:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
জয়দীপ দে

লেখক, কথাসাহিত্যিক

অপরাজেয় আচার্য
ব্যবহৃত শিল্পকর্ম: সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ

অপরাজেয় আচার্য

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পড়ব কখনো ভাবিনি। শুনতাম দেশের সবচেয়ে বাঘা বাঘা শিল্পীরা এখানে পড়ান। মুর্তজা বশীর, মনসুরুল করিম, ঢালী আল মামুন, অলক রায়, মিজানুর রহিম, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ প্রমুখ। ভাবতাম, এ এক স্বপ্নের জগৎ। আমার মতো মন্দভাগ্যের মানুষের প্রবেশাধিকার নেই এখানে। যে বছর আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, সে বছরটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকারতম বছর। এক বছরে ৮টি খুন হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ততদিনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর থেকে শিক্ষার্থীদের আস্থা সরে আসে। এই ফাঁকতালে হয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক অনুষদে আমি চান্স পেয়ে যাই। পরিবারের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে নিজের সাবালকত্ব প্রমাণের চেষ্টায় চারুকলায় ভর্তি হই। ভর্তি হওয়ার পর বুঝলাম কি ভুলটা না করেছি। অন্ধকার কলা ভবনের অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে রুমগুলোতে আমাদের ক্লাস হতো। সবসময় একটা ভেজা ভেজা বাতাসের সাথে লিনসিড আর স্পিরিটের গন্ধ মিশে কেমন একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করত। দুপুর বেলায়ও কিছু কিছু রুমে অন্ধকার লেগে থাকত। আমি বিভাগটার নাম দিলাম আলতামিরার গুহা। কিছুদিন ক্লাস হতে না হতেই ৬ মাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। অনেক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে খোলা হলে আবার বন্ধ হয়ে যায় ৮ মাসের জন্য। চারদিক অন্ধকার দেখতাম। কবে পাস করব আর কবে যে সংসারের হাল ধরব বুঝতে পারতাম না। ভাবতাম বের হতে হতে তো চাকরির বয়স চলে যাবে। ছোটখাটো ব্যবসাপাতি করে সংসার চালাতে হবে। মনের ভেতরে অনিশ্চয়তার ঘূর্ণি।

কিন্তু বহিরাবরণে একটা প্রশান্তির ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। প্রায় এ ও জিজ্ঞেস করত: অপরাজেয় বাংলার স্থপতি বলে তোদের স্যার। জয়নুল আবেদীনের ভাতিজা বলে তোদের পড়ায়। মুখ রহস্যের হাসি নিয়ে সম্মতি জানাতাম। কিছুদিন পর ক্লাসেই পেলাম সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদকে। অপরাজেয় বাংলার স্থপতি। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মনে মনে তাকে ঘৃণা করত। কেন করত পরে বলছি। কিন্তু সামনে এলে সবাই শ্রদ্ধায় নত হত তার কাছে। প্রথম বর্ষে তিনি মাড মডেলিং এর ক্লাস নিতেন। একটা মাটির গোলক তৈরি করে তাকে বিভিন্ন অংশে কেটে তা দিয়ে একটা কম্পোজিশন তৈরি করা। তিনি আমাদের কাজ দেখতে সকাল সকাল ক্লাসে চলে আসতেন। থাকতেন সন্ধ্যে পর্যন্ত। তখন তার কথা শুনে আবিস্কার করলাম তার বাড়ি সিলেট। একদিন তার কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। দেখলাম বিকারশূন্য। যা বোঝার বুঝে গেলাম। পরে আর কখনো তার কাছে ভিড়বার চেষ্টা করিনি। মডেলিং এর ক্লাসে তিনি একেবারে শিশুদের মতো হয়ে যেতেন। একে বকছেন। ওকে শাসাচ্ছেন। কারো কাজ দেখে এতোটা মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন অন্য শিক্ষকদের ডেকে এনে দেখাচ্ছেন। কোন ভণিতা ছিল না তার মধ্যে। একটা পুরোপুরি সাদা মনের মানুষ। একদিন তো ক্লাস করাতে করাতে এতো দেরি হয়ে গেলো তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ গাড়িটা চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ভাগ্যিস রঞ্জু স্যার এসে অনেকটা জোর করে তাকে নিয়ে যান।

খালিদ স্যারের দুর্ভাগ্য না চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জানি না। তার মতো একজন শিল্পী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল, কিন্তু একটা ভাস্কর্য গড়তে পারেনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। তেমন কোন মূল্যায়ন পাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে। একজন পাগলাটে মদ্যপ লোক হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু আমরা জানতাম কি পবিত্র ও নির্মল একটা হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগার। একটা টিলার উপর লাল ইট দিয়ে তৈরি একটা তিনতলা ভবন। টিলার নীচ থেকে দাঁড়িয়ে দেখলে মনটা ভরে যেত। একদিন বিকেল বেলা দেখি সেখানে দাঁড়িয়ে খালিদ স্যার কয়েকজন শিক্ষকের সামনে ইচ্ছেমত গালিগালাজ করছেন। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। কি জানি কি হয়ে গেলো বাবা। পরে শুনলাম লাইব্রেরির পাশে খালি জায়গায় আইসিটি ভবন বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। খালিদ স্যার এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ভিসি তা শুনেননি। যথারীতি উন্নয়ন কাজ শুরু হলো। খালিদ স্যার দলছুট মানুষ। তার কথা কেউ শুনত না। ঠিকই আইসিটি বিল্ডিং হয়ে গেলো সেখানে। এই ভবনের কারণে লাইব্রেরির সৌন্দর্য পুরো মাঠে মারা যায়।

খালিদ স্যারের দুর্ভাগ্য না চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জানি না। তার মতো একজন শিল্পী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল, কিন্তু একটা ভাস্কর্য গড়তে পারেনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। তেমন কোন মূল্যায়ন পাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে। একজন পাগলাটে মদ্যপ লোক হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু আমরা জানতাম কি পবিত্র ও নির্মল একটা হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি। প্রায় স্যাররা এটা ওটার খ্যাপ মারতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যেতেন। অল্প কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিদেয় করে দিতেন। আর খালিদ স্যার যা পেতেন তার সবটাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। কোন টাকা হাতে রাখতেন না। তাই সবাই খালিদ স্যারের কাজ করার জন্য পাগল ছিল।

সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদছবিসূত্র: observerbd.com

এবার বলি তার প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের (এমনকি আমারও) ক্ষোভের কারণটা কি। ১৯৯৭ সালে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজে বহুতল কিছু ভবন বানিয়ে দেন। কথা ছিল এই ভবনেই স্থানান্তরিত হবে চারুকলা বিভাগ। চারুকলা বিভাগ ও কলেজ এক হয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট হবে। আমরা যখন ভর্তি হই তেমনটা শুনি। এমন হলে শহরেই আমরা ক্লাস করতে পারতাম। ক্যাম্পাসের অস্থিরতা আমাদের স্পর্শ করত না। আমরা সেশনজট মুক্তভাবে পাস করে যেতাম। কিন্তু সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ স্যার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়ায় সে উদ্যোগ সাময়িক ভেস্তে যায়। তার যুক্তি তখন কেউ শুনে নি। আমরা এর প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতাম। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় আরো ১৩ বছর পর ২০১০ সালে। এতে সবচেয়ে বেশি যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে সে আমিই। এখন বুঝি স্যার কতটা দূরদর্শী ছিলেন। বিসিএসে আমি চারুকলা কলেজের প্রভাষক পদের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হই। কিন্তু আমার নিয়োগের এক বছর আগে কলেজটি সরকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দেয়ায় আমাকে কোথাও পদায়ন দেয়ার জায়গা পাচ্ছিল না সরকার। শেষমেশ উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগে যোগদান করায়। যা’হোক অনেক কাঠখড় পোড়ানোর মধ্য দিয়ে একটা সুরাহা হয়। কিন্তু যখনই ভাবি খালিদ স্যারের কথা, তখনই লজ্জায় আনত হই। স্যার চেয়েছিলেন দুটো প্রতিষ্ঠানই থাক। শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত না হোক। ক্যাম্পাস থেকে চারুকলা বিভাগ চলে গেলে সাম্প্রদায়িক শক্তি নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পাসে দাঁড়ানোর আর কোন জায়গা থাকবে না।

স্যার ছিলেন হযরত শাহজালালের সঙ্গে আসা আউলিয়া হযরত শাহ মোস্তফা (র.)-এর বংশধর। এরকম একটা সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান মূর্তি বানায় সেটা সিলেটের অনেক মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য। বংশ পরম্পরায় তিনি মাজারের খাদেম হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মূর্তি বানানোর অভিযোগে তাকে সেই সুযোগ দেয়া হয়নি। খাদেম হতে পারলে বিনাশ্রমে গাড়ি বাড়ি কোটি কোটি টাকার মালিক হতে পারতেন। কিন্তু মনে প্রাণে শিল্পকলাকে ধারণ করা এই মানুষটি শিল্পের নেশায় সব জাগতিক প্রাপ্তিকে অগ্রাহ্য করেছিলেন।
শুধু ধর্মীয় নয় সামাজিকভাবেও খুবই প্রভাবশালী ছিল তার পরিবার। তার দাদা ছিলেন সৈয়দ আব্দুল মজিদ, যাকে লোকে চিনত কাপ্তান মিয়া নামে, আসামের প্রথম মুসলিম চা বাগানের মালিক। আসামের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন শেষে।

সর্বশেষ তার সাথে দেখা তাও বছর তিনেক হয়। আমরা একটা ফ্যামিলি পিকনিকে যাব শ্রীমঙ্গল। পাহাড়িকা এলে উদয়ন হয়ে যাবে। অনেক লেট করে ট্রেনটা এলো। হুড়মুড় করে ছুটলাম আমরা ট্রেন ধরার জন্য। চট্টগ্রাম স্টেশন। হঠাৎ দেখি স্যার ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হাঁটছেন। আমি আমার ভাগনে ভাগনিকে নিয়ে গেলাম তাঁকে সালাম করানোর জন্য। পেছনে আমার বোন ও ভগ্নিপতি। তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলাম স্যারের সঙ্গে। ভাগনি তো শুনে অবাক। ও বিস্ময়ের সাথে বলল, আমি তো মনে করেছি উনি মারা গেছেন। এতো বড়ো মানুষ কি বেঁচে থাকে মামা। আমার ছোট্ট ভাগনির কথা কাল ফলে গেলো। স্যার দেহবেড়ি থেকে মুক্তি পেয়ে অক্ষয় অমর হয়ে গেলেন। হয়ে গেলেন সত্যিকারের মহাকালের বড় মানুষ।

২১.০৫.২০১৭

(মৌলভীবাজার থেকে প্রকাশিত দীপঙ্কর মোহন্ত সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘খনন’ -এ প্রকাশিত লেখাটি লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশ করা হল।)

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.