অগ্রজের প্রস্থান : আবদুল মান্নান সৈয়দ
পাঁচই সেপ্টেম্বর, দু হাজার দশ।
বাংলাবাজার পুস্তকপল্লি। গ্রাফিক শিল্পী মোবারক হোসেন লিটনের দফতর। শিল্পী নাসিম আহমেদ, পেস্টিং কারুকর আরিফ রহমান, লেখক-শিল্পী লিটন স্বয়ং আর আমি সরস আড্ডা দিচ্ছিলাম সন্ধ্যার পরে। সহসা সেলফোনে উদগ্রীব কণ্ঠ ভেসে এল নভেরা হোসেনের, “তারিক ভাই, আপনাকে একটি খবর দিব।” “বলো।” “আবদুল মান্নান সৈয়দ মারা গেছেন কিছুক্ষণ আগে। পিয়াস মজিদের কাছে খবর পেলাম।” আড্ডার আবহাওয়া নিমেষেই মন্দ্র হয়ে উঠলো। আত্মীয় বিয়োগের বেদনা আবৃত করলো আমাদের। লিটন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পরিচিত কিছু জনের কাছে দুঃসংবাদটি পরিবেশনে।
কিন্তু একেবারে আকস্মিক ছিলো না এই ঘটনা। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি পীড়াগ্রস্ত ছিলেন; তাঁর বর্তমান সম্পর্কে অবহিতরা এ-কথা জানতেন। মাঝে মাঝে তিনি বলতেন “ডাক্তারের বাড়ি দৌড়াতে দৌড়াতে আমার অবস্থা কাহিল। আমার জন্য দোয়া করবেন।“ সে অবস্থা হতে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। কোনো পীড়াই আর বিপর্যয় আনবে না তাঁর।
শুধু শারীরিক অসুস্থতাই নয়, মানসিকভাবেও তিনি কিছুটা অস্থিতির মধ্যে ছিলেন। তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদায় ঘাটতি ছিলো বলে তিনি অনুভব করছিলেন। তিনি নিজেকে ‘না বামের না ডানের’ বলে মনে করতেন। আমাদের সাহিত্যিক-শিল্পীদের মধ্যে ভাবনাগত-রাজনীতিগত বিবিধ উপগোত্র রয়েছে— কোনো সম্প্রদায়েরই যেন তিনি তেমন আপন ছিলেন না। এ-কারণে নিঃসঙ্গ ছিলেন তিনি খুব। আবার প্রকাশকেরা কেউ কেউ তাঁর বইয়ের স্বত্বের প্রাপ্য অর্থ দিতে যে কার্পণ্য ও চাতুরি করছিলো তা নিয়েও তাঁর মর্মবেদনা ছিলো। তা ছাড়া সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে তাঁর মতো একজন মানুষের যে-রকম উপস্থিতি ও সম্মান থাকবার কথা তারও অন্যূনতায় তাঁর ক্ষোভ ছিলো। এখন তিনি সেইসব কিছুরই সীমানা পেরিয়ে চলে গেছেন নিঃসীম শূন্যতায়। তবু তিনি রয়ে গেছেন। রয়ে যাবেন। তার কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধাবলির মধ্যে থেকে যাবে তাঁর সত্তার সারাৎসার। থেকে যাবে তাঁর ভাবনা ও কল্পনার সঙ্গে সিসৃক্ষার আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতিচিহ্নসমূহ। এবং থেকে যাবে পরিচিতজনদের স্মৃতির ভেতরে তাঁর যাপিত সময়ের টুকরো-টুকরো ছবির কোলাজ।
শুধু শারীরিক অসুস্থতাই নয়, মানসিকভাবেও তিনি কিছুটা অস্থিতির মধ্যে ছিলেন। তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদায় ঘাটতি ছিলো বলে তিনি অনুভব করছিলেন। তিনি নিজেকে ‘না বামের না ডানের’ বলে মনে করতেন। আমাদের সাহিত্যিক-শিল্পীদের মধ্যে ভাবনাগত-রাজনীতিগত বিবিধ উপগোত্র রয়েছে— কোনো সম্প্রদায়েরই যেন তিনি তেমন আপন ছিলেন না। এ-কারণে নিঃসঙ্গ ছিলেন তিনি খুব। আবার প্রকাশকেরা কেউ কেউ তাঁর বইয়ের স্বত্বের প্রাপ্য অর্থ দিতে যে কার্পণ্য ও চাতুরি করছিলো তা নিয়েও তাঁর মর্মবেদনা ছিলো।
আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে আমার প্রথম যোগাযোগের সূত্রটি মনে পড়লে আমি একটু কুণ্ঠিত বোধ করি। কিন্তু তারও আগের কথা দিয়ে শুরু করি। সে আশির দশকের গোড়ার কথা। মান্নান সৈয়দের রচনা ও বক্তৃতার সাথে ততদিনে বেশ পরিচিত হয়েছি। আশি-বিরাশি সালে ঢাকা কলেজে পড়বার সময় থেকে সমকালীন ও আধুনিক সাহিত্য প্রচুরভাবে পড়তে শুরু করি। আমার সাহিত্যপাঠ ও লেখালেখির শুরু অবশ্য আরও আগে থেকেই; কিন্তু এ-সময়ে তা ব্যপকতর হয়ে ওঠে। তাঁর বইগুলোর মধ্যে শুদ্ধতম কবি, করতলে মহাদেশ এবং দশ দিগন্তের দ্রষ্টা এই সময়ে আমার বিশেষ প্রিয় ছিলো। তাঁর গদ্যশৈলীর স্বাতন্ত্র্য ও আধুনিকতা ভালো লাগতো। তাঁর তথ্য ও বিশ্লেষণের উপস্থাপনা থেকে অনেক কিছু শিখেছি। পরাবাস্তববাদ সম্পর্কে তাঁর লেখা ওই আন্দোলন সম্পর্কে কৌতূহলী করে তুলেছিলো। আর তাঁর কবিতা — সে যে তাঁর সমকালীন সবার থেকে বেশ আলাদা সে তো স্বতোপ্রকাশিত। তাঁর কবিতার বিশিষ্ট চিত্রকল্প, স্মার্ট উচ্চারণ, রহস্যময় সৌন্দর্যের হাতছানি ও প্রেমের সংরাগ আমার নিকটে বিশেষ স্বাদের আয়োজন বলে মনে হতো। এসব থেকে আমার পদ্যও কখনো-কখনো প্রাণিত হয়েছে নিশ্চয়ই।
বই-পুস্তক ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকা এবং দৈনিক কাগজের সাহিত্য সাময়িকীগুলো তখন নিয়মিত পড়তে চেষ্টা করতাম। সংবাদ, ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলা’র সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত কবিতা-প্রবন্ধ-আলোচনা ইত্যাদি পড়ে ফেলতাম। আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখা এইসব পত্রিকায় তখন প্রায়ই ছাপা হতো। তা ছাড়া বরণীয় জনেদের জন্ম-মৃত্যুদিনে এবং বিশেষ দিবসগুলোতে এবং বইয়ের প্রকাশনা উৎসব উপলক্ষে বাংলা একাডেমি, গ্রন্থকেন্দ্র, তদানীন্তন বাংলাদেশ পরিষদ ইত্যাদি স্থানে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। সুযোগ হলেই এগুলোতে যেতাম। এভাবে মান্নান সৈয়দের বক্তৃতাও শুনেছি। তাঁর ভাষাপ্রয়োগ ও উচ্চারণ সাবলীল, ব্যক্তিত্ব আকর্ষণীয়, বক্তব্য ভাবনা-উদ্দীপক ও জ্ঞানসঞ্চালক। সমকালীন সে-লেখকেরা, যারা উত্তর প্রজন্মের তরুণ আমার মধ্যে প্রেরণা সঞ্চার করেছিলেন, তাদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ তার কবিতা, গদ্য ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রবলভাবে উপস্থিত ছিলেন।
সম্ভবত তিরাশি কি চুরাশি সালে সংবাদ-এর সাহিত্য সাময়িকীতে তাঁর একটি প্রবন্ধ ছাপা হলো। আমার কাছে কপি নেই, স্মৃতি থেকেই লিখছি। প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সম্পর্ক নিয়ে বলা হয়েছিল। সম্ভবত প্রবন্ধটির নাম ছিলো ‘রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলাম’। লেখাটি শুরু হয়েছিল এভাবে, “কোথায় যেন বুদ্ধদেব বসু নজরুল ও শরৎচন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথের দুই তরলিত সংস্করণ বলে মন্তব্য করেছেন।” [স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত।] আর লেখাটির শেষ কথা ছিল, “রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই নজরুল ও শরৎচন্দ্র যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন সম্ভবত সেটাই ক্ষোভের কারণ ছিল বুদ্ধদেব বসুর।” [স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত।] সে সময় আমার পাঠের অভ্যাস ভালোই ছিল। আমি চট করে সাহিত্যচর্চা বই হতে“রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক” প্রবন্ধটি খুলে মিলিয়ে দেখলাম আবদুল মান্নান সৈয়দ একটু ভুল করে ফেলেছেন। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, “আর যারা বাংলাদেশের পাঠক সাধারণ, বড়ো অর্থে পাব্লিক, তারা কিছুদিন আগে পর্যন্তও রবীন্দ্রনাথের স্বাদ নিয়েছে— রবীন্দ্রনাথে না, তাঁরই দুই তরলিত, আরামদায়ক সংস্করণে : গদ্যে শরৎচন্দ্রে আর পদ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তে।”
ইতোমধ্যে আমাদের সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক মেরুকরণ বেশ স্পষ্টতায় দৃশ্যমান হয়ে উঠলো। ‘পদাবলি’ ও ‘কবিকণ্ঠ’ নামক দুটি কবিতা পাঠের সংগঠন দিয়ে যার শুরু তা ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’ এবং ‘এশীয় কবিতা উৎসব’-এর উৎসব ছাড়িয়ে দ্বন্দ্বময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি তৎকালীন ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসক লে.জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ-এর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকায় এবং প্রথমটি স্বৈরাচারবিরোধী হওয়ায় দুই দলেরই কবি ও কবিতা তখন রাজনীতির সাথে একটু বেশি সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে।
দেখা যাচ্ছে, আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখাটিতে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের জায়গায় নজরুলের নাম বসে গেছে। তারুণ্যের আতিশয্যে একজন বিদগ্ধ সমালোচকের ভুল ধরতে পারার শ্লাঘাবশত সংবাদ-এ একটি চিঠি পাঠালাম প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিসহ, যার শেষে শ্লেষাত্মক একটি বাক্য ছিল— সে-কথা মনে করলে আজও আমার কর্ণমূল রক্তিম হয়ে ওঠে। কথাটি ছিল এরকম, “সুতরাং ‘রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই নজরুল ও শরৎচন্দ্র যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন সেটাই বোধ হয় ক্ষোভের কারণ ছিল বুদ্ধদেব বসুর’— এ রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি করবার আগে সংশ্লিষ্ট লেখকের রচনা যথাযথভাবে পাঠ করা প্রবন্ধ-রচনারও পূর্বকৃত্য।”
সংবাদ-এ পাঠাবার পর দু-এক সপ্তাহ পার হলো, পাঠকের প্রতিক্রিয়া আর ছাপা হয় না। তারপর একদিন ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে দেখা হয়ে গেল আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে। আমি কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম, “আপনাকে একটি কথা বলতে চাই।” “হ্যাঁ, বলুন।” “সংবাদ-এ আপনার যে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তাতে বুদ্ধদেব বসুর উদ্ধৃতিতে…।” উনি আমার কথা শেষ হবার আগেই স্বাভাবিক ও আন্তরিক স্বরে বললেন, “হ্যাঁ, আমি চিঠি পেয়েছি, ওখানে সত্যেন দত্তের নাম হবে। আমি স্মৃতি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, ভুল হয়েছে।” তিনি এতই সাবলীল অকপটতায় কথাটি স্বীকার করলেন আমার মতো ছোকরার কাছে যে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম এবং যে-শ্লেষাত্মক বাক্যটি লিখেছিলাম তার জন্য গ্লানি বোধ করলাম”।
এই ঘটনার পর কিছুকাল পেরিয়ে গেল। আবদুল মান্নান সৈয়দ একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করলেন। পত্রিকাটির নাম এখন। আমি কবিতা পাঠালাম। সঙ্গে ডাকটিকেট (অথবা জবাবি খাম-ঠিক মনে নেই) দিলাম। যাতে লেখা অমনোনীত হলে যেন ফেরত পাঠানো হয়। বলা যায়, পরের ডাকেই চিঠি পেলাম। প্লাবনে আমার কতিপয় প্রিয় জিনিস বিনষ্ট হয়েছে; বেশ কিছু বই, নিজের লেখা ডায়েরি— আশির দশকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে লেখা— যেখানে আমার জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ সময়ের কিছু বিবরণ ছিল, এবং কিছু চিঠি। আবদুল মান্নান সৈয়দের চিঠিটিরও ওই উপপ্লবে সংহার ঘটেছে। ওতে তিনি যা লিখেছিলেন তা এই রকম, “আপনার লেখা মনোনীত হয়েছে এবং আগামী সংখ্যায় ছাপা হবে। আপনাকে কি আমি চিনি? আপনি আমাদের দফতরে আসুন না, আড্ডা দেওয়া যাবে। বিকালে আমি থাকি।“
অবিলম্বে এই ঔদার্যময় আহ্বানে সাড়া দিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে পত্রিকার কার্যালয়ে চলে গেলাম এক বিকেলে। অনেকক্ষণ কবিতা ও কবিদের নিয়ে আড্ডা হলো। প্রথমদিন আরও উপস্থিত ছিলেন আবদুল হাই শিকদার– এটুকু মনে আছে। ওই দফতরে আরও কয়েকবার গিয়েছিলাম।
এর কিছুকাল পর তিনি সম্পাদনা করতে শুরু করেন শিল্পতরু। শিল্পতরু-তে ও ক’বার গিয়ে আড্ডা দিয়েছি তার সঙ্গে। তিনি আমার লেখাও ছেপেছেন ওই পত্রিকায়।
একবার কী এক প্রসঙ্গে আমার জন্মদিন দশই অগাস্ট শুনে উনি বললেন, “সিংহ রাশি! আমিও সিংহ রাশির।”এই রাশির ব্যাপারটি উনি মানতেন। মনে পড়ে, একবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক আড্ডায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের দিকে ইঙ্গিত করে উনি বলেছিলেন, “ওনার সঙ্গে আমার রাশির মিল আছে।”
ইতোমধ্যে আমাদের সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক মেরুকরণ বেশ স্পষ্টতায় দৃশ্যমান হয়ে উঠলো। ‘পদাবলি’ ও ‘কবিকণ্ঠ’ নামক দুটি কবিতা পাঠের সংগঠন দিয়ে যার শুরু তা ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’ এবং ‘এশীয় কবিতা উৎসব’-এর উৎসব ছাড়িয়ে দ্বন্দ্বময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি তৎকালীন ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসক লে.জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ-এর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকায় এবং প্রথমটি স্বৈরাচারবিরোধী হওয়ায় দুই দলেরই কবি ও কবিতা তখন রাজনীতির সাথে একটু বেশি সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। ঘটনাক্রমে আবদুল মান্নান সৈয়দ দ্বিতীয় দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। যদিও আমি এবং আমার বন্ধুদের অনেকেই দুই দলের কোনোটিরই সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম না, কিন্তু অনেকেরই প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল প্রথম দলেরই প্রতি। আবদুল মান্নান সৈয়দকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে তিনি কেন জাতীয় কবিতা পরিষদে গেলেন না। উনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমাকে ডাকেনি।” শামসুর রাহমানের সাথে আমার সুসম্পর্ক ছিল, উনি আমাকে স্নেহ করতেন। তাকে আবদুল মান্নান সৈয়দের এই উক্তিটি জানাতে তিনি যা বলেছিলেন তা মোটামুটি এ রকম “না ডাকলেই কি প্রতিক্রিয়াশীলদের সাথে যোগ দিতে হবে?”
বিষয়টা উল্লেখ করলাম কারণ আমাদের সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে লেখকদের মতাদর্শগত ও সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান লেখককে ঐতিহাসিক ট্রাজেডির চরিত্র করে তোলে। ফররুখ আহমদ এবং তাঁর স্বগোত্রীয়রা এরকম ট্রাজেডির কুশীলব। আবদুল মান্নান সৈয়দকেও একবার উত্তেজিত তরুণদের তাড়া খেতে হয়েছিল বলে শুনেছি— বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে, এরশাদ সরকারের পতনের পর, ‘স্বৈরশাসকের দোসর’ হবার অপরাধে। সে আলাদা কাহিনী।
নব্বইয়ের দশকে আমি ক্রমশ ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে থাকি। সবার সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ক্ষীণ হতে থাকে। মাঝে-মধ্যে শহরে বেরুলে ক্বচিৎ কখনো আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে দেখা হয়েছে। দেখা হলে লেখার কথা জিজ্ঞাসা করেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। একবার কী এক প্রসঙ্গে আমার জন্মদিন দশই অগাস্ট শুনে উনি বললেন, “সিংহ রাশি! আমিও সিংহ রাশির।”এই রাশির ব্যাপারটি উনি মানতেন। মনে পড়ে, একবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক আড্ডায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের দিকে ইঙ্গিত করে উনি বলেছিলেন, “ওনার সঙ্গে আমার রাশির মিল আছে।” এক বাম ঘরানার লেখক— যেন কিছু বুঝতে পারেন নি— বললেন, “কিসের মিল?”আবদুল মান্নান সৈয়দ হাত নেড়ে বললেন, “ওটা কিছু নয়।”
তাঁর সঙ্গে যখন দীর্ঘদিন অদর্শন ছিল তখন একদিন সুহিতা সুলতানার সাথে গল্প হচ্ছিল তার গ্রন্থভবনের দফতরে। সুহিতা বললেন, “মান্নান ভাই আপনার কথা বলেন, আপনার প্রশংসা করেন। তাঁর সাথে দেখা করবেন।” তিনি তখন নজরুল ইনস্টিটিউটে। কিন্তু কখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
এদিকে আমি লেখালেখি সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে অন্য মগ্নতার অন্বেষণে মশগুল। একসময় আবার লেখা শুরু হলো সাত বছর বিরতির পর। আমার নতুন পর্যায়ের কবিতা নিয়ে আরও কয়েক বছর পর বেরুলো মগ্ন তখন মোরাকাবায়। এই বইয়ের ভূমিকায় আবদুল মান্নান সৈয়দের বই সকল প্রশংসা তাঁর– এর উল্লেখ আছে। সকল প্রশংসা তাঁর যখন প্রকাশিত হয় তখন বইটি পড়ে খুশি হতে পারিনি। তখন আমার ভাবাদর্শগত ও সাহিত্যিক যে ধ্যান-ধারণা ও রুচি ছিল তাতে বইটি সম্পর্কে আমি নিঃস্পৃহই হয়েছিলাম। এ-বইয়ের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে আমার আরও সময়ের দরকার হয়েছিল। কিন্তু এ-বইয়ের কারণে আবদুল মান্নান সৈয়দ অনেকের কাছেই অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এ-দেশের একজন প্রধান কবিকে আমি বলতে শুনেছি, “সে রাজাকার হয়ে গেছে।” অবশ্য শুধু এ-বইটার কারণেই নয়, বিভাগপূর্ব ইসলামপন্থী লেখক-কবিদের নিয়ে তাঁর কাজ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে তাঁর বই প্রকাশিত হওয়া এবং ইসলামি আদর্শবাদীদের সঙ্গে তাঁর সখ্য হওয়া, তাঁর বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগকে পোক্ত করেছে।
কিন্তু এ-বিষয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের অবস্থান স্পষ্ট। তাঁর সাথে সাম্প্রতিককালে আমার যোগাযোগ পুনরায় স্থাপিত হয়েছিল। মাঝে-মাঝে ফোন করতাম। এ বিষয়ে একটু পর লিখছি। এ-সময়ে তাঁর সাথে যে আলোচনা হয়েছিল তাতে তিনি নিজের সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছেন। তিনি অবশ্যই মুসলমান এবং সৈয়দ হিসেবে গর্ববোধ করতেন। তিনি এটা নিছক সাম্প্রদায়িকতা বোধ থেকে করতেন না। তিনি বলতেন, আমি কমিউনিস্ট নই, কিন্তু সুকান্ত ও মানিক আমার দুজন প্রিয় লেখক। আমি হিন্দু নই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয় কবি।”
অনেক দিন পর একটি সাহিত্যমূলক সভায় উপস্থিত হবার অবকাশ ঘটলো আমার একুশে অগাস্ট দুহাজার নয়তে। বিষ্ণু দে’র জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে ‘জিয়নকাঠি’ নামে একটি সংগঠন ও শিল্পকলা একাডেমি যৌথভাবে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অন্যান্যদের সাথে আবদুল মান্নান সৈয়দ বক্তা হিসেবে উপস্থিত। আকাশি রঙের শার্ট ও লাল রঙের টাই পরা আবদুল মান্নান সৈয়দকে তারুণ্যে উজ্জীবিত ও স্বপ্নিল মনে হচ্ছিল। [চাক্ষুসভাবে সেই তাঁকে শেষ দেখা।] কিন্তু আলোচনার শেষ দিকে তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমার শরীর ভালো যাচ্ছে না, আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন।” এ ছাড়াও তাঁর কথার ভেতরে ঈষৎ বেদনার ভাব লক্ষ করলাম। শুনে খুব খারাপ লাগলো। একজন প্রিয় মানুষ, প্রিয় কবি, প্রিয় গদ্যশিল্পী– তাঁর কথার ভেতর কেমন যেন হতাশার সুর ছিল। সাফল্য ও সম্মান তিনি কম লাভ করেননি। পড়ন্ত বেলায় তবে কি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণে গড়মিল অনুভব করছেন?
নতুনধারা-র শ্রাবণ সংখ্যায় আমার লেখা প্রবন্ধ ‘কবিতায় সুফিবাদ’ প্রকাশিত হলো। এতে আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রসঙ্গও রয়েছে। ওই পত্রিকার পূর্ববর্তী এক সংখ্যায় চঞ্চল আশরাফ তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু কথা লিখেছিলেন। আমার লেখাটিতে সে প্রসঙ্গেও আলোচনা ছিল। আমি প্রথমে আমার লেখাটির কথা বললাম এবং ওতে যে তাঁর সম্পর্কে লিখেছি সে কথা বললাম। উনি বললেন, “তারিক, আপনি আমার সম্পর্কে লিখলে সেটা ভালোবেসেই লিখবেন। কিন্তু অনেকে আজেবাজে কথা লেখে।
আমার দীর্ঘদিনের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু দম্পতি জিয়াউল করিম আর লায়লা শার্মিন। শার্মিন চিত্রশিল্পী। ওর সাথে মান্নান সৈয়দের একটা যোগাযোগ ছিল। ওরা দুজনে মিলে সংলাপ ধরনের একটি বই লিখবার পরিকল্পনা করছিলেন। শার্মিন সম্পর্কে আবদুল মান্নান সৈয়দ আমাকে পরে বলেছিলেন, “এদেশে দলবাজি না করলে তাকে একলা হয়ে থাকতে হয়। আমার যে অবস্থা। শার্মিন মেয়েটা ভালো কাজ করছে, চেষ্টা করছে, কিন্তু কেউ তাকে মূল্যায়ন করছে না।” শার্মিন মান্নান সৈয়দের সাথে তার যোগাযোগ ও আলাপের বিবরণ যেমন শোনাতেন তেমনি ওই সংলাপ লিখবার পরিকল্পনা নিয়েও কথা বলতেন। কাজটা শুরুও হয়েছিল : শেষ আর হলো না। আরও শেষ হয়নি মোবারক হোসেন লিটনের কাজটাও। অমল হোম সম্পাদিত ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গ্যাজেট-এর ‘ট্যাগোর মেমোরিয়াল স্পেশাল সাপ্লিমেন্ট’-এর বঙ্গানুবাদের ভূমিকা লিখবেন আবদুল মান্নান সৈয়দ- এ-রকমই কথা ছিল।
শার্মিনের কাছ থেকে মান্নান সৈয়দের সেলফোন নম্বর সংগ্রহ করলাম। নভেম্বরের ছয় তারিখে ফোন করলাম তাকে। নিজের নাম বলে জিজ্ঞাসা করলাম যে, উনি আমাকে চিনতে পারছেন কি না– যেহেতু অনেক বছর পর যোগাযোগ করছি। উনি বিলক্ষণ চিনতে পারলেন। বললেন, “তারিক, আমি আপনাকে কেন চিনবো না! আমিই তো আপনাকে আবিষ্কার করেছি।” ‘এখন’-এ যে সাগ্রহে আমার লেখা ছেপেছিলেন তার স্মারক হিসেবে এই আবিষ্কারের কথা বললেন। পরেও দু-একবার আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, “আমিই কিন্তু আপনার আবিষ্কর্তা।” আমার রচনার ভেতরে তিনি প্রশংসাযোগ্য কিছু লক্ষ করে থাকলে, সেই পর্যবেক্ষণের ফলাফলের নিশ্চয়ই তিনি আবিষ্কর্তা। আর তাঁর— যেমন আরও অনেকের— সস্নেহ প্রশ্রয় আমাকে অবশ্যই উৎসাহিত করেছে গড়ে উঠবার সময়ে।
মান্নান ভাই নিমন্ত্রণ করলেন আড্ডা দেবার জন্য। বিকালে শাহবাগে ‘পাঠক সমাবেশ’-এ থাকেন, ওখানে যেতে বললেন। তাঁর সাথে ওই আড্ডা আর দেয়া হয়নি কখনো, তবে সেলফোনে কয়েকবার কথা হয়েছে।
মগ্ন তখন মোরাকাবায় বইটির কপি তাঁকে পাঠালাম। সাথে একটি চিঠিও দিলাম। চিঠির কপি আছে আমার কাছে তাই এখানে সেটি তুলে দিচ্ছি।
০৭ নভেম্বর ০৯
শ্রদ্ধেয় মান্নান ভাই,
সালাম নেবেন।
আপনার কথা অনেক সময়েই মনে পড়ে-শুধু বাংলাদেশের একজন প্রধান ভাষাশিল্পী হিসেবেই নয়, আপনার প্রতি কেন যেন একটা গূঢ় টান অনুভব করি। হয়তো আপনার আকর্ষণীয় দিঘল কাঠামোর ভেতরে যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব রয়েছে— যিনি সবার মধ্যে থেকেও তুমুল আড্ডার পরেও মনে হয় নিঃসঙ্গ, মনে হয় অপর কিছুর অভিসারী— তাঁর প্রতি এক প্রকার আত্মীয়তা অনুভব করি।
আপনার কবিতার বইগুলোর মধ্যে সকল প্রশংসা তাঁর নিশয়ই আলাদা রকম। এই বইয়ের কিছু কবিতা আধ্যাত্মিক বিভায় চমকিত।
আপনার যৌবনে এক ‘সু’— সুররিয়ালিজম– আপনাকে দিয়ে সোনা ফলিয়েছে। আমার মনে হয়, এই উত্তর বয়সে অপর এক ‘সু’— সুফিবাদ— আপনার কবিতার জন্য যেমন পৃথক দিগন্ত উদ্ভাসিত করতে পারে, তেমনই প্রশান্তির এক রাজ্যে আপনার সত্তাকে স্থিতি দিতে পারে, যে-প্রশান্তি এই সমাজ-সংসারে নিতান্ত দুর্লভ। মানবের চিরকালের এক আকুলতা ও অন্বেষণের নাম সুফিবাদ— দেশ-কাল-পরিপ্রেক্ষিতের বৈচিত্র্যে তাঁর অভিধা যা-ই হোক না কেন।
আপনি যদি আমার এই কথাগুলোকে বাগাড়ম্বর হিসেবে না নেন, কৃতার্থ থাকবো।
আপনার স্বাস্থ্য ততটা ভালো নয়, জানি। পরমসত্তার কাছে প্রার্থনা করি যেন আপনি আরও দীর্ঘকাল সুস্থ অবস্থায় আমাদের মধ্যে লিখনশীল থাকেন ও শান্তি যাপন করেন।
আমার জন্য দোয়া করবেন।
আপনার স্নেহভাজন
সৈয়দ তারিক
বাড়তি কথা : একটা পদ্যের বই পাঠালাম। হয়তো আপনার কাছে উপস্থাপন-যোগ্যই নয়– তবু নিতান্ত আবেগে অগ্রজের কাছে সবিনয় উপহার।
পরে তার সাথে যোগাযোগ হলে তিনি বললেন যে বইটি তার ভালো লেগেছে। তাঁর কাছে অনেক তরুণ আসে, তাদের কাছে তিনি এর কথা বলেছেন। বললেন, “মতাদর্শ অনেক সময় কবিতার ক্ষতি করে, আপনার ক্ষেত্রে তা হয়নি, স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা উঠে এসেছে।” আমার চিঠি প্রসঙ্গে বললেন, “তারিক, আমার ভেতরে এক বৈরাগী বাস করে। আমি ভেতরে ভেতরে সুফি ঘরানার।” তাঁর এ-কথা যে সত্য তার প্রমাণ আছে তাঁর লেখায়। আমার বিশ্বাস নামের প্রবন্ধের বই বেরিয়েছিল আশির দশকে, তাঁর ত্রিশোত্তর বয়সে। ওতে মরমি ভাবাপন্ন ভাবনারাশি পরিস্ফুটিত।
কিন্তু আবদুল মান্নান সৈয়দকে আর সহ্য করতে হবে না কিছুই— না পুষ্পমাল্য, না নিন্দাবাদ। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই অবলুপ্ত হয়ে যায়, আর যা কিছু মানবমনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তা থেকে যায় মানবের হৃদয়ে ও মননে। আবদুল মান্নান সৈয়দ বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি ও প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক। তাঁর গদ্যরীতি এতই প্রাতিস্বিক যে হুমায়ূন আজাদের মতো বাতিলীকরণে সিদ্ধ ব্যক্তিও একবার আমাকে বলেছিলেন, “বাংলাদেশে মাত্র দুজনে বিশিষ্ট গদ্য লিখি : আমি আর আবদুল মান্নান সৈয়দ।”
পরবর্তীতে যে-কয়বার কথা বলেছি তাঁর সাথে, অসুস্থতার প্রসঙ্গই উঠেছে প্রথমে, তার সাথে তাঁর নানা ক্ষোভ ও অভিমান। তাঁর মনে হচ্ছিল যে তার যে-মূল্যায়ন ও সম্মান ও অধিষ্ঠান হবার কথা তা যথাযথভাবে হচ্ছিল না। তিনি কাউকে তোয়াক্কা যেমন করতেন না, তেমনি সমালোচনার ব্যাপারে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিলেন।
তাঁর সাথে শেষবার যোগাযোগ হয় এ বছর জুলাই মাসে। নতুনধারা-র শ্রাবণ সংখ্যায় আমার লেখা প্রবন্ধ ‘কবিতায় সুফিবাদ’ প্রকাশিত হলো। এতে আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রসঙ্গও রয়েছে। ওই পত্রিকার পূর্ববর্তী এক সংখ্যায় চঞ্চল আশরাফ তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু কথা লিখেছিলেন। আমার লেখাটিতে সে প্রসঙ্গেও আলোচনা ছিল। আমি প্রথমে আমার লেখাটির কথা বললাম এবং ওতে যে তাঁর সম্পর্কে লিখেছি সে কথা বললাম। উনি বললেন, “তারিক, আপনি আমার সম্পর্কে লিখলে সেটা ভালোবেসেই লিখবেন। কিন্তু অনেকে আজেবাজে কথা লেখে। তা কোন পত্রিকায় লেখাটি ছাপা হয়েছে?” পত্রিকার ও তার সম্পাদকের নাম শুনে তিনি খেপে গেলেন। বললেন ওই পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে আজেবাজে কথা লেখা হয়, ওই পত্রিকা তিনি হাতে নেবেন না— ইত্যাদি। পত্রিকাটির সম্পাদক সম্পর্কেও তিনি কিছু অসহিষ্ণু মন্তব্য করলেন। আমি আর কথা বাড়ালাম না। বুঝলাম বয়স ও অসুস্থতার কারণে তাঁর সহ্যক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। অথচ সাহিত্য সমালোচনা আর ব্যক্তিগত আচরণ যে এক বিষয় নয় তাঁর উদাহরণ তো তাঁর মধ্যেই পেয়েছি। সাতাশি সালের অক্টোবরে এশিয়াটিক সোসাইটিতে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের ওপর তিনদিনব্যাপী সেমিনার হয়েছিল। আমার শিক্ষক প্রফেসর খান সারওয়ার মুরশিদের ইচ্ছায় ওই অনুষ্ঠানের সাথে আমি কিছুটা সংশ্লিষ্ট ছিলাম। ওতে একটি সেশন ছিল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ওপর। প্রবন্ধ পড়েছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। আলোচক হিসেবে আবদুল মান্নান সৈয়দ ওই প্রবন্ধের বিভিন্ন বক্তব্যের তুমুল সমালোচনা করেন। কিন্তু অধিবেশন শেষে তিনি সৈয়দ হকের সাথে প্রীতি বিনিময় করলেন এবং নিজের লেখা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ওপর বইটি তাকে উপহার দিলেন।
কিন্তু আবদুল মান্নান সৈয়দকে আর সহ্য করতে হবে না কিছুই— না পুষ্পমাল্য, না নিন্দাবাদ। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই অবলুপ্ত হয়ে যায়, আর যা কিছু মানবমনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তা থেকে যায় মানবের হৃদয়ে ও মননে। আবদুল মান্নান সৈয়দ বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি ও প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক। তাঁর গদ্যরীতি এতই প্রাতিস্বিক যে হুমায়ূন আজাদের মতো বাতিলীকরণে সিদ্ধ ব্যক্তিও একবার আমাকে বলেছিলেন, “বাংলাদেশে মাত্র দুজনে বিশিষ্ট গদ্য লিখি : আমি আর আবদুল মান্নান সৈয়দ।” মনে পড়ে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস-এ এককালে মঙ্গলসন্ধ্যা নামে যে সাহিত্যসভা হতো তার একটিতে অধ্যাপক হারুন অর রশীদ বলেছিলেন, “বাংলাদেশে আধুনিক কবি মাত্র দুজন : শহীদ কাদরী আর আবদুল মান্নান সৈয়দ।” ওই অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মুহম্মদ নুরুল হুদা, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সরকার আমিন প্রমুখ। এ উক্তির সাথে সবাই নিশ্চয়ই একমত হবেন না। (অনুষ্ঠানের পর রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আমাকে বলেছিলেন, “আমি এই কথার প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম।”) তবে এটাও বিশিষ্টজনের একটি ভাবনা নিশ্চয়ই। আবদুল মান্নান সৈয়দের রচনা যে বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে ও মননে দিনের পর দিন ক্রিয়াশীল থাকবে এতে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।
মৃত্যু তাঁকে নিয়ে গেছে : তাঁর রচনাবলি মৃত্যুকে উপহাস করছে।
গত পর্বে পড়ুন- কবিতায় সুফিবাদ
অলংকরণ : রাজীব রায়