আকাশপ্রদীপ আর দীপাবলি
‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে…’ লতার এই গানটা শুনলে একটানা দিনভর, রাতভর শুনি। শৈশব থেকেই এমন হয়। আরো অনেক গানের ক্ষেত্রে এমন হয় আমার। ‘কতোকাল এই হিয়া আকাশপ্রদীপ হয়ে জ্বলবে…?’ এই গান শুনে শুনে আমার আকাশপ্রদীপকে একটা তারা মনে হতো। পরে জেনেছি, আকাশপ্রদীপ হচ্ছে বাঁশের মাথায় চায়নিজ ল্যাম্পের মতো বর্গাকার কাগজের বাকশে জ্বালানো প্রদীপ। আশ্বিন থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত পূর্বপুরুষদের স্মরণ করতে ঘরে ঘরে তোলা হয় এই প্রদীপ। ঘরের উঠানে পোঁতা হয় কপিকল লাগানো লম্বা বাঁশ, তারপর লাল কাপড় বা কাগজের বাকশের মধ্যখানে রাখা হয় ঘি অথবা সর্ষের তেলে জ্বালানো দীপ, যাতে বাতাসে নিভে না যায়। বাকশো-সহ দীপটি সুতা টেনে উপরে তুললেই হয়ে যায় আকাশপ্রদীপ। যে বাঁশের মাথায় এই দীপ থাকবে সেই বাঁশ হবে লম্বায় একজন মানুষের সমান।’
‘আর দীপাবলি?’
‘দীপাবলি মানে হলো প্রদীপগুলি। মানে অনেক প্রদীপ। দীপাবলিকে হিন্দিতে দেওয়ালি বলে। দেওল মানে প্রদীপ। দীপাবলিকে দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও ডাকা হয়। কার্তিকের অমাবস্যায় দীপাবলি হয়। দীপাবলির রাতে ঘরে ঘরে প্রতীকী অর্থে অন্ধকার তাড়ানোর জন্যে প্রদীপ জ্বালানো হয়। তারপর এই রাতে মা কালীর শ্রাদ্ধ খাওয়ার জন্যে মৃতরা পৃথিবীতে আসে, তাদের অন্ধকার পথকে আলোকিত করার জন্যে এইসব প্রদীপ জ্বালানো হয়। আরো অনেক কারণে এই প্রদীপ জ্বালানো হয়। দীপাবলি শুধু হিন্দুদের উৎসব নয়। এটা একই সঙ্গে শিখ, জৈন আর বৌদ্ধদেরও উৎসব। এই রাতে জৈনধর্মের প্রবর্তা তীর্থঙ্কর মহাবীর মোক্ষ লাভ করেছিলেন বলে তারা দীপ জ্বালায়। শিখরাও তাদের কতিপয় গুরুর মুক্তিদিন হিশেবে এই দিন পালন করে। বুদ্ধের গৃহত্যাগ স্মরণে বৌদ্ধরা এই রাতে দীপ জ্বালায়। কৃষ্ণ কর্তৃক নরকাসুর বধের স্মারক হিসেবে একে নরকচতুর্দশী বলা হয়। তবে এই অনেকগুলি কারণের একটা কারণ আমার ভালো লাগে না।’
‘কী কারণ?’
রাম-সীতার ছাব্বিশবছরের সংসার জীবনে সীতা একবারও অন্তঃসত্ত্বা না হওয়ার ঘটনা রামের পুরুষত্ব সম্পর্কে সন্দিহান না করলেও ছাব্বিশবছর পর রাবণের সুরম্য অশোক-কাননে গৃহবন্দী দশা থেকে পরিত্রাণের পর যখন জানা যায় সীতা অন্তঃসত্ত্বা তখন সংশয় ঘন হয়ে আসে। রামও বুঝতে পারে এই সন্তান তার ঔরসজাত নয়। ফলত সীতাকে চলে যেতে হয় তপোবনে।
‘এই দিনেই রাম চৌদ্দ বছরের নির্বাসন ও লঙ্কায় যুদ্ধে অন্যায় কৌশলে জ্ঞানী রাবণকে হত্যার পর অযোধ্যায় ফেরে। তাকে ফিরে পেয়ে অযোধ্যাবাসীরা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে সাজিয়ে তোলে শহর। রামকে পছন্দ করি না বলেই হয়তো এই কারণ পছন্দ নয় আমার।’
‘রামকে কেনো অপছন্দ, রাবণকে অন্যায় কৌশলে হত্যা করেছে বলে?’
‘না, শুধু তা নয়। আরো কারণ আছে। অনার্য, বেদ বিরোধী, মাতৃভূমি রক্ষার যুদ্ধে নিহত রাবণের সঙ্গে সীতার যৌনসংসর্গের ফলেই সীতা গর্ভবতী হন। এবং এই সম্পর্ক সংগঠিত হয়েছিলো অশোক-কাননে পারস্পরিক সম্মতিতে। কারণ রাবণের প্রতি জনৈক ঋষির অভিশাপ ছিলো যে তিনি জোরপূর্বক কোনো নারীর সতীত্ব হরণ করলে সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হবে। রাম-সীতার ছাব্বিশবছরের সংসার জীবনে সীতা একবারও অন্তঃসত্ত্বা না হওয়ার ঘটনা রামের পুরুষত্ব সম্পর্কে সন্দিহান না করলেও ছাব্বিশবছর পর রাবণের সুরম্য অশোক-কাননে গৃহবন্দী দশা থেকে পরিত্রাণের পর যখন জানা যায় সীতা অন্তঃসত্ত্বা তখন সংশয় ঘন হয়ে আসে। রামও বুঝতে পারে এই সন্তান তার ঔরসজাত নয়। ফলত সীতাকে চলে যেতে হয় তপোবনে।’
‘আচ্ছা।’
‘সীতার প্রতি সন্দেহের আঙুল প্রজারা তোলার আগে প্রথম রামই কিন্তু তুলেছিলো। আর শেষে সীতা যে পাতাল প্রবেশ করে এটাও আসলে আমার কাছে রটনা মনে হয়, যেটা পরে কিংবদন্তি থেকে পুরাণে রূপ নেয়। আমার মনে হয়, বাল্মীকি মুনির প্ররোচনায় শ্রীরাম লব আর কুশকে নিজের বংশরক্ষার জন্যে গ্রহণ করে। অতঃপর সীতাকে মাটিমধ্যে জীবন্ত পুতে ফেলে। রত্নাকর ডাকাত বাল্মীকি মুনি হয়ে যদি রামায়ণ না লিখতেন তবে নপুংসকের আখ্যানই লেখা হতো। কেননা রাবণ শ্রেষ্ঠ এবং জ্ঞানী। আর রাবণকে রাক্ষস বানানোর কারণ তিনি যারা শাস্ত্র এনেছিলেন তাদের অংশ ছিলেন না, মানে আর্য ছিলেন না, ছিলেন অনার্য। তার মানে রাবণ আমাদেরই পূর্বপুরুষ, এই অঞ্চলের সন্তান, আর্যদের মতো বহিরাগত না।’
অলংকরণ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য