আর্ট করে গণমত এখন তৈরি করা যায় না। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার যুগ শেষ : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
রাজীব দত্ত : আপনার কবিতা লেখা দিয়ে শুরু করতেছি। আপনার কবিতা লেখার শুরু কখন থেকে?
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য : ছোটবেলা থেকে। তবে কতো বছর বয়স থেকে মনে নাই। একটা ব্যাপারই মনে আছে আমি একটা ৪০ লাইনের পদ্য লিখেছিলাম, অন্ত্যমিল দিয়ে। পদ্যের বিষয় মা। প্রথম লাইন এমন—‘মা নাই যার…’। সেটা লিখেছিলাম ৮ বছর বয়সে, গেলো শতাব্দীর ১৯৮৯ সালে। এই ঘটনা মনে থাকার কারণ আব্বা আমার কাছ থেকে ওটা নিয়ে স্থানীয় একটা কাগজ মানে একটা মাসিক সাহিত্য পত্রিকায় ছাপিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। ওই জাতীয় পদ্যকে যদি কবিতার আত্মীয় ধরো, তবে ধরতে পারো ওটাই আমার শুরু।
রাজীব : পদ্য বলছেন এরকম লেখাগুলোকে। সচেতনভাবে প্রথম কবিতা লিখেন কখন? মানে কখন আপনার প্রথম মনে হলো কবিতা লিখলাম?
নির্ঝর : পদ্য বলছি কারণ আমার মতে পদ্য কোনোকিছুকে আড়াল করে না, সব বলে দেয়, সব দৃশ্য দেখিয়ে দেয়, পদ্য একপ্রকার শিশুতোষ চলচ্চিত্র যেমত। আর কবিতার থাকে প্রচ্ছন্নতা, শব্দের অবগুণ্ঠন। সেই অবগুণ্ঠন বানানোর মিস্ত্রিবিদ্যা শৈশবে তৈরি হওয়ার কথা নয়। সচেতনভাবে কবিতা ঠিক লেখা নয়, অনুশীলন করা শুরু করি, ১৯৯৩/৯৪ সালের দিকে। আমাদের এলাকার বইয়ের দোকান আদর্শ লাইব্রেরি থেকে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা কিনে যখন পড়তে থাকি। তখন তার মতো লেখার কথা মাথায় আসে। তখন আমি তার একটা কবিতা পড়ে সেটার মতো করে মানে ওই সিনটেক্স আর মাত্রা ব্যবহার করে নিজেই একটা কবিতা লিখতাম। তবে এর ফাঁকে পদ্য, ছড়া এইসবও প্রচুর লিখেছি।
১৯৯৬/৯৭ সালে অনুকরণ ছাড়াই কবিতা লিখি। বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই ছাপার জন্যে। কলেজে পড়ার সময় থেকে মনে হয় কবিতা হচ্ছে। তবে অনেকের প্রভাব থেকে যাচ্ছে, কিন্তু আমি ধরতে পারছি না।
রাজীব : আচ্ছা। আপনি ফেসবুকে সম্ভবত লিখেছেন, আপনার বাবাও লিখতেন। উনার প্রভাব কি কোনোভাবে আছে আপনার উপর?
নির্ঝর : না, আমার কবিতায় আব্বার কোনো প্রভাব নাই। উনি নীতিকথামূলক পদ্যটাইপ কবিতা লিখতেন, অন্ত্যমিল রেখে। পরে বুঝেছি কলেজ মানে ১৯৯৯/২০০০ সাল পর্যন্ত আমার কবিতায় প্রভাব ছিলো জীবনানন্দ দাশের।
রাজীব : লেখার উপর প্রভাব না, মানে লেখালেখির করার অভ্যাসের পেছনে কোনো প্রভাব কি থাকতে পারে কোনোভাবে? প্রশ্ন বোরিং লাগলে বইলেন কিন্তু…
নির্ঝর : সেটা খানিকটা হতে পারে। কারণ ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের বাড়িতে সবাই লিখতো, একলাইন হলেও, চিঠিপত্র, ডায়েরি, আমার ভাইবোনরা সবাই লিখতো। আমিও লিখতাম ডায়েরি। এই পরিবেশটা হয়ত আব্বার লেখালেখির কারণেই গড়ে উঠেছিলো।
রাজীব : লেখালেখির শুরুর দিকে কী ধরনের বই পড়ার সুযোগ ছিল আপনার? বিশেষ করে কবিতা?
নির্ঝর : আমার আব্বার কালেকশনে পাঁচশো মতো বই ছিলো। ওখানে দাদার আমলেরও কিছু বই ছিলো আর সব ধরনের বই ছিল, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, পুঁথি। মধ্যযুগের কবিতা থেকে শামসুর রাহমানও ছিলো। আমি নিজেও কিনেছি অনেক কবিতার বই। যেমত জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা, আল মাহমুদের কালের কলস, লোক লোকান্তর, সোনালি কাবিন ইত্যাদি বই-সহ আরো অনেক বই আমি সেভেন-এইটে থাকতেই কিনেছি।
রাজীব : কবিতা প্রথম ছাপান কখন?
নির্ঝর : ওই যে বললাম, আমার লেখা প্রথম ছাপা হয় ৮ বছর বয়সে। ১৯৮৯ সালে একটা স্থানীয় কাগজে। এর পর নিয়মিতই লেখা ছাপা হয়েছে নানা জায়গায়।
রাজীব : এই লেখালেখির জন্যই কি আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমে বাঙলায় ভর্তি হন?
নির্ঝর : হ্যাঁ। আমার খানিকটা বাসনা ছিলো বাঙলায় পড়লে মনে হয় কবি হওয়া সহজ। কারণ অনেক বাঙলা পড়া যাবে। পরে বাঙলা সাহিত্যের ৫ বছরের সিলেবাস দেখে মনে হলো এর অধিকাংশই আমার পড়া। আর মনে হলো বাঙলা তো তাহলে এমনিই পড়া যায়।
রাজীব : চারুকলায় পড়তে চাইলেন কেন?
নির্ঝর : মনে হলো বাঙলা তো এমনিই পড়া যায়। কিন্তু আঁকাআঁকির বেসিকটা তো শেখাই লাগে। আর স্টাডি একা একা আমার মতো অস্থির মানুষের পক্ষে সম্ভব না, তাই একটা শৃঙ্খলার মধ্যে ঢুকলাম আর কী। বাঙলায় ক্লাস করতে যেতে আসতে চারুকলার ছেলে মেয়েদের আঁকতে দেখে মনে হলো ভর্তি হয়ে যাই। আর যেই ভাবা, ভর্তি হয়ে গেলাম। তবে আমাদের বাড়ির সকলে আঁকতে পারতো। আমিও আঁকতাম ছোটবেলায়। এক আব্বা ছাড়া আমি, মা, বোন, ভাই সকলকে কিছু না কিছু আঁকতে দেখেছি ফুল, পাখি, লতা, পাতা ইত্যাদি হাতপাখায়, রুমালে, ওয়ালমেটের জন্যে, বালিশের কভারে নানা জায়গায়। আমার মা ক্র্যাফ্টও করতো, নানা হাতের কাজ পারতো। তবে সব থেকে ভালো আঁকতো আম্মা। আম্মাকে দেখেছি আমাদের ভাইবোনদের বিজ্ঞানের প্র্যাকটিকাল খাতা এঁকে দিতে, এরপরে তিনি পাড়ার ছেলেমেয়েদের খাতাও এঁকে দিতেন, কিছু টাকা পয়সা পাওয়া যেতো। তারপর ভালো আঁকতো আমার মেজভাই। তিনি তো আমাদের উপজেলা মিলনায়তনে ২৩ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি বক্সবোর্ডে ফেব্রিক কালার, কালি, এনামেল পেইন্ট এইসব রঙে আঁকা প্রায় শখানেক ছবির একটা প্রদর্শনীও করেছিলেন ১৯৯৩/৯৪ সালের দিকে। অথচ আমাদের কারোরই একাডেমিক কোনো শিক্ষা ছিলো না আঁকার ব্যাপারে। আম্মাও শেখায়নি। দেখে দেখে শেখা হয়ত। তো এইসব ব্যাপারও মাথায় কাজ করতে পারে আমার চারুকলায় পড়ার পেছনে।
কবি হওয়া যায় না আসলে। কিংবা হয়ত কবি হওয়ার ক্ষমতা আমার মধ্যে নাই। তাই আশা ছেড়ে দিয়ে কবিতাকেও খেলা হিশেবে নিয়েছি। যেহেতু এই জিনিশ প্যাশনের মধ্যে ঢুকে গেছে, শিরার ভিতর ক্যান্সারের তো সাঁতার কাটছে তাই এইটাকে মানে কবিতাকে ছাড়তে পারছি না। কিন্তু লেজে ধরে খেলাচ্ছি, আর কবিতালেখক হয়ে আছি।
রাজীব : যেহেতু ছোট থেকেই আঁকতেন, আর্টিস্ট হবার কোন ইচ্ছা আপনার ছোটবেলায় তৈরি হয় নাই?
নির্ঝর : না। ঠিক আর্টিস্ট হবো বা হতে চাই এমন কোনো বাসনা ছিলো না। আমি সব কিছুকে খেলা হিশেবে নিয়েছি ছোটবেলা থেকে। এখনো আমার মধ্যে আর্টিস্ট হওয়ার বাসনা নাই।
রাজীব : কবিও হতে চান নাই?
নির্ঝর : শুরুতে খানিকটা বাসনা অবশ্য ছিলো। পরে এই বিষয়ে বুদ্ধিসুদ্ধি হওয়ার পর মনে হয়েছে কবি হওয়া যায় না আসলে। কিংবা হয়ত কবি হওয়ার ক্ষমতা আমার মধ্যে নাই। তাই আশা ছেড়ে দিয়ে কবিতাকেও খেলা হিশেবে নিয়েছি। যেহেতু এই জিনিশ প্যাশনের মধ্যে ঢুকে গেছে, শিরার ভিতর ক্যান্সারের তো সাঁতার কাটছে তাই এইটাকে মানে কবিতাকে ছাড়তে পারছি না। কিন্তু লেজে ধরে খেলাচ্ছি, আর কবিতালেখক হয়ে আছি। আদত পড়ে গেছে এই যা। কবিতা ছেড়ে দিতে পারলে প্রথম চান্সেই ছেড়ে দিতাম।
রাজীব : এই যে সবকিছুকে ‘খেলা’ হিসেবে নিলেন বললেন, এর কারণ কী? আর ‘কবি হওয়া যায় না আসলে’ এমন মনে হবার কারণ কী?
নির্ঝর : এইটা গভীর দার্শনিক প্রশ্ন হয়ে গেলো। জীবন আসলে অর্থহীন মনে হয় আমার কাছে। কারণ জীবনের গন্তব্য মৃত্যু। মাঝে মঝে মনে হয় এটাকে নানাভাবে অর্থবহ করতে যাওয়াও অর্থহীন। মানুষের অস্তিত্বে যন্ত্রণা মানুষকে ভয়াবহ এবং অন্তহীন শূন্যতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। তাই মানুষ নিজেকে শেষ করতে পারে না বলেই বেঁচে থাকার সময়টাকে নানাভাবে যাপন করে। আমিও করি সামর্থ অনুসারে অর্থ ও অনর্থের মধ্য দিয়ে। এটাই আমার কাছে খেলা। খেলারও একটা ডিসিপ্লিন থাকে। সেই ডিসিপ্লিনই আমি মূলত প্লে করি।
রাজীব : আর ‘কবি হওয়া যায় না আসলে’ এমন মনে হবার কারণ কী?
নির্ঝর : নামের আগে কবি লিখতে পারি না বলেই মনে হয়, কবি হওয়া যায় না। কিংবা নিজেকে কবি বলতে পারি না বলেই মনে হয় কবি হওয়া যায় না।
রাজীব : আপনি নিজে নিজের নামের আগে কবি না লিখলেও, বা নিজেকে নিজে কবি না বললেও, আপনার পাঠকরা যদি আপনাকে কবি মনে করেন, তাহলে তো আপনি কবিই। না?
নির্ঝর : সেইটা আমি মনে করি না কারণ আমার গুরু নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নয়, আমার গুরু জীবনদাশ। তিনি বলেছেন…। কী বলেছেন সেটা তো জানোই।
রাজীব : সবাই কবি না, কেউ কেউ কবি এটা?
নির্ঝর : হ্যাঁ তুমি মনে হয় মজা পাইতেছো! আমি এই ইন্টারভিউটাকেও খেলা হিশেবে নিসি।
রাজীব : আচ্ছা, আপনি আপনাকে জীবনানন্দের ‘কেউ কেউ’ তে রাখতে চাচ্ছেন না কেন?
নির্ঝর : কারণ আমার সীমা আমি জানি। আমার আরো একটা গুণ বলতে পারো আবার দোষও বলতে পারো, আমি অন্যদের সীমাও জানি। তাই এখনকার কবি ও কবিতা ব্যাপারটাই কখনো কখনো আমার কাছে হাস্যকর হয়ে ওঠে।
রাজীব : এই সীমাটা আপনি কীভাবে নির্ধারণ করতেছেন?
নির্ঝর : পূর্বের কবিদের কবিতা পড়ে। আমার যেটা মনে হয় কবিতার যুগ শেষ। পেইন্টিং-এর যুগ যেমন শেষ হয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়।
রাজীব : কবিতার যুগ শেষ কেন? বা পেইন্টিংয়ের যুগ?
নির্ঝর : কারণ পেইন্টিং আর কবিতায় নতুন কোনো এক্সপেরিমেন্ট আর করা যাচ্ছে না, যে যা করতে চাইতেছে দেখা যাচ্ছে ওইসব গত শতাব্দীর ষাটের দশকে হয়ে গেছে পৃথিবীতে। তাই দেখবা পেইন্টিং-এ এখন কোনো নির্দিষ্ট স্টাইল নাই কারো কোথাও। আমি তোমার মতো আঁকি তুমি আমার মতো, সে তোমার মতো আমি তার মতো। সেই লাইন, সেই রং, কম্পোজিশন। আর্টিস্টরা তাও ইনস্টলেশন, পারফর্মেন্স আর্ট, ল্যান্ডস্কেপ আর্ট ইত্যাদিতে নেমে পড়েছে হুড়মুড় করে। কিন্তু কবিরা বড়ই অসহায়। তারা খোদার খাসির মতো মরুসাহারায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু ঝরনার দেখা পাচ্ছে না। একই চক্রে ঘুরে ঘুরে হয়ে যাচ্ছে চির চক্রবর্তী। আর এটাই অনিবার্য। চিরদিন কিছুই থাকে না একই আকারে বা প্রকারে, ফুরিয়ে যায়। ইতিহাস তাই বলে।
রাজীব : আঙ্গিক হয়ত একই, কিন্তু এখন যে সময়ের ভিতর আমরা আছি, তা কি কোনোভাবে যুক্ত হচ্ছে না এখনকার কোন কবির কবিতায়, ছবিতে?
নির্ঝর : তা হচ্ছে। হবে না কেন? সময়কে প্রকট সব ধরনের সবল দুর্বল শিল্পই করতে পারে। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে বয়ে নিতে পারে কটা শিল্পকর্ম। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় ধরো অন্তত ৫০ টা ছবি এঁকেছিলো শিল্পীরা। কিন্তু টিকে গেলো গের্নিকা। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর ধরো হাজার হাজার কবিতা লেখা হয়েছে কিন্তু টিকে গেল ওয়েস্টল্যান্ড-সহ দুয়েকটা কবিতা ঠিক।
রাজীব : যেহেতু নতুন একটা সময়ের ভিতর দিয়ে এই সময়ের শিল্প-সাহিত্য যাচ্ছে, এবং তার ইমপ্যাক্টও পড়তেছে, এই ইমপ্যাক্ট কি নতুন কোনো পরিবর্তন আনতে পারতেছে না? আমি শুধুই বক্তব্যধর্মী শিল্প-সাহিত্য বোঝাচ্ছি না, খুব বিমূর্ত কিছুর উপরও নিশ্চয় এই প্রভাব পড়তেছে, এবং পরিবর্তনও ঘটতেছে, যেহেতু সময়টা নতুন। আপনার কী মনে হয়?
নির্ঝর : সে তো অবশ্যই। তাই শিল্প তার ধরন পাল্টাবে। কবিতার কথাই যদি বলি, ধরো এপিক থেকে কালক্রমে কবিতা যে জায়গায় এসে ফর্ম করেছে। এই ফর্মটা আর বর্তমান কালকে টানতে পারতেছে না। তাই এই ফর্মটা পাল্টে অন্য একটা আকার নিবে। সেটাই অনিবার্য। কারণ বুকে হেঁটে সরীসৃপ চলতে পারে, আর্ট চলতে পারে না। পতনের মতো আর্টের উত্থানও হয়। আপ অ্যান্ড ডাউনের নামই আর্ট।
রাজীব : আচ্ছা। আপনি বললেন একটু আগে আপনার গুরু নীরেন্দ্রনাথ না, জীবনানন্দ। এটা একটু ব্যাখা করেন তো!
নির্ঝর : ‘কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি’ এই কথা বলে জীবনদাশের পরের দশকের কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পণ করেছিলেন সকল বাঙলাভাষীকে কবি বানিয়ে ছেড়ে দিবেন। এই ব্রত সামনে রেখে তিনি রচনা করেছিলেন ‘কবিতার ক্লাস’। আমার ছোটোবেলায় মানে গত শতকের ১৯৯২/৯৩ সালে এই বইটা আর খাতাকলম নিয়ে বাবা প্রায় আমার সঙ্গে বসতেন। অবশ্য এর আগেই আমি রাইম লিখি। বাবা বলতেন কেবল অন্তমিল থাকলেই হবে না, মাত্রাটাও ঠিক থাকা চাই। আমি দুইলাইনের পঙক্তি লিখতাম প্রথমে মাত্রাবৃত্তে। বাবা মাত্রা গুনতেন। মাত্রার অমিল হলেই, তর্জনিটা ভাঁজ করে টং করে আমার মাথায় গুতা মারতেন। মনে হতো হাতুড়ির বাড়ি। তো বাবা আর নীরেন্দ্রনাথ কাকা মিলে মাত্রাটা ঠিকমতো ধরিয়ে দিতে পেরেছিলেন হয়তো। কিন্তু কবি বানাতে পারেননি। জীবনদাশেরই জয় হলো। আমি জানলাম সকলেই ‘কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ জানলাম কেউ আসলে কাউকে কবি বানাতে পারে না। ছন্দ কবিতার ছোট্ট একটা অনুষঙ্গ মাত্র। কবিতা মহাকাশের থেকে বিশাল।
রাজীব : এতে কী ‘কবি’র উপর মহাত্মা বা ওহি-প্রাপক টাইপের মাহাত্ম্য আরোপ করা হয় না?
নির্ঝর : কবির উপর নয়, কবিতার উপর। কবি সাধারণ প্রাণি; সে হাগামুতা, কামকাজ, ঘুম, স্নান, চুরিচামারি সবই করে। কিন্তু প্রথম লাইনটা আতকাই আসে মাথায়, তারপর পরের লাইনগুলি সে বানায় বা আসে বা যা ইচ্ছা তাতে কিছু যায় আসে না। তাহলে তো কবিতাকে মাহাত্ম্য খানিকটা দিতেই হবে। অন্তত কবিতা তো আর বাজারের ফর্দ বা ওষুধের প্রেসক্রিপশন বা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি নয়। যদি বলো যে এইগুলিও কবিতা হতে পারে। আমি তোমার সঙ্গে একমত। তাহলে এইগুলি হয় অবস্থান নাহয় ফর্ম পাল্টাতে হবে, আর সেটা কে করবে? একজন কবি করবে। ওই যে দাদাইস্ট কী যেন নাম ইউরিনালকে উল্টে দিয়ে আর্ট পিস বানিয়ে ছিলেন—ফাউন্টেন, তিনি কিন্তু মালটাকে উল্টে দিয়েছিলেন, মার্সেল দুশাম্প।
তো কবির উপরও খানিকটা মাহাত্ম্য আরোপ করা যায়, কারণ উল্টে দেয়ার কাজ কবি মানে আর্টিস্ট ছাড়া অন্য কেউ করতে পারবে না। কারণ এর জন্যে কেবল কল্পনা থাকলে হয় না, কল্পনা প্রতিভা লাগে। তুমি কল্পনাকে যত বেশি বাস্তবসম্মত করে প্রকট করতে পারবা সেইটা হলো তোমার কল্পনা প্রতিভা।
দেখবা পেইন্টিং-এ এখন কোনো নির্দিষ্ট স্টাইল নাই কারো কোথাও। আমি তোমার মতো আঁকি তুমি আমার মতো, সে তোমার মতো আমি তার মতো। সেই লাইন, সেই রং, কম্পোজিশন। আর্টিস্টরা তাও ইনস্টলেশন, পারফর্মেন্স আর্ট, ল্যান্ডস্কেপ আর্ট ইত্যাদিতে নেমে পড়েছে হুড়মুড় করে। কিন্তু কবিরা বড়ই অসহায়। তারা খোদার খাসির মতো মরুসাহারায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু ঝরনার দেখা পাচ্ছে না। একই চক্রে ঘুরে ঘুরে হয়ে যাচ্ছে চির চক্রবর্তী। আর এটাই অনিবার্য।
রাজীব : আচ্ছা। সকলেই যে কবি না, কেউ কেউ কবি—এই কেউ কেউ টা নির্বাচিত করে কারা, পাঠক নাকি কবিরা?
নির্ঝর : সময় করবে, আক্ষরিক অর্থে মহাকাল। পাঠক, কবি বা সমালোচক কেউই করবে না।
রাজীব : কতটা সময় পরে এটা নির্বাচন শেষ হয়? মানে কত বছর পঠিত হতে হয়?
নির্ঝর : এইটার কোনো নির্দিষ্ট টাইমলিমিট নাই। এইটা পঠিত হওয়ার উপরও ডিপেন্ড ওই অর্থে করে না। এইটা চিরন্তনতার অর্থে করে। ধরো হাজার হাজার বছর আগের কবিতাও অনেকে গবেষণার জন্যে পড়ে। সেটা বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে ওইসব কবিতায় চিরন্তন মানে চিরকালীন উপাদান ছিলো বা আছে কিনা। যা বর্তমানকেও কানেক্ট করতে পারছে।
রাজীব : বর্তমানকে কানেক্ট করতে পারতেছে কি না, এটা কীভাবে বোঝা যাবে? চিরকালীন উপাদানই বা কী?
নির্ঝর : চিরকালীন উপাদান হচ্ছে ধরো আকাশের তারা। জীবনানন্দের কবিতায় যখন আকাশের তারা ফোটে, সেই তারা তোমার আকাশ থেকে এখনো দেখা যায়, চাঁদেরও একই বিষয়। তুমি তার কবিতা যখন পড়ো তোমার বর্তমান বেদনাকে সে ছুঁতে পারে। ছুঁতে পারলে বুঝবে কানেক্ট করতে পারতেছে। পার্থিব-অপার্থিব সবকিছুই চিরকানীল উপাদান হতে পারে যদি ঠিকমতো প্রয়োগ করা যায়। মানে ইন ডিসিপ্লিন।
রাজীব : আচ্ছা। আর্ট আর পলিটিক্সকে আপনি কীভাবে দেখেন?
নির্ঝর : আর্ট-পলিটিক্স, নাকি পলিটিকাল আর্ট, কিংবা আর্ট আর পলিটিক্সের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে এ জাতীয় কিছু জানতে চাইছো। প্রশ্নটা স্পেসিফিক করো।
রাজীব : মানে আর্ট এবং পলিটিক্সের মধ্যে সম্পর্কটা কীভাবে দেখেন আপনি?
নির্ঝর : জাগতিক-পরাজাগতিক সবকিছুই তো পলিটিক্স-এর মধ্যে। সেই হিশেবে আর্টও। তো তাদের সম্পর্ক তো ভালো হওয়ার কথা। এটাই জানতে চাইছো নাকি আর্টে আর্থসামাজিক রাজনৈকিক মানবিক ব্যাপারস্যাপার থাকা না থাকার ব্যাপারে জানতে চাইছো? মানে আমি আর্ট ফর আর্ট সেক, নাকি আর্ট ফর লাইফ সেক এর মধ্যে আছি ইত্যাদি?
রাজীব : আর্ট ফর আর্ট সেক বা লাইফ সেক আমার কাছে কেন জানি একটু মোটা দাগের মনে হয়। মানে এইভাবে দুইভাবে ভাগ করা যায় কিনা? আর হচ্ছে আর্টে পলিটিক্সের ইমপ্লিমেন্ট নিয়ে…
নির্ঝর : বুঝতে পেরেছি। মোটা দাগের তো বটেই। তবে আমি আর্ট ফর আর্ট সেকই মানি। তবে এইটা যারা বানিয়েছে তাদের মতো করে না। বলছি কীভাবে। আমি ছবি আঁকা দিয়ে বলি ব্যাপারটা। একই কথা কবিতার ক্ষেত্রেও হবে। তবে ফিকশনের ক্ষেত্রে কিছু বানানোর ব্যাপার থাকে। তাই ওইসব নিয়ে আলাদা কথা বলা যেতে পারে।
অনেকে মনে করেন শিল্প হচ্ছে প্রতিবাদের হাতিয়ার—যে শিল্পী সে ছবি এঁকে তার প্রতিবাদ জানাবে, জনমত গঠন করবে। এই কথাটা একদা হয়তো সত্য ছিলো, কিন্তু এখন আর সত্য নয়। এখন এইসব ছবি, প্রতিবাদী চিত্র দেখে লোকজন হাসাহাসি করে, আহ্-উহ্-ইস্ করে; তাও মুহূর্তের জন্য। তারপর যে যার মতো একা হয়ে যায়, গণমত কিংবা গণবিদ্রোহ কোনোটাই তৈরি হয় না। কিন্তু তথাকথিত দায়বদ্ধ শিল্পীদের দায় সারা হয়। ভাবখানা এই যে, ‘আমি চিত্রশিল্পী, আমার প্রতিবাদ আমি তুলির আঁচড়ে করে ফেলেছি, আমার তো আর কিছু করার নেই।’ এই জাতীয় ভাবনা নিঃসন্দেহে পলায়নকামীদের। আমি মনে করি প্রতিবাদ আর প্রতিরোধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা উচিত। তাহলে আমরা কী ধরনের শিল্পকর্ম নির্মাণ করবো। আমি মনে করি, শিল্পকর্ম সৃষ্টি হবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য। আর এ সৌন্দর্য বিমানবিক নয়, মানবিক; এ আমাদের স্বপ্ন ও স্মৃতির অভাবনীয় নন্দন। এ নন্দন কল্পনার। শিল্প কারো কাছে, কোনোকিছুর কাছে দায়বদ্ধ নয়। তবে শিল্পী দায়বদ্ধ; যেহেতু সমাজে বসবাস তার, সেহেতু এ সমাজ এবং তাকে ঘিরে থাকা প্রতিবেশ তাকে প্রভাবিত করবেই, তাড়িত করবেই। তাই বলে তাকে তা আর শিল্পে সরাসরি প্রয়োগ করতে হবে না। কিন্তু শিল্পী যখন ছবি আঁকবেন তিনি চান বা না চান তা তার ছবিতে কোনো না কোনোভাবে, হয় রঙে, নয় একটি সংক্ষিপ্ত রেখায় অথবা কোনো বিন্দুতে প্রকাশ পাবেই। তিনি যদি সরাসরি তার প্রয়োগ করেন তবে তাকে আরোপিতই মনে হবে, কোমলতা, ছন্দময়তা, তাল ইত্যাকার সুকুমার গুণাবলি আর থাকবে না। যে শিল্পকর্ম দর্শকের মধ্যে ভীতি আর বিতৃষ্ণার জন্ম দেয়, টেনে ধরে রাখতে পারে না—তা কতোটুকু শিল্পোতীর্ণ তা বিবেচনার বিষয় বৈকি। আমি অবশ্য এই জাতীয় কর্মকে শিল্প বলি না। শিল্পের কাজ চমক দেয়া নয়, চমকে চটুলতা আর ফাঁকি থেকে যায়। আবারও বলি, শিল্পের কাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সৌন্দর্য সৃষ্টি করা। যে-সৌন্দর্য মানুষ তথা দর্শককে টেনে ধরে রাখবে; দর্শকের চোখে পলক পড়বে না। মানুষের অন্তর্গত বেদনা, দুঃখ-পরিতাপকেও চিত্তাকর্ষক ভাবে প্রকাশ করা যায়। দেখলেই বুকের ভিতর হুহু করে উঠবে। দর্শক ভাববে আরে! এইটে আমারই যন্ত্রণার ফুল। দর্শকের কাছে এক একটি শিল্পকর্ম হবে এমন এক জগতের দরজা—যে দরজা দিয়ে তার চোখ-মন প্রকৃত অর্থে দর্শক প্রবেশ করবে আর শুরু হবে অন্তহীন পথ। তাই শিল্পীরা যাপিতজীবন মানে বর্তমানে যে জীবন আমরা যাপন করি, যে পরিবেশে, যে নোংরা নর্দমায় আমরা বসবাস করি, সাঁতরে বেড়াই, যে রক্তের গন্ধে আকাশ কালো হয়ে যায় শকুনের ডানায়—তা আঁকবে না। এইসব কদর্যতা, নৃশংসতা আমরা প্রতিদিন মিডিয়ার কল্যাণে গায়ে মাখি। কিন্তু এইসব তো ডাস্টবিনের বিষয়। এইসব শিল্পীরা আঁকবে কেন?
রাজীব : ঠিক। কিন্তু একজন শিল্পী, যিনি ধরা যাক, ফিলিস্তিনের কোন শিল্পী, যে-কোনো মিডিয়ামের হতে পারেন, হয়তো তার সামনেই তার পরিবারের কেউ ধর্ষিত হয়েছেন, বা খুন; তিনি তার অভিজ্ঞতাকে কীভাবে এড়াবেন?
নির্ঝর : সেই গের্নিকা দিয়েই তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিই। ধরো গের্নিকা শহরে পিকাসোর সামনেই তার পরিবারে কেউ মা বোন কন্যা ধর্ষিত হলো খুন হলো নিষ্ঠুরভাবে। তোমার কি মনে হয় পিকাসো তার পরে গের্নিকা ছবিটা আঁকতে পারতো? পারতো না। সে নিজেও হয় খুন হতো, কিংবা খুনি হতো কিংবা স্রেফ পাগল হয়ে যেতো। পিকাসো যেটা এঁকেছে সেটা অন্যের সাফারিংস, আর তাও অনেক সিম্বলটিম্বল দিয়ে কিউবিক ফর্মে যেহেতু তার স্টাইলই ওটা। আশা রাখছি বুঝাইতে পারছি। নাহয় পাল্টা প্রশ্ন করো।
রাজীব : আমার বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার শিল্পীদের নিয়ে এই ভাবনাটা আসে প্রায়ই; তারা যে বাস্তবতার ভিতর দিয়ে যায়, তার মধ্যে থেকে অনেকেই পাহাড়ি সুন্দর সুন্দর ল্যান্ডস্কেপই আঁকেন; এই ‘সুন্দর’ সৃষ্টি দিয়ে তো তারা তাদের এই বাস্তবতার জন্য যারা দায়ী, তাদের রাজনীতিকেই তো শক্তিশালী করেন, না? আপনার কী মনে হয়?
নির্ঝর : না করে না। কারণ আগেই বলেছি, রাজনীতি এখন আর ওইসব আর্টিস্টিক প্রতিবাদের ধার ধারে না। তাদের উচিত সুন্দর সুন্দর বন-জঙ্গল, নদী-ঝরনা, জুম-কুমারী আঁকার পাশাপাশি নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্যে মাঠে নামা, বিচ্ছিন্ন বা দশটা পাঁচটা দলে ভাগবিভক্ত হয়ে নয়, একসঙ্গে। তো একসঙ্গের আন্দোলনে প্রাণ ক্ষয় হলেও লাভ। এতে কিন্তু গণমত তৈরি হয়। আর্ট করে গণমত এখন তৈরি করা যায় না। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার যুগ শেষ।
রাজীব : গণমত না, বিদ্রোহ বা প্রতিবাদের জন্যও না, কেউ যদি এই বাস্তবতাকে এভয়েড করতে পারতেছেন না বলেই, তার শিল্প এসব এসব নিয়ে আসেন, আপনি কীভাবে দেখবেন?
নির্ঝর : আমি তো শুরুতে বলেছি নিয়ে আসা, আর চলে আসা এক জিনিশ নয়। নিয়ে আসাটা হয় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া থেকে করলে। বিষয়কে সময় দিতে হবে। তারপর ফিল্টার হয়ে যা আসবে তা আর্ট ধরবে। মানে ভিতর থেকে আসতে হবে। এইভাবে যদি আসে তাকে রুখবে কে? সুতরাং স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবই আসতে পারে। কেবল সুন্দরই আঁকতে হবে এইটা আমার ব্যক্তিগত বাসনার প্রকাশ।
রাজীব : আচ্ছা, বুঝেছি। আপনার প্রিয় কবি কারা বাঙলায়, জীবনানন্দ বাদে?
নির্ঝর : আর কেউ নাই। তবে অনেকেরই কিছু কবিতা, কারো দুয়েককটা, কারো কারো অনেকগুলি কবিতা আমার প্রিয়। বেশ ভালো লাগে নিয়মিত পড়া যায়। এদের মধ্যে বিনয় মজুমদার, ভাস্কর চক্রবর্তী, আবুল হাসান, হুমায়ুন আজাদ ইত্যাদির নাম করা যায়।
রাজীব : প্রিয় গদ্যকার?
নির্ঝর : হুমায়ুন আজাদ। তুমি কি গদ্যকার বলতে ফিকশন রাইটারের কথা বলতেছো, নাকি প্রবন্ধ?
রাজীব : সব রকম। আলাদা আলাদা করেও বলতে পারেন।
নির্ঝর : তাহলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, কমলকুমার মজুমদার, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, শহীদুল জহির, মাহমুদুল হক প্রমুখ।
রাজীব : প্রিয় আর্টিস্ট?
নির্ঝর : বাঙলাদেশে?
রাজীব : সব মিলায়ে
নির্ঝর : রামকিঙ্কর বেইজ আর এসএম সুলতান। আর পৃথিবীতে ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ।
রাজীব : তিনজনেরই লাইফ স্টাইলে মিল আছে, এক রকম। প্রিয় ফিল্মমেকার?
নির্ঝর : সারা পৃথিবীতে?
রাজীব : বাংলায় বলতে পারেন প্রথমে…
নির্ঝর : ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ।
রাজীব : তিনজনই তিন মেজাজের। বিশেষ করে ঋত্বিক এবং সত্যজিতকে কাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় হয়? মানে যদি একজনকেই নিতে বলা হয়।
নির্ঝর : সত্যজিৎ রায়।
রাজীব : সত্যজিতের কোন সিনেমাটার কথা আপনি সবার আগে বলবেন?
নির্ঝর : নায়ক।
রাজীব : আর বাইরে?
নির্ঝর : তারকোভস্কি আর ওয়ং কার-ওয়াই।
রাজীব : রবীন্দ্রনাথের কোন সত্তাটা আপনাকে বেশি টানে?
নির্ঝর : কবিসত্তা।
রাজীব : আমি ভাবলাম গান বলবেন।
নির্ঝর : সেটাই তো বলেছি।
রাজীব : অবশ্য এটাও কবিসত্তার এক্সটেনশন।
নির্ঝর : হ্যাঁ। উনি তো কবি হিশেবেই গান লিখেছেন।
রাজীব : হ্যাঁ। রবীন্দ্রনাথকে তো আপনি রবিনাথ বলেন…
নির্ঝর : হ্যাঁ রবিনাথ বলি। রবীন্দ্রনাথকে তো রবিঠাকুরও বলে। তাতে কারো আপত্তি নাই। আমার একটা প্রশ্ন ঠাকুর আর নাথ তো একই জিনিশ! তাহলে আমি কেন বলতে পারবো না? এইটা নিয়ে রবীন্দ্রমৌলবাদীদের আপত্তি-অভিযোগের শেষ নাই। রবিনাথ লিখলে অনেকে প্রশ্নও করে বসেন, রবিনাথ কে? অনেকে আমাকে নোংরাভাষায় গালি পর্যন্ত দিয়েছেন। আমি রবিনাথ বললেই তিনি যেনো আমার সারিতে নেমে যাবেন।
ছোটবেলায় জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যে-কবির সঙ্গে আমার গভীর প্রণয়, সেই কবির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আব্বা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিশাল পাঠক। কথায় কথায় তার থেকে কোট করতেন। ফলত তখন থেকেই তার পাঠ, তার সঙ্গে কঠিন প্রণয়। তার অনেক কবিতা ইশকুল কলেজে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পাঠের জন্যে বলতে গেলে আমাদের ভাইবোনদের সকলের ঠোঁটস্থ ছিলো। বিশেষ করে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। তার গান শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি। সে দীর্ঘ আলাপ। অন্যদিন করা যাবে। মূলকথা তাকে আমি ভালোবাসি, তার গানই আমার সর্বশেষ আশ্রয়, আর পরিত্রাণের জায়গা। ছোটবেলা থেকেই আমার স্বভাব হচ্ছে ভালোবাসার মানুষের নাম দিয়ে দেয়া কিংবা নিজের মতো করে তাকে ডাকা বা সেই নামে চিঠি লেখা। তো স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমি রবিনাথ বলি, লিখি। হয়তো আরো অনেকেই রবিনাথ বলে থাকতে পারেন, আমি জানি না।
রাজীব : তার কোন গানটা এ মুহূর্তে আপনার মনে আসছে?
নির্ঝর : এই মুহূর্তে মাথায় আসছে, আকাশ আমায় ভরলো আলোয়, আকাশ আমি ভরবো গানে…
অবশ্যই এই ছবিগুলি যদি রবিনাথের না হয়ে এমনিই যদুমধু কারো হতো তাহলে তখনই শেষ হয়ে যেত। তার ছবি টিকে আছে মূলত তার নামে। তার ছবিতে যদি কোনো ফর্ম, কালার রেখা কিছুই না থাকতো কেবল কালি মেরে দিতেন তাও চিত্র-সমালোকচক, বোদ্ধারা তার ছবি থেকে ব্ল্যাক হোলের অমিয় রহস্য আবিস্কার করতেন বলে আমার বিশ্বাস।
রাজীব : আচ্ছা। ছবির রবীন্দ্রনাথ কেমন আপনার কাছে?
নির্ঝর : তেমন একটা ভালো না। আমি মনে করি তার ছবি আঁকাই উচিত হয় নাই। আমার মনে হয় তার সবকিছুই হইতে হবে এই কারণে ছবিও এঁকেছিলেন। দেখো শুরুতে কিন্তু ছবি আঁকেন নাই। কারণ আঁকার ব্যাপারটাই তার মধ্যে ছিলো না। মরার বছর দশেক আগে হঠাৎ করে ছবি আঁকতে শুরু করেন। এইটা সন্দেহ জনক। আমার মনে হয়, ভাই, ভাইয়ের ছেলে-মেয়ে সব শিল্পী হয়ে গেলো এই লাইনে তার কোনো নাম থাকবে না তিনি সেটা হতে দিতে চান নাই। ফলত জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের মতো ছবি আঁকা ধরলেন। তাও ছবিতে সব সহজ ডার্কনেস। ছোট-মাঝারি কাগজ বা পেপার-বোর্ডে আঁকা ছবি। বছর দশেকের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ডেলিভারি দিলেন। যাতে আধিক্যের কারণে হলেও টিকে যায়। অবশ্যই এই ছবিগুলি যদি রবিনাথের না হয়ে এমনিই যদুমধু কারো হতো তাহলে তখনই শেষ হয়ে যেত। তার ছবি টিকে আছে মূলত তার নামে। তার ছবিতে যদি কোনো ফর্ম, কালার রেখা কিছুই না থাকতো কেবল কালি মেরে দিতেন তাও চিত্র-সমালোকচক, বোদ্ধারা তার ছবি থেকে ব্ল্যাক হোলের অমিয় রহস্য আবিস্কার করতেন বলে আমার বিশ্বাস।
রাজীব : আমার অবশ্য এমন মনে হয় না।
নির্ঝর : কারণ রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা যায় না।
রাজীব : অনেকেই করেন তো!
নির্ঝর : যারা করেন তারা ঈর্ষাপ্রসূত কারণে বা অজ্ঞতাবশত বা সাম্প্রদায়িক হীনমন্যতার কারণে করেন। সাম্প্রদায়িক কারণটা তাদের শত শত বছরের আইডেনটিটি ক্রাইসিসের ফল।
রাজীব : আমার মনে হয় ছবিতে যে রবীন্দ্রনাথ তা অবদমিত রবীন্দ্রনাথ।
নির্ঝর : সেটাই তো বললাম সেটা তার শেষ জীবনের বাসনার অবদমন। তবে তার অবদমন প্রকট করার আরো পাঁচটা ললিত মাধ্যম তো তার মুঠোর মধ্যেই ছিলো। তাই ছবি বিষয়ে আমার সন্দেহ।
রাজীব : আপনি যে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে ডার্কনেসের কথা বললেন তা আগে ভারতীয় কারো পেইন্টংয়ে অইভাবে আসে নাই। অন্য শিল্পমাধ্যমগুলাতে রবীন্দ্রনাথের নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম ছিল। মানুষের অন্ধকার দিকটা তিনি লেখালেখিতে আনতে চান নাই অইভাবে…
নির্ঝর : শোনো, এইসব কথা গবেষকরা বের করছে। ডার্কনেস ওয়েস্ট-এর মতো ছিলো না ঠিক, কিন্তু ওরিয়েন্টে ডার্কনেসের ট্রিটমেন্টে ওইভাবে করে না, করে ভাবগতভাবে। আর তাছাড়া অন্যদের কথা না বলি, গগনঠাকুরের ছবিতেও অনেক ডার্কনেস আছে। আসল ব্যাপার যেটা বলছিলাম সেটাই, তিনি জানতেন যে জিবরান, বোদলেয়ার, লোরকা, ব্লেইক-সহ অনেক বড় বড় কবি ছবি আঁকতেন। তাই তাকেও আঁকতে হবে। কিছু রেখা রেখে যেতে হবে কালের ধূলিতে। এইমতে তিনি সবকিছু হতে পারার তৃপ্তি নিয়া মরেছেন।
রাজীব : গগনঠাকুরের ডার্কনেস আমার মনে হয়েছে আলো ছায়ার মতো অনেকটা। ওয়াইল্ডনেসটা নাই। ছকমাপা।
নির্ঝর : তোমার কথা ঠিক আছে। রবিনাথের ব্যাপারেও কথাগুলি মানলাম ধরো। একজন শিল্পসাহিত্যের পরিপূর্ণ মানুষ যদি ছবি আঁকতে আসেন, তিনি যদি রবিনাথ হোন তবে তাঁর আঁকার মধ্যে তো অন্য রকম কিছু থাকবেই। আমার এতক্ষণের তর্ক হচ্ছে তিনি আঁকতে এসছিলেন কেন? আমি বলেছি তিনি প্যাশনের জায়গা থেকে আসেন নাই। যেভাবে কবিতায় এসেছিলেন, ফিকশনে বা গানে বা অভিনয়ে। তো তিনি কী আঁকলেন সেটা বড় বিষয় নয়। তবে এটা তো মানবে যে তার কবিতা বা গানের মতো তার ছবি কিন্তু বিশ্বখ্যাত নয়। সেই তুলনায় অবনঠাকুর এগিয়ে।
রাজীব : হ্যাঁ, ছবিতে তিনি বিখ্যাত নন। এর একটা কারণ কিন্তু এমন, এখনো লোকজন যেরকম চোখে দেখে অইরকম না হলে ছবি মনে করে না। তার উপর রবীন্দ্রনাথের ছবি ডিসটর্টেট।
নির্ঝর : ধুর। আমি ওই অর্থে সাধারণ জনপ্রিয়তা বা খ্যাতির কথা বলিনি। আমি বলেছি বিশ্বখ্যাতির কথা। মানে তার ছবিগুলি আউটস্ট্যান্ডিং কিনা সেটা।
রাজীব : বাইরে তো অইভাবে তার ছবির প্রচার কম। আর পশ্চিমের বিচারে খুব নতুন কিছুও না।
নির্ঝর : এই যে পশ্চিমের বিচারে অনেকটা আধা পশ্চিমী স্টাইলে নতুন কিছু আঁকতে না পারলে সেইটা কী দাঁড়ালো তার মতো বৃক্ষের কাছে সেটাই প্রশ্ন। এই কারণেই বলেছি তার এইসব করে সময় নষ্ট করা ঠিক হয় নাই। দেখা গেছে তিনি সারাদিন ছবি আঁকছেন টানা। এই সময়টায় আরো কিছু গান লিখতে পারতেন। নিজের কবিতার স্টাইল নিয়ে চিন্তা করতে পারতেন। কারণ তার সময় তার সমসাময়িক পৃথিবীর কবিরা যা লিখে গেছেন তা এখনকার আধুনিক কবিরাও পারে না।
রাজীব : মহাভারতে আপনার সবচে প্রিয় চরিত্র কোনটা?
নির্ঝর : শ্রী কৃষ্ণ
রাজীব : শ্রী কৃষ্ণ কেন?
নির্ঝর : প্রিয় চরিত্র শ্রী কৃষ্ণ হওয়ার কারণ মাহভারতকে যদি একটা পাপেট-শো ধরি, শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন পাপেটিয়ার। আমার চোখ তার আঙুলের দিকে।
রাজীব : আপনি তো কবিতা লিখেন, গল্পও। কয়েকটা গানও লিখেছেন। ছবিও আঁকেন। বইয়ের প্রচ্ছদও করেন। কোনটা করে বেশি আরাম পান?
নির্ঝর : যখন যেটা করি সেটাতেই এক অর্থে আরাম পাই। তবে ছবি আঁকি আনন্দের জন্যে, কবিতা লিখি পরিত্রাণের জন্যে। আর গল্প লিখি নিজের জীবন ও অভিজ্ঞতাকে প্রকট করার জন্যে।
প্রচ্ছদ করি লোকজন করতে দেয় বলে। এইটাকে আমি পুরোপুরি আর্টের মধ্যে রাখি না। এইটা আর্টের খুবই ক্ষুদ্র একটা শাখা।
তবে সবকিছুকে কবিতার অনুষঙ্গ মনে করি। মানে ছবি আঁকা থেকে শুরু করে ঘর-সংসার, প্রেম-কাম সবকিছুর উপরে কবিতা।
রাজীব : তার মানে কবি পরিচয়টা প্রাইওরিটি পাচ্ছে। কবিতার আঙ্গিক এবং বিষয় কোনটা বেশি টানে আপনাকে?
নির্ঝর : দুটোকেই সমান প্রাধান্য দিই তবে বিষয় টানে বেশি।
রাজীব : বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে আপনার অবজারভেশন কী?
নির্ঝর : কখনকার কবিতা?
রাজীব : আগের কবিতার কথা বলেন প্রথমে, তারপর সমসাময়িক…
নির্ঝর : জীবনদাশের কবিতাকে পৃথিবীর সব থেকে ভালো কবিতা মনে হয়। আর সমসাময়িক কবিতা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নাই। আগেই বলেছি কবিতার যুগ শেষ। এখন আমরা যারা কবিতা নিয়ে এখনো লড়ালড়ি করছি, এইটা করছি কিছু না পারতে, কিংবা পিত্তদোষে। সাহিত্যের সব শাখা ধরো কবিতা ফিকশন সব অবিমিশ্র একটা আঙ্গিকে ফর্ম করবে আশা রাখছি। কারণ কবিতার মতো পুতুপুতুটাইপ, স্টিরিওটিপিকাল ফিকশনের যুগও শেষ। ফিকশনকে তো বোর্হেস আরো ৮০ বছর আগেই ভেঙে দিয়েছেন। তারপরও আমাদের গল্পকাররা ১০০ বছর আগের জিনিশই লিখে যাচ্ছেন।
আর সমসাময়িকদের নিয়ে কোনো আশা নাই। কারণ প্রত্যেতেই একেক আত্মমুগ্ধ বাইসাইকেল।
রাজীব : আপনার নিজের কোন কবিতার বইটা আপনার সবচে পছন্দের?
নির্ঝর : উদ্ভিদ ও বৃন্দাবনী।
রাজীব : গল্পের বই একটা না আপনার?
নির্ঝর : না, তিনটা—ডুবোজ্বর, রাজহাঁস যেভাবে মাছ হয় আর ফুলের অসুখ।
রাজীব : আচ্ছা। উপন্যাস কি লিখবেন?
নির্ঝর : না। কারণ উপন্যাস লিখে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। দুইলাইনের গান দশলাইনে গাওয়া ক্লান্তিকর। লেখক ও পাঠক উভয়ের জন্যেই ক্লান্তিকর।
রাজীব : বাংলা সাহিত্যের আপনার ৫টা প্রিয় উপন্যাসের নাম বলেন তো…
নির্ঝর : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কপালকুণ্ডলা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা, কমলকুমার মজুমদারের গোলাপসুন্দরী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুষ্কোণ, শহীদুল জহিরের সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো।
রাজীব : অন্যভাষার?
নির্ঝর : মিগেল দে সেরভানতেসের দন কিহোতে, ফিওদর দস্তয়ভস্কির অপরাধ ও শাস্তি, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস, এরিক মারিয়া রেমার্কের থ্রি কমরেড্স, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নিঃসঙ্গতার একশ বছর।
কবিতার মতো পুতুপুতুটাইপ, স্টিরিওটিপিকাল ফিকশনের যুগও শেষ। ফিকশনকে তো বোর্হেস আরো ৮০ বছর আগেই ভেঙে দিয়েছেন। তারপরও আমাদের গল্পকাররা ১০০ বছর আগের জিনিশই লিখে যাচ্ছেন।
রাজীব : আবার জন্মানো বাধ্যতামূলক হইলে, এবং অপশন থাকলে আপনি কী হইতে চাইবেন?
নির্ঝর : এক এক সময় একটা হতে মন চায়। কখনো মিউজিশিয়ান, কখনো কুকুর, কখনো দাঁড়কাক, কখনো ফিল্মমেকার। একবার মনে হলো নারী হয়ে জন্মাবো, পৃথিবীতে নারী হিশেবে আমার মা যে যন্ত্রণাময় জীবনযাপন করে গেছে, তা ভোগ করবো। কিন্তু তুমি প্রশ্ন করার পর যে ইচ্ছাটা তৈরি হলো সেটা যদি বাধ্যতামূলক হয় তবে মহাজ্ঞানী শয়তান হয়ে জন্মাতে চাই। মানুষের শিরায়-উপশিরায়, ধমনীতে রক্তের ভিতর সময়ে-অসময়ে পরিমভ্রমণ করতে চাই। কারণ শয়তানের চেয়ে মাল্টি ডাইমেনশনাল ক্রিয়েটিভিটি আর কারো মধ্যে নাই। আর বাধ্যতামূলক নাহলে এই নষ্ট-গলিত দুর্গন্ধময় মানুষরূপী মানব-ইতরের পৃথিবীতে আর কখনোই জন্মাতে চাই না।
রাজীব : আচ্ছা। আপনার ছবি আঁকতে কেমন লাগে?
নির্ঝর : ভালো লাগে। ছবি আঁকি আনন্দের জন্যে। আর আনন্দের এই কারণে যে আমি ছবি আঁকতে বেশি সময় নিই না। সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা। আর পাশাপাশি সারফেসে একই সঙ্গে একাধিক ছবি আঁকি। মজা লাগে।
রাজীব : আর আপনার ছবিতে নারীর উপস্থিতি বেশী। কিংবা যুগল। এটা কেন?
নির্ঝর : আমার কবিতা লেখার প্রেরণা যেমন নারী। তেমনই আমার ছবি আঁকার প্রেরণা কাম। কবিতা আর ছবি আমার কাছে প্রায় কাছাকাছি জিনিশ।
রাজীব : ধরেন, অনেক পয়সাওয়ালা হয়ে গেলেন একদিন, কী করবেন প্রথমে?
নির্ঝর : পয়সাঅলা হওয়ার সম্ভবনা নাই, কারণ চেষ্টা আর প্রবণতা কোনোটাই নাই। তবু যদি লটারিটাইপ কিছু হয় তবে সেই টাকা থেকে একটা অনাথ আশ্রম বানাবো। ওটার নাম হবে ‘আমাদের বাড়ি’। তার সঙ্গে একটা ইশ্কুল থাকবে ওটার নাম হবে, ‘জ্ঞান বিদ্যালয়’। ব্যাপারটা অনেকটা শান্তি নিকেতন টাইপ। ওখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায় আগ্রহী করার জন্যে অনাথদের অনুশীলন করানো হবে, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, অভিনয়, স্টোরি টেলিং, ক্রিয়েটিভ রাইটিং সব, সিনেমা দেখানো হবে। গার্ডেনিং সব থাকবে। মানে জ্ঞান, আর্ট আর সুন্দরের সকল বেসিকটা এইখানে শিশুদের মাথায় বপন করা হবে। এইটা হচ্ছে স্বপ্ন। আর এর বাইরে পৃথিবীর প্রিয় জায়গাগুলি ঘুরে বেড়াবো।
রাজীব : নির্ঝরদা, এইবার প্রচ্ছদ নিয়ে প্রশ্ন করি?
নির্ঝর : করতে থাকো। প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার ভালো লাগে।
রাজীব : আপনার প্রচ্ছদ করা শুরু কবে?
নির্ঝর : আমি যখন সেভেনে পড়ি, সেইটা ১৯৯৩ সাল। আমি আমার কবিতার একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করি। ওইটার নাম দিই জন্মান্ধ রাতের আঁধার। আমি সেই পাণ্ডুলিপির জন্যে কিছুদিন পরপরই প্রচ্ছদ করতাম। তো ওইটারে আসলে প্রচ্ছদ করা বলা যাবে কিনা বুঝতেছি না। কারণ ওই প্রচ্ছদ ছাপা হয় নাই। আমার প্রথম করা প্রচ্ছদ ছাপা হয় ২০০১ সালে। ওইটা আমি করি ২০০০ সালের শেষের দিকে। একটা কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ। ওইটা আমি হাতে এঁকে আর কাগজের কোলাজ করে করেছিলাম।
রাজীব : অই বইয়ের কী নাম ছিল?
নির্ঝর : প্রেম মদিরা হাতে নাও হে সাকি। লেখক কবি জওয়াদুল হক চৌধুরী।
রাজীব : আচ্ছা।
নির্ঝর : প্রকাশক ইবরাহীম মুহম্মদ। ঋতবর্ণ প্রকাশন।
রাজীব : বাংলাদেশের প্রচ্ছদকে মানের বিচারে কোন জায়গায় মনে হয় আপনার?
নির্ঝর : সার্বিক বিচারে বাঙলা বইয়ের প্রচ্ছদ হিশেবে বাঙলাদেশের প্রচ্ছদের মান অতো খারাপ নয়। মাঝারি টাইপ।
রাজীব : বাংলাদেশের প্রচ্ছদের এই যে মাঝারি মান, এর কারণ কী?
নির্ঝর : অনেকগুলি কারণ আছে। কয়েকটা বলছি।
- মেলাকেন্দ্রিক বেশিরভাগ বই প্রকাশ হওয়ার কারণে প্রচ্ছদশিল্পীকে একই সঙ্গে ধরো দিনে ১০/১২টাও করতে হয়, তাই মান ভাগ হয়ে যায়।
- দেশে প্রচ্ছদ শিল্পী হাতে গোনা। ১০/১২ জনের বাইরে দেখি না সব মিলিয়ে। সেই তুলনায় প্রতিবছর বই প্রকাশিত হয় ধরো ৫ হাজার। সবগুলিরই তো মলাট লাগে। তাহলে হিশেব করো।
- লেখক-প্রকাশক-সহ অপেশাদার লোকজনকেও এখন প্রচ্ছদ করতে দেখা যায়।
- কম্পিউটার জেনারেটেড প্রচ্ছদও একটা ফ্যাক্ট। ফটোশপে একটা ফটোকে ভেঙে অনায়াসে প্রচ্ছদ করার কারণে মান পড়ে যায়।
- লেখক-প্রকাশক কিংবা যারা প্রচ্ছদ একজন আর্টিস্টকে দিয়ে করান তারা আর্টিস্টকে ঠিকমতো সম্মানী/পারিশ্রমিক দেন না, অনেক ক্ষেত্রে দিবে বলে ঘোরাতে থাকেন। এইসব বিষয় যখন আর্টিস্টের মাথায় থাকে আর্টিস্ট-এর অন্তর থেকে কাজ বের হয় না।
- আরেকটা ভয়াবহ কারণ মনে পড়লো। অনেক সময় দেখা যায় লেখক-প্রকাশকের জঘন্য আইডিয়া নিয়া বাধ্য হয়ে কিছু প্রচ্ছদ করতে হয়, ফলত সেইসব প্রচ্ছদও অতিশয় জঘন্য হয়।
ইত্যাদি নানা কারণে বাঙলাদেশের প্রচ্ছদ দাঁড়াতে দাঁড়াতে নেতাইয়া পড়তেছে।
রাজীব : আচ্ছা। আপনাদের পছন্দের প্রচ্ছদ বললে দেশের ভিতরে বা বাইরের, কোন বইগুলো আপনার আগে মনে আসে?
নির্ঝর : পুর্ণেন্দু পত্রী, সত্যজিৎ রায়ের করা বইয়ের প্রচ্ছদ। দেশের প্রচ্ছদ তেমন একটা মাথায় আসে না। ও আচ্ছা, কামরুল হাসানের কয়েকটা প্রচ্ছদ বেশ ভালো লাগে। যদিও কয়েকটাই দেখেছি।
রাজীব : এমন কোনো বই অছে যেইটার প্রচ্ছদ আপনি করতে চান? ক্লাসিক কোনো বই?
নির্ঝর : দেশি না বিদেশি?
রাজীব : দেশি বা বিদেশি। দুইটা আলাদা আলাদা করেও বলতে পারেন।
নির্ঝর : জীবনদাশের ধূসর পাণ্ডুলিপির প্রচ্ছদ করতে চাই।
রাজীব : আর?
নির্ঝর : শার্ল বোদলেয়ারের লে ফ্ল্যর দ্যু মাল-এর প্রচ্ছদ করতে চাই।
রাজীব : বিশেষ কী কারণে?
নির্ঝর : প্রিয় কবির প্রিয় বই এই কারণে।
রাজীব : আচ্ছা। সত্যজিতের করা বনলতা সেনের কাভারটা কেমন লাগে আপনার?
নির্ঝর : ভালোই। রেখাগুলি সুন্দর। তবে আমার মনে হয় সত্যজিৎ সেইটা ভাইবা করেন নাই। কারণ বনলতা সেন মূর্ত কেউ নয়। জীবনদাশের কল্পনা, বা অধরা বা গোপন। তাকে ধরতে হতো বিমূর্ত বা আধা বিমূর্ততায়, আলোছায়ার ভিতর। মূলত সত্যজিতের বনলতা আসলে জীবনদাশের কবিতার সঙ্গে যায় না। ওইটা বড়াজোর গল্পের প্রচ্ছদ বানানো যায় কিংবা প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ বানানো যায়, প্রেমের কবিতার আর কি। বনলতা সেন তো ওই অর্থে প্রেমের কবিতার বই নয়।
রাজীব : আপনি কদিন আগে ফেসবুকে পিকাসোর পর আর্ট আর আগায় নাই বা এরপরের সব পিকাসো প্রভাবিত, এরকম একটা পোস্ট দিছিলেন। এটা এখানে একটু ব্যাখ্যা করেন তো!
নির্ঝর : আমি বলেছিলাম পিকাসোর পরে আর্টের লাইনে আর কেউ নতুন কিছু করে দেখাইতে পারে নাই। তার পরে যারাই করতে গেছে সে-ই ঘুরিয়ে পেচিয়ে পিকাসোই হয়ে গেছে। কেবল কন্টুর মুছে দিলেই পিকাসোকে মোছা যায় না। অ্যাবস্ট্রাক্ট তো পিকাসোরই এসেন্স।
এইটা আসলে ব্যাখ্যা করার কিছু নাই। আমি থিম বা আইডিয়া এইসব বলি নাই। আমি ফর্মের কথা বলেছি।
রাজীব : আচ্ছা।
নির্ঝর : তুমি যদি দালি-টালি এই সব ধরো তাদের আইডিয়া, কল্পনার জায়গায় চেঞ্জ আসছে কিছুটা, যদি পরাবাস্তব চিন্তা শুরু থেকেই অনেক আর্টিস্টের কাজে ছিলো। কিন্তু ফর্মের ক্ষেত্রে আমার কাছে ফভিস্টদের যে ডিসটরশন ওইসবের একটু উৎকর্ষিত প্রকাশ বলে মনে হয় আরকি। ফভিস্টদের ফর্ম দেখলে অনেকটা দ্বিমাত্রিক সেটা সুরিয়ালিস্টদের ত্রিমাত্রিক মনে হয়, মানে ত্রিমাত্রিক করে এঁকেছে।
রাজীব : পল ক্লি, মিরো, অঁরি মিশো এরা পিকাসোর সমসাময়িক বা এরকম। কিন্তু অনেক আলাদাই। আর আর্টের লাইন বলতে কি আপনি শুধু পেইন্টিং মিন করতেছেন?
নির্ঝর : রাজীব, এইসব প্রশ্নের ডিটেইল উত্তর আজকে দিব না। কারণ এইটা দীর্ঘ আলাপ। এইখানে পোষাবে না। কোনোদিন সাক্ষাতে আলাপ করবো। আমার মাথার মধ্যে আছে। আর এখন গোছাইয়া বলার মতো মাথার অবস্থা নাই। তবে একটা বিষয় তোমার মাথায় দিই, পেইন্টিং-ই যদি ধরো বিমূর্ত ছবিতে ফর্ম খুঁজতে গেলেও দেখবা যে ওইগুলি কোনো না কোনোভাবে কিউবিক, পল ক্লি বলো, জ্যাকসন পোলক বলো। জাস্ট কন্টুর দিলেই সেইসব হয়ে যাচ্ছে কিউবিস্টদের মতো পেইন্টিং। এই আরকি।
রাজীব : আপনার সঙ্গে ইন্টারভিউ শেষ।
নির্ঝর : আচ্ছা।