:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
অন্য পথে যাত্রা

অন্য পথে যাত্রা

আগুনের মতো দুপুর। ট্রেনটা কেন থামল, তাই নিয়ে সকলে বেশ বিরক্ত। সকলে মানে ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণির সব যাত্রী আর আমার পরিবারের তিন নারী। মা, দাদি আর বড়মা মানে দাদির মা। আমরা সংখ্যায় চার-পাঁচজন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়জনের বয়স আট বা নয়, সে এই দলের একমাত্র পুরুষ সদস্য। ট্রেন ঘণ্টাখানেক থেমে আছে। ভেতরে সবাই কাঁঠালের মতো পেকে উঠছে গরমে, তার ওপর নতুন শাড়ি কাপড়ের খসখসানি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলের ‘যাত্রী’ মুখোশ ছাপিয়ে বেরিয়ে এল গৃহকর্ত্রী পরিচয়। প্রথম প্রকাশ ভাষায়। এতক্ষণ যিনি আমাদের আদুরে কণ্ঠে ‘এই যে দ্যাখো দ্যাখো, শোভারামপুর পেরিয়ে গেলাম’ বলছিলেন, তিনিই তিতিবিরক্ত হয়ে ‘উফ্ জানলা দিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন, সরে দাঁড়া, বাতাস লাগতে দে।’ আর যিনি, ‘মৌরাটের বাড়িতে একটা ভূত আছে, রাতে একা বের হলে ধরবে…’ টাইপ গল্প করছিলেন, তিনি বললেন, ‘উফ্ মরার ট্রেনের হইলডা কী? শসাটসা কিছু পাওয়া যায় না?’ আমাদের কিন্তু দিব্যি লাগছিল। অচেনা পথ। নতুন নতুন স্টেশনের নাম। সুচ ফেলা দায়। ভিড়ের ভেতরও বাদাম, চানাচুরওয়ালাদের সুর করে ডাকা ‘এইই ঘটি গরম’। টেনে টেনে কথা বলছে তারা। ওটা যে অন্য শহরের ভাষা, তা বোঝার বয়স আমাদের হয়নি। তবে বেড়ানোর এই আনন্দের মধ্যে সবাই এত বিরক্ত কেন, মাথায় আসছিল না। আমাদের দলের একমাত্র পুরুষ একটা কাজ করে বসল।

সে জানালা দিয়ে লাফিয়ে নেমে সিনেমার নায়কদের মতো শার্টের বোতাম খুলে দিল হাওয়া খেতে। তারপর নিজের পকেটে জমানো পাঁচ টাকার নোট ভাঙতি করে দুটো শসা কিনে বড় তিন নারীর মধ্যে বিলিবণ্টন করে একটা প্রসন্ন হাসি উপহার দিয়ে ফেলল। কিন্তু এবার বড়মা ছাড়া বাকি দুজনের অপ্রত্যাশিত গালিবর্ষণে মুহূর্তে সে কুপোকাত। ‘অ্যাই অ্যাই, তোকে এসব কে কিনতে বলল? কোন ময়লা পানি দিয়ে ধুয়েছে কে বলবে! কেন কেন, বাড়ির খাবার তোর ভালো লাগে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বেচারা আমাদের তিন বোনের সামনে কেমন ভেজানো মুড়ি-মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। এখন আর সে ট্রেনের জানালা দিয়ে লাফিয়ে নামার রিস্ক নিতে সাহস পাচ্ছে না। আমার মা, মানে তার মেজ কাকি, এবার নির্ঘাত দু-একটা দিয়ে বসবে পিঠে। বয়স যতই কম হোক, তিন বোনের সামনে বীরবাহাদুর খেতাব পাবার আন্তরিক বাসনার মৃত্যু একবার হয়েছে। এরপর যে আর কতটা সামলানো যাবে, সে কথা বিবেচনা করে ভিড়ের ভেতর একটু মিশে যেতে চেষ্টা করতেই দাদি কান ধরে টেনে বসালেন, ‘বানরের মতো আরেকবার লাফালাফি করলে তোকে এইখানে রাইখাই চইলা যাব।’ বেচারার আত্মসম্মানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়ে গেল। ছোট তিন বোন জানালা ধরে দাঁড়িয়ে, কেউ যাত্রীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে মশগুল, আর সে দাদির কোলে বসে আছে! আতঙ্কের এখানেই শেষ নয়। এই বীরপুরুষ আশঙ্কা করছে, যে বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে, নিশ্চয়ই সেখানেও এই গল্প প্রচার পেতে বিশেষ দেরি হবে না। আমরা তিন বোন সব দেখেশুনে ভদ্র হয়ে আছি নিরাপদে। অবশেষে কাঁঠাল পুরো পেকে নেতিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে ভোঁ শব্দ করে, বেশ যেন অনিচ্ছায়, হেলেদুলে চলতে শুরু করল ট্রেনটা। গোয়ালন্দ হয়ে যায় ট্রেন, চন্দনা নদী পার হয়ে যায়।

বেশ ডাঁটের সাথে গ্রীবা উঁচু করে জানান দিল, ‘আমার বিয়ের পরপর শ্বশুর পালকি পাঠাত। স্টেশন থেকে যাওয়ার পর বাড়ির সীমানায় প্রবেশের আগে দুইবার ফাঁকা গুলি করা হতো। বিশ্বাসবাড়ির বউ নিয়ে আসতেছে বেহারারা, মানুষজন যেন সতর্ক হয়।’ এই গল্প আমরা এতবার শুনেছি কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতাম না, একজন মানুষ যাওয়ার জন্য কেন বন্দুক ব্যবহার করা হবে আর তাতে আমোদেরই-বা কী আছে।

বিকেলবেলা আমরা পৌঁছলাম রতনদিয়ার কালুখালী স্টেশনে। স্টেশনে নামতেই আমার দাদির চেহারা এমন বদলে গেল যে আমরা আর তাকে চিনতে পারছি না। ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে, আমার মায়ের চেয়ে তার বয়স দশ বছর কম। বেশ ডাঁটের সাথে গ্রীবা উঁচু করে জানান দিল, ‘আমার বিয়ের পরপর শ্বশুর পালকি পাঠাত। স্টেশন থেকে যাওয়ার পর বাড়ির সীমানায় প্রবেশের আগে দুইবার ফাঁকা গুলি করা হতো। বিশ্বাসবাড়ির বউ নিয়ে আসতেছে বেহারারা, মানুষজন যেন সতর্ক হয়।’ এই গল্প আমরা এতবার শুনেছি কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতাম না, একজন মানুষ যাওয়ার জন্য কেন বন্দুক ব্যবহার করা হবে আর তাতে আমোদেরই-বা কী আছে। বন্দুক তো ব্যবহার করে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার দারোগা চাচা। এটাও বুঝতে পারতাম না বড়মা কেন প্রতিবার এই গল্প শুনে মিটমিট করে হাসতেন। পরে জেনেছিলাম, বন্দুক শুধু বহরের একজনের সাথে থাকত নিরাপত্তার খাতিরে। ওটাকেই আমার দাদি গল্প করার সময় শ্বশুরবাড়ির অহংকারে গুলি ছোড়া পর্যন্ত নিয়ে যেতেন। মায়ের সামনে মেয়ে তার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে আহ্লাদেপনা করলে প্রশ্রয় দেওয়া ছাড়া আসলে কিছু করার থাকে না। যাহোক, আমরা কালুখালী স্টেশনে নামার পর তরুণী দাদির হাত ধরে পৌঁছালাম একটা টমটমের কাছে। সে গাড়ি আবার মহিষে টানা। সবাইকে ওতে গুনে গুনে তুলে দিয়ে একজনকে সাথে নিয়ে গিয়ে দাদি তরমুজ কিনলেন গোটা ছয়। রাজবাড়ীর মিষ্টি আগেই নেওয়া হয়েছে। বড়মার বয়স তখন কত হবে, আশির কাছাকাছি, কিন্তু চলাফেরায়, বেশি হলে ষাট। এর মধ্যে আমার মা-ই সবচেয়ে বয়স্ক। তখন ২৩ বা ২৪, কিন্তু তরুণী শাশুড়ি এবং নানি শাশুড়ির ভাবভঙ্গিতে সে কাত। এখনো সে কোথাও একা যাবার কথা ভাবতে পারে না, আর এই দুই নারী দিব্যি ডেকে ডেকে, একে দিয়ে জিনিসপত্র ওঠাচ্ছে, তাকে ডেকে নামাচ্ছে। তো আমাদের বড়মাকে এবার বসিয়ে দেওয়া হলো তার চার প্রপৌত্র আর পুত্রীকে সামনে বসিয়ে। এরপর আমার মা হচ্ছে বাক্সের ঝাঁপি হিসেবে পেছনে। যাতে কেউ না পড়ে যায়। আমার দাদি সব সামলেসুমলে উঠে বসলেন টমটমের একেবারে পেছনে। তার একারই ওজন তখন প্রায় ৮০ কেজি। মাটির পথ ক্রমাগত ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোচ্ছে টমটম। সামনে মহিষগুলো মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে সম্মতি-অসম্মতি দুই-ই জানাচ্ছে। আমরা দুপাশের ফসলের মাঠ দেখতে দেখতে নিজেদের মধ্যে বকবক করছিÑ ‘ছোট দাদির বাড়ির পেছনে অনেক দিনের পুরোনো পুকুরের পাশে ভূত থাকে। খবরদার, রাতে বের হলেই তোকে ধরবে।’ এর মধ্যে আমি ছাড়া বাকি তিনজন, কেমন করে কোন পুকুরে সাঁতার কাটতে নামবে, তারও পরিকল্পনা করে ফেলেছে। তখনো কেউ জানত না, পুরো ট্যুরে তাদের আসলে তোলা জলেই নাইতে হবে। ও রকমই ঠিক করা হয়েছে, শহুরে বাচ্চা বলে কথা। এর মধ্যে সেই বীরপুরুষের জল বিয়োগের যন্ত্রণা শুরু হলো। পালোয়ান হেন মুখভাব উড়ে গেল মুহূর্তে। বোঝা গেল বেচারা অনেকক্ষণ ধরে কষ্ট পেয়েও ইজ্জত কা সওয়াল হিসেবে কিছু বলেনি। সে এবার মিনমিন করে বলল, দাদি, বাথরুম। দাদি গাড়োয়ানকে হুকুম দিলেন গাড়ি থামাতে। সামনে থেকে আমার ভাই নেমে গেল পইপই করে দাদির হাত ধরে পথের পাশেই মুক্তি খুঁজতে আর ৭৫-৮০ কেজি ওজনের ক্ষীণকায় দাদি নামলেন পেছন থেকে। এরপরের দৃশ্যটা ভাবুন তো…

আমরা তিন বোন মহিষের টানা গাড়িতে বসে আছি বড়মার গাঁ ঘেঁষে। আমার মায়ের তখনো গায়ে ‘নতুন’ গন্ধ। বেতের ঝুড়ি, কাঠের বাক্স সামলাচ্ছেন সবার। মায়ের কাপড়ে ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ। কানে সূর্যবালা নকশার মাকড়ি। নাসির ১৪ বছর বয়সে সবার আগে, ‘আসছি’ বলে চলে গিয়েছে সেই কবে আর দাদি গিয়েছেন হাসতে হাসতে হঠাৎই সংজ্ঞা হারিয়ে, নাতির দেখানো পথে।

মুহূর্তে গাড়ির ভারসাম্য ওলট-পালট হয়ে গেল। ভেতরের ছইয়ের সাথে আমাদের কপাল-টপাল সামান্য একটু ঠুকল বটে কিন্তু সর্বনাশ হলো অন্য জায়গায়। বড়মা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তাই ঠিক ক্যাচ ধরে উঠতে পারেননি। তার পাশ দিয়ে অতগুলো তরমুজ হড়হড় করে গড়িয়ে নেমে ঠাস ঠাস শব্দে পথে পড়ে ফাটল। আমার দাদি এই দৃশ্য দেখামাত্র ঘুরে দাঁড়ালেন নাতিনের দিকে, তোর আর সময় হইল না। আর সেই নাতিন ততক্ষণে চোখের বাইরে। প্রথম তরমুজটিকে পড়তে দেখেই আমার ভাই বুঝে গিয়েছে এবার কী হতে পারে। তবে সে বোকার মতো দৌড়াচ্ছে সামনের দিকে, মানে গাড়ি যেদিক দিয়ে যাবে। আমরা ভয়ে শেষ। এখন কী হবে! ওর মধ্যে যে দু-একটা তরমুজ অক্ষত ছিল, সেগুলো তুলে নিয়ে গাড়ি রওনা হলো। আমার ভাই তখনো দৌড়াচ্ছে। দু-পাঁচ মিনিট যাবার পর বোঝা গেল যে সে থামবে না। বাড়িও অবশ্য বেশি দূরে নয়। গাড়ির ভেতর থেকে আমার দাদি তার নাতিকে ডাকছেন, ‘নাসির, দাঁড়া দাঁড়া।’ নাসির থামছে না। দু-এক মিনিট অপেক্ষা করে আবার হুকুম, তবে এবার কণ্ঠ ম্রিয়মাণ। ছেলের বউয়ের কাছে পায়ের স্যান্ডেল জমা রেখে নেমে গেলেন। খালি পায়ে মাটির পথে আমার দাদি হাঁটছেন। নাসির একটু হাঁপিয়ে উঠেছে। গতি শ্লথ। আমরা গাড়ির খোলা জায়গা থেকে বসে দেখছি। আমাদের চোখে দুজনের আকারই তখন ক্রমে ছোট হয়ে আসছে, দূরত্ব বাড়ছে। অদৃশ্য হওয়ার আগের দৃশ্য, প্রচ- গ্রীষ্মের এক হাঁ করা বিকেলে মাটির পথে আমার দাদি তার নাতির হাত ধরে হেঁটে হেঁটে আসছেন। দুপাশে ফসলের মাঠ। এখানে তার শ্বশুরবাড়ি। তিনি সবাইকে নিয়ে এসেছেন বেড়াতে। কিন্তু নাতি নেমে যাওয়ায় এখন তিনিও হেঁটে আসছেন মাটির পথে খালি পায়ে। বাড়ি পৌঁছানোর পর আমার ছোট দাদি একটা চিৎকার দিলেন, ‘এ সাঁইঝে বুজি আইছে মুনিগেরে নিয়ে।’ কারা কারা যেন এগিয়ে এসেছিল আশপাশের বাড়ির। ছোট দাদি সবাইকে কয়েকবার করে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, ‘ইডা আমাগের সুজার বড় মুনি, ইডা আমাগের মিলুর মুনি। আমার পাঁচ বছর বয়সে ওই যে গিয়েছিলাম, সেটাই জীবনের শ্রেষ্ঠ বেড়াতে যাওয়া।’

খুব বেশি কোথাও যাইনি আমি, তবু কিছু কিছু বন্দরে কখনো থামা হয়েছে। অন্য রকম মানুষজনের তিন-চারটে শহর তো দেখেছি। মিউনিখ থেকে ইরাবতী, পেনসিলভেনিয়া থেকে পারো, সান্তস আইল্যান্ড থেকে নাগরকোট বা লাঙ্কাউই থেকে দার্জিলিং। কিন্তু এই সব পথই আমার সেই বেড়াতে যাওয়াকে অতিক্রম করতে পারল না আজও। এই সব গল্প কেউ প্রকাশ করতে তেমন আগ্রহী হয় না। কিন্তু এই যে আমার শ্রেষ্ঠ যাত্রা স্মৃতি।

নাসির দাদির হাত ধরে হাঁটছে, রাজবাড়ীর কালুখালীর পাকশি গ্রামের এক বাড়িতে পৌঁছাবে আর একটু পরই। আমরা তিন বোন মহিষের টানা গাড়িতে বসে আছি বড়মার গাঁ ঘেঁষে। আমার মায়ের তখনো গায়ে ‘নতুন’ গন্ধ। বেতের ঝুড়ি, কাঠের বাক্স সামলাচ্ছেন সবার। মায়ের কাপড়ে ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ। কানে সূর্যবালা নকশার মাকড়ি। নাসির ১৪ বছর বয়সে সবার আগে, ‘আসছি’ বলে চলে গিয়েছে সেই কবে আর দাদি গিয়েছেন হাসতে হাসতে হঠাৎই সংজ্ঞা হারিয়ে, নাতির দেখানো পথে। দুজনের মৃত্যুতে প্রায় ১৩ বছরের ব্যবধান হলেও গোরস্তানে তাদের পাশাপাশি বাস। মৃতদের বয়স বাড়ে না। নাসিরের এখন বয়স হতো আটত্রিশ থেকে উনচল্লিশ। কিন্তু আমার কাছে ১৪-তে থেমে আছে সেই কবে থেকে। তবু এত স্পষ্ট সকলে। এই তো দাদি, আমার মতোই কোঁকড়া চুল, রাগী মেজাজ।

আবার কোনো দিন আমরা ঠিক একই রকম করে একসাথে রাজবাড়ী যাব। মহিষগুলোর শিঙে একই রকম সোনালি ঘণ্টা বাঁধা থাকবে। মাথা দোলালে শব্দ হবে টুং টুং টুং। নাসির আর দাদি হাত-ধরাধরি করে পায়ে মাটি মেখে এগিয়ে আসতে থাকবে আমাদের দিকে।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.