Thappad
আঁতের কথা, ঘাটের কথা
যখন মেয়েটির জন্মের খবর এসে পৌঁছায়, মেয়েটির প্রফেসর বাবা ক্লাসে অমৃতা প্রীতমের ‘আমার ঠিকানা’ কবিতাটি পড়াচ্ছিলেন। সাত-পাঁচ না ভেবে নির্দ্বিধায় তিনি তাঁর মেয়ের নাম রাখলেন অমৃতা। হ্যাঁ! ‘থাপ্পড়’ সিনেমাটি এই অমৃতা মেয়েটিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। ‘থাপ্পড়’ সিনেমাটি প্রকৃত প্রস্তাবে অমৃতার গল্প।
কী আছে ‘আমার ঠিকানা’ কবিতায়? কবিতাটি এমন:
আজ আমি আমার ঘরের নম্বর মুছে ফেলেছি
আমার গলির নামফলক সরিয়ে দিয়েছি
যে সকল পথ আমার বাড়ি পৌঁছায় সব নিশ্চিহ্ন করেছি
তারপরেও যদি সত্যি তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাও
তাহলে প্রতিটি দেশের প্রতিটি শহরের প্রতিটি দরজায় কড়া নেড়
এবং যেখানে মুক্ত আত্মার আভাস পাবে
ধরে নিও সেটিই আমার বাড়ি
আসলে তো বুদ্ধিমান পরিচালক অনুভব সিংহ পক্ষান্তরে ভার্জিনিয়া উলফের মতো নিজস্ব এক ঘরের কথা বলতে চেয়েছেন, মেয়েদের নিজস্ব এক স্পেসের কথা। বাবা ও মেয়ের সম্পর্কের রসায়নটা একটি দৃশ্যে খুব সুন্দর দর্শকদের বুঝিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। যেখানে মেয়ে বাবার একটি একটি করে বই মুছে দিচ্ছে আর বাবা সেই বই তাকে গুছিয়ে রাখছে। বোঝা যায় কেজো প্রাত্যহিকতা তাদের সম্পর্ককে ম্লান করতে পারেনি। তারা অনন্ত ছুঁয়ে আছে। বোঝা যায় অমৃতা নামটি রাখবার যৌক্তিকতাও।
নিছক আর থাপ্পড় থাকল না এই থাপ্পড়। একটা সমাজের নড়বড়ে ভিতকে, তার মুখোশধারী মানুষজনকে এবং পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে যেন এক্সরে আলোর নীচে নগ্ন করে দেখালো।
গল্পটি তেমন কিছু নয়। সাধারণ একজন গৃহবধূর গল্প। অমৃতা আর পাঁচজন গৃহবধূর একজন। হ্যাপি গো গৃহবধূ। হয়তো একটি ঘটনা তার জীবনে না ঘটলে নিজের স্বরূপ সে কোনো দিন বুঝতেও পারতো না। প্রতিদিন সকালে একই দৃশ্য পুনরাবৃত্ত হয়। অমৃতা ঘুম থেকে উঠে ফূর্তিতে লাফিয়ে লাফিয়ে কাজ করে। লেমন গ্রাস নিজের হাতে কেটে- আাদা ঘষে চা বানায়, শাশুড়ির সুগার মাপে, স্বামীর মানিব্যাগ ও টিফিনবক্স হাতে গুঁজে দেয়, রাত্রে নিয়মিত সহবাস করে, বাইরে খেতে যায়। সব একদম ঠিকঠাক। অবশ্য স্বামী বিক্রমকে যখন জানায় ড্রাইভিংটা সড়গড় করে নেবে কিনা তখন উত্তরে বিক্রম বলে, আরে পরোটাই এখনও পর্যন্ত ভালো করে বানাতে শিখলে না তা আবার গাড়ি!
এই অবধি সবকিছু অমৃতা মেনে নিয়েছিল কারণ বিক্রমকে সে সত্যিই ভালোবাসত। সে ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখত দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ গৃহবধূ হবে। এরমধ্যে একদিন একটা ঘটনা ঘটে। কর্পোরেট অফিসের প্রোমোশন নিয়ে টেনশনে ভরা পার্টিতে বিক্রম অমৃতাকে থাপ্পড় মেরে বসল।
অন্য ফর্মুলা ফিল্মের পরিচালক থেকে এখানে অনুভব আলাদা হয়ে যান। তাঁর আগের সিনেমা ‘আর্টিকেল ফিফটিন’! অনেকের বিরাগভাজন হয়েছেন সিনেমাটি করে। নিছক আর থাপ্পড় থাকল না এই থাপ্পড়। একটা সমাজের নড়বড়ে ভিতকে, তার মুখোশধারী মানুষজনকে এবং পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে যেন এক্সরে আলোর নীচে নগ্ন করে দেখালো।
এত নিস্পৃহতা একজন কীভাবে অর্জন করে, আমি অমৃতার নিস্পৃহতার কথা বলছি, ভেবে আকুল হতে হয়। আঘাত কতটা গভীর হলে এমনটি ঘটে। এই নেতিবাচকতাও আসলে নীরব একটা থাপ্পড়। উলটো একটা থাপ্পড় মারলে যতটা না আমাদের স্পর্শ করত, অমৃতার এই পাথর হয়ে যাওয়া আমাদেরকেও যেন নিশ্চল করে দেয়।
অমৃতাও কী কম অসহায়। বিক্রম যখন নরমে ও গরমে বারবার আকুতি জানায়, ফিরতে চায়, ফেরাতে চায় অমৃতাকে, কী অসহায়ভাবেই না অমৃতা জানায়, তার আর প্রেম নেই। আসলে মেয়েরা প্রকৃতিগতভাবে এমনই। মাটির মতো। সবকিছু সহন করতে পারে। সব টুটাফুটা মেরামত করে নিতে পারে। অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু যদি একবার ভূমিকম্প হয় আমূল সত্তায়, সহজে আর ফেরে না।
একটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আমরা সবাই তাতে সামিল। মেয়েরা এখানে সম্পত্তি। জঙ্গম সম্পত্তি। তাকে মাথায় তুলে রাখবার ও পায়ে পিষবার নিয়ন্ত্রক শুধু পুরুষ। এমনকি মেয়েরাও তাই ভাবে। অমৃতার মা-ও ঠিক যেন বুঝতে পারেনা, বিক্রমের দোষ ঠিক কোথায়। একটা থাপ্পড়ই তো মেরেছে।
আঘাত কতটা গভীর হলে এমনটি ঘটে। এই নেতিবাচকতাও আসলে নীরব একটা থাপ্পড়। উলটো একটা থাপ্পড় মারলে যতটা না আমাদের স্পর্শ করত, অমৃতার এই পাথর হয়ে যাওয়া আমাদেরকেও যেন নিশ্চল করে দেয়।
সিনেমাটি দেখতে দেখতে পুরুষ হিসেবে ক্ষতবিক্ষত হই। আয়নার সামনে যেন নিজের ভাঙাচোরা মুখ। একটা থাপ্পড় হয়তো বড়ো কথা নয়। কখনও একজন নারীও একজন পুরুষকে থাপ্পড় মারতে পারে। এখানে থাপ্পড়টা মারা হচ্ছে নারীকে পরাধীন ভেবে। ভালোবাসা অধীন করে… দখলদার তৈরি করে না।
এখন হয়তো কুমারী বলি হয় না, সহমরণ হয় না, বিধবাবিবাহ হয়, মেয়েরা এখন ট্রাক চালায় ও মহাকাশ যায় তবু কোথাও যেন হানাদার ওঁৎ পতে বসে আছে। কতরকম স্যাডিস্ট আচরণ, ভয়ারিজম ও টর্চারের মধ্য দিয়ে একজন মহিলাকে যেতে হয়। নাম বদলে ফেলা হয়, গৃহ থেকে উৎখাত করা হয়, নজরবন্দী করে রাখা হয়। যৌনতায় একতরফা ভূমিকা পুরুষের। অথচ একটা সফল ক্রীড়ায় সমান অংশীদার হওয়াটা জরুরি।
এমন তরোবেতরো ঘটনাক্রমে একটাই আশার আলো। অমৃতার বাবা। অমন একজন বাবা থাকলে হাজারটা অমৃতা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। কোনও কথা নয়, শুধু নিঃশব্দ উপস্থিতি অনেক সময় বড়ো ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের এমন একজনকে দরকার যে ‘রাজা’ নাটকের সুরঙ্গমার মতো ‘অন্ধকারের মতো কথা’ কইতে জানে। যা আসলে একজন মেয়ের আঁতের কথা, ঘাটের কথা ও নোঙরের কথা।
বহুদিন পর একটা সিনেমা দেখে ফিরতে ফিরতে জলোচ্ছ্বাস অনুভব করলাম।
ট্রেইলার দেখতে ক্লিক করুন- Thappad