দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু স্মরণ
আমি ও গেওর্গে আব্বাস ৩
আগে পড়ুন- আমি ও গেওর্গে আব্বাস ২
শেষ রাতে মঞ্জুভাইকে স্বপ্নে দেখলাম। ঠিক দেখলাম বলা যাবে না। স্বপ্নে দেখলাম আমি ঘুম যাচ্ছিলাম, আর তখন একটা ফোন এলো +৪৪৭৮৩৪১৯৫২৩৩ এই নম্বর থেকে। এটা মঞ্জুভাইয়ের দ্বিতীয় ফোন নম্বর। তাকে স্বপ্ন দেখার প্রধান কারণ বলে আমার মনে হয়, এই প্রথম রক্তের সম্পর্কের বাইরের কারো মৃত্যুতে আমার ভয়ানক কষ্ট হয়েছে। মনে হচ্ছে এই ক্ষতি পুরনের ক্ষমতা আর প্রকৃতির নাই। তো ফোন ধরার পর আমাদের মধ্যে কথা হলো নিম্নরূপ :
মঞ্জুভাই : হ্যালো নির্ঝর, আমি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু।
আমি : জি, মঞ্জুভাই বলেন। কিন্তু আপনি আমাকে ফোন কেমনে করতেছেন? আপনি তো মরে গেছেন। আজকে তো আপনার কবরে থাকার কথা।
মঞ্জুভাই : কবর থেকেই ফোন দিলাম, নির্ঝর। কী ঝামেলায় পড়লাম বলেন তো! এরা আমার কফিনটা মনে হয় ছোটো বানিয়েছে। পা মুড়ে শুয়ে আছি, এপাশওপাশও করতে পারছি না। পা টেনে চিৎ হয়ে শুতে ইচ্ছে করছে। পারছি না।
আমি : মঞ্জুভাই, আপনি কফিনটাকে মায়ের গর্ভের মতো মনে করে নেন, তাহলে আর অস্বস্তি লাগবে না। মায়ের গর্ভের ভিতর তো শিশুরা এইভাবে কুণ্ডলী পাকিয়েই থাকে। আর মানুষ মরে গেলে তো শিশুর মতোই হয়ে যায়।
মঞ্জুভাই : হো হো হো, ভালো বলেছেন তো! কিন্তু নির্ঝর সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়…
আমি : আপনি সমস্যা বলার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেন। আপনি কবরের মধ্যে ফোন পাইলেন কই?
‘মঞ্জুভাইতো চাইতো উনার কবর দেশে হবে, আমাকে অনেকবার বলেছে। তার অনেক লেখাপত্রেও আছে। দেশে উনার মা এখনো জীবিত। কিন্তু হইতেছে না। মানুষ আসলে অন্য মানুষের মন বুঝে না, নিজের যন্ত্রণাটাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি। দেখেন, হুমায়ুন আজাদের মনও কেউ বুঝেনি।’
মঞ্জুভাই : কফিন বন্ধ করার সময় দানিয়েল চুরি করে কফিনের ভিতর আমার ফোনটা আর একটা টেকিলার বোতল দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বেটা ভুল করে গোল্ড দিয়ে দিয়েছে, আমি খাই ব্ল্যাঙ্কো। সে যাইহোক সমস্যা হচ্ছে বোতলের মুখটা খুলতে পারছি না ঠিকমতো হাত নড়াচড়া করতে পারছি না বলে।
আমি : মদ খাবেন আবার? অবশ্য এখন খেলেই বা কি! এখন তো আর ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তো এখন আপনার দুঃখ কী?
মঞ্জুভাই : ভিনদেশি মাটির গন্ধ ভালো লাগছে না। ভেবেছিলাম মৃত্যুর পর মায়ের কাছাকাছি যাবো। নিজের মাটিতে যাবো, হলো না। কেউ আমার মন বুঝলো না। মা তো আমার পথ চেয়েই ছিলো। (মঞ্জুভাইয়ের গলা কাঁপছে মনে হলো)।
আমি : আপনি কফিনের ডালাটা ঠেলে ওপরের দিকে একটু আলগা করতে পারেন কিনা দেখেন। এখনো মাটি নরম আছে। তারওপর বৃষ্টি হইছে। আপনি কিলবিল সিনেমায় উমা থারম্যানের কফিন থেকে বের হবার সিন মনে করেন…
এরপর লাইন কেটে গেলো। আমার ঘুমও ভেঙে গেলো। এই স্বপ্নে মাঝখানে আরো কিছু কথা ছিলো মনে করতে পারছি না। এই স্বপ্ন দেখার কারণ হচ্ছে গতকাল মঞ্জুভাইকে কবর দেয়া হয়েছে। আর তাকে কবর দেয়ার বিষয়ে বুননের সম্পাদক কবি খালেদ উদ-দীনের সঙ্গে পরশুদিন কথাও হচ্ছিলো। বলছিলাম, ‘মঞ্জুভাইতো চাইতো উনার কবর দেশে হবে, আমাকে অনেকবার বলেছে। তার অনেক লেখাপত্রেও আছে। দেশে উনার মা এখনো জীবিত। কিন্তু হইতেছে না। মানুষ আসলে অন্য মানুষের মন বুঝে না, নিজের যন্ত্রণাটাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি। দেখেন, হুমায়ুন আজাদের মনও কেউ বুঝেনি।’ এই স্বপ্ন দেখার আরেকটা কারণ হলো, আমরা কয়েকজন মিলে ঠিক করেছি মঞ্জুভাই স্মরণে গলা অবধি টেকিলা খাবো। আরেকটা কারণ হচ্ছে মঞ্জুভাইয়ের একটা কবিতার লাইন, খুব সম্ভবত তার ‘সাপ ও সূর্যমুখী’ বইটাতে আছে। সেই লাইনটা কদিন ধরে মাথার মধ্যে ঘুরছিলো, ‘ আমার শবদেহ কি দীর্ঘ মনে হচ্ছে তোমাদের কফিনের মাপে!
তো সব মিলিয়ে আমার আনকসাস এই স্বপ্ন তৈরি করেছে। আশা রাখছি, আমার এই স্বপ্ন কারো পবিত্র অনুভূতিতে আঘাত করবে না।
আরও পড়ুন-
● আমি ও গেওর্গে আব্বাস ১
● আমি ও গেওর্গে আব্বাস ২
● ক্যান্সার আক্রান্ত অকবিতা