আমি ও গেওর্গে আব্বাস ১
মঞ্জুভাইটা মরে গেলো। চরম খারাপ কাজ করলো।
মঞ্জুভাই মানে বিদ্যুতের বাগানের একচ্ছত্র অধিপতি কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু। তার অন্য নাম গেওর্গে আব্বাস।
মাঝখানে বেশ কয়েকমাস মঞ্জুভাই ফোন-টোন দেন নাই। আমি ফেসবুকও চালাই না। ভাবলাম বোধহয় কোনো কাজেটাজে ব্যস্ত। গতমাসের শেষে দিকে হঠাৎ আসমা অধরার কাছে খবর পেলাম উনার ক্যান্সার। আমি মিলটন রহমানের কাছে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলনেন, না ক্যান্সার না। আমার সন্দেহ হলো। ওই রাতেই মানে ১৯ অক্টোবর ২০১৮ মঞ্জুভাইকে ইমেইল লিখলাম—
‘মঞ্জুভাই, শুনতেছি আপনি মারা যাচ্ছেন, আপনার কঠিন ক্যান্সার? আপনিও দেখি আত্মবিধ্বংসী কবির তালিকায় চলে গেলেন। যাই হোক, হ্যাপি জার্নি টু ইটারনিটি। মানুষ তো মৃত্যুর পরই কবিতা লিখে, তাই না? আপনাকে মিস করবো।’
পরদিন মঞ্জুভাই আমাকে ‘বিষুববৃক্ষ অথবা শাদামাছি’ নামে তার নতুন বইয়ের প্রচ্ছদ করতে দিলেন। আমি তাকে প্রচ্ছদ করে দিলাম। পরদিন মানে ২১ অক্টোবর আমাকে ফোন দিলেন। বললেন এতদিন হাসপাতালে ছিলেন, চেতন-অবচেতনের মধ্যে ছিলেন। তাই ফোনটোন দিতে পারেন নাই। তবে এর মধ্যে চেতন-অবচেতনের মধ্যে যে ঘোর সেই ঘোরের মধ্যে বসে তিনি একটা কবিতার বই লিখে ফেলেছেন। সেই বইয়ের নামই ‘বিষুববৃক্ষ অথবা শাদামাছি।’ বইটা প্রকাশ করবে অনন্যা। উনার কণ্ঠস্বর খুব দুর্বল মনে হলো। তারপরও সেদিন শেষবারের মতো আমার সঙ্গে প্রায় ১৫ মিনিট কথা বললেন। কতো কথা! শেষে উনাকে বললাম, ‘মঞ্জুভাই এইভাবে চলে গেলে হবে না। আপনাকে মৃত্যুর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বাঁচতে হবে।’
উনার সঙ্গে আমি অনেক রসিকতা করতাম। মজা করতাম। সেইদিন উনার মনখারাপ ছিলো বলে মনে হলো। আমি ভাবলাম উনাকে হাসাতে পারি কিনা দেখি। আমি বললাম, মঞ্জুভাই, ‘যখন আজরাইল এসে আপনার পৈথানে দাঁড়িয়ে সালাম দিবে, অাপনি অবশ্যই তার সালামের উত্তর দিবেন না। তাহলে সে ফিরে যাবে। সম্ভব হলে তাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবেন।’
মঞ্জুভাই হো হো করে হাসলেন দুর্বল শরীর নিয়ে। বললেন, ‘কী বললন, আজরাইলের সালামের উত্তর দিব না?’
বললাম, ‘ হ্যাঁ, মঞ্জুভাই। আমার বাবা সালামের উত্তর দেয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা গিয়েছিলেন।’
তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে এইভাবে তাকে ফাঁকি দিয়ে, স্রষ্টার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বাঁচতে হবে।’
‘হ্যাঁ, মঞ্জুভাই আপনাকে আরো কিছুদিন বাঁচতে হবে। অাপনি অবশ্যই আজরাইলের সালামের উত্তর দিবেন না।’ এটা ছিলো তার সঙ্গে বলা আমার শেষ বাক্য। এরপর পরে আবার ফোন দিবেন বলে কেটে দিলেন। মনে হচ্ছিলো হাঁপাচ্ছিলেন। তারপর আর তার ফোনে কথার বলার অবস্থা মনে হয় তেমন ছিলো না। তবে কয়েকদিন পর ৩১ তারিখ উনার ‘অনবদ্য ইতর’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ করতে বললেন। ওটাও করে দিলাম।
আমি অবশ্য আরো ২/৩ বছর আগেই অনুমান করেছিলাম উনার এমন কিছু হয়েছে, যখন তিনি তার ‘ক্যান্সার আক্রান্ত কবিতা’ নামের একটা পাণ্ডুলিপির প্রচ্ছদ করতে দিলেন। কবিতা পড়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মঞ্জুভাই, আপনারও কি ক্যান্সার হয়ে গেলো নাকি?’ তিনি বললেন, ‘ওইরকম কিছু না। ডাক্তার দেখাচ্ছি।’ বলার সময় কেমন লজ্জা পাচ্ছিলেন মনে হলো।
ব্যবহৃত শিল্পকর্ম : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
আরও পড়ুন-
● আমি ও গেওর্গে আব্বাস ২
● আমি ও গেওর্গে আব্বাস ৩
● ক্যান্সার আক্রান্ত অকবিতা