স্বর্গীয় শৈশব
আব্দুল্লাহ মুন্সি ও লাল তাবিজের অসুখ
কলমিলতা দুলছে। সামনে বড় পুকুর। হাঁসের পাল হইচই করে পানিতে নামছে। হলদি রঙের পাগুলো সাঁতার কাটছে। ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে হাবুডুবু খাচ্ছে কেউ কেউ। গরমের সকাল। দক্ষিণা বাতাসে বসে এই সব দৃশ্য ধরার চেষ্টা করছি। কে ধরছে? আমি। সারা গায়ে হাম উঠেছে আমার। মানে বসন্ত। ছোটবেলায় শরীরের চেয়ে পেটই বেশি মোটা ছিল আমার। কারণটাও মজার। খুব লোভ ছিল বোধ হয়। আসলে আমি ছিলাম খাদ্যরসিক। কিন্তু তখন সেটা খারাপ অর্থ মিন করত। পেটুক ও লোভী বলে পাড়ায় ডাকনাম বেড়ে গেল! কিন্তু আমি তো আর কারো কাছে খেতে চাই না। সবার রান্নাঘরের দোরে গিয়ে বসে থাকি শুধু! তাও খাবার সকালে ও দুপুরে!
রাতে নিমের পাতার ওপর ঘুমিয়েছিলাম। কীভাবে রাত কেটেছে জানি না। কাঁথায় প্রস্রাব করার পর ঘুম ভাঙে। এমনিতে মা রাগী খুব। তার ওপর মায়ের হাত চলে তুমুল। কানে-পিঠে কখন কীভাবে পড়ে, তা পরে আবিষ্কার করতে হয়। অসুস্থ বলে এ যাত্রা রক্ষা হলো। প্যান্ট বদলাতে মা বাইরে নিয়ে এল। হারিকেনটা ডুবুডুবু করে জ্বলছে। রাত প্রায় শেষ। পুবের আকাশ সাদা গাইয়ের মতো ফরসা। গুব গুব করে দূরে কোনো রাতকানা পাখি ডাকছে! মন ভারী হয়ে ওঠে। সবার মনই কি একই সূত্রে বাঁধা? পাখির মনের সাথে মানুষের মনের আসলে সম্পর্ক কী? এই সব আবিষ্কার করতে করতে মা অজু করে ফিরলেন। তাহাজ্জুত পড়ে আমার গায়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন। একটু হালকা লাগছে। মা আমাকে বলছেন, আর একটু ঘুমো।
মসজিদ থেকে আজান ভেসে এল। বাজান ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবিটা নিয়ে চলে গেলেন। আমি আব্বার পথের দিকে তাকিয়ে আছি। ফিরেই তিনি আমাকে নিয়ে আব্দুল্লাহ মুন্সির বাড়ি নিয়ে যাবেন। আব্দুল্লাহ মুন্সি আমাদের এলাকার নামীদামি তদবিরওয়ালা। তার পানি পড়া ও তাবিজ-কবজে ব্যাপক কাজ হয়। ভোরবেলায় আব্বা আমাকে তার শক্ত কাঁধের ওপর উঠালেন।
আব্বা, কদ্দুর পথ যেতে হবে?
এই তো বেশি পথ না বাপ।
আমি তোর সাথে হাঁটি?
না বাবা, তুই হাঁটতে পারবি না এত পথ।
কলি যে বেশি দূর না।
আগে অসুখ সারুক, তারপর একসাথে হাঁটপানে।
কলাপাতা দুলছে। গাঢ় সবুজ তার রং। মায়া লাগে দেখলে। সবুজ রঙে এত মায়া!
আব্বা গাছের পাতা সবুজ ক্যান?
হবেনে হয়তো কোনো কারণে।
তুই এসব জানতে চাস?
হুম জানতি চাই।
তাইলে ইশকুল পড়তে হবে।
ইশকুল তো ভর্তি করালে সেদিন।
এসব শেখনের জন্যই তো পাঠশালা।
তা স্যাররা কেমন করে জানতে পারবে?
অনেক না পড়লি এসব জানা যায় না।
ওওওওওওওওও…
আব্বার সাথে ছোটবেলায় আমার তুই-তোকারি সম্পর্ক ছিল। এ কথা ভেবে এখন আমার লজ্জা করে। যদিও এটার একটা মধুর ব্যাপার থাকে।
রাতে নিমের পাতার ওপর ঘুমিয়েছিলাম। কীভাবে রাত কেটেছে জানি না। কাঁথায় প্রস্রাব করার পর ঘুম ভাঙে। এমনিতে মা রাগী খুব। তার ওপর মায়ের হাত চলে তুমুল। কানে-পিঠে কখন কীভাবে পড়ে, তা পরে আবিষ্কার করতে হয়। অসুস্থ বলে এ যাত্রা রক্ষা হলো। প্যান্ট বদলাতে মা বাইরে নিয়ে এল। হারিকেনটা ডুবুডুবু করে জ্বলছে। রাত প্রায় শেষ। পুবের আকাশ সাদা গাইয়ের মতো ফরসা। গুব গুব করে দূরে কোনো রাতকানা পাখি ডাকছে! মন ভারী হয়ে ওঠে। সবার মনই কি একই সূত্রে বাঁধা?
মাথা ভালো করে থরে বয়। চুল ধর শক্ত করে। কথা কতি কতি পড়ে যাসনে আবার! আমার গায়ের লোককূপ খাড়া হয়। আমার ভয় ভয় লাগে। আসলে আব্বার কাঁধ অনেক উঁচু! এখন বুঝি আসলেই কত উঁচু। কথা বলতে বলতে সকালের সাথে দেখা। পাকা রাস্তার পাশে বড় বিল। বিলের মধ্যে খেজুরের বাগান। কলাবাগান। পেঁপেবাগান। তারপর বড় বড় সাতটা দিঘি। সেই দিঘির পর খাল। সেই খালের পাড়ে উঠেছে লাল সূর্য। কী গনগনে তার শরীর। আব্বা আমাকে তার গলার গামছাটা গায়ে জড়িয়ে নিতে বলল। রোদ লাগানো যাবে না। সূর্য উঠতে উঠতে আমরাও পৌঁছে গেলাম আব্দুল্লাহ মুন্সির বাড়ি।
পাকা রাস্তা থেকে একটা সরু মাটির পথ। দুপাশে পুকুর। বাম পাশে পুরোনো মসজিদ। বুড়ো মানুষের মতো হাঁপাচ্ছে! এখনো কেউ কেউ মসজিদে বসে আছে। কেউ তসবি টিপছে তো টিপছে। হিসাব তার কে রাখে? খোদার ঘরে বসে ইবাদতের হিসাব কেন? দুজন নামাজ পড়ছে। সূর্য ওঠার ২০ মিনিট পরের নামাজ। আমার মা এই সব ইবাদতে পাকা। তাই আমিও জানতাম এগুলো। আব্বা উঁকি মেরে কাকে যেন জিজ্ঞাসা করলেন। মুন্সি আছেন কি না। মুখের ইশারা দিয়ে বললেন, বাড়ি গেছে।
মুন্সির বাড়িতে কিসের যেন ধোঁয়া। কর্পূর আর নারকেলের ছোবড়া। তারপর আব্বা আমারে আব্দুল্লাহ মুন্সির সামনে বসিয়ে দিল। আমি হুজুরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। তার জোড়া ভ্রু। মুখজুড়ে দাড়ির সমাহার। ছোটখাটো মানুষ। কিন্তু কী তার ধার। কী তার ভার! এত লোক, কারো মুখে কোনো কথা নেই। হুজুরের কাছে অনেক ভিড়। মনে হয় সবাই মৃত। কারো কোনো কথা বলা লাগে না। আমি অবাক হলাম। লোকটার চোখ দুটো এত মায়াময় যে চোখ ফেরানো কঠিন। তার মতো এত নেশাময় চোখ আমার নজরে আজও পড়েনি। কারো দিকে তাকালে সে নিশ্চিত ভয় পেত। কি জানি কী ভুল করেছে। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় মুখে তার বাম হাত বুলিয়ে একটা লম্বা ফুঁ দিলেন! ফুঁয়ের সাথে কি একটা ঘ্রাণ যে আমাকে পাগল করে তুলল। পটাপট আমাকে একটা তাবিজ লিখে দিলেন। আব্বাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘লোহার মাদুলিতে পুরে, এঁটেল মাটিতে মুখ বন্ধ করে, ওর গলায় ঝুলিয়ে রাখিস। কমে যাবে ইনশা আল্লাহ।’ এমনভাবে বললেন, যেন আমার কিছুই হয়নি।
মুচকি হেসে, কী নাম তোমার? মজার বিষয়টা শেষেই বলি। তার কাছে গিয়ে কারো রোগের কথা বলা লাগে না। তিনি প্রথমে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। পরে প্রয়োজন হলে হাত দেখেন। কারো তেল, কারো পানি। কারো ছোট ছেলে। কারো অসুস্থ স্বামী। কারো মা তো কারো বৃদ্ধ পিতা। সাদা কাগজে লাল আর সবুজ কালি দিয়ে হুজুর কী সুন্দর করে আরবি লিখতেন। চারকোনা ঘরের ভেতর বন্দী সেই অক্ষর আমাকে কতকাল মাতাল রেখেছে। ছোটবেলার একটা বিষয় আমাকে খুব আনন্দ দিত। কোনো কিছু দেখে ভালো লাগলে আমি সেটাই চাইতাম। যেমন আব্দুল্লাহ মুন্সিকে দেখে স্বপ্ন দেখতাম, আমি বড় হয়ে তাবিজ লিখব!