:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
সৈয়দ তারিক

কবি, ভাবুক

আল মাহমুদ বিষয়ে নিবন্ধ, জহির হাসানের মন্তব্য ও প্রাসঙ্গিক কথন
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

একথা সেকথা

আল মাহমুদ বিষয়ে নিবন্ধ, জহির হাসানের মন্তব্য ও প্রাসঙ্গিক কথন

‘আল মাহমুদ, সুফিবাদ ও ইমাম খোমেনি’ শিরোনামে আমার একটি লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন প্রীতিভাজন কবি জহির হাসান: ‘আল মাহমুদের পক্ষে সুফি কবিতা লেখা সম্ভব ছিল না। এইটারে কওয়া যায় আল মাহমুদের সততা। কারণ, সুফি লোকের তার পুরানা আমি কর্তৃক আকাম করলে তা তওবা বা আত্মদহনের রীতিতে সেই আকামের রিজেক্ট করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তার ‘সোনালী কাবিন’রে বাতিল করতে হয়। তো তিনি তা করতে যাবেন কেন! ‘সোনালী কাবিনে’ ব্যাভিচারী প্রেমের পক্ষে গীত গাইছেন উনি। যেমন আমাদের এক সুফি দোস্ত তার পুরানা আধিুনিক ধাঁচের প্রায় আটখান বই পোড়াই ফেলছেন এবং নিজের নামই পাল্টাই ফেলছেন। কারণ, ওই লেখাগুলি মানুষকে জগৎ সম্পর্কে ব্যাভিচারী ধারণার পক্ষে আকাঙ্ক্ষা জাগায় রাখে। তারিক ভাই এই মতামতরে কি ডিলিট করবেন?’

এই বিষয়টি নিয়ে দুয়েকটা কথা বলবার আছে। আল মাহমুদের পক্ষে সুফিবাদের কবিতা লেখা সম্ভব ছিল না এই কারণে যে সুফিবাদের মর্মমুখী ধারাটিতে তিনি যথোচিত আকর্ষিত হননি। হয়তো এটাই তার তকদির, যাকে অন্য পরিভাষায় অনিবার্যতা বলা যায়। যদি তিনি সুফি ভাবধারায় সম্যক প্রাণিত হতেন তবে ‘সোনালী কাবিন’কে বাতিল করতে হবে কি হবে না, এই শঙ্কা তাকে দ্বিধান্বিত না-ও করতে পারত। এই বাতিলীকরণ বিষয়েও আমার কিছু বলবার আছে।

‘আল মাহমুদের পক্ষে সুফি কবিতা লেখা সম্ভব ছিল না। এইটারে কওয়া যায় আল মাহমুদের সততা। কারণ, সুফি লোকের তার পুরানা আমি কর্তৃক আকাম করলে তা তওবা বা আত্মদহনের রীতিতে সেই আকামের রিজেক্ট করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তার ‘সোনালী কাবিন’রে বাতিল করতে হয়। তো তিনি তা করতে যাবেন কেন! ‘সোনালী কাবিনে’ ব্যাভিচারী প্রেমের পক্ষে গীত গাইছেন উনি।’

ভারতীয় প্রথায় যখন কেউ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, তখন তার দীক্ষাপূর্ব জীবনকে পূর্বাশ্রম বলে। হবু সন্ন্যাসীকে পূর্বাশ্রমের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়, তার নতুন নামকরণ হয়। তার দ্বিতীয় জন্মের আয়োজন হয়। একটা পর্যায়ে এটা জরুরি, যাতে সে একমুখী নিষ্ঠতায় আরাধ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। এই সময় তিনি পূর্বাশ্রমের সবকিছুই অস্বীকার করতে পারেন (যদিও কর্মফলের দায় তাকে বহন করতেই হয়, অপরাধ বা ভুল করে থাকলে তার জন্য অনুশোচনার পর্ব অতিক্রম করতে হয় তাকে)। কিন্তু এই সাধনার গূঢ় লক্ষ্য হলো আত্মসাক্ষাৎকার: নিজের সীমাবদ্ধ সত্তার ভেতরেই অনন্তকে উপলব্ধি করা। এই উপলব্ধিরও পর্যায়, গভীরতা, ব্যাপ্তি ও স্থায়িত্ব সাধকভেদে বিভিন্ন হতে পারে, তবু যিনি এই উপলব্ধির প্রাথমিক অবস্থায়ও পৌঁছুতে পেরেছেন, তার ক্ষেত্রে আর পূর্বাশ্রম-সন্ন্যাসের দ্বৈততার কী আছে? পূর্ণতার ভেতরে তো সবকিছুই নিহিত। ওটি দ্বৈততার সীমা পেরোনো জগৎ।

সুফির জগৎও আত্মসাক্ষাৎকার লাভের, পূর্ণতার উপলব্ধির দিকে এগিয়ে যাবার, আত্ম ও অপরবিষয়ক দ্বন্দ্ব-মিলন-বিরহের নাটকীয় আবহের জগৎ। এই জগতে প্রবেশের জন্য দীক্ষালাভের পর নিশ্চয়ই তার পূর্বাশ্রমের ভাব-ভাবনা-যাপনের সাথে বিরোধ তৈরি হয় এবং প্রথম দিকে তাকে অস্বীকারের প্রয়োজন ও আবেগও দেখা দেয়। কিন্তু পূর্বজীবন তো তার অস্তিত্বেরই ধারাবাহিকতার অংশ: সেগুলো সম্পর্কে তার মূল্যায়ন ও উপলব্ধি যা-ই হোক, ওগুলো বাস্তবতার অংশ হয়ে গেছে। ওর অনেক কিছুকেই আর অস্বীকার বা বাতিল করেও কোনো লাভ নাই।

ধরা যাক, আল মাহমুদ কোনো মানসিক পরিবর্তনের কারণে ‘সোনালী কাবিন’কে বাতিল করতে চাইছেন। এর অর্থ কী! এই কবিতাবলিকে তিনি তো আর বাস্তবত ধ্বংস করতে পারবেন না। এদের পিতৃত্ব অস্বীকার করাও কার্যত অর্থহীন। বড়জোর তিনি বলতে পারবেন, এই কবিতাগুলো যে ভাবধারা বহন করছে, তিনি আর তা ধারণ করেন না, বরং বিরোধিতা করেন।

জহির বলেছেন, তার এক কবিবন্ধু আটখানা বই পুড়িয়ে ফেলেছেন ও নিজের নাম পাল্টে ফেলেছেন। কারণ, ওই লেখাগুলো ব্যাভিচারী ধারণার পক্ষে আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত রাখে। বইগুলো যদি প্রকাশিত হয়ে থাকে (এবং লেখার কিছুমাত্র সাহিত্যমূল্য থাকে), তবে ওগুলো পোড়ালেও ধ্বংস না হবারই সম্ভাবনা প্রবল।

শিল্প-সাহিত্যে নানা বিষয়-ভাব-অনুভব-দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়, সেগুলো বিবিধ প্রভাবও তৈরি করে। তারপরও শিল্প-সাহিত্যের নিজস্ব একটা পাটাতন আছে, শিল্পগুণ নামক উপাদানে বা উপাদানরাশিতে সেটি নির্মিত। সেই পাটাতনের কারণেই বিষয়-ভাব-ভাবনার আপেক্ষিক অগ্রহণীয়তা সত্ত্বেও তা টিকে থাকে। তবু কোনো কবি-লেখক কোনো কারণে বা মনোবেদনায় নিজের পাণ্ডুলিপি বা অন্যান্য জিনিস বিনষ্টও করতে পারেন।

ধরা যাক, আল মাহমুদ কোনো মানসিক পরিবর্তনের কারণে ‘সোনালী কাবিন’কে বাতিল করতে চাইছেন। এর অর্থ কী! এই কবিতাবলিকে তিনি তো আর বাস্তবত ধ্বংস করতে পারবেন না। এদের পিতৃত্ব অস্বীকার করাও কার্যত অর্থহীন। বড়জোর তিনি বলতে পারবেন, এই কবিতাগুলো যে ভাবধারা বহন করছে, তিনি আর তা ধারণ করেন না, বরং বিরোধিতা করেন।

প্রসঙ্গক্রমে, নিজের গান গাই একটু। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়বার সময় থেকে লেখার শুরু আমার। যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি, উনআশি সালে, তখন কবিতা, গল্প, ডায়েরি ইত্যাদি লেখা খাতা ছিল বেশ কয়েকটা। কিন্তু ওই সময় প্রেমে ব্যর্থতা ও অতঃপর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আশ্রয় গ্রহণ করে বিশ্বাস বিসর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে সন্ন্যাসীর পূর্বাশ্রম ত্যাগের মতোই যেনবা, লেখার সব খাতা, দিনলিপি, চিঠিপত্র ও প্রেমপত্র কুচি কুচি করে ছিঁড়ে হাত ধুয়ে ফেলেছিলাম।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আধুনিকতাবাদের নেতিবাচক প্রভাব, ব্যক্তিগত কিছু গূঢ় নিদান, মাদকদ্রব্য ও আরও নানাবিধ কারণে আমার কবিতা আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি, নেতিবাচক মনোভাব, সংশয়, রুদ্ধরতি ইত্যাদি উপাদানে ভরপুর ছিল। পরবর্তী সময়ে সুফিবাদে দীক্ষা নেবার আগে-পরের সময়টাতে সব রকম সামাজিক যোগাযোগ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিলাম আমি, কবিতা লেখাও ছিল বন্ধ। এই সময় আত্মানুশীলন, ভাবনাধারার পরিবর্তন ও নানাবিধ যাপনচর্যার ভেতর দিয়ে সময় কাটে। একসময় সুফিবাদী ধ্যানসাধনা বা মোরাকাবার একপর্যায়ে আবার কবিতা লেখা শুরু করি। তবে অন্তত বিষয়বস্তু ও ভাব-ভাবনার দিক থেকে এই সময়ের লেখা আগের লেখা আলাদা। আরও কিছুকাল পরে আমার সামাজিক যোগাযোগগুলো পুনঃস্থাপিত হয়।

কিন্তু আমার আগের কালের কবিতাগুলো আমি অস্বীকার করি না। সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমার পক্ষে অমন লেখাই সম্ভব ছিল, ওগুলোর সামান্য শিল্পমূল্যও থাকতে পারে হয়তোবা, অন্তত কবিতা হিসেবে কেউ কেউ তো পছন্দই করে সেগুলোকে। আর আমার পরবর্তী কালের লেখার পটভূমি হিসেবেও ধরা যায় ওই লেখাগুলোকে। তা ছাড়া কবি-লেখকের ‘আমি/আমার’ তো আরও বহুজনেরই প্রতিনিধি। সুতরাং লেখা হিসেবে ওগুলোকে আর ধ্বংস করতে চাই না।

সুতরাং প্রিয় জহির, কিছুই ডিলিট করবার নাই। আল মাহমুদ তা-ই হয়েছেন, যা তার পক্ষে হওয়া সম্ভব ছিল। তবু ওই লেখাটা লিখেছিলাম তার অপর সম্ভাবনার দিকটির কথা ভেবে। আল মাহমুদের না হোক, অন্য কোনো কবির, তরুণতর কারো, ভাব ও ভাবনার জগতে যদি লেখাটি কোনোভাবে অনুঘটকের ভূমিকা রাখে, রাখতেও পারে।

 

পড়ুন- আল মাহমুদ, প্রেমবাদ ও ইমাম খোমেনি

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.