:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি, চিত্রশিল্পী

আবুল হাসান, সে এক লাবণ্যময় পাথরের গান
ব্যবহৃত চিত্রকর্ম: 'শেষ সন্ধ্যা', নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, জলরং।

আবুল হাসান, সে এক লাবণ্যময় পাথরের গান

‘দ্রাক্ষার বদলে আমি দুঃখ দেবো:/ মৃত্যুর বদলে মধু চাও তবে,/ পা ডুবিয়ে বসো এই যুগল তৃষ্ণার চোখে…’

(সহবাস, পৃথক পালঙ্ক, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ১২৮)।

রবিনাথ আর জীবনদাশের সঙ্গে আরো একজন কবি আমার সঙ্গে সকল সময় থাকেন—যিনি দ্রাক্ষার বদলে দুঃখ দিতে ভালোবাসেন, যিনি ফুল ছিঁড়তেই হয়ে যান মানুষ, তিনি সেই লাবণ্যময় পাথর, গোলাপের নিচে নিহত চির কিশোর কবি আর চাঁদের দাঁতের নিচে বিদীর্ণ গান—আবুল হাসান, ২৯ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া ক্ষণজন্মা কবি। তাকে যখনই পড়তে যাই ভয়ানক অসহায় লাগে, সমস্ত খা খা লাগে। এখন তাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অসহায় হয়ে গেলাম—কে জোগাবে বাণী? ওগো বাণীমা, বাণী দাও…।

আবুল হাসানের কবিতা দিয়েই তবে আবার শুরু করি বাণী,

‘গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর আমিও ভবঘুরেদের প্রধান ছিলাম।/ জ্যোৎস্নায় ফেরা জাগুয়ার চাঁদ দাঁতে ফালা ফালা করেছে আমারও প্রেমিক হৃদয়!…/ আমি তবু এর কিছুই তোমাকে দেবো না ভাবুক…/ তুমি সেরে ওঠো তোমার পথেই/ আমাদের পথে কখনও এসো না,/… ভীষণ ব্যর্থ আমাদের পথ।’

(গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর, যে তুমি হরণ করো, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ৯৪)।

গোলাপের নিচে নিহত কবি কিশোরের প্রতি এই নিষেধ আহ্বানের মতোই শোনায়, অন্তত আমার কাছে। এ আসলে আহ্বানই। কেননা যে একবার গোলাপের নিচে নিহত হয়—সে বারংবারই নিহত হতে চায়, প্রিয়তম আততায়ী কুহকের মতো টানে, এইখানে চাঁদ দাঁতাল জাগুয়ার—দন্তাঘাতে ফালি ফালি করে চিরে দেয় কবির হৃদয়। ঝলসানো রুটির পরে চাঁদ এইখানে জাগুয়ার হয়ে গেছে। এই অসহ্যসুন্দরের টানেই পতঙ্গ আগুন ভালোবাসে। প্রকৃত অর্থে ভালোবাসে আলো, প্রতারক আলো তাকে কাছে টেনে নিয়ে নিজে আগুনের রূপ ধারণ করে। স্বাহা চিরদিনই অগ্নিকে ভালোবেসেছে—সে তো দগ্ধ হওয়ার জন্যেই। আবুল হাসান পুড়তে ভালোবাসতেন। সুন্দর এবং নারীর কাছে বারংবার যেতেন নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর হওয়ার জন্যেই। এই কথার সত্যতা নির্মলেন্দু গুণের কাছে লেখা তার একটা চিঠির অংশ-বিশেষে পাই, তিনি লিখলেন,

‘…মহাদেবের (কবি মহাদেব সাহা) কাছে তোমার চিঠি বারবার পড়েছি। বারবার পড়বার মতোই। কবির চিঠির মধ্যে যে দুঃখবোধ এবং নৈঃসঙ্গ্য বোধ থাকে, তার সবরকম চিৎকার হঠাৎ আমাকেও একা- সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। এই একাকীত্বের দরকার ছিলো আমারও। আমি অনেক দিন এরকম সুন্দর ভাবে একা হতে পারি নি। বার্লিন থেকে ফেরার পর আমি এই একাকীত্বই বিভিন্নজনের সান্নিধ্যে খুঁজতে চেষ্টা করেছি। যার জন্য আমি এক রমণীর সাথে যুক্ত হয়েছিলাম, এখন সেই শ্রীমতিও আমাকে আর একাকীত্ব দিতে পারেন না।…’

(মেঘের আকাশ আলোর সূর্য, আবুল হাসানের অপ্রকাশিত কবিতাবলি, পৃষ্ঠা ১০১)।

প্রকৃত অর্থে শূন্যতা ও নৈঃসঙ্গ্যই কবির নিয়তি। না হলে কবিতাকে বিষয়, ধর্ম এবং রাজনীতি খেয়ে ফেলে।

আমাদের সাহিত্যের নির্জনতম কবি জীবনদাশ। আর আবুল হাসান নিঃসঙ্গতম কবি, শূন্যতার ভিতর অভিমানের বাদলে ভিজে যাওয়া চির কোমল পাথর। কবিতায় এতো গান আর এমন শূন্যতা ষাটের দশকের কবিদের আর কারো কবিতায় এতো প্রগাঢ়ভাবে চোখে পড়ে না। বলা যায় ষাটের দশকেই বাঙলা কবিতার শ্রেষ্ঠ এবং পরিণত অংশ রচিত হয়, এবং তা এই বাঙলাদেশেই—যা পঞ্চাশের দশকের কবিদের হাতে শুরু হয়েছিলো।

আমাদের সাহিত্যের নির্জনতম কবি জীবনদাশ। আর আবুল হাসান নিঃসঙ্গতম কবি, শূন্যতার ভিতর অভিমানের বাদলে ভিজে যাওয়া চির কোমল পাথর। কবিতায় এতো গান আর এমন শূন্যতা ষাটের দশকের কবিদের আর কারো কবিতায় এতো প্রগাঢ়ভাবে চোখে পড়ে না। বলা যায় ষাটের দশকেই বাঙলা কবিতার শ্রেষ্ঠ এবং পরিণত অংশ রচিত হয়, এবং তা এই বাঙলাদেশেই—যা পঞ্চাশের দশকের কবিদের হাতে শুরু হয়েছিলো। আর আবুল হাসান সেই ষাটের এমন একজন কবি যার কবিতায় এমন একধরনের নিত্যতা আছে—যা কবিতাকে দশকাবদ্ধ করে না। এই নিত্যতা হয়তো পাঠকের চিরবাঞ্ছিত গীতিময়তা। তিনি লিখলেন,

‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!/ জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!/ দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন!’

(পাখি হয়ে যায় প্রাণ, রাজা যায় রাজা আসে, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ২২)।

কেবল কবির এই স্বীকারোক্তি তার অমল নৈঃসঙ্গ্যকে প্রকাশ করছে তা নয়, তার অধিকাংশ কবিতা ও রচনার ভিতর প্রলম্বিত হয়েছে মাইল মাইল নির্বাসনের মতো একাকীত্ব। প্রলম্বিত হয়েছে বিছিন্নতাবোধ যেনো বা নিজের খেয়ালেই তিনি নিঃসঙ্গ। যেমন তিনি গাছকে বৃক্ষ কিংবা মহিরুহ না বলে তরু বলতে চাইতেন—তিনি নিজেই হয়তো হতে চেয়েছিলেন কোনো নির্জন মাঠের একাকী কোনো গাছ। তরু শব্দের মধ্যে যে কোমলতা সেই কোমলতা ধারণ করেন কবিপাথর এবং নারী। তার নিঃসঙ্গতা স্বেচ্ছানির্বাসনের ব্যাপ্তি নিয়ে তাকে ঢেকে রেখেছিলো। তিনি ছিলেন দারুণ স্বপ্নপীড়িত, দুঃখবিলাসী, চিরভবঘুরে—ডুবে থাকতে চাইতেন নিজের মধ্যে। তিনি অন্যদের থেকে পৃথক এই কারণে যে, তিনি নিজে হতাশা এবং একাকীত্বের স্রোতের তলে ক্ষয়িষ্ণু পাথর হয়েও তার কবিতায় বারংবার লিখে গেছে আশাবাদ আর স্বপ্নের গান।

সে এক নিদারুণ কৈশোরে পুরনো বইয়ের দোকান ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পেয়ে যাই আবুল হাসান রচনাসমগ্র। সেই থেকে সাথে আছে। বারবার ঘুরে ঘুরে পড়ি আশ্চর্য সব কবিতা,

‘সে আমার পাশে শুয়েছিলো, বাঁশির মতন বিবসনা!’

(শেষ মনোহর, পৃথক পালঙ্ক, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ১৩১)।

বাঁশির মতন বিবসন এমন চিত্রকল্প আর কোথাও পৃথিবীতে পাওয়া যায় না, পড়ে চমকে উঠতে হয়, ঈর্ষায় জ্বলে উঠি, চোখের ভিতর আটকে থাকে পাশে শোয়া বাঁশির মতন বিবসন প্রিয়তম নারী, নক্ষত্র ফুরনোর পর যে বাদকের হাতে বেহালার মীড়ের মতো কাঁদে। আবুল হাসান লিখলেন,

‘মা বলতেন বাবাকে, তুমি এই সমস্ত লোক দ্যাখো না?/ ঘুষ খাচ্ছে, জমি কিনছে, শনৈঃ শনৈঃ উপরে উঠছে,/ কতো রকম ফন্দি আটছে কতো রকম সুখে থাকছে,/ তুমি এসব লোক দ্যাখো না?/ বাবা তখন হাতের বোনা চাদর গায়ে বেরিয়ে কোথায়/ কবি গানের আসরে যেতেন মাঝরাত্তিরে/ লোকের ভিড়ে সামান্য লোক, শিশিরগুলি চোখে মাখাতেন।/ এখন তিনি পরাজিত, কেউ দ্যাখে না একলা মানুষ/ চিলেকোঠার মতন তিনি আকাশ দ্যাখেন, বাতাস দ্যাখেন/ জীর্ণ শীর্ণব্যর্থচিবুক বিষণ্ন লাল রক্তে ভাবুক রোদন আসে,/ হঠাৎ বাবা কিসের ত্রাসে দুচোখ ভাসান তিনিই জানেন।’

(রাজা যায় রাজা আসে, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ২৩)।

সেই চিরন্তন ছবি, মধ্যবিত্তের সততার পরিণাম। এই কবিতা পড়ে আমার বাবার সাথে নিয়মিতই কবির বাবাকে মিলিয়ে নিই। এই সততার বিষ রক্তে ধারণ করে বাঙালি তরুণরা কবিতার মদে ডুবে ডুবে ভুলে থাকতে চায় দৈন্য আর ব্যর্থতা।
আধুনিক কবিতার যে গীতিময়তা তা আমরা আবুল হাসানের মধ্যে পাই। বাহুল্যহীন কবিতার মধ্যে যে এতো সহজ সুরের মতো গান—তা গৃহকাতর কবি আবুল হাসানই লিখলেন,
‘আমি আবার ফিরে এলাম, আমাকে নাও/ ভাঁড়ার ঘরের নুন মরিচ আর মশলাপাতা গেরুয়া ছাই/ আমায় তুমি গ্রহণ করো।…/ একজোড়া চোখ নিয়ে এলাম নিজের সঙ্গে/… আমাকে নাও!’

(প্রত্যাবর্তনের সময়, রাজা যায় রাজা আসে, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ১৯)।

যেমন তিনি গাছকে বৃক্ষ কিংবা মহিরুহ না বলে তরু বলতে চাইতেন—তিনি নিজেই হয়তো হতে চেয়েছিলেন কোনো নির্জন মাঠের একাকী কোনো গাছ। তরু শব্দের মধ্যে যে কোমলতা সেই কোমলতা ধারণ করেন কবিপাথর এবং নারী। তার নিঃসঙ্গতা স্বেচ্ছানির্বাসনের ব্যাপ্তি নিয়ে তাকে ঢেকে রেখেছিলো। তিনি ছিলেন দারুণ স্বপ্নপীড়িত, দুঃখবিলাসী, চিরভবঘুরে—ডুবে থাকতে চাইতেন নিজের মধ্যে।

তার আগে আমাদের কবিতায় বুদ্ধদেব বসু এবং অন্যভাষায় লোরকার কবিতায় আমরা এই রকম গীতিময়তা পাই।

আমরা পড়ি,

‘অতটুকু চায়নি বালিকা!/ অত শোভা, অত স্বাধীনতা!/ চেয়েছিল আরো কিছু কম,/আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে/ বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল/ মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!/… চেয়েছিল/ একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!’

(নিঃসঙ্গতা, যে তুমি হরণ করো, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ৯১)।

এই নিঃসঙ্গতা ও প্রতীক্ষাও যেনো তেমন কোনো বালিকার নয় এ কবির নিজেরই। প্রতিটি কবিই বহুসত্তা লালন করেন। এইখানে কবি ধরেছেন বালিকার বেদনা। এ আসলেই সকল বালিকার একান্ত হাহাকার—যা বালিকা মাত্রই ধারণ করে। তারপর আমরা এই কবির প্রতীক্ষার রূপ দেখি ব্যস্ত এক রেস্তোরাঁর টেবিলে,

‘তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে/ আর আমার হাতঘড়ি/ নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে!/… এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে/ শিশিরের মতো নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি কালো অ্যাসট্রেতে!/…রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবে না আজ স্বাতী?’

(প্রতীক্ষার শোকগাথা, রাজা যায় রাজা আসে, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ৫৫)।

প্রতীক্ষার চিরন্তন টেবিলে চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে থাকার দৃশ্যচিত্র যে রূপক প্রকাশ করেছে তার অভিনবত্ব তা আশ্চর্যসুন্দর। তার কবিতায় এমন আরো অনেক দৃশ্যচিত্রের সন্ধান আমরা পাই যেখানে থমকে যেতে হয়। তারপর আছে বিরোধাভাস। কবিরা ‘হবে এবং হবে না’র গোঁলকধাঁধায় ঘুরে ফিরে চিরদিন। আমরা পড়ি,

‘…আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ!/ সচ্চরিত্র ফুল আমি যত বাগানের মোড়ে লিখতে যাই, দেখি/ আমার কলম খুলে পড়ে যায় বিষ পিঁপড়ে, বিষের পুতুল!’

(আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি; অগ্রন্থিত কবিতা, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ১৫৭)।

আবার কোথাও লিখেছেন দুরন্ত স্বপ্ন আর আশাবাদের কথা। এইসব বৈপরীত্য থেকেই আসলে সুন্দর এবং কবিতার জন্ম হয়।
তার কবিতায় কাম, প্রেম, নাগরিক যন্ত্রণা, মর্ষকাম, পলায়নকাম, ধর্ষকামিতা, মৃত্যুচেতনা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নৈঃসঙ্গ্যচেতনা, গৃহকাতরতা আবুল হাসানের কবিতায় বিস্তারিত। কবি লিখলেন,

‘নদীর পারের কিশোরী তার নাভির নীচের নির্জনতা/ লুট করে নিক নয়টি কিশোর রাত্রিবেলা/ আমার কিছু যায় আসে না,…’

(নির্বিকার মানুষ, যে তুমি হরণ করো, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ৯০)।

এইখানে হয়তো ধরা দেয় কবির অভিমান, নির্লিপ্ততা, বিছিন্নতাবোধ অথবা ব্যাঙ্গ। আর তারপর মৃত্যুচেতনার কথা যদি বলি—আমরা পাঠ করি,

‘মাথার ভিতরে তুমি কবরের মতো ঢুকে গেছো/ মাথা তাই উঁচু গর্ভবতী, হায় তোমার আসার অপেক্ষায় মেয়েদের/ মতো আমি/ সেজেগুঁজে থাকি সুগন্ধ লোবান জ্বেলে…’

(তুমি, অগ্রন্থিত কবিতা, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ২৫৭)।

এইখানে ‘তুমি’ কে? তুমি আসলে মৃত্যু। এই প্রতীক্ষা যেনো মৃত্যুকে বরণ করার জন্যে নয়, এই প্রতীক্ষা মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার। তার যেসব কবিতায় মৃত্যুচেতনা দেখি—সেসবে রয়েছে প্রবল জীবনবোধ। সব কবির মধ্যেই মৃত্যুচেতনা থাকে। থাকে বৈপরীত্য, সঙ্গ ও নৈঃসঙ্গ্যের বাসনা।

একজন কবি যতই নির্লিপ্ত, অথবা কলাকৈবল্যবাদী হোক—তিনি প্রকৃত অর্থে সমাজবদ্ধ। ফলত তার মধ্যে, হোক তা অবচেতনে দায় থাকবেই। তার অভিজ্ঞতা ও যাপনের অংশ হিশেবে তার কবিতায় প্রকাশ পাবেই। তবে তিনি তা আরোপ করবেন না—তা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই আসবে। আর আবুল হাসান ছিলেন আপাদমস্তক কবি। একজন কবির জীবন বলতে যা বোঝায় তা এই বাঙলায় আবুল হাসানই যাপন করতে চেয়েছিলেন, ওপার বাঙলায় যেমন বিনয় মজুমদার করে গেছেন।

আবুল হাসান সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তিনি রাজনীতি সচেতন ছিলেন। সেই রাজনীতি—যা গণমানুষের নৈর্ব্যক্তিক সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে। তার কবিতার স্বপ্ন ও আশাবাদে সেই রাজনীতি আমরা পাঠ করি,

‘উদিত দুঃখের দেশ তাই বলে হে কবিতা, দুধভাত তুমি ফিরে এসো,/ সূর্য হোক শিশিরের ভোর, মাতৃস্তন হোক শিশুর শহর!’

(উদিত দুঃখের দেশ, যে তুমি হরণ করো, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ৬৪)।

তার কবিতাই আমাদের মুক্তি যুদ্ধের চেতনা গভীরভাবে দাগ কেটে গেছে। আমরা পড়ি তার কবিতা,

‘… অনেক রক্ত যুদ্ধ গেলো,/ অনেক রক্ত গেলো,/ শিমুল তুলোর মতো/ সোনারূপো ছড়ালো বাতাস।/ ছোটো ভাইটিকে আমি/ কোথাও দেখি না,/ নরোম নোলক পরা বোনটিকে/ আজ আর কোথাও দেখি না!/ কেবল পতাকা দেখি,/ কেল উৎসব দেখি,/ স্বাধীনতা দেখি,/ তবে কি আমার ভাই আজ/ ঐ স্বাধীন পাতাকা?/ তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?’

(উচ্চারণগুলি শোকের, রাজা যায় রাজা আসে, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ৩২)।

একজন কবি যতই নির্লিপ্ত, অথবা কলাকৈবল্যবাদী হোক—তিনি প্রকৃত অর্থে সমাজবদ্ধ। ফলত তার মধ্যে, হোক তা অবচেতনে দায় থাকবেই। তার অভিজ্ঞতা ও যাপনের অংশ হিশেবে তার কবিতায় প্রকাশ পাবেই। তবে তিনি তা আরোপ করবেন না—তা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই আসবে। আর আবুল হাসান ছিলেন আপাদমস্তক কবি। একজন কবির জীবন বলতে যা বোঝায় তা এই বাঙলায় আবুল হাসানই যাপন করতে চেয়েছিলেন, ওপার বাঙলায় যেমন বিনয় মজুমদার করে গেছেন।

মানুষের রক্তের ভিতর যে রক্তক্ষরণ, যে দহন আর যন্ত্রণা তা আবুল হাসানের কবিতার ভিতর আমরা পাই। যেনো সকলের বেদনা একা ধারণ করে এই কবি রচনা করেছেন যাতনার মানচিত্র।

আমাদের সমকালীন কবিতায় আবুল হাসানের প্রভাব ভালোভাবেই ব্যাপ্ত। আমরা এখনো যখন সহজ বর্ণনাধর্মী কবিতা লিখতে যাই—হয়ে যায় যেনো তারই কবিতা। বাক্যে শব্দের ব্যবহার, উপসর্গ, শব্দবন্ধ তৈরি, রূপালঙ্কার, উপমা সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন সৎ এবং দক্ষ। এবং বলা বাহুল্য যে, কবিতায় পরপর গল্প বর্ণনা থাকলেও তার কবিতা বাহুল্যহীন।

আবুল হাসান গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি নাগরিক যন্ত্রণা, ক্লেদ এবং ধরনকে ব্যাঙ্গ করেননি—তিনি এর মধ্যে ডুবে ডুবেই একে আপন করেছেন কবিতায় তুলে এনেছেন। পাশাপাশি তিনি গ্রাম ও গ্রামে ফেলে আসা প্রিয়তম স্বজনদের ভুলে যান নি। তিনি লিখলেন,

‘…মনে পড়ে সরজু দিদির কপালের লক্ষ্মী চাঁদ তারা/ মনে পড়ে তার নরোম যুঁইয়ের গন্ধ মেলার মতো চোখের মাথুর ভাষা আর/ হরি কীর্তনের নদীভূত বোল!’

(পাখি হয়ে যায় প্রাণ, রাজা যায় রাজা আসে, রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা: ২২)।

এইভাবে শহর এবং গ্রামের সাবলিল অনুভূতিগুলিকে কবিতায় বপন করে আমাদের কথাই লিখেছেন তার মন্ময় কবিতাসমগ্রে।

যদিও তার কিছু কবিতায় বৈষ্ণব সহজিয়া উদাসীনতা এবং শেষের দিকের কয়েকটা কবিতায় দার্শনিকতার আভাস দেখা যায়—কিন্তু তারপরও তার অধিকাংশ কবিতা সহজেই পাঠকের হৃদয়লগ্ন হয়। কেননা তিনি আমাদের ভিতরকার সহজ কথাগুলি, অন্তর্গত যাতনাগুলিকে সহজবোধগম্য করে তার কবিতায় বলেছেন। মন্ময় কবিতা হলেও শেষপর্যন্ত তার কবিতায় মানুষের জন্যে দুঃখবোধ ছাড়া আর যা পাওয়া যায় তা গৌন।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!