:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি, চিত্রশিল্পী

আমার এবং তাহাদের আল মাহমুদ

আমার এবং তাহাদের আল মাহমুদ

আল মাহমুদকে আমি মানুষ হিশেবে অপছন্দ করতাম। অপছন্দ করার অনেক কারণ ছিলো। কিন্তু তার কবিতা আমি পড়তে ভালোবাসতাম, এখনো বাসি।
‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেছে শেষে/হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাঙলাদেশে।’ এই পঙক্তি আমার মাথার ভিতর, রক্তের ভিতর ঢুকে গিয়েছিলো সেই শৈশবে। এখনো আছে। হয়তো মায়ের কথা আছে বলেই। তারপর শৈশবে পড়া আল মাহমুদের আরো অনেক ছড়া পদ্য এখনো আমাকে তাড়িত করে।

আল মাহমুদ। এইটা তার পেন-নেম বা লেখক-নাম। কবিতা লিখবেন বলে তিনি এই নাম নিয়েছিলেন। তার আসল নাম মীর আবদুস শুকুর। এই যে কবিতার জন্যে নিজের একটা নাম দেয়া, এইটা আমি প্রথম আল মাহমুদের কাছে জেনেছি। তিনি এই বিষয়ে আমার প্রথম অনুপ্রেরণা। যদিও এর আগে ছদ্মনামধারী অনেকের লেখা আমি পড়েছি, তথাপি নামের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিশেবে কাজ করেছে আল মাহমুদ।

আল মাহমুদের কবিতা সমগ্র বের হয়েছিলো ২২ বছর আগে, ১৯৯৭ সালে। ওই বছরই সেইটা আমি সংগ্রহ করেছিলাম। তখন আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি মাত্র। এর আগে আমার কাছে তার ‘সোনালি কাবিন,’ ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ আর ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ এই ৪টা কবিতা ও পদ্যের বই ছিলো। তো সমগ্রে এক মলাটে পেয়ে গেলাম ১৩ টা বই। জীবনদাশের কবিতা সমগ্রের সঙ্গে আরেকটা সমগ্র যুক্ত হলো সেটা আল মাহমুদের। দুইটা বই দুইটা থান ইটের মতো মাথার বালিশের পাশে পড়ে থাকতো। কতো লাইন পড়তে পড়তে মনস্থ হয়ে গিয়েছিলো! এখন স্মৃতি ক্ষয় হচ্ছে বলে মনে নাই কিছু।

‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’ এই লাইন আমাকে প্রথম ভয়ানকভাবে তাড়িত করে। কবিতার নাম ‘কবিতা এমন’। আমি যখন খুব শৈশবে মক্তবে যেতাম আলিফ বা তা ছা আর আমপারা পড়ার জন্যে তখন আমার পাশে কখনো একটা মেয়ে বসতো, যাকে একদিন চিমটি কেটেছিলাম। ফলত হুজুর আমার পিঠের উপর একটা বেত ভেঙেছিলো। সেই মার খেয়ে আমি মক্তবই ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর কখনো যাইনি। আল মাহমুদের এই লাইন পড়ে আমার সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ে যায়। তার নাম কী ছিলো তাও ভুলে গেছি। হয়তো আয়েশাই ছিলো। তবে একটা মক্তবের মেয়ে চুলখোলা হওয়া, এইটা একটা খোলসছেঁড়ার মতো ব্যাপার। তার মানে কবিতা মানে উইদআউট বাউন্ডারি। সেইটা আমি অনেক পরে বুঝেছি। যখন বুঝেছি তখনো আয়েশা আক্তারের কথাই মনে হয়েছে।

আল মাহমুদের ‘পুরুষ সুন্দর,’ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ এইসব আমি মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। মুগ্ধ হয়ে পড়েছি ‘আগুনের মেয়ে।’ পড়া ছাড়া আল মাহমুদের সঙ্গে আমার সরাসরি কোনো স্মৃতি নাই।

প্রথমবার তাকে দেখি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬/১৭ বছর আগে, ছাত্রশিবিরের নবীনবরণে। হচ্ছিলো বুদ্ধিজীবী চত্বরে। আমি দেড়টার ট্রেন ধরার জন্যে যাচ্ছিলাম স্টেশনের দিকে। আল মাহমুদের নামের ঘোষণা শুনে কাটাপাহাড়ের মুখেই দাঁড়িয়ে গেলাম। ছাত্রশিবিরের ছেলেদের গুণের প্রসংশা দিয়ে তিনি তার ভাষণ শুরু করলেন শুনে আর কাছে গেলাম না। অবশ্য কাছে গেলে মাইর খাওয়ার সম্ভবনাও ছিলো। তো সেদিন তার প্রতি পুনর্বার বিবমিষা তৈরি হলো। সেটা ব্যক্তি আল মাহমুদের প্রতি।

অজস্র নঞ্চর্থক দিক থাকা সত্ত্বেও আল মাহমুদ আমার কাছে কবি। চেতনাধারীরা তার নামের আগে ‘‘কবি’’ শব্দের দুপাশে কোটেশন দিলেও তিনি সন্দেহাতীতভাবে কবি। এমন কি তার নামের আগে কবি না লিখলেও তিনি কবি। জীবনদাশ-উত্তর বাঙলা কবিতাকে এগিয়ে আনার ক্ষেত্রে তার যে শক্তিমত্ত ভূমিকা, শুধু এই একটা কারণেই তার অন্ধকারের অনেকটাই মুছে যায়।

দ্বিতীয়বার আল মাহমুদের মগবাজার ওয়্যারলেস গেটের বাসায় গিয়েছিলাম। দুই হতদরিদ্র ছোটকাগজকর্মী ছোটভাইয়ের সঙ্গে। তারা তাদের কাগজের জন্যে কবিতা চাইবে কবির কাছে। আমি বিবমিষার কারণে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ছেলে দুইটা মন খারাপ করে বের হয়ে এলো। বললো, ‘কবি তো লেখক সম্মানী ছাড়া কবিতা দিবেন না বলেছেন।’ তাদের চেহারা দেখে আমার হাসি পেলো। কিছু বললাম না। ফিরে এলাম।

তৃতীয়বারও মগবাজারের বাসায়, একটা সাহিত্য সভার সভাপতি পদ অলংকরণ করার জন্যে কয়েকজন হতদরিদ্র লেখক ছোটভাইয়ের সঙ্গে গেলাম। আগের মতোই বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর তারা মুখ কালো করে বের হয়ে এলো। বললো, ‘কবি তো হলুদক্যাব ছাড়া সভায় যাবেন না বলেছেন। কিন্তু হাতে হলুদক্যাব ভাড়া করার টাকা নাই।’ তাদের চেহারা দেখে আমার হাসি পেলো। কিছু বললাম না।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘটনা নয়দশ বছর আগের। আল মাহমুদ মানুষ হিশেবে সুবিধাভোগী, খানিকটা অসহায়, কিছুটা অভদ্র, কিছুটা গোঁয়াড়, কিছুটা হিংসুক, কিছুটা গোঁড়া, কিছুটা ধর্মান্ধ, কিছুটা কৃপণ, তার কথা ও কাজের মিল নাই। তিনি তার ‘কবির আত্মবিশ্বাস বইতে একটু পর পর ঘৃণা ছড়িয়েছেন, অনেককে খারিজ করে দিয়েছেন। রফিক আজাদ সম্পর্কে বলেছেন, রফিক আজাদের একটা লাইনও কবিতা নাই ইত্যাদি। তো ইত্যাকার অজস্র নঞ্চর্থক দিক থাকা সত্ত্বেও আল মাহমুদ আমার কাছে কবি। চেতনাধারীরা তার নামের আগে ‘‘কবি’’ শব্দের দুপাশে কোটেশন দিলেও তিনি সন্দেহাতীতভাবে কবি। এমন কি তার নামের আগে কবি না লিখলেও তিনি কবি। জীবনদাশ-উত্তর বাঙলা কবিতাকে এগিয়ে আনার ক্ষেত্রে তার যে শক্তিমত্ত ভূমিকা, শুধু এই একটা কারণেই তার অন্ধকারের অনেকটাই মুছে যায়।

চেতনা কী? চেতনার একটা সার্বজনীন পয়েন্ট থাকে, সেটা চেতনা উদ্গত হওয়ার উৎসে। তারপর চেতনার রকমারি ধরন তৈরি হয়। সেই জায়গা থেকে আমি বাতিল বা গ্রহণ এইসব করতে পারি। আপনার প্রশ্ন হলো শুধুমাত্র ভাষা ও নন্দনের উপর একটি সাহিত্যকর্ম দাঁড় করানো আসলে সম্ভব কিনা। আপনার এই কথার মধ্যে নৈতিকতার গন্ধ আছে। কবিতা-সহ সকল প্রকার শিল্পসাহিত্যকে আমি সকল প্রকার মানবিক, ধর্মীয়, সামাজিক, দার্শনিক ইত্যাদি নৈতিকতার অনেক ওপরে মনে করি। এরা নৈতিকতার ধার ধারে না। কথা ও কাজের সততাই চরিত্রের ব্যাকবোন এই জাতীয় কথা নবিদের জন্য প্রযোজ্য, কবি-শিল্পীদের জন্য নয়। শিল্পসাহিত্যের ইতিহাস পরস্পর বিরোধের ইতিহাস। হিটলার ভালো ছবি আঁকতেন। কিন্তু মানুষ হিশেবে তার বিকৃতি ছিলো। রাজনৈতিক অবস্থানও আমার সঙ্গে মিলে না। কিন্তু তার আঁকার ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগে। আর একজন কবি বা শিল্পী বা সাহিত্যিক রাজনৈতিক বা দার্শনিকভাবে আমার চোখে পতিত মনে হলেই যে তার সব বাদ দেবো তাও আমি ভাবি না। তিনি যদি তার সেই রাজনৈতিক বা দার্শনিক ক্লেদ তার সাহিত্যকর্মে ঢেলে দেন তবে অবশ্যই তা আমি পড়বো না। যেমত ফরহাদ মজহার। এখন তাকে আমি পড়ি না। কিন্তু আগের কবিতা আমি এখনো চোখের সামনে পেলে পড়ি।

আল মাহমুদকে পড়ি। তার কথা ও কাজের মিল ছিলো না। কিন্তু তিনি কবিতায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সৎ ছিলেন। তিনি কবি হিশেবে বৈপরীত্য নিয়েই শেষপর্যন্ত দেদীপ্যমাণ ছিলেন। কিছু কবিতা বাদ দিলে, তিনি কবিতায় তার রাজনৈতিক বা দার্শনিক ক্লেদ কখনোই ঢেলে দেন নাই। যেইগুলিতে এইসব ক্লেদ আছে, বা যেইসব কবিতায় তিনি ধর্মের মহিমা প্রচার করেছেন, সেইসব আমার না পড়লেও চলে। পড়ার মতো তার যথাঅর্থে কবিতার অভাব নাই। তার বেশিরভাগ কবিতাই ক্লাসিক, সেইসব পড়ি।

আল মাহমুদের অনেক বাউন্ডারি ছিলো—ধর্ম, শিক্ষা, দর্শন, বিশ্বাসগত আরো অনেক বিষয়ে। তারপরও তিনি তার সময়ের সব থেকে শক্তিমান কবি। তার এইসব সীমা যদি না থাকতো তবে তিনি কী হতেন তা আমি জানি না। তিনি এমনই একজন কবি যিনি কবিতায় কখনো বৃদ্ধ হন নাই। শেষ বয়সে অনেকেই ফুরিয়ে যান, তারপরও লিখতে থাকেন অভ্যাসের বসে। কিন্তু আল মাহমুদ কখনোই ফুরিয়ে যান নাই।

এইবার পড়ি সোনালি কবিন—‘সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী /যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি/আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনো কালে সঞ্চয় করিনি/আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;/ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি।’

শেষ কথা হলো মূলত আমরা প্রত্যেকেই ‘কাবিনবিহীন হাত’ই চেয়েছিলাম। কিন্তু আল মাহমুদ-সহ আমাদের প্রত্যেকেরই কপালের দোষ। লালত! এই মনুষ্যজীবনের প্রতি।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.