:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
আহমেদ নকীব

কবি

‘আলাদা’-‘আলাদা’ বলে চেঁচালে কি আলাদা হবে? ‘আলাদা’ সে-ই, অন্য আরেকজন ‘আলাদা’-কে সনাক্ত করে যে ধারণ করতে পারে: সেলিম মোরশেদ
আলোকচিত্র: সৌরভ রহমান

‘আলাদা’-‘আলাদা’ বলে চেঁচালে কি আলাদা হবে? ‘আলাদা’ সে-ই, অন্য আরেকজন ‘আলাদা’-কে সনাক্ত করে যে ধারণ করতে পারে: সেলিম মোরশেদ

আহমেদ নকীব: এতদিন পর এসে আপনার কি মনে হয় লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট যে অর্থে একটা দার্শনিক ভিত্তির উপর দাঁড়াবার কথা ছিল, অর্থাৎ যেভাবে আমরা এই মুভমেন্টকে কালেকটিভ মুভমেন্ট হিসেবে দাঁড় করাতে চাইলাম, সেই জায়গা কি আমরা পূরণ করতে পেরেছি?

সেলিম মোরশেদ: অনেকটা দাঁড়িয়েছে। যেকোনো দর্শনই চিন্তার গ্রন্থনা। সেই চিন্তার সঙ্গে যখন দৃশ্যমান গতিশীল তৎপরতা কাজ করে তখনই তো তা আন্দোলন। আন্দোলন কিছু কর্মমুখী কাজের প্রেরণা যোগায়। কিছু লোক বা একটা গোষ্ঠী করে ঠিকই, ফলাফল যুক্ত হয় সমষ্টির চেতনার সঙ্গে। যদিও সাহিত্যের আন্দোলন একেবারে হুবহু রাজনৈতিক কর্মসূচি না। এরপরেও এই পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরে একাধিক লিটলম্যাগের নিয়মিত-অনিয়মিত এই যে প্রকাশ, এর প্রারম্ভ থেকে এই অবধি পথ চলা, (তার নিরিখে গ্রন্থ ‘স্বপ্নের সারসেরা’– যা আজ সারা দেশের বিকল্প চিন্তাগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করে।) ‘উলুখড়ে’র ৬০-৬৫টা বই, ‘প্রতিশিল্পে’র কিছু, ‘শিরদাঁড়া’র দুয়েকটা, ‘জংশনে’র কয়েকটা, ‘গাণ্ডীবে’র আরো কয়েকটা আর সব মিলিয়ে সেই গ্রন্থগুলোর যথেষ্ট বিপণন ভূমিকা এখনও না রাখতে পারলেও বর্তমানে এর অবস্থা অনেকটা আশাজনক। দ্রষ্টব্য বছরকয়েক বেশ কিছু বই করল। তারাও কাগজটা চালাচ্ছে। আপনি যে অর্থে কালেক্টিভ মুভমেন্ট বললেন, ছোটকাগজে সারা জীবন লিখেছে, এই উপরের লেখকগুলো, তাদের পাশাপাশি আরো একটি প্রকাশনা হলো ‘উড়কি’। উড়কি এই দুকুলে লেখা গোষ্ঠীগুলোকে নিয়েও যেটা করলো, আমি সেটাকে সমর্থন দিয়েছিলাম। কেন? তাদের খ্যাতি নিয়ে আমার হীনম্মন্যতা নেই, তবে কেন? সাহিত্যে শেষমেশ বিচার্য হয়ে দাঁড়ায় যে যে তার সময়ের প্রেক্ষিত মোকাবেলা করে। তারা করেছিল। যেহেতু আশির সময়ের বাংলাশের সাংস্কৃতিক অবস্থাটা বন্ধ্যা ছিল। মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে যেহেতু তাদের ভূমিকা ছিল, সেই সময়ে সাহিত্যে নিবেদিত ছিল; আমি তাদেরকেও আমার সতীর্থ মনে করি। আপনি এবং মোশারফ খোকন বার বার আমার কাছে লেখকদের নাম এবং তাদের বইয়ের নামগুলো জানতে চেয়েছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের আত্মকেন্দ্রিকতা, লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি তাদের কটুক্তি দাঁতে দাঁত চেপে ভুলে বইগুলোর কথা বলেছিলাম, সেইসমস্ত লেখকদের কথা বলেছিলাম, কারণ তারা ওই সময়ের মোকাবেলা করেছিল। একটাই কারণ, অন্তত একটা প্রকাশনীর ভেতর থেকে আশি থেকে বাংলাদেশের সাহিত্য একত্রে আসতে শুরু করুক। একটা পরপম্পরা হোক। কালেক্টিভ বলতে এই প্রশ্নে আমি এটাকেও মনে করি। সমস্ত লেখকদের সম্মিলিত সচেতন পাঠকগোষ্ঠী আবার যাতে এক হয়।

আহমেদ নকীব: আর আমরা যাকে যৌথতা কিংবা কালেকটিভ বলি, বিশেষ করে লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট করতে গিয়ে যেভাবে যৌথতার কথা চিন্তা করেছি, এই যৌথতা প্রকৃত অর্থে কিসের যৌথতা? এটা কি কিছুসংখ্যক লেখকগোষ্ঠী নিয়ে শুধু পত্রিকা বের করা নাকি এর মধ্যে আরো বড় কোনো দার্শনিক ভিত্তি এসে যুক্ত হয়েছিল? আর যদি যুক্ত হয়েই থাকে, তবে এই মুভমেন্টের মধ্যে যৌথতার এই ভাবনকে আমরা কিভাবে ধারণ করতে পেরেছি বলে আপনি মনে করেন?

সেলিম মোরশেদ: আসলে এটা ছিল সেসময় শিল্পীদের একটা কমন এগ্রিমেন্টের যৌথতা। না, চাপিয়ে দেয়া কিছু না। সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানগত যৌথতা। প্রতিটা শিল্পী আলাদা লিখবে। তার দৃষ্টিভঙ্গিও নিজস্ব মননের। কিন্তু পৃথিবীর যেকোনো শিল্পী অন্য শিল্পীর সঙ্গে কখন একাত্ম হয়? নানা কারণের ভেতরে সবচেয়ে বড় কারণ, নিপীড়িত হয় যখন। কম বৈষম্যের সেই সমাজ শিল্পী কল্পনা করে। এই চাওয়াটাই ছিল। একটা সক্রিয় শিল্পীসমাজ যা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে। নিজেরাই প্ল্যাটফর্ম করবে। পত্রিকাগুলো প্রকাশের ভেতর দিয়ে সেটা গঠনমূলক হওয়া উচিত ছিল যা হয়তো সব ক্ষেত্রে হয়নি।

আহমেদ নকীব: ব্যক্তিগতভাবে আমার বেড়ে ওঠাটা ছিল যুদ্ধোত্তর একটা দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে। তাই সেই সময় দিবস ভিত্তিক, বিশেষ করে ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ই ডিসেম্বর এই বিশেষ দিনগুলোকে কেন্দ্র করে প্রতিটি জেলায়, পাড়ায় মহল্লায় দেয়াল পত্রিকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাহিত্য সংকলন বেরুত। একটা সদ্য-স্বাধীন দেশের মানুষজনের মাঝে যে স্বপ্ন আর উদ্দীপনা জাগ্রত হয়েছিল তারই একটা প্রতিফলন এই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলোতে লক্ষ করা যেত। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এর-ই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন কনসেপ্টটা  দাঁড়িয়েছিল। যদিও এখন অনেকেই এই আন্দোলনকে পশ্চিমবাংলা মার্কা আন্দোলন বলে চালিয়ে দিতে চায়। এক্ষেত্রে আপনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এই আন্দোলনকে সূত্রায়িত করতে চান?

সেলিম মোরশেদ: আপনি যেটা বললেন, অতীব সত্য। আমার পরিচিত অধিকাংশ বন্ধুদের জীবনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমার নিজের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। পারিবারিক সংস্কৃতির কথাটা বাদ দিচ্ছি, পনেরো বছর বয়সে যশোর শহরে আমরা যারা কবি-বন্ধু ছিলাম, দারা মাহমুদ, কবীর হোসেন, তাপস আবদুর রব, রেজাউদ্দিন স্টালিন, এই সব বন্ধুবান্ধবের লেখা নিয়ে নিউজপ্রিন্ট পত্রিকার সাইজে একটা কাগজ বের করি দু তিনটি সংখ্যা। নাম ‘শতকণ্ঠ’। এটা একুশে ফেব্রুয়ারি বা স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বের করতাম। কিন্তু লিটলম্যাগ বলে কিছু আছে কিনা তখনও জানি না। আপনার এই স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে আমার কেন, এটা অনেকেরই মিলবে। ‘প্রতিশিল্প’ প্রকাশিত হবার আগে, কবি মারুফুল আলম ‘অর্ণব’ বলে একটা কাগজ করতেন। সেটা যথেষ্ট ম্যাচিউড এবং পাড়াগত ভিত্তি ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের, সে সময়কার তরুণদের নিয়ে হতো। মারুফুল আলমের পরিবারে একজন চিত্রশিল্পী ছাড়া অন্তত চারজনই লেখক। ‘লোক’ সম্পাদক অনিকেত শামিম জামালপুরে ইন্টারমিডিয়েটের সেকেন্ড ইয়ারে থাকার সময় ট্যাবলয়েডের একটু ছোট ফর্মের ‘উত্তরণ’ বলে একটা কাগজ বের করত। উদ্দেশ্য ছিলো সাহিত্য করবে। একটা ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টের দিকে এইসবের ভেতর দিয়ে আমাদের শৈশবের একটা ছাপ আসে।

সাতচল্লিশ-পরবর্তী এই ভূখণ্ডে বালক-তরুণ-বুড়ো সবাই এই লেখালেখির প্রণোদনাটা তৈরি করেন। এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সম্পর্কটা, পরে কিছুটা হলেও একথা সত্য যে পশ্চিমবাংলার সঙ্গে বাংলাদেশের এই ধারাবাহিকতার কোনো মিল নেই। বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন বা প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ধারাবাহিকতা একুশে ফেব্রুয়ারি বা ১৬ই ডিসেম্বর; এটার সাথেও আমি একমত হতে পারছি না এইজন্যে, এই স্বতঃস্ফূর্ত জাতীয়তাবাদী চেতনার সাথে একটি ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্বের সাথে আত্মত্যাগের সম্মান মিলিয়ে যে উদযাপনী, যে বেদনা তা জাতীয়বাদী চেতনাকে সম্মান দিতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা বা লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট বলতে আমাদের এখানে যা হয়েছিল, তা স্বতঃস্ফূর্ত শুরু হলেও যে সরকার বা যে সিস্টেমের বিরুদ্ধে চেয়েছিলাম, তা তো ব্যক্তিগত আমার ভেতর থেকে এসেছিল।

আশি থেকে কী দেখলাম! তখন তরুণদের আলাদা দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিতে একটা কাগজ বের হতো ‘সন্ধানী’। ‘সংবাদ’ তেমন একটা কাগজ ছিল। যাইহোক, ‘সন্ধানী’তে একটা গল্প যশোর থেকে পাঠালাম। বাম, হানাদার বাহিনী, মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধবিরোধী—এরকম তিনজনের সংগ্রাম নিয়ে লেখাটা লিখেছিলাম। শেষে বাম এবং মুক্তিযোদ্ধা হানাদার বাহিনীর সঙ্গে লড়ে। আজকে এসব নিয়ে অনেক বই লেখা হয়। কিন্তু ওই সময়কার ওই জীবন, ওইসময়কার ওই দর্শনের ভেতর দিয়ে আমি একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে চেয়েছিলাম। ওই বীজগুলো আমার ভেতর পোঁতা ছিল। যশোরে জন্ম হওয়ার কারণে এগুলো ওই কমবয়স থেকেই জানতাম। ‘সন্ধানী’ এটা ছেপেছিল। তারেক শাহরিয়ারের সঙ্গে ঢাকায় এসে পরিচিত হলে ওর ‘দৌড়’ নামে আরেকটা গল্প ‘সন্ধানী’তে দিয়ে এলাম। সুশান্ত মজুমদার তখন সম্পাদক। তিনি খুব আন্তরিকতার সঙ্গে ছাপলেন। এ সব কিছুর পরেও ঘটনা অন্য জায়গা থেকে ঘটে গেল যেন। সংবেদ-অনিন্দ্য-গাণ্ডীব। যখন সাজ্জাদ শরিফ, শান্তনু চৌধুরী, শোয়েব শাদাব ইশতেহার লিখলেন, ওই সময় যে কবিতা লেখা হতো তার বিপরীতে এমনসব কবিতা লিখলেন যা আমার পঠন-পাঠনের বাইরে ছিল। গাণ্ডীব বেরোচ্ছে, চর্যাপদ বেরোচ্ছে, অন্তত বিশ জন মিলে আমরা এসব ভাবছি। থুতু ছুড়ি তথাকথিত সুন্দর ও কুৎসিতের স্থূল কাব্য-বন্দনায়। কেবল আমাদেরই অভিজ্ঞানে রয়েছে রহস্যময় সংবেদনের আবর্ত। এই ধরনের কথাগুলোকে শুধু নন্দনতত্ত্ব-কেন্দ্রিক আমার মনে হয়নি, মনে হয়েছে ওই সময়কার সময়কেও তারা ইঙ্গিত করেছিল। পুরো সময়ের যাবতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-বাস্তবতাকে বিদ্ধ করে যেন তারা সেই ইস্তেহার লিখেছিল। সেই তিনজনের কবিতা অন্যরা অতোটা আত্মস্থ করতে না পারলেও আমার মনে হয়েছিল কবিতাগুলো শুধু সম্মানিত হওয়ার জন্য লেখা না। অনেকে ইস্তেহারের বিরোধিতা করেন এই জন্যে, প্রচলিত ধারায় তখন যে কবিতা লেখা হচ্ছিল, সেগুলোও লিখতে পারতেন না। সেইজন্যে তাদের লেখার ক্ষমতার অভাবে তারা ইস্তেহারের বিরোধিতা করেন। আমি ওই ইস্তেহারে এতোটা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম যে, আমার অচেতন মন ওই রাজনীতি, সমাজ, নিপীড়ন, দুর্ভিক্ষ নিয়ে ওই গোটা বিষয়ের একটা প্রতিচ্ছবি ওই ইস্তেহারে দেখেছিল। এবং ওটাকে একটা প্ল্যাটফর্ম মনে করেছিল। সেই প্ল্যাটফর্ম বার বার আমাকে বাস্তবতার দিকে নিয়ে গেল। ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ আমি তিন দিনের ভেতরেই লিখে ফেলেছিলাম। ফলে আমি আজও বিশ্বাস করি, সমাজে সুবিধাভোগী শোষক শ্রেণির গ্রহণযোগ্য নন্দনতত্ত্ব নিয়ে একজন শিল্পী হাজির হতে পারেন। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যের আন্দোলনের আমার যেটা উপলব্ধি; বড় শিল্পী হবার চেয়ে কম বৈষম্যের সমাজ চাওয়াই একজন শিল্পীর আজীবনের আত্মাহুতি।

হাংরি জেনারেশনের আন্দোলনে আমি ক্ষুধা দেখি না। তাদের তৎপরতা অনেক সক্রিয় ছিল। ফাল্গুনী রায় এবং দুয়েকজনের লেখা বাদে সেই মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষাই ঘুরে-ফিরে তাদের হয়েছে। বিষয়টা রাষ্ট্র যদি শ্রেণি-দ্বন্দ্বের অমীমাংসিত ফলাফল হয়, তাহলে শ্রেণি-উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা লেখকদের থাকে। কিন্তু সে আকাঙ্ক্ষা যদি রীতিমতো ভোগবাদী আকাঙ্ক্ষার মতোই কখনো কখনো মনে হয়, জৈবতায়; তখন কিন্তু সেটাকে আর আন্দোলন মনে হয় না। সেই অর্থে কোথাও কোথাও আমার সুনীল-সন্দীপনের মতো ওদেরকেও মনে হয়েছে। কম বৈষম্যের সমাজের আকাঙ্ক্ষার থেকে ভোগবাদের মতো তাদের লেখায় যে জৈবতা, ক্ষুধার মনে হয়নি, মনে হয়েছে বিলাস। আমি অনেক কিছু শিখেছি যদিও। অনেক লেখা থেকে নিজের লেখাকে সমৃদ্ধ করেছি। কিন্তু তাদের অনেক বিষয়ের সাথে আমি একমত হতে পারিনি। বিশেষ করে সতীর্থদের প্রতি তাদের যে হিংসাত্মক মনোভাব, তাতে মনে হয়নি যে তাদের বিপ্লবের শুরুতে ভিত মজবুত ছিল।

বাংলাদেশে আশির আগে ‘স্যাড জেনারেশন’ নামে ইংরেজিতে ইশতেহার দিয়েছিল ষাট দশকের কবিরা। আবদুল মান্নান সৈয়দ, মুহাম্মদ নূরুল হুদা, আবুল হাসান। শিল্পী হিসেবে তাঁরা বিখ্যাত হয়েছেন বহু আগেই। কিন্তু তাঁদের জেনারেশনের ইস্তেহার প্রজন্ম পরম্পরায় গ্রহণ করেনি। তাঁরা গুণী ছিলেন, সন্দেহাতীতভাবে তাঁরা সুবিধাভোগীও ছিলেন, সেই জন্য পরের প্রজন্ম তাঁদের ইস্তেহারটাকে এমনকি তাঁদের কাব্যের দৃষ্টিভঙ্গিটাকেও পুরোপুরি নেয়নি।

আমার মনে হয় বাংলাদেশে আমাদের এই আন্দোলনটা সম্পূর্ণভাবে লেখালেখির আন্দোলন হিসেবেই তৈরি হয়েছিল। পশ্চিমবাংলার সাথে এর সম্পর্ক এইজন্যে হবে না, পশ্চিমবাংলার লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন কোনো-না-কোনো ভাবে পলিটিক্যাল। কিন্তু আমাদের এখানে আশির থেকে এই পর্যন্ত, হয়তো ব্যক্তিগতভাবে আমি এটাকে একটা প্ল্যাটফর্ম মনে করে রাজনৈতিক আন্দোলন মনে করি, কিন্তু অন্য যাঁরা, তাঁরা অভাবনীয় সৃজনশীলতা দিয়ে এই আন্দোলন করেছেন। এবং সেটা সাহিত্যেরই আন্দোলন হয়েছে। যতোটা লিটল ম্যাগ আন্দোলনের ভেতরে যে রাজনীতির দরকার ছিল, সেটা হয়তো হয়ে ওঠেনি।

আহমেদ নকীব: আমার আম্মা গীতি-কবি ছিলেন। ‘৭১-এর পর তাঁকে দেখেছি প্রবাহ গোষ্ঠী ও প্রদীপন সংগীত গোষ্ঠী এরকম দুটি গানের ও সাংস্কৃতিক দল পরিচালিত করতে। আবার অনেকে মিলে ‘চৈতী’ নামে একটা সাহিত্য সংকলন বের করতেন। আর আব্বা ছিলেন মার্ক্সবাদী চিন্তাচেতনায় সমৃদ্ধ একজন ব্যক্তিত্ব। তাই লেখালিখি ছাড়াও আমার মধ্যে প্রথম থেকেই পারিবারিক এই বলয়ের একটা প্রভাব ছিল। তাই  লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আমার যে যুক্ততা তার প্রেক্ষাপট আগে থেকেই সুপ্ত অবস্থায় ছিল। পরবর্তীতে আপনাদের সংস্পর্শে এসে তা আরো বেগবান হয়। তাই সব মিলিয়ে লিটল ম্যাগাজিন ভিত্তিক সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডে যেভাবে একটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা ও স্বপ্নের প্রতিফলন থাকার কথা ছিল, আমি মনে করি সেই অবস্থান থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। তাই যেভাবে শুধু প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার নামে এই লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্টকে একরৈখিকভাবে পণ্যসাহিত্য-বিরোধী মুভমেন্ট বলে কেউ কেউ চিহ্নিত করতে চাইছে, তা কি শুধু বাক-সর্বস্বতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে না? আর যাঁরা লিটল ম্যাগাজিনকে ভিত্তি করে তাদের সাহিত্যকর্ম বিকশিত করতে চান, তাঁদের লেখার মাঝে কি এই দার্শনিক ভিত্তি গভীরভাবে ছাপ ফেলতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?

সেলিম মোরশেদ: সুশিক্ষিত সংস্কৃতিমান শিক্ষিকা মাতার সঙ্গে সমৃদ্ধ মার্কসবাদী পিতা।  এরকম মিশেল খুব কমই হয়। ভেতরে সাহিত্যের শুধু প্রবণতা না, সামাজিক কর্মকাণ্ডের মননটাও তৈরি হয়েছিল আপনার। দুয়েকজন লিটল ম্যাগাজিনের লেখকসহ আমি আপনার ব্যক্তিগত কার্যক্রমের কিছু দিক উল্লেখ করি, প্রায় তিরিশজনকে ব্যক্তিগত খরচে রিহাব থেকে আপনি সুস্থ করান। এই সময়ে দেশের জন্য এই অসামান্য অবদান নীরবে করলেন। লিটলম্যাগের ভেতর এটা অনেকেই জানে না। আপনি তো ফান্ড নিয়ে করেননি। ওইভাবে আপনাকে ধনাঢ্য ব্যক্তিও বলা যায় না। তারা সবাই লেখক ছিল তা-ও না। কিন্তু কেন করেছেন? কোনো-না-কোনোভাবে আপনার চোখে সেই তরুণেরা দেশ ও সমাজের সেই প্রজন্ম— যারা নানান ক্ষেত্রে বিকল্প চিন্তা করে বলে আপনি ভেবেছিলেন। এই ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলো একটা প্ল্যাটফর্মে করলে তখন সেটা সাংগঠনিক কাজ হয়। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা বা স্বপ্ন নিয়ে আপনি যেটা করেছেন, আপনি যদি মনে করেন আমরা তার থেকে দূরে এসেছি, কথাটা ঠিক হবে না। এইজন্যে যে, ব্যক্তিগত উদ্যোগও অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে বলব, একটা জায়গায় বোধহয় অন্যভাবে ভাবা যেতে পারে। শুধু লিটলম্যাগ এবং দু-চারটে বাখোয়াজকে নিয়ে বিরক্ত হয়ে আপনি নিজেদের টোটালিটির প্রতি বড় একটা অভিযোগ তুলেছেন। এভাবে কি ভাবা যেতে পারে, এদেশের মিডিয়া বা মিডিয়ার খ্যাতিমান কেউ কেউ এই লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্টে আমার বা আপনার সঙ্গে তারা ছিল এবং এই তিরিশ-চল্লিশ বছর তারা এই কাজ দেখেছে! আপনি যে কালেক্টিভিটির কথা বলেছেন, তারাও তো সেই কালেক্টিভিটির অংশ। সাহিত্যের কালেক্টিভিটি তা যেকোনো বিবেকবান সাহিত্যিককেই স্পর্শ করে। আমি-আপনি যে আলোচনা করছি, তা আমাদের শিল্প-সাহিত্যের সফল কোনো সেলিব্রেটিদের মতো না। এটা একটা সাংস্কৃতিক ইতিহাস, এটা একটা বিপ্লবের ইতিহাস। তাই আমরা আলোচনা করছি। এই ইন্টারভিউয়ের কিছু অংশ কি সেই মিডিয়া তাদের ফেসবুকে, ওয়েবে শেয়ার করবে? কবি আহমেদ নকীবের আত্মজিজ্ঞাসার বিশ্লেষণ কি তারা বলবে? এটা তো সাংবাদিকতার এথিকসও। এর মানে এই না, মিডিয়ার কাছে আমি কোনো প্রত্যাশা করছি। একটি ইতিহাসকে তুলে ধরা তাদেরও তো কালেক্টিভিটির অংশ। তারাও তো রাষ্ট্রের কাছে জানাতে পারে। এটা সংবাদপত্রের অবশ্যই এথিক্সও। আপনি বলতে পারেন, মিডিয়া শেষমেশ এটা করবে না। কারণ তারা এখানে শত্রু মনে করে কিংবা অনেককে লেখক মনে করে না। তাহলে আপনিও-বা চাইছেন কেন এই টোটাল কালেক্টিভিটি? সেক্ষেত্রে ওই তথাকথিত ভালো লেখাও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না।

আপনি বলেছেন, আপনার বাবা একজন সমৃদ্ধশালী মার্কসবিদ। তিনি সইফ-উদ-দাহার-এর সাথে থেকেছেন। আরো একজন গুণী মানুষ আছেন। তাঁর সাথে তাঁদের দ্বিমত ছিল। পার্থক্য ছিল, ভদ্রস্থ পার্থক্য। সেই অর্থেও আপনার বাবা বা সাইফ উদ দাহার কখনো সমন্বয়বাদী হতে চাননি। এই গুণী মানুষটার সাথে একাত্ম হতে চাননি। এ কে এম আনোয়ারুল হক আপনার বাবার নাম। ক’জন জানেন তাঁর এই নামটি? কিন্তু তাঁর যে অবদান, সে অবদান অনেক সাংগঠনিক নেতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।

মার্কসবাদ নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল। যদিও অতোটা বুঝিও না। কিন্তু যতটুকু আগ্রহ বা বুঝি, তা থেকে আমার মনে হয়, এখানে মাওয়ের এবং লেনিনের চর্চাটা যতো হয়েছে মার্কস-এঙ্গেলেসের চর্চাটা হয়নি। ফলে বাম মার্কসবাদী বলে যাঁদের কথা বলছেন, তাদের অনেক ত্রুটিও যেমন ধরা পড়েছে, পাশাপাশি এঁদের এখনও কর্মতৎপরতা আমার কাছে বিস্ময় আনে। আর যাঁদের কথা বলছেন বাকসর্বস্ব, কে বাকসর্বস্ব? যে সবার থেকে নিজেকে পৃথক মনে করে। কিন্তু ‘আলাদা’-‘আলাদা’ বলে চেঁচালে কি আলাদা হবে? ‘আলাদা’ সে-ই, অন্য আরেকজন ‘আলাদা’-কে সনাক্ত করে যে ধারণ করতে পারে। বিদ্যাসাগর থেকে বুদ্ধদেব বসু তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সত্যিকার আলাদা লোক কখনো একা হয়?

যদি বলেন বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট ব্যর্থ, সেই অর্থে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও ব্যর্থ। যদি লিটল ম্যাগাজিনে তার নিষ্ঠা হয় তাহলে তার লেখার ভেতর সেই দার্শনিক ছাপ পড়বেই। না হলে তারা শুধু শিল্পের জন্যই শিল্প করবে। আপনারই মতো, আমারই মতো একইভাবে কথা বলছে, কিন্তু ওই মানুষগুলো এসবের ভেতরের না। তাই তার লেখায় ছাপও পড়ে না। যতক্ষণ আমাদের সাথে থাকে, ততক্ষণ তাল মিলিয়ে চলতে চায়, লিটল ম্যাগাজিনের উপর ভর করে চলতে চায়। জনাকয়েক সতীর্থদের কাছ থেকে জোর করে সমর্থিত হতে চায়। তার যদি গোষ্ঠীও থাকে, তবে তারা জানেও না এটা প্রপঞ্চ। এবং শেষমেশ লেখা সেই নির্মম বিষয় যা প্রতিশোধ নেয়।

আহমেদ নকীব: সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের সাথে এর কতটুকু যোগ আছে আমি জানি না, তবে আমি মনে করি আমরা যারা একসময় এই মুভমেন্টের দার্শনিক ভিত্তিটাকে  যৌথতা হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছি, আমাদের চর্চার মধ্যে ব্যাপারটি নানাভাবে এসেছে। বামধারার আন্দোলনের সাথে এই আন্দোলনের একটা যোগসূত্র থাকলেও, এই আন্দোলন তো আর সরাসরি কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, এর সামাজিক মূল্যটা আমাদের কাছে প্রধান ছিল। এর মূল্য শুধু জনাকয়েক লোক মিলে একটা পত্রিকা বের করা না, এর মধ্যে একটা সামাজিক কমিটমেন্টও জড়িয়ে আছে। তবে একজন লেখকের মধ্যে শুধু যদি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ব্যাপারটি  কাজ করে তবে এই যৌথতার কনসেপ্টটি তার কাছে বাহুল্য মনে হতে পারে। তাই লেখালেখি ছাড়াও আমরা বিভিন্ন প্রকাশনা, ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন, যেমন চা-শ্রমিকদের দাবি আদায়ের আন্দোলন, সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন— এরকম কিছু ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলাম। অনেকেই কিন্তু বলেছে, আমরা কবি-সাহিত্যিকেরা কি মিছিল-মিটিং করব? অর্থাৎ লেখক-সত্তা আর কর্মী-সত্তা’র মধ্যে একটা টানাপড়েন তৈরি হল। তাই লেখক-সত্তা ও কর্মী-সত্তা এই দুটি সত্তার অবস্থানকে আপনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করবেন?

সেলিম মোরশেদ: আসলে লেখক-সত্তার যে কমিটমেন্ট আছে, এরা নিজেরাও তা জানে না। যেন খেলতে খেলতে লিখতে এসেছে। লিখে প্রশংসা পেলেই খুশি। আপনি যে কমিটমেন্টের কথা বলছেন, এটা আপনার প্রশ্নের ভেতর অনেকভাবে এসেছে। লেখকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধহয় তখনই কাজ করে, যখন সে কোনো আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এর প্রতি নিষ্ঠাবান হয় না। ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের যে উদাহরণগুলো দিয়েছেন, আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছেন, লক্ষ করবেন, সেগুলো যাদের আমরা সার্বক্ষণিক সমালোচনা করি, সেই বামদের কার্যক্রমের ভিত্তিতেই হয়েছে। যারা ব্যর্থতা এবং সফলতার প্রশ্ন তোলে, তারা একবারও ভাবে না যে জনসম্পৃক্ত বলে যেটা আছে সেটা যে কোনোভাবে বৃহত্তর জাতীয়তাবাদী দলগুলোর হাতে। তারা এখানে অংশ নেয়নি। ফলে আন্দোলনে যে মধ্যবিত্ত আপনি চাইছেন, তারা দ্বিধান্বিত ছিল। এখন বাংলাদেশের বামদের ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে ভূমিকা যথেষ্ট। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বামগুলোও চেষ্টা করে তাদের শেষ দেশপ্রেমটুকু বজায় রাখতে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় দেশের সামরিক বাহিনীর একাংশ যখন ‘রেশমা নাটক’ করছে, তখন সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের এবং জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঐক্যে রাজেকুজ্জামান রতনের নেতৃত্বে তারা ভূমিকা রাখে। আমরা সবাই সেটা দেখেছি। কবি-সাহিত্যিকেরা প্রয়োজনে মিটিং-মিছিল করবে না, এমন কথা কোথায় লেখা আছে? তারা যুদ্ধও করে। পল এলুয়ারের জীবনী তারা পড়ুক, জানবে। এখনও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মান পান লোরকা এবং নেরুদা, মায়কোভস্কিও। এঁরা শুধু কবিতার জন্যই পান তা না, তাঁদের রাজনৈতিক মনস্কতা এবং একই সাথে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির জন্যেও।

আহমেদ নকীব: একসময় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে গোষ্ঠীবদ্ধ আন্দোলন বলে কটাক্ষ করা হল। অবশ্যই এটা গোষ্ঠীবদ্ধ আন্দোলন। কিন্তু এই গোষ্ঠী কি শুধু মুষ্টিমেয় কিছু লেখক আর সাংস্কৃতিক কর্মীদের গোষ্ঠী নাকি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের গোষ্ঠী? অথচ দেখা গেল যারা এই আন্দোলনকে বাঁকা চোখে দেখলেন, পরবর্তীতে তারাই বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে সাহিত্যের নানারকম সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এই ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

সেলিম মোরশেদ: এই প্ল্যাটফর্ম নিয়ে যারা যতোটা কটুক্তি করেছে তারা ততোটাই অক্ষম ছিল নিজের পায়ের তলায় একটা ভর তৈরি করার জন্যে। পারেনি। উন্মূলরা চিরকালই দিশেহারা, হিংস্র আর ধূর্ত।

আহমেদ নকীব: লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের ভেতর দিয়ে যে ম্যাসেজটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে এই আন্দোলন হচ্ছে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আন্দোলন। আর যেহেতু লিটল ম্যাগাজিন শুধুমাত্র সাহিত্যচর্চার একটা মাধ্যম হিসেবেই তার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিল, আপনার কাছে কি মনে হয়, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার মতো একটা দার্শনিক এবং রাজনৈতিক ডিসকোর্স শুধুমাত্র সাহিত্যিক উপলব্ধি দিয়েই ব্যাখ্যা করা সম্ভব? নাকি এর সাথে অপরাপর বিষয়গুলো জড়িয়ে আছে? যদি থাকে আপনার কাছে এই বিরোধিতা’র মূল লক্ষ্য কী এবং কেন?

সেলিম মোরশেদ: প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা নিয়ে আমি আমার ‘অমায়িক খচ্চর’ বইয়ের দীর্ঘ একটি নিবন্ধ থেকে কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি— (২৯ পাতা)

‘এই অসম সমাজে সমসত্তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়া কিছু স্ববিরোধিতা নিয়ে যে নিরন্তর কোশ্চেন, এই টোটাল সবকিছু নিয়ে ভাবনা, যাপন, লেখা আর এই এলোমেলো তৎপরতার শেষমেশ যে যোগফল হয়ে ওঠে তা প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা একটা নিরন্তর কোশ্চেন। ফলে এটার সাথে যাপন, এটার সাথে লেখা, এটার সাথে নিজের প্রতিনিয়ত ভাবনা, এর সাথে ব্যর্থতা-সফলতার চেয়েও বেশি জরুরি তার আত্মনিমগ্নতা।’

তো এই ক্ষেত্রে আমি বলবো যে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন আমাদের সমাজ-বাস্তবতায় আমাদের মতোন করেই হয়েছে। এটা ঠিক কোনো সুচিন্তিত থিওরি বা কোনো আউটলাইনের উপরে না। লক্ষ্যটা ছিল, আমরা কালচারাল কলোনির শিকার হয়েছি, তার বিরুদ্ধে। লক্ষ্যটা ছিল আমাদের বর্তমানের যে সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতা, সেটার সাথে আমরা কেন খাপ খাওয়াতে পারছি না। এই সব মিলিয়ে একটা মনন তৈরি হয়েছিলো। অবশ্যই সব লেখকের মধ্যে না। আমি আগেই বলেছি যে, যাঁরা গুণী লেখক তাঁরা লেখায় তাঁদের সর্বোচ্চ স্বাতন্ত্র্য প্রমাণ করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে তাঁদের কোনো লক্ষ্য ছিল না। তার পরও হতে পারে। তাঁরা তাঁদের মতো করে একধরনের রাজনীতিমনস্ক।

একজন লিটল ম্যাগাজিনের লেখক, তার লড়াই নানা ধরনের হয়। তার ব্যক্তিজীবনের একটা লড়াই আছে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়ার কারণে। কারণ সবকিছুই তো আসলে প্রতিষ্ঠান। আপনার সাথে যতটুকু আমি হাসি, আপনার সাথে যতটুকু আমার স্বস্তিদায়ক সম্পর্ক, আপনার সাথে যতটুকু আমার প্রেম-ভালোবাসা—সবকিছু প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য থেকে। এই মূল্যবোধগুলো রক্ষা না করলে আপনার গোটা জীবন তছনছ হয়ে যাবে। আমি আজকে যে প্যান্ট এবং শার্টটা পরি, সেটার কাটিংও তো আমার দ্বারা নির্ধারিত না। সেটা আমাকে সেভাবেই নিতে হয়। তাহলে আমার দ্বারা কী নির্ধারিত হয়, এ প্রশ্নটা খুবই কঠিন এখন। আদৌ কি আমার বা আমাদের দ্বারা কিছু নির্ধারিত হচ্ছে?

সেইসব ক্ষেত্রে আরো একটি কঠিন বিষয় হলো পেশা। পেশায় ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে লড়াই করা, এটা একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। প্রতিষ্ঠানে থেকে প্রতিষ্ঠানের সাথে লড়াই করা। আমি যাপনের একটু উদাহরণ দেই, আমাদের লিটল ম্যাগাজিন গাণ্ডীব এবং চর্যাপদ একই সঙ্গে বের হলো। চর্যাপদের সম্পাদক আযাদ নোমান, কর্মক্ষেত্রে যাঁর নাম নোমানুজ্জামান আল আযাদ। তখন চাকরি করতেন শিল্প মন্ত্রণালয়ে। লাইব্রেরি ডকুমেন্টের ইনচার্জ হিসাবে। এটা হলো ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডাস্ট্রি। ওই সময় কর্মচারীদের ভোটে জেনারেল সেক্রেটারি পদে তিনি একাধিকবার নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাঁর কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সচিবকে দিয়ে কর্মচারীদের পক্ষে কথা বলার জন্যে তাঁকে বডি ওয়ারেন্ট করে। এই বডি ওয়ারেন্ট যতক্ষণ জারি থাকে তার অর্থ হলো দেখামাত্রই তাঁকে গুলি করা।
তিনি হাইকোর্টে মামলা করেন। তদন্তে ডিজিএফআইয়ের মন্তব্য আসে— কর্মচারীদের স্বার্থে কথা বলা ছাড়া উনি আর কিছু করেননি। তিনি মুক্তি পান।
ওই এক বছর পুলিশি নিপীড়ন, সামগ্রিকভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে তখন তিনি চিহ্নিত, এবং যে কষ্টের সময় তিনি পার করেছেন, লিটল ম্যাগাজিনের তেমন কেউই তাঁর পাশে তখন দাঁড়ায়নি।

তো, ব্যক্তিজীবনে তিনি যেটা করলেন, এটাও তো একটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী লড়াই। শুধু তাই না, ২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকারের আমলে আবার সেই মামলা রিস্টার্ট হয়। শ্রমিকদের বিশ্বাসভাজনতার কারণে তিনি পুনরায় চাকরিতে বহাল হন। সেই মামলা স্টার্ট হওয়ার পেছনের কারণ ছিল, ১৫ আগস্ট তিনি পালন করেছেন, তাই। এবার মামলার সময় তাঁকে প্রলোভন দেখানো হয় যে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি কিংবা সমপর্যায়ের কোনো পদে যাবেন কিনা। তিনি সে প্রস্তাব ও প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করেন। তারপরেও কর্মচারীদের ভোটে তিনি মহাসচিব নির্বাচিত হন বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদের।

৩২ বছর পরে আযাদ নোমান যখন কবিতার বই বের করলেন, (প্রসঙ্গত যেটা আগের অধ্যায়ে বলার কথা ছিল।) তখন তিনি বহু লেখককে ডাকার পরে সে অনুষ্ঠানে শান্তনু চৌধুরী, সাজ্জাদ শরিফ, তুষার দাশ, মোশারফ খোকন এবং পারভেজুর রহমান ছাড়া অন্য কাউকে যেতে দেখিনি। ‘প্রণয় যুদ্ধ প্রলয় গান’ কাব্যগ্রন্থে আযাদ নোমান পাতায় পাতায় সমাজবাস্তবতা, রাজনীতি, অর্থনীতি কবিতায় তুলে আনতে পেরেছেন। আমি এই বিষয়গুলো আনছি এইজন্যে যে, ব্যক্তিজীবনের স্ট্রাগলও একটা মনোভঙ্গি, প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যাওয়ার কারণেই, চাকরি বা গার্হস্থ্য বাঁচিয়ে রাখার কারণেই একজন বাইরের যে ঝুঁকি নিতে পারে না, সেখানে আযাদ নোমানের এই পদক্ষেপ আমাদেরকে সাহসী করে। এই ৩২ বছর কবিতার বই বের না করার নিস্পৃহতা আমাদের তরুণ মহলকে অবাক করে।

আমি কথাগুলো বলছি এইজন্যে যে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটা কথা সবসময় স্মরণ করি, ‘মুভমেন্ট না করলে মানুষ মানুষ হয় না’। আমি এর সঙ্গে যুক্ত করতে চাই এবার, যে মুভমেন্ট করে সে নিজেই প্রশ্ন এবং উত্তর। এখানে ভিন্ন কিছু বলার নেই। কে জানলো কে জানলো না এটাও আপেক্ষিক। এখানে ক্ষুদ্র বা বৃহৎ, বিষয়টা বড় না। বড় হলো, সেই মানুষটির প্রবণতা। আপনার ক্ষেত্রে, মারুফুল আলমের ক্ষেত্রে, সাগর নীল খানের ক্ষেত্রে আমি নানাভাবে দেখেছি। উলুখড় প্রকাশক সাগর নীল খান তো গণজাগরণ মঞ্চে আমার আকাঙ্ক্ষাটুকু জেনে কীভাবে ঠেলে নিয়ে গেলো এবং বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিবাদ সভায় আমাকে যেভাবে যুক্ত করলো, সেটা আমাকে আজও বিস্মিত করে।

লিটল ম্যাগাজিন থেকে যে কাজ হয় না কথাটা ঠিক না। কালেক্টিভ কাজ এবং সামাজিক কাজ হয় তো। গাজায় গণহত্যা হলে লিটল ম্যাগাজিন প্রাঙ্গণ থেকে ‘লোক’-এর ব্যানারে অনিকেত শামীম শাহবাগে প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেন। দীপন-হত্যা এবং ‘শুদ্ধস্বর’ প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের উপর আঘাতের প্রতিবাদে অনিকেত শামিম আজিজ মার্কেটে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন। নিসর্গ সম্পাদক সরকার আশরাফ, চারবাক সম্পাদক রিসি দলাই এবং কবি ও লেখক মুজিব মেহেদী ছিলেন। ফলে এইভাবে সামাজিক কাজ যে লিটল ম্যাগাজিন করেনি নানাদিক থেকে, সেটা নয়। তবে সেগুলো বিচ্ছিন্নভাবে হয়েছে, যার একত্রিত ইমপ্যাক্ট যেভাবে জনগোষ্ঠীর ওপরে পড়ার কথা ছিল, সেভাবে হয়তো হয়ে ওঠেনি। এইতো সেদিন, কবি হেনরী স্বপনের মুক্তির দাবিতে চর্যাপদ প্রতিবাদী অবস্থান রাখলো লাইব্রেরির সামনে। অন্যরাও করেছিল।

আহমেদ নকীব: এতদিনের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অন্যদের সাথে একটা ব্যাপারে আমার কিছুটা মতপার্থক্য রয়ে গেছে, তা হচ্ছে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা এবং প্রতিষ্ঠান-বিমুখতা। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানবিমুখ ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করতে চাচ্ছে। আপনি যদি এই ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করতেন তাহলে এর একটা মীমাংসিত রূপকে ধরা যেত।

সেলিম মোরশেদ: প্রতিষ্ঠান-বিমুখতা একধরনের মনোভঙ্গি। লেখক যদি একটু ইন্ট্রোভার্ট ক্যারেকটারের লোক হয়, সব জায়গায় তার যেতে ইচ্ছা করে না। লেখালেখির ভেতরে থাকা, চিন্তা করা, স্বল্প কিছু বন্ধুদের সাথে চলা, প্রপাগান্ডায় জড়ায় না সে। এমন কিছু চরিত্র। আমাদের ভেতরেও কখনো কখনো হয়তো এরকম আসে। তবে একটা বিষয় আমি লক্ষ করেছি। এই নির্বিকার, এই নিরবচ্ছিন্ন, এই নির্মোহ লেখকগুলোর লেখাও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে যায়। বাংলাদেশে জীবনানন্দ দাশের মতো জীবন যাপন করার অবকাশ নেই।

আহমেদ নকীব: লিটল ম্যাগাজিনে সাহিত্যচর্চার ভেতর দিয়ে যে ডিমারকেশন তৈরি হল, অর্থাৎ আমরা শুধু অল্পসংখ্যক পত্রিকা ছাড়া লিখব না, বা অনেক সময় ব্যাপারটা এই জায়গায় এসে ঠেকেছে যে, আমরা কারো সাথে মিশব না, হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে একটা কমন আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল যে, আমরা কেউ বড় কাগজে লিখবো না, শেষপর্যন্ত কি তা একধরনের এলিটিস্ট ভাবমূর্তি গড়ে তুলল না? আমার কাছে তো মনে হয় লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট-এর যে সামাজিক দায়টা ছিল, তা হচ্ছে জনমানুষের সাথে একটা যোগসূত্র তৈরি করা, তা-না হয়ে বরং একটা জনবিচ্ছিন্নতা পেয়ে বসল। এই না-মেশামিশি’র মতো একটা ছুৎমার্গি ব্যাপারটিকে ঘিরে অনেকটাই কালেক্টিভ অবস্থান থেকে অনেকটাই ব্যক্তিগত ভালো-মন্দের একটা বেড়াজালে আটকা পড়ে গেল, এ ব্যাপারে আপনার মতামত দিয়ে যদি এই অবস্থাকে ব্যাখ্যা করেন তাহলে এই আন্দোলনকে ঘিরে যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে তা অনেকাংশেই স্পষ্ট হত।

সেলিম মোরশেদ: জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত না-হওয়া অবশ্যই লিটল ম্যাগাজিনের সামষ্টিক, দার্শনিক এবং সাংগঠনিক কিছুটা ব্যর্থতাই বলবো। কিন্তু এ ছাড়াও যে ছুৎমার্গীয় কথাটা আপনি বললেন, এই কালেক্টিভের প্রশ্নও যদি আমরা মনে করি তাহলে সেটাও তো গুটিকয়েক লেখকদের সঙ্গে প্রথম থেকে শুরু হয়েছিলো। যারা আসলেই সুপার ফিশিয়াল। তারা এলিট যদি বলে— তাহলে আমি বলব, তাদের সাবঅল্টার্ন মানসিকতাকে তারা কাজে লাগাতে পারতো। যদি তারা এই জায়গাকে এলিট মনে করতো। তারা সেটাও তো কাজে লাগাতে পারেনি। আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি, ‘লোক’ ২০ বছর পূর্তিতে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে আলোচনার এক পর্যায়ে মুজিব মেহদী ঠিক আপনার মতো একই কথা বলেছিল যে, ‘আমি লিটল ম্যাগাজিনে থাকলাম না কারণ আমি কার সাথে চলব কার সাথে চলব না, এটা মনিটরিং করা হতো।’ পরের অংশে ছিল, “কখন যে ‘শিরদাঁড়া’ আমার হাত থেকে অন্যের হাতে চলে গেলো সেটা আবার আমি বুঝলাম না।” ফলে আমরাও সবার সাথে যথার্থ ব্যবহার করেছি কিনা এ প্রশ্নটাও যেমন আছে তেমন আপনি যে প্রথমে লেখকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কথা বলেছিলেন, আসলেই এমন একটা পর্যায়ে গিয়েছিলো যে, যতোটা-না আমি বলি শুদ্ধবাদী হওয়া, তার চেয়ে বেশি মনে হয়েছে, ওই লোকটির প্রচার এবং ওই লোকটির খ্যাতি নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়া থেকে এই ধরনের মানসিকতা হয়েছিলো বোধহয়। অথবা আমরা প্রতিষ্ঠানের মতো সর্বোচ্চ ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্টকে কেবলমাত্র গুরুত্ব দিচ্ছি না তো? কারণ এটা কোনো শুদ্ধবাদিতার প্রশ্ন হতে পারে না যে, কে কার সাথে মিশবে কি না-মিশবে, বরং ওই ব্যক্তিটি কেন এতো গ্রহণযোগ্য হচ্ছে এটা নিয়ে একটা মনোবেদনা থেকে এই ধারণা হয়েছিল। এখানে তো কোনো অফিস নাই। কোনো কমিটি নেই। হুটহাট করে এখানে এসেই কাজ করা যায়। আপনি আমাদেরকেই শুধু যেতে বলছেন, অন্যরাও এখানে আসতে পারে। আমরা কি তাদের জন্যে সেই পথটা খুলে রাখছি কিনা সেটা দেখতে হবে এবং একইভাবে অন্যরা আসতে চাচ্ছে কিনা সেটাও দেখাটা জরুরি।

আহমেদ নকীব: শেষ পর্যন্ত লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন শুধুমাত্র সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে অগ্রসর হল। এর সাথে রাষ্ট্রীয় ইস্যু, বৈশ্বিক রাজনীতি এবং সমাজের আরো আরো বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে যে ভাবনা ও চিন্তার ব্যাপার রয়ে গেছে, এই দার্শনিক চর্চাটা খুব বেশি হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। হ্যাঁ, সেই সময়ে বড় কাগজ ও বড় কাগজের সাথে সংশ্লিষ্ট সাহিত্যের যে প্রতিষ্ঠানগুলো এবং তাদের বলয়িত যে সাহিত্যিক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, সেই বলয়ের মধ্যে একটা চাপ তৈরি করতে পেরেছিল, কিন্তু সেই চাপ সৃষ্টি থেকে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন বিভিন্ন চিন্তাধারার লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটা মুক্ত প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে ওঠার কথা ছিল, তা থেকে অনেক পিছিয়ে গেলো। এই ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

সেলিম মোরশেদ: একেবারে যথার্থই বলেছেন। কারণ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির যে অবস্থা, তাকে কোনোভাবেই মানা যাচ্ছিল না। ধারাবাহিকভাবে যে ডিজাস্টারস— সেগুলো আসছিল। বামদের ভুলভাল সিদ্ধান্তগুলো তখন আরো বিরক্তিকর হয়ে উঠছিলো। ফলে প্ল্যাটফর্মটা তৈরি করার অবকাশটাই-বা পাওয়া গেল কোথায়? তার পরেও আমরা-আপনারা সবাই মিলে যে লিখে যেতে পারলাম, আর চল্লিশ বছর পরে এই যে আলোচনাগুলো করছি, এখনও আমরা জীবন্ত আছি। এখনও আমরা অন্তত বিশ-পঁচিশজন নিয়ে ভাবি। যা প্রমাণ দেয় যে, কোথাও-না-কোথাও এখানে একটা সততা ছিলো। যা আপাতত ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না এমন একটা রাজনীতি ছিলো, এমন একটা মনোভঙ্গি ছিল। এটুকুই সফলতা।

আহমেদ নকীব: মূলধারার লেখা কিংবা লিটল ম্যাগাজিনের লেখা এরকম কি কোনো ধারা আদৌ গড়ে উঠেছে? আর মেইনস্ট্রিম-এর লেখাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এরকম লেখা কি লিটল ম্যাগাজিন চর্চাকে কেন্দ্র করে হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? আর যদি হয়েই থাকে তবে লিটল ম্যাগাজিনের লেখার বৈশিষ্ট্য কী এবং কেমন বলে আপনি মনে করেন?

সেলিম মোরশেদ: এখানে মেইনস্ট্রিম ধারা যদি বলেন, সেটার সাথে জনপ্রিয় ধারারও একটা সম্পর্ক থাকে। আবার অনেক কিছু বিষয় আছে, কিন্তু সেটা তৈরি হয়নি। দুটো ধারা অন্যভাবে এসেছে। সেবা প্রকাশনী থেকে এসেছে কল্পকাহিনিভিত্তিক গল্পের একটা ধারা। কমবয়সী পাঠকদের জন্যে বয়সের লেখার ধারাটাই এখানে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সব জনপ্রিয় লেখাই যে খারাপ লেখা— আমি একথা বলবো না। কিন্তু এখানে জনপ্রিয় ধারাটাই তো তৈরি হয়নি। আর দ্বিতীয় যে ধারাটা আছে, যে ধারাটা অবশ্যই সিরিয়াস, তাদের কিছু কিছু লেখাও জনপ্রিয় হতে পারতো। কারণ জনপ্রিয়তা মানেই যে সব খারাপ লেখা, তা না। কিন্তু সেটা হয়নি। যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, হাসান আজিজুল হক, কায়েস আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন প্রমুখ লেখক। তাদের যে পরিমাণ পাঠকপ্রিয়তার জায়গা নেবার কথা ছিলো, পাঠক এই কল্পকাহিনিকারদের পাল্লায় পড়ে আর বড় হতে পারেনি।

তাহলে বলতে পারেন, আমরা কী করছি? আসলে আমরা এই দুটো ধারার বাইরে থার্ড লিটারেচার করি। যা সফল-বিফল লেখা হিসেবে যতোটা-না তার চেয়ে বড় হলো আমাদের অনেকেরই লেখা মেইনস্ট্রিম ধারাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

আহমেদ নকীব: আমি আমার শেষ প্রশ্ন করতে চাই। আর তা হচ্ছে বাম রাজনীতিতে যেভাবে আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স-এর সূত্রপাত হল, অনেকটা সেই আদলেই লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্টে একটা সুপ্ত ভাবধারা গড়ে উঠেছিল। যে অর্থে বাম রাজনীতিতে আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স একটা জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতিতে পরিণত হল, আপনার কাছে কি মনে হয় না যে, লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট এক-ই ভাবধারার কারণে শেষপর্যন্ত জনবিচ্ছিন্ন আন্দোলনে পরিণত হল?

সেলিম মোরশেদ: লিটল ম্যাগাজিনের লেখকের বাইরে বড় কাগজে হাতে-গোনা কয়েকজন লেখক ছাড়া আমার তো মনে হয় লেখক সমাজটাই পুরো জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। যে কজন লোক কোনো-না-কোনো ভাবে আপনি মনে করছেন যে তারা মানুষের কাছাকাছি গেছে, আসলে ফেসবুকে গেছে এবং সংবাদ সাময়িকীতে গেছে। এবং কোনো-না-কোনোভাবে তারা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত বা সেইসব বিষয়-কেন্দ্রিক লেখালেখি করছে। এছাড়া পুরো লেখক সমাজটাই তো এখন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

তার চেয়ে বরং একটা কথা বলি, সেটা হলো, আমার কাছে সেই ধরনের লেখাই লেখা, যেটা আপনি প্রশ্ন করলেন, লিটলম্যাগের লেখা, যা আমি আমার ‘মানুষ উত্তম’ নাটকে আপনার একটি কবিতা সংযোজিত করেছিলাম। বরং আপনার শেষ প্রশ্নে এই কবিতাটা দিয়েই শেষ করি,

আনন্দ

অধিক হাসির আয়োজনে ভয় হয়,
তাই বধিরতা ভালোবাস;
নিভৃতে প্রকাশ করো যত
গান ও কান্নার ভাষা,
সুরে সুরে ঢুকে পড়ে নিরুপায় জল…

আবারো মূর্তির সাথে দেখা :
কেন তাকে ভয় পাও শিশু?
গোপনে কান্নার শুরু ছিলো
তবু পাথরের জ্ঞানে ধরে আছে
আমাদের নৃত্যকলা।

আঙুল চূড়ায় ছিলো পৃথিবীর কথা,
তুমি ক্লিষ্ট মনে ভাবো—কে সে?
স্ত্রী না পুরুষের কলা?

তোমার সংশয় খুব নিচু
শুরুতেই দেখা দিলে বর্ণ-কোলাহলে!

ও তো পোকা নয়, কেন তবে
প্রাণঘাতী তুমি?
মাঝে মাঝে নিদ্রাত্যাগে সে-ও পোকা হয়ে যায়,
যদিও সরু সরু হাত-পা তাহার—
হাসতে হাসতে তোমাদের দাঁত দেখা যায়।

তোমরা কি দেখো নাই
তার হাত আজ তীর, ব্যাকুল নির্দেশ—
অনিয়ম বলো যাকে তুমি।

ওর হাত ভেঙে গেলে তুমি হেসে ওঠো

এসকল বৃন্দহাসি তোমাদের আরো ছোট করে, ক্ষুদ্র করে—
বোধ করি ভুলে গেছো আমাদের আরম্ভ কোথায়,
ভাবতে ভাবতে পিছে চলে আসো
নৃত্যময় দু’হাতের পাশে; পায়ের মুহূর্ত
দেখো, ঘ্রাণ নাও, কান পেতে ধ্বনি শোনো—

তবুও কি বোঝ নি তোমার মস্তিষ্ক কতো বড়? চক্ষু ছাড়া দৃশ্য সব বুঝে ফেলো; নৃত্যের অধীনে
তুমি চিরকাল!

প্রতিযোগী যারা, দূরে থাকো

কোনো দিন বুঝলে না সকল দৌড়ের
আগে পিছে হাত বাঁধা থাক্ব?

(আহমেদ নকীব, শিশু ও হারানো বিড়ালের কথা, ১৯৯৬)

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!