অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক
এই অধ্যাপক-লেখক-চিন্তাবিদের লেখার সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল একেবারে তরুণ বয়সে। মুক্তধারা থেকে ‘বইয়ের খবর’ নামে একটি সংকলন বের হতো। ‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রবন্ধ’ নামে এতে তার একটি লেখা পড়ে উৎসাহিত হয়েছিলাম বলে মনে পড়ছে। তারপর সাহিত্য-সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতি-নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে তার নানা প্রবন্ধ পড়েছি, কোনো কোনো সভায় আলোচনা শুনেছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর যদিও সাবসিডিয়ারি বা সহযোগী বিষয় ছিলো বাংলা, কিন্তু আমাদের কোনো ক্লাস তিনি নিতেন না। তবে তিনি ‘লোকায়ত’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক হবার কারণে তার কাছে মাঝেমধ্যে যেতাম। তিনি আমাকে উৎসাহিত করে কয়েকটি প্রবন্ধ অনুবাদ করিয়েছিলেন। বার্ট্রান্ড রাসেল ও হেমিংওয়ের দুটো প্রবন্ধের অনুবাদ ছেপেছিলেন তার পত্রিকায়। চিন্তামূলক বই পড়বার ও লিখবার জন্য প্রণোদনা দিতেন তিনি। তার বাসায়ও গেছি অনেকবার। তার সাথে ঘনিষ্ঠতার সূত্র ছিলেন আফজালুল বাসার।
একবার কবিতাবিষয়ক কী আলোচনা হচ্ছিল, হুমায়ুন আজাদের বক্তব্যের পর ( সম্ভবত তিনি বলছিলেন : ষাটের দশকের পর আর কোনো ভালো কবিতা বাংলায় লেখা হয়নি। শামসুর রাহমানের সেরা কবিতাগুলোও ষাটের দশকেই লেখা) কবি মুহম্মদ সাদিক খুব উত্তেজিত হয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিলেন।
লোকায়ত পাঠকেন্দ্র নামে একটি ব্যাপার গড়ে উঠেছিল। ভাষা ইনস্টিটিউটের একটি কক্ষে মাঝেমধ্যে এর সভা হতো। কোনো বই বা প্রবন্ধের ওপর আলোচনা হতো। একবার কবিতাবিষয়ক কী আলোচনা হচ্ছিল, হুমায়ুন আজাদের বক্তব্যের পর ( সম্ভবত তিনি বলছিলেন : ষাটের দশকের পর আর কোনো ভালো কবিতা বাংলায় লেখা হয়নি। শামসুর রাহমানের সেরা কবিতাগুলোও ষাটের দশকেই লেখা) কবি মুহম্মদ সাদিক খুব উত্তেজিত হয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিলেন। আরেকবার একটি প্রবন্ধ পড়লেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক শহিদুজ্জামান। তার প্রবন্ধের নাম ছিল ‘কবি একজন ক্ষতিকর ব্যক্তি’। এই প্রবন্ধও বেশ আক্রান্ত হয়। (আমিও সমালোচনা করেছিলাম। পরে ওই প্রবন্ধটি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত ‘সাহিত্যপত্র’ পত্রিকায় ছাপা হয় এবং তারপর চৌধুরী স্যারের আহ্বানে ওই প্রবন্ধের সমালোচনা করে লেখা আমারও একটি প্রতিক্রিয়া ছাপা হয়।) পাঠকেন্দ্রের এক সভায় আমাকেও একটি প্রবন্ধ পড়তে দিয়েছিলেন তিনি সৃষ্টির স্বাধীনতা বিষয়ে। এই রকম একটি খোলামেলা ভাবনাচর্চার মুক্ত পরিপ্রেক্ষিত তৈরির জন্য তিনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন।
ড. আহমদ শরীফের বাড়িতে ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘ’-এর সাপ্তাহিক মাহফিল হতো প্রতি জুমাবার, শরীফ স্যারের প্রয়াণের পরও। কাসেম স্যার ছিলেন এর সভাপতি। এই সভাতেও গেছি কয়েকবার।
মাঝখানে অনেক বছর কোনো যোগাযোগ ছিল না। সম্প্রতি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে তিনি রামমোহন রায়ের ওপর বক্তৃতা দিতে এলে তার সাথে দেখা হয় আবার, শোনা হয় তার বক্তব্য। অতিসম্প্রতি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে টলস্টয়ের ‘শিল্প কী’ বইটির ওপর তিনি বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতার শেষের দিকে বাংলায় আধুনিকতাবাদ নিয়েও বললেন যে বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্বে এই কলাকৈবল্যবাদী আধুনিকতাবাদ রেনেসাঁসের মানবতাবাদী ও জীবনমুখী ইতিবাচক চেতনাবিরোধী, যেমন বিরোধী সাম্প্রতিক কালের উত্তর আধুনিকতাবাদ।
কাসেম স্যারের আধুনিকতাবাদবিরোধী ভাবনাকে তখন মনে মনে একটু পরিহাস করেই এড়িয়ে যেতাম। বুদ্ধদেব বসু ও অন্য পাণ্ডবেরা ছিলেন আমার পরম শিক্ষাগুরু। তাদের ও তাদের গুরু পশ্চিমা আধুনিকতাবাদীদের প্রচারিত নেতিবাদের যে মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলাম, তা আমার জীবন, ভাবনা ও আচরণকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। একসময় আমি আত্মবিধ্বংসী প্রবণতায় ভুগতে থাকি…।
আশির দশকে যখন ছাত্র ছিলাম, তখন তুমুলভাবে আধুনিকতাবাদী ছিলাম। কাসেম স্যারের আধুনিকতাবাদবিরোধী ভাবনাকে তখন মনে মনে একটু পরিহাস করেই এড়িয়ে যেতাম। বুদ্ধদেব বসু ও অন্য পাণ্ডবেরা ছিলেন আমার পরম শিক্ষাগুরু। তাদের ও তাদের গুরু পশ্চিমা আধুনিকতাবাদীদের প্রচারিত নেতিবাদের যে মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলাম, তা আমার জীবন, ভাবনা ও আচরণকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। একসময় আমি আত্মবিধ্বংসী প্রবণতায় ভুগতে থাকি…।
কাসেম স্যার সেদিন তার আলোচনার শেষের দিকে বললেন, তার কোনো কোনো ছাত্রছাত্রী তাদের নানা সংকটে অনেক সময় তার কাছে পরামর্শ চায়। কেউ কেউ যখন হতাশায় ভোগে, স্যার জানতে চান যে সে কার লেখা বেশি পড়ে। অমন কেউ হয়তো বলে জীবনানন্দের নাম। স্যার তখন তাকে জীবনানন্দ না পড়ে রবীন্দ্রনাথ পড়তে বলেন। জীবনানন্দ পড়লে হতাশাবোধ তো বাড়তেই পারে। আর হতাশ-বিষণ্ণ-বিপন্ন মানুষ ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’র মতো ইতিবাচক ভাবধারার সংসর্গে থাকলেই উত্তরণের পথ পেতে পারে।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি: শেষবার যখন আমি চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিই আত্মহননের, হোটেল কক্ষ ভাড়া করে গিলি বিপুল পরিমাণ ঘুমের বড়ি, সারা রাত ধরে স্ত্রোত্রের মতো আউড়েছিলাম এলিয়টের পঙ্ক্তি:
Burning burning burning burning
O Lord, Thou pluckest me out
O Lord, Thou pluckest…
তাঁর প্রতি অবিরল শ্রদ্ধা আমার।
ইতিবাচকতার আলো অবিনশ্বর হোক।
আগের পর্বে পড়ুন- নূরা পাগলা