:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
আনন্দময়ী মজুমদার

কবি, অনুবাদক

আদিগন্ত জ্বালিয়েছি লবণের আয়ু
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

আদিগন্ত জ্বালিয়েছি লবণের আয়ু

অজানিত পাখি

কতো অজানিত যেন সব পাখি। কতো অজানিত যেন সব হাওয়া। অবলীলায় আলোকিত সাত পা ছায়ার কাছে এসে, হুতাশ আশ্বাসে দুই হাতে গুলমোহর পেতে দেয়। সে ফুলের চূড়ার প্রহরে নীল জেগে রয় মেঘের ভিতর। আর মনে হয়, যখন সে আসে এক অবিভাজন পাখি আলোকিত। দুচোখে হীরার কাজল। কাচকাটা ব্যথার চঞ্চু ভুলে থাকে নাহার ও রাত! সেও জাগে তারপর। কানাকুয়া পাখি কি দেখতে ভুলে গেছে? ভুলে গেছে! কেউ কি কেঁদে গেছে দীঘির তলায় কোনো দিন!

কাঁটার বিবরে কেউ যায় বহুদূর সাথ, অদেখা। দেখেনি কেউ। পায়ের আর হাতের শিরায় মিশে আছে শিশুগাছ, সব ঝারি, চার ঋতুর ভিভালদি প্রকার। মিশে আছে ষড়তান, লিপিকার প্রাণ।

জানি না কেন। জানি না কেন ভাঙা পায়েলের ধ্বনি আমাদের চিরে দেয় যেন বা উদারা আর তারায়। যেন মহাকাশ বেদনায় খাক। আমরা ছিলাম এই পাখির দোসর। কোনো পুরনো হাওয়ায়। কোনো জন্মান্তর। রক্তজবা জরায়ুর প্রতিদিন ধ্যানে। অথবা হয়ত সে অন্য কোনো তামার রসায়ন ভেঙে শোরা হয়। সেই শোরা সেঁচে আদিগন্ত জ্বালিয়েছি লবণের আয়ু। গন্ধ ভেঙেছি মোম। সে জন্ম অবসানে নবান্নের একটি শিখা হয়ে যায়। এল্ক হরিণের পথ ধরে কেউ হেঁটে হতে চায় কণ্টকহীন। বহু তীর ছুঁয়ে আসে ভূ আর সাগর। সাগর হয় মাটির পদতল।

তারা কাঠ কুঁদে তাড়িয়েছে শীত। বেঁধেছে রুমির দোতারায় একটি গান কোনো দিন। তারা পুকুরের জল বেঁধে স্বকীয় খেয়াল। জলের ফোঁটা জেনেছিল সে ফোঁটামাত্র না। সে-ই জল।

এখনো ধূ ধু রং দেখে আমরা কাঁদি। রজত বসন ঝড়ের কাছে আমরা দাঁড়িয়েছি কখনো। দুইটি রৌদ্রাক্ষরের মাঝে একটি জোনাকি, তারার রাজধানী আমরা জানি। বারবার শব্দভুল কেন সে প্রতারিত করে আমাদের। জলে এতো স্রোত যে বিম্ব হয় না।

কেউ বা দেখেছে হেমন্তের পাখি বাদামী রঙিন। ফল্গুর শব্দ শোনে নাই, সেখানে সে বেঁধে থাকে নীড়। ধূসরতা, কাঁটাজল, তুষারের দিন নয়টি থালায় বেঁটে নিতে। সেই সব অশ্রুত সেতার।

 

বরফের রং

যারা বলে বরফ ধবধবে শাদা তারা বরফের রং জানে না।

বরফ নানা রং হতে পারে।

মাহমুদুল হক অবশ্য জেনেছেন, কালো বরফ। এই সব বরফ রাতে চোখে মাপা যায় না। যদি এমন এক রাতে বরফে চাকায় ভর দিয়ে গড়িয়ে যেতে চাই, তবে চাকার নাক বরফে জমে যায়। চাকায় কাঁটার মালা পরানো থাকে যাদের তারা এ বরফ কেটে চলে যেতে পারে।

আর দীর্ঘদিন যেখানে বরফ পড়ে, সেখানে বরফ পাথর, কয়লা, অথবা কটা রং হয়ে যায়। আমরা জানি। আমরা দেখেছি।

আর তুষারের ফুল যে উড়ে হ্যাপি প্রিন্সের অন্ধ কোটর ঢেকে দেয়, তাকে বলে শিউলি।

আর যে মেঘ গলনাঙ্ক থেকে আগলে পৃথিবীকে কাশ্মীরী শালে ঘিরে থাকে, সে তুষারের নাম ফ্লোরেন্স।

চিরদিন তুষারের পেঁজা তুলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে শিশুরা বল বানায়। আর ছুঁড়ে মারে একে অপরের গালে। ভেঙে, গলে যাবে জেনে। তারপর হাততালি দেয়। গিলিগিল হাসে। সে তুষারের নাম আমরা রেখেছি দুর্গা।

আর যে তুষার ভূমধ্যসাগর, নীল নদ, আমাজোন পেরিয়ে, অঝোর হাওয়ার দেশে নীলকণ্ঠ উদাস পাখির চোখে, গানে গানে, আর সোনাঝুরির পাড়ে দেখি, সে তুষারের কাজ মাটির শিকড় সিঞ্চিত করা।

একবার চীনের প্রাচীর, স্যালসবুর্গে মোৎজার্টের পিয়ানোর টুং টাং পেরিয়ে, নীল বনভূমি ফেলে কোনো এক অন্য মহাকাল আমরা হেমলকদের সবুজ থেকে আনতে গিয়েছিলাম। সেদিন সবুজ ছিল না। শুধুই তুষার। তুষারে সে সর্বদা শখের ছলে নামে। বুট ভেঙে দেয় চরাচর। ওভারকোট, চশমা আর টুপি পরে তাকে দেখায় মেট্রিক্সের পুলিশ। হেমলক ডানা ঝাপটায়। আর তুষার ভেঙে দাগ রাখে। বলে, এই তার প্রথম বরফ। বলে, এঞ্জেলরা এরকম ডানার দাগ রাখে। যাক সে কথা। সে কথা কেন আসে?

পৃথিবী জুড়ে আমরা তুষার দেখেছি। আফ্রিকার জলহস্তী মতো স্থির জলে শুয়ে, আর তালগাছের নিঝুম উদাসে। আর চীনের প্রাচীরের ওপর উড়ে যেতে যেতে।

আমরা বরফ দেখেছি।

বরফ ঝড় ঘূর্ণি মতো ধীরে ধীরে জমা হয় অথবা আসে। শিকড় টেনে তুলে নিয়ে যায়। ভারশূন্য হয় অদেখা গান। কণ্ঠকে করে দেয় শিবপ্রসাদের ছবিতে অর্জুনের লাল ফুল। সেই সব ফোঁটা ফোঁটা বরফফুল আমার এখনো আঁকা হয়নি। টেরোডেকটিল ডায়েরিতে লেখা আছে কিছু। চাইনিজ ইঙ্কে এঁকেছিলাম। শিশুরা দেখলে ভয় পাবে, তাই সেই ডায়েরি আমি একটু একটু করে উড়িয়ে দেব নীল আর লাল কমলের বনে।

এখনো আমাদের ঘুমে আমরা টেরিডাকটিলের স্বপ্ন দেখি। কেন? মানুষের নীলনক্সায় কি বিবর্তন নেই? আমরা তো শরতের অখণ্ড বর্তুল যথা সুনীল দেখেছি। ভরা শেফালির পথ। সে গাছ না-কেঁপে পুষ্পপিতা হয়ে ঝরে আর ঝরে। সেই পথে শুয়ে, কতো দিন। চালের ফেনার মতো বুক ভর্তি ফুল।

আমরা প্যারিস রোড দিয়ে যেতে শিশুগাছের রিনরিন শুনেছি। গির্জার বাতাস যা গানকে হাতের ভাঁজে নামিয়ে আনে, মুদ্রিত করে। হেলিকপ্টারের মতো আমাদের নাচ নিয়ে খেলা করে।

আকাশ আর সমুদ্র তো আমাদের উড়তেই বলে।

এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ওড়ার ব্যাকুলতা তুষারের মত হালকা করে দেয়।

পৃথিবী জুড়ে নানা নীল। আমি নীল নদের মোহনায়, শৈশবে ছিলাম। সেখানে সাতটি প্রস্রবণ। জীবনানন্দর মতো বলতে পারলে বলতাম, সাতটি পাতার প্রস্রবণ। সেখানে বিনুনি ঝুলিয়ে এক কৃষ্ণকালো মেয়ে দেখি, লাল স্কার্ট পরা। মেটে আলুর দাগ, টমেটো রস তার কুরুশের শার্ট-কে রঞ্জিত করে রাখে। চুল ঝাঁকড়া, বাদামী চোখ। প্রকৃতির রং হয়ত এখানে এমন।

আর কোবাল্ট ব্লু মেখে সুগন্ধী পাহাড়ী বনভূমি। সেসব পাহাড়ের মাথায় ফুল ঝুলিয়ে ঘর নির্জন। যারা থাকে তাদের কপালে ধূপছায়া টিপ। চোখে আফ্রিকার আলো। হাতে এক কাপ গরম চায়ের পেয়ালা পিরিচ। মহিষের দুধ। এই সব পাহাড়ের গল্প একদিন বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন। তখনো পাহাড়ী বারন্দা তিনি চোখে দেখেননি। সেখানে জেরেনিয়াম ফুটে ফুটে ওঠে। পাহাড়ে আমরা গিয়েছি, পায়ে পায়ে।

 

ছুটি

শিশুরা বলে ছুটি বলে কিছু নেই। কেননা, ছুটিকে তারা রোদ কাদা জল পাখি বা মেঘের আকার ভেঙে কুড়িয়ে নেয়নি। শিশুরা যখন ফুলদানি রং করে তখন হাসি পায়, যেন বা প্রলাপ। হলুদ দাগের ধারে কালো, কালোর পিঠে লাল ইত্যাদি। আর তারা বানায় অদ্ভুত বালির মান্ডালা। তারা নয়টা রেখায় আকাশ আঁকে। এই সব মান্ডালা সাজিয়ে কী হয় আমরা জানি না।

ছুটির কাছে উল ছিল, কাঁটা, আর ছিল মুক্তোদানার মতো টলটলে হরেক রোদের বোতাম। আর ছিল টিনের বাক্স। আমরা দেখি, কাঁটায় জড়িয়ে আছে উলের তেরো নদী। সেই নদী যারা দুই হাতে বোনে তাদের চোখের রং ধারণ করে। প্রায়শ কোনো সুনীল বালিকার উদাসীনতা বোনে। আর তার নির্লিপ্তির বুকের ভিতর আমরা দেখি, বেগুনি, সবুজ নীল রঙের পাখি হয়ে বিলীন হয় পৃথিবীর শ্রাবণসন্ধ্যা।

ছুটি ভুলে উলকাঠি রেখে যায়। কখনো উলকাঠির স্বপ্নে থাকে না হেমন্তের হিম। হিমপাহাড়ের গায়ে শোনা যায় খণ্ডিত প্রতিধ্বনি।

সকলে একদিন জানাল, ছুটি চলে গেছে। সন্ধ্যার দইওলা বলে, তার কাছে ছুটির ঠিকানা নেই। সেই শুনে শিশুদের হাতের মান্ডালা ভেঙে যায়। বনের বাকল মরমর করে ওঠে কী এক অহেতু গানে।

আমি ভাবি, যত্নে আঁকা বালির মান্ডালা ছুটি সাজায় গোজায়, রং ঢালে, সবটাই মুছে যাবে বলে।

কখনো মনে হয়, মান্ডালার রং-এ যে কলস উপুড় সূর্যাস্ত ছিল, সেই তো ছুটিকে ডেকেছিল।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!