধ : আমি কী করেছি?
আমি : মাদারফাকার, আমি আপনার নাক কাটবো, কান কাটবো, চোখ উপড়াবো, দাঁত টেনে তুলবো একটা একটা। বুঝেছেন?
বৃদ্ধ : আমাকে যেতে দিন, প্লিজ।
আমি : আপনাকে আপনার শেষ যে দেখতেই হবে— প্রিয়, প্রিয়তম শয়তানের ছাও।
বৃদ্ধ ব্যথা ও ভয়ে আর্তনাদ করে। আমার ভালো লাগে। আনন্দ লাগে। নার্স আর ডাক্তারের আতঙ্কিত মুখে মৃত্যুভীতির উপস্থিতি লক্ষ্য করে উল্লাস আরো বেড়ে যায় আমার। বুঝতে পারি— একটি চমৎকার হত্যাদৃশ্যের জনক হতে যাচ্ছি। যতদিন এই দৃশ্যের শেষাংশে না পৌঁছুতে পারছি আমার শান্তি নেই।

বৃদ্ধের পিঠের ঘা শুকিয়ে গেছে বেশ। আমার ইচ্ছে হচ্ছে একটা চিরুনী দিয়ে তার পিঠ আঁচড়ে দিই। ইচ্ছে করছে আমার ধারালো নোখ দিয়ে তার পিঠটাকে ক্ষত করতে। ইচ্ছে করছে সারাপিঠে স্কচটেপ লাগিয়ে ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দে একটা একটা টান মেরে তুলতে। তা না করে আমি বরং চাপাতি নিয়ে আসি। বৃদ্ধকে বলি— আজ আপনার হাতটা আমি কনুই পর্যন্ত কাটবো। এ ব্যপারে কিছু বলার আছে আপনার?
বৃদ্ধ চিৎকার-চেচামেচি শুরু করে। আমার ভালো লাগে। বৃদ্ধের হাতটা টেবিলের উপর রেখে চাপাতিটা তার চোখের সামনে নাড়াচাড়া করি। বৃদ্ধের চোখের অস্থির কাঁপন, নিশ্বাসের ঘনত্ব আমার রক্ততৃষ্ণা বাড়িয়ে তোলে। চাপাতিটা পাঁচবার বসাই তার হাতে। কব্জি থেকে কনুই পর্যন্ত পাঁচটা টুকরো হাতে নিয়ে খেলতে থাকি। এবার আর ডাক্তার-নার্সকে কিছুই বলতে হয় না। তারা হন্তদন্ত হয়ে গেলে লেগে যায় বৃদ্ধের চিকিৎসায়। নার্স-ডাক্তার ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বৃদ্ধের চিকিৎসা করতে থাকে। পাঁচটি টুকরো হাতে নিয়ে চলে আসি আমার কুকুর দু’টির কাছে। ওরা খায়— আমি দেখি, আমার ভালো লাগে। কুকুরগুলিকে শান্ত করে চলে আসি আমার হতাশা রুমে। আমার ঘুম ভেঙে যায়।

ঘুম এক অবিনশ্বর বেঁচে থাকা। স্বপ্ন তার উপকরণ। সব সময় যে স্বপ্ন আসে তাও কিন্তু নয়। হ্যাঁ, একথা সত্য আমি ইচ্ছাস্বপ্ন মানুষ। এও সত্য— আমাকেও স্বপ্নখরায় ভুগতে হয়। একচেটিয়া ঘুম আমার ভালো লাগে না। অথচ একচেটিয়া ঘুমের জন্য মানুষ হাহাকার করে, কচু খাওয়া শুয়োর আর এসব মানুষের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। শুয়োরের প্রসঙ্গ আসতে একটা কথা মনে হলো— এটা শৈশবের।
শৈশবে আমি দেখতাম— কেবল এই একটা স্বপ্নই শৈশবে দেখতাম আমি, বলা চলে এটা আমার স্বপ্ন দেখার ফাউন্ডেশন; দেখতাম পৃথিবী শুয়োরময়। নরশুয়োর-মাদিশুয়োর। লক্ষ লক্ষ শুয়োর ঘোৎ ঘোৎ করে কাদার ভেতর ডুবছে-ওঠছে। একটা বিশ্রী গন্ধে চতুর্দিক তোলপাড়। শুয়োরের পারফিউমের ভেতর গুটিকয়েক মানুষ নাক ঢেকে হাঁটছে। কেউ বমি করছে— কেউ বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে। শুয়োরে শুয়োরে শুয়োরময় পৃথিবীর গুটিকতক মানুষও ধীরে ধীরে শুয়োরে পরিণত হচ্ছে। শুয়োরের নাক, শুয়োরের মুখ, শুয়োরের হাত-পা, কী আশ্চর্য— কেবল আমি একা মানুষ থেকে যাচ্ছি। মানুষগুলি শুয়োর হলে বড় বেশি গন্ধ ছড়ায়। আর শুয়োরের গন্ধ তো রয়েছেই। ফলে আমার বমি আসে। বমি আসে না— মূলত পাকস্থলিটা বেরিয়ে আসে মুখ দিয়ে। আমি চিৎকার করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি আমি যেনো শুয়োর হয়ে যাই। কিন্তু আমি মানুষ থাকছি আর যান্ত্রণায়-দুর্গন্ধে গোঙাচ্ছি। এ যে কী দুঃসহ যন্ত্রণা। অকথ্য।
আমার স্ত্রী বলে আমি একটা স্বপ্নগ্রস্তমানব। আমি স্বপ্নগ্রস্ত বটে তবে অমানুষ নই। হয়তো আমার শৈশবের স্বপ্নটাই সত্য। এই শুয়োরময় পৃথিবীতে আমিই একমাত্র সত্যমানব।

এপ্রিল, ২০২০

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.