

আমার ভাই সেলিম মোরশেদ
এক বর্ষনসিক্ত বিকেলে এইড পরিচালক আমিনুল ইসলাম বকুলের সাথে যশোর টাউন হলে যাচ্ছি কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। সাথে অতীন অভীক (দিলীপ ঘোষ)ও আছে। নির্দিষ্ট সময়ে মুষলধারার ঝাপসা পথ ধরে গাড়ি এগিয়ে চলে যশোরের পথে।
সেলিমের সংবর্ধনা! সেলিম আমার মামতো ভাই। আমার মায়ের পিঠাপিঠি এক বছরের বড় মেজো মামার ছেলে সেলিম। এই মামার পরিবারের সাথেই আমাদের বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল। মামা চাকরি জীবনে প্রথমে ঝিনাইদহে ছিলেন। তখন এক মেয়ে রত্না, এক ছেলে মাখন দুই শিশুসন্তান নিয়ে তাঁদের সংসার। তারপর বদলি হয়ে চলে যান নড়াইল। সেখানে চিত্রা নদীতে স্নান করতে যেয়ে ভেসে যায় শিশু মাখন। তাকে আর কখনও ফিরে পাওয়া যায়নি। যে শোক মামা-মামির আমৃত্যু বহন করে বেড়াতে হয়েছে। নড়াইল যেয়ে দেখেছি বাসার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা চিত্রার পাড়ে দাঁড়ানো মামির বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস।
নড়াইল থেকে ফিরে যশোরের ষষ্ঠীতলার নিজের জায়গায় মামা অস্থায়ী ঘর তুললেন। চারিপাশে জলাঞ্চল আর সবুজের সমারোহে মেজো মামার সে বাসা। ৬০ দশকের গোড়ার কথা। ওখানেই দেবকান্তি রূপের সেলিম জন্মগ্রহণ করে। ওই বাসাতেই তখন যশোরের আত্মীয়স্বজনের মামার সমবয়সীদের আসর। আমি ছুটিছাটা পেলেই চলে যেতাম সেখানে। মামার থেকে মামির আদর-প্রশ্রয় বেশি পাওয়ার কারণে দিনের পর দিন থাকতাম সেখানে। পঞ্চাশ দশকের বোম্বের কোনো নায়কের মত অত্যন্ত সুদর্শন সৌখিন সুরুচিবান মামা ছিলেন সংগীতের প্রকৃত সমঝদার। বাড়িতে হারমোনিয়াম-তবলার এক সাংস্কৃতিক আবহ সেখানে। নিজেও মাঝে মাঝে সৌখিন নাট্যঅভিনয়ে অংশ নিতেন। অনেক শিল্পী এসে গান করতেন তার বাসায়। আবার মামিও মাটির ঘটের সৌখিন পটুয়া শিল্পী ছিলেন।
সেলিম বড় হতে থাকে সেই পরিবেশে। ততদিন সেলিমের পরের বোন স্বপ্নার জন্ম। এর পর মামারা আবার ঝিনেদা বদলি হয়ে আসেন। ‘৭১-পরবর্তী কয়েক বছর পর্যন্ত থেকে গেছেন। বাড়ি নেন আমাদের বাড়ির কাছাকাছি। ইতিমধ্যে সেলিমের বোন আমার বছর দুয়েকের ছোট রত্নার কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বেশ সুখ্যাতি ছড়িয়ে গেছে। সেলিমকেও দেখতাম তবলা বাজাতে। মামা স্থায়ীভাবে চলে যান ষষ্ঠীতলায়, যেখানে তাঁর বিশাল বাগানের সাথে সামঞ্জস্য রাখা রঙিন মাছের প্রাকৃতিক বিচরণস্থান পুকুর, অজস্র গাছগাছালির এক স্বপ্নের আবাসস্থান গড়ে তোলেন।
তারপর জীবনের বাস্তবতায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি যে যার মতো। আমি পশ্চিম ইউরোপে একটা দীর্ঘ সময় পার করে ফিরে আসি। ততদিনে মেজো মামার ছেলে সেলিম সাহিত্যিক মহলে প্রাণপুরুষ সেলিম মোরশেদ হয়ে গেছে। উত্তরাধিকার সূত্রেই আমার বড় মামা, নুরুল ইসলাম শান্তি মিঞা, আমার মা ঝিনাইদহের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানশিক্ষিকা, নারীআন্দোলনের পথিকৃৎ, ঝিনাইদহ মহিলা পরিষদের আমৃত্যু সভানেত্রীর দায়িত্ব পালনকারী, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ঝিনাইদহ জেলা সংসদের সাবেক সভাপতি মানোয়ারা খাতুন ও আমার নিউইয়র্ক-প্রবাসী সাপ্তাহিক আজকালের প্রধান সম্পাদক বড় ভাই মনজুর আহমদের লেখার ধারায় হয়তো লোকচক্ষুর অন্তরালে সেলিমের উৎসরণ ঘটে, শোনা যায় আমার নানার বাবা একজন সুপণ্ডিত ছিলেন।
ব্যক্তিজীবনে বয়ে বেড়াতে হয়েছে তাকে চরম ঘাত-প্রতিঘাত। স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যধিতে মারা গেলেন। বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্ম সেলিমের অষ্টম শ্রেণির একমাত্র কিশোরসন্তান সঞ্চয় প্রথম তার কাজিনদের সাথে এক রাত আমাদের ঝিনেদায় পুরো বাড়ি মাতোয়ারা করে গেল। কথা দিয়েছিল, আবার ফেরার পথে আমাদের এখানে উঠবে। কিন্তু কখনই সে দিন আর ফিরে আসেনি।
আমাদের দুইজনের বিচরণ-জগৎ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাঝে মাঝে যশোরে মামার বাড়ি গেলে দেখতাম তার বিদুষী আলাপী অভিজাত বংশের সুশ্রী মুখের স্ত্রীকে। ঢাকায় বোনের বাড়িতে কোনো উৎসব থাকলে দেখা হত সেলিমের সাথে।
ব্যক্তিজীবনে বয়ে বেড়াতে হয়েছে তাকে চরম ঘাত-প্রতিঘাত। স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যধিতে মারা গেলেন। বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্ম সেলিমের অষ্টম শ্রেণির একমাত্র কিশোরসন্তান সঞ্চয় প্রথম তার কাজিনদের সাথে এক রাত আমাদের ঝিনেদায় পুরো বাড়ি মাতোয়ারা করে গেল। কথা দিয়েছিল, আবার ফেরার পথে আমাদের এখানে উঠবে। কিন্তু কখনই সে দিন আর ফিরে আসেনি। আমি দ্বিতীয় দফা বিদেশ থেকে এসে এনজিও-তে তখন। যশোরে এক স্থানীয় পত্রিকায় এক আকর্ষণীয় চেহারার ২০ বছরের তরুণের ছবির সাথে মৃত্যুসংবাদ, পাশে সেলিমের নাম দেখি। যশোরে পৌঁছাতেই আমাকে জড়িয়ে মামির কী আহাজারি! আর পাশেই পেলাম রিক্ত শূন্য সন্তানের সৎকারের যাবতীয় দায়িত্ব পালনরত সেলিমকে। সেলিমের পরম আশ্রয় মা মারা গেলেন এর পরে।
তার ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’র ছড়িয়ে পড়া খ্যাতির ঢেউ আত্মীয়স্বজনকে তখনও আলোড়িত করেনি। আপনজন আত্মীয়স্বজনের স্বীকৃতি না-পাওয়া সেলিমের জীবনে তখন এক কঠিন চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দেখতাম আজিজ সুপার মার্কেটে তার সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে আসতে।
জানতাম না সেলিমের কলম তখন প্রথাবাদের সেকেলে ধারণা ভেঙে কী প্রবল গতি নিয়ে ছুটে চলেছে দেশ ও দেশের গণ্ডি পার হয়ে এক নতুন দিগন্তে। আত্মীয়স্বজনেরা যখন জেনেছে তখন সেলিমে পিছনে তাকানোর আর সময় নেই।
একদা মাইল আড়াই দূরের কাজিপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুন্সিবাড়ি থেকে ছড়িয়ে পড়া বিশাল মাতুলালয় গোষ্ঠী আবৃত যশোরে আজ সেলিমের অনুষ্ঠান। টাউন হলে পৌঁছালাম থেমে আসা বৃষ্টির মধ্যে। হল-ভরা উপচে-পড়া দর্শকে তিল ধারণের জায়গা নেই তখন। মূল মঞ্চে অতিথিদের মধ্যে কিছুটা ভাবলেশহীন সেলিমকে দেখলাম। আমাদের যশোরের অনেক আত্মীয়ের মাঝে নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়া অশীতিপর ছোট খালাকেও দেখলাম। পিনপতন নিস্তব্ধতায় একদল স্বেচ্ছাসেবক এত মানুষের সমাগমে শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে চলেছে।
এর কয়েক বছর পরেই সারা শহর কাঁদিয়ে আমার মা মৃত্যুবরণ করলেন। সরকারি গার্লস স্কুল প্রাঙ্গণে মায়ের শবাধার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, অগণিত সাংস্কৃতিক সংগঠন, নাগরিক সমাজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফুলের মালায় ভরে গেল। যশোর থেকে অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছেন, সাথে সেলিম।
স্কুলপ্রাঙ্গণে মাইক্রোফোনে সেদিন ঝিনেদায় অপেক্ষাকৃত অপরিচিত সেলিমকে একের এক স্বকণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করতে দেখলাম। অনেকই তার নাম শুনেছে এতদিন, কিন্তু জানত না প্রয়াত মনোয়ারা খাতুন তার ফুফুমা। কোন অসীম শূন্যতায় উচ্চারিত সে কবিতাগুলো নিঃসঙ্গ কবি সেলিমেরই যে বুকের ক্ষরণ তা আর নতুন করে বলা লাগে না।