:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মোশতাক আহমদ

কবি, গদ্যকার

আমি এক মেঘ-হরকরা, আমি এক বর্ষাদষ্ট কবি
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

নারসিসাসের আরশি – 8

আমি এক মেঘ-হরকরা, আমি এক বর্ষাদষ্ট কবি

“কতদূর এগুলো মানুষ?
কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষনের মাঝে
আজও উবু হয়ে আছি।”

(আল মাহমুদ)

চাটগাঁ থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিয়ে এসে আরেক বর্ষণ মুখরিত দিনে ঢাকা থেকে চাটগাঁ ফিরেছিলাম। হাতে এক ওষুধ কোম্পানির নিয়োগপত্র; কিন্তু কাউকে এই নতুন পরিচয়টা জানাচ্ছি না। পাহাড়ি বৃষ্টির মধ্যে সবুজ হোটেলে গিয়েছি আড্ডার লোভে। কবি এজাজ ইউসুফী, হাবিব আহসান, পুলক পাল ছিলেন। কবি হাফিজ রশীদ খান তার ছাতাটি এক কোনে গুটিয়ে রেখে এলেন। আরেক কবি জিললুর রহমান তাই নিয়ে কবিতা লিখলেন ‘সবুজ ছাতার কবি’। ভেজা ছাতা থেকে যেমন পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পথ খুঁজে নিয়ে কোথাও গিয়ে জমছে, হয়ত মেধাবী কবির ‘প্রতিচ্ছবি ঝুলে ঝুলে / তৈরী করছে/ অসামান্য বাক্য কিংবা যুক্তির জঞ্জাল’।

সেবারে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছিলাম। টিনের চালে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারাপাতের শব্দ, জানালার পাশে ‘গুবাক তরুর সারি’। না লিখে উপায় ছিল না ‘আষাঢ় মাসের পর্যটক’—

ফিরে চলো পদস্খলিত মেঘদূত
বোহেমীয় মন আর মহাস্থবির দেহে
কুবেরের গৃহে বসে খাও ঝলসানো রুটি
পারো তো ভুলে থেকো এই অসম্পন্ন পূর্ণিমা।

আষাঢ় মাসের পর্যটক ফিরে চলো
বাতায়ন পাশে পড়ে থাক গুবাক তরুর সারি,
এখানে তুমি ছিলে একথা সত্যি যতো
এখানে তুমি নাই আরও নিঃসংশয়!

এরও কয়েক বছর পরের কথা। আমি তখন প্রথম বইয়ের প্রায় কুড়ি বছর পরে দ্বিতীয় কবিতার বইটির জন্য যাবতীয় পদ্যরাশি, ডায়েরি, পত্র পত্রিকা, আলগা কাগজ ইত্যাদি ঘেঁটে মোটামুটি একটা সংগ্রহ দাঁড় করালাম, দেখি অধিকাংশ লেখাই বর্ষা আক্রান্ত; অনেক লেখাই নিজের কাছে পছন্দ হল, অনেক লেখাই তুচ্ছ মনে হল। পাণ্ডুলিপির নাম দিলাম ‘মেঘপুরাণে পর্যটন’। পুলক পাল বললেন শুধু ‘মেঘপুরাণ’ই সই। তবে ‘পর্যটন’ বইয়ের প্রচ্ছদে ঠাঁই না পেলেও শব্দটি আমার কবিতায় ঘুরে ফিরে আসে।

২.
বাংলার বর্ষার চিত্রায়ন কেউ করেছেন কবিতায়, কেউ করেছেন গানে, কেউবা উপন্যাসে, চলচ্চিত্রের ফিতায়, মন্তাজে। রবীন্দ্রনাথ এসে গেলে আর কারু কথা বলা হবে না তাই সংক্ষেপে দু একটা কথা সেরে নিই। পদ্মা নদীর মাঝি চলচিত্রে গৌতম ঘোষ অনবদ্যভাবে সেলুলয়েডে তুলে রেখেছেন বাংলার বর্ষা। নাগরিক বর্ষার কবিতা লিখেছেন শহীদ কাদরি, যেখানে সন্ত্রাস ছুঁয়ে যায় সহসা বৃষ্টির মতো। কিংবা বৃষ্টিচিহ্নিত ভালবাসার বুকের কাছে ট্রেন এসে থামল; ঠান্ডা লাগিয়ে কাশছে আবুল হাসানের কাব্যচরিত্র- বলছে, ওহে নুন চায়ে একটু লেবু দিও! এদিকে সুমন রহমানের পোস্টমডার্ন জমানার বর্ষায় কৃষ্ণকলি সম্পর্কে সংশয় জাগে কবির- ‘কখনোই জানবো না, লাগাতার বজ্রপাতের ভেতর সে ঠিকঠাক বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিল কিনা? নাকি তাকে পেড়ে ফেলেছিল কয়েকজন যুবক, বর্ষামন্দ্রিত বনপথে?’ কিংবা ‘বানভাসি মানুষ ঠাঁই নিচ্ছে ইউটিউবে, ফেসবুকে থৈ থৈ করছে পানি। ইমোকটিন ছাড়া আপাতত আর কোনো ত্রাণসামগ্রী নাই।’

বুদ্ধদেব বসু নিয়ম করে প্রতি বর্ষায় একবার মেঘদূত পড়তেন, যেখানে রামগিরি পর্বতে কুবেরের শাপে যক্ষ নির্বাসিত অবস্থায় মেঘকে দূত সাব্যস্ত করে মন্দাক্রান্তা ছন্দে চার লাইনের আকাশমুখী ক্ষুদে বার্তা পাঠাতেন কবি কালিদাস। পৃথিবীর প্রাচীনতম এসএমএস গুলো হয়ে উঠল পূর্বমেঘ আর উত্তরমেঘ। কপি করে রাখলেন কোথায়? –ভূর্জপত্রে? কেমন হরফই বা ছিল সেকালে?

পূর্ব মেঘের ২য় শ্লোকে ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ আছে। কালিদাস আসলে কি লিখেছিলেন?  – “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে” নাকি “আষাঢ়স্য প্রশম দিবসে”? ‘প্রথম’ লিখে থাকলে আষাঢ় মাসের প্রথম দিন যক্ষের বেদনার কথা শুরু করেছেন; আর ‘প্রশম’ লিখে থাকলে সেই বর্ষণ মন্দ্রিত মাসের শেষ দিনের কথা বলেছেন, যে দিন প্রকৃতপক্ষে বর্ষা তার সমূহ পীড়ন নিয়ে বিরহী যক্ষের বুকে শেল বিঁধিয়েছিল! এই দ্বিতীয় শ্লোকের পর ৪র্থ শ্লোকেই আছে অদূরে উদ্যত শ্রাবণ। মল্লিনাথের দোহাই দিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, আষাঢ়ের ৩১ বা ৩২ তারিখে না বলে ১ তারিখেও বলা যায় যে শ্রাবণ মাস আসন্ন; কেননা ‘প্রথম দিবসে’ ইতোমধ্যে যে প্রচুর খ্যাতি লাভ করেছে তাতে আর দিন তারিখ নিয়ে তর্ক করার প্রয়োজন নাই।

রাবীন্দ্রিক বর্ষা – উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করা যাবে না। আমার কাছে তিনি বর্ষাকালের কবি। বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে চুপিসারে এসে দূরে বাহিরে তিমিরে অপেক্ষমান প্রেমিক দেখছে দয়িতার ভবনতলে প্রদীপ জ্বলছে! আহারে! রবীন্দ্রনাথ বর্ষা আক্রান্ত কবি নাকি বর্ষাকালই রবীন্দ্র–আক্রান্ত ঋতু?

গুলাম আলীর বরষণ লাগি, পংকজের শাওন কে সুহানা, জগজিতের গজল শুনে প্রেরণা পেয়েছি তা বর্ষার কবিতায় অনূদিত করতে। আর রিমিঝিমি গিরে শাওন, আর কলকাতার বৃষ্টিভেজা রাস্তায় শুটিং করতে করতে অমিতাভ-রেখার সত্যি সত্যি প্রেম হয়ে যাওয়া! আদিতে বর্ষা বিরহের ঋতুই ছিল সেকালে যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিল না – প্রেমিক প্রেমিকা অপেক্ষা করত কবে শ্রাবণ মাস শেষ হবে! বর্ষায় মানুষের যৌথ অবচেতনের বিরহ রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে ভালবাসায়, অবদমন মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে শত ধারাপাতে!

রাবীন্দ্রিক বর্ষা – উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করা যাবে না। আমার কাছে তিনি বর্ষাকালের কবি। বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে চুপিসারে এসে দূরে বাহিরে তিমিরে অপেক্ষমান প্রেমিক দেখছে দয়িতার ভবনতলে প্রদীপ জ্বলছে! আহারে! রবীন্দ্রনাথ বর্ষা আক্রান্ত কবি নাকি বর্ষাকালই রবীন্দ্র–আক্রান্ত ঋতু? তাঁর গল্পেও বর্ষা আবহ সঙ্গীত রচনা করে গেছে। কোনো কোনো চরিত্রের চালিকাশক্তিই বর্ষা – তখন ‘তাহার মনে এক নতুন তত্ত্বের উদয় হইল’! কালিদাসের মেঘদূত পাঠের স্মৃতিসত্তার বাস্তবতাকে মাথায় রেখে অমিত- লাবণ্যকে রামগড় পর্বতের শিখরে আলাপ করিয়ে দিলেন আধুনিক সিনেমার দৃশ্যের মতো এক দৃশ্যে। রবীন্দ্রনাথের গানের তারিফ করতে শিখি বন্ধু রিজুর গান শুনে (না সজনী না কিংবা এবার সখি সোনার মৃগ) কিংবা সেই এক মধুপুরের গড়ের পিকনিকে এনায়েত ভাইয়ের গলায় ‘আজি বর্ষা রাতের শেষে’ শুনে। বাবলা ভাই শুনিয়েছিলেন সুনীলের বরাতে পাহাড় কেনার শখের কথা। শীতকাল ছিল, কিন্তু সেই বর্ষার গান আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল সারাজীবনের জন্য, মানে অবসেসন হয়ে গেল। তেমনি ইন্দিরা গান্ধী মিলনায়তনে অদিতি মহসিনের গাওয়া ‘আবার এসেছে আষাঢ়’ গানের গায়নই শুধু নয়, গান গাইবার আগে আবহ সৃষ্টির জন্য শিল্পী বর্ষা নিয়ে সান্দ্র স্বরে যে কথা কয়টি বলেছিলেন, তাও মনের উপর প্রভাব ফেলে গিয়েছিল। ফিরে এসে টুকে রাখলাম খেরো খাতায় —

আমাদের অদিতি মহসিন আগাম আষাঢ় নামালেন হলঘরে –
কোথায় পাবো তানসেন, বিপুল তরঙ্গে আষাঢ় আকাশ এলো রাবীন্দ্রিক গানে,
মল্লারে ভর করে শিউরে উঠলো ঘাসের ডগা –
আগাম সোঁদা গন্ধ ছড়ালো মাটিতে;
বহিছে আনন্দধারা।
তানসেনের গানেও নাকি বর্ষা নামত!
কবিতার টুকরোটি শিল্পীকে ইনবক্সে পাঠিয়েও দিলাম; শিল্পী বললেন আমার কল্পনাশক্তি ভাল।

৩.
বর্ষার দিনে আমি এক স্বেচ্ছাবন্দি প্রকৃতির ক্রীতদাস। বৃষ্টি শেষের মিষ্টি হাওয়াটুকুর জন্য বারান্দায় গিয়ে মুক্তির আনন্দ কুড়াই –

‘এমন ঝড়-বাদলের দিনে
বারান্দা থেকে খামোখাই হারিয়ে যাবে দু এক ফালি মোজা
কিংবা রুমাল,
অফিস ফেরতা গলির মুখে ভিজে একাকার –
রিকশাওয়ালা নিজেই হুডের নিচে, অনিচ্ছুক সহিস-
ডুবে-যাওয়া জুতো।

ঝড় শেষ হলে বারান্দা জুড়ে
হাওয়া মহল,
সোঁদা রাস্তায় ঝরা পাতা, চিপসের প্যাকেট –
খিচুড়ি মাংসের ঘ্রাণ।

ঝড়ের দিন চলে গেলে
বিরহের আদি পিতা কালিদাস
বেড়াতে আসেন ঝমঝমিয়ে
আমাদের গ্রহে।’

(ঝড় বাদলে)

আমি এক মেঘ হরকরা। আমি এক বর্ষাদষ্ট কবি!

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!