:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
বেলায়াত হোসেন মামুন

লেখক, সংগঠক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

বাংলাদেশের স্বাধীন চলচ্চিত্র এবং নির্মাতাদের লড়াইয়ের গল্প: প্রসঙ্গ চলচ্চিত্র ‘আহত ফুলের গল্প’

বাংলাদেশের স্বাধীন চলচ্চিত্র এবং নির্মাতাদের লড়াইয়ের গল্প: প্রসঙ্গ চলচ্চিত্র ‘আহত ফুলের গল্প’

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য এই খবর কত আনন্দের যে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থানার একজন তরুণ তাঁর নিজের গ্রামের গল্প নির্মাণ করে গ্রামেই প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। যে গ্রামে কোনো সিনেমা হল নেই, সেখানে চলচ্চিত্র দেখানোর নিজস্ব আয়োজন করতে পেরেছেন। একা একজন মানুষের জন্য এই লড়াই অনেক কঠিন। কতটা কঠিন? অনেকের জন্য তা অনুভব করাও সম্ভব নয়। কিন্তু এই কঠিন লড়াই পার হয়ে কেউ যখন এক পা সামনে এগিয়ে যায়, তখন সে অন্য অনেকের জন্য উদাহরণ হয়ে যায়। সব কঠিন লড়াইয়ে বিজয়ের পর কোনো একজনের লড়াই হাজারো মানুষের বিজয়ে পরিণত হয়।

চলচ্চিত্র নির্মাতা অন্তু আজাদ এই কঠিন লড়াই করেছেন। তিনি একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। চলচ্চিত্রটির নাম ‘আহত ফুলের গল্প’। ছবিটি আমার দেখার সুযোগ হয়নি…। তাই ছবিটি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু নির্মাতা অন্তু আজাদকে আমি দীর্ঘদিন ধরে জানি। আমি বহু বছর ধরে তাঁর লড়াই এবং লড়াইয়ের প্রতি নিষ্ঠা খুব কাছ থেকে দেখেছি। কোনো মানুষ যখন একটি লক্ষ্যে স্থির থাকে এবং নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে, তখন সে ঘোরগ্রস্ত মানুষে পরিণত হয়। আর এই ঘোর খুব আরামদায়ক বিষয় নয়। যখন জীবন ধারণই কঠিন, তখন শিল্পের প্রতি ঘোর ধরে রাখা এক অগ্নিপরীক্ষায় পরিণত হয়। অন্তু আজাদ সেই পরীক্ষা দিয়ে চলেছেন অবিরাম। আমি তাঁর লড়াইকে সম্মান এবং মর্যাদার বিষয় বলে মনে করি। তাঁর মতো একজন নিষ্ঠাবান চলচ্চিত্রকর্মী যখন নিজের স্বপ্নের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে সক্ষম হন, তখন তা আমাদের সকলের জন্য আনন্দ এবং গর্বের বিষয় হয়ে ওঠে।

আমি বহু বছর ধরে তাঁর লড়াই এবং লড়াইয়ের প্রতি নিষ্ঠা খুব কাছ থেকে দেখেছি। কোনো মানুষ যখন একটি লক্ষ্যে স্থির থাকে এবং নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে, তখন সে ঘোরগ্রস্ত মানুষে পরিণত হয়। আর এই ঘোর খুব আরামদায়ক বিষয় নয়। যখন জীবন ধারণই কঠিন, তখন শিল্পের প্রতি ঘোর ধরে রাখা এক অগ্নিপরীক্ষায় পরিণত হয়। অন্তু আজাদ সেই পরীক্ষা দিয়ে চলেছেন অবিরাম। আমি তাঁর লড়াইকে সম্মান এবং মর্যাদার বিষয় বলে মনে করি।

এমনিতে আমাদের রাজধানী ঢাকা খুব নিষ্ঠুর শহর। পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরগুলোর কাতারে ওপরের দিকে এর অবস্থান। অথচ নাগরিক সুবিধার দিক থেকে পৃথিবীর নিকৃষ্ট শহরগুলোর একটি। আর তাই এই শহর শিল্পবান্ধব শহর নয়।  কেবল যে শিল্পবান্ধব নয়, তা-ও নয়; এই শহর ক্রমেই শিল্পচর্চাবিরোধী হয়ে উঠছে। শহরের উন্মুক্ত স্পেস কমে যাচ্ছে। শহরে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিসর সংকুচিত হতে হতে গৃহবন্দী হয়ে গেছে। আর গৃহগুলো হয়ে উঠছে ঊষর মরুভূমি। একজন কবির ভাবনার জন্য যে নির্ভার ঘোর দরকার, তা এই শহর আর দিতে পারছে না। সকাল-সন্ধ্যা অফিস করে এই শহরের গল্পকারেরা আর গল্প খুঁজে পাবার শক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। একজন চলচ্চিত্রকারকে জনা পঞ্চাশেক মানুষের যৌথ সংসার সামলাতে হয়। সেই সংসারে থাকে অনেক মতের, পথের মানুষ। ঢাকা আজ একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্যই নাভিশ্বাস তুলে দিচ্ছে, পঞ্চাশ জনের শিল্পপ্রেমকে সে কীভাবে জায়গা দেবে? ঢাকাবাসীদের অনেক বন্ধু-স্বজন-আত্মীয় থাকায় কোনোরকমে টিকে থাকে, কিন্তু দেশের অন্য কোনো শহর থেকে, গ্রাম থেকে আসা একজন শিল্পসাধক তরুণ বা তরুণীর লড়াইটা কেমন? কখনো এসব আমরা তলিয়ে দেখি না…

‘আহত ফুলের গল্প’ ছবির পোস্টার।

এই শহরে দেশের দূর অঞ্চল থেকে আসা কোনো তরুণের শিল্পসাধনা ভীষণ কঠিন এক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শহীদ হতে দেখেছি বহু মানুষকে। কিন্তু যুদ্ধে বিজয়ী যে একেবারেই নেই, তা-ও নয়…তবে শিল্পপ্রেমী চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠার লড়াইয়ে সফল হতে খুব বেশি মানুষকে দেখিনি…অন্তু আজাদ তাই সকলের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম হোক… যেভাবে তিনি নিজের চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন, যেভাবে তিনি নিজের গ্রামে-শহরে নিজের চলচ্চিত্রের বিপণনের দায় নিলেন, তা ছোট কাজ নয়…এ অনেক বড় কাজ। অনেক বড় চলচ্চিত্র প্রেমের উদাহরণ। অন্তু আজাদ একজন সৎ চলচ্চিত্রকর্মী। তিনি তাঁর এই সৎ এবং সুন্দরের লড়াইয়ে অবশ্যই সফল হবেন।

এই ছোট ছোট সাফল্যের গল্পগুলোর ভেতরে আমাদের লড়াইয়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হবে। তা থেকে হয়তো কোনো একদিন কোনো চলচ্চিত্র আন্দোলন দানা বাঁধবে। কে জানে? হয়তো আমরা বাংলাদেশে স্বাধীন চলচ্চিত্রের কাঙ্ক্ষিত রূপ দেখতে পাব। অনেকে ভাবেন, স্বাধীন চলচ্চিত্র মানে হলো পুঁজির স্বাধীনতা। অথবা ভাবেন সিনেমা হলমুখী না হয়ে চলচ্চিত্রের বাজার খোঁজাটা স্বাধীনতা। আবার অনেকে ভাবেন, স্বাধীন চলচ্চিত্র মানে হলো আশির দশকের বিকল্প ছবির আন্দোলন। আসলে এগুলো সবই হয়তো ঠিক। আবার কোনোটাই ঠিক পুরোটা নয়। আমি মনে করি, স্বাধীন চলচ্চিত্রকার হলেন একধরনের মনোভাব পোষণকারী ব্যক্তি, যিনি চিন্তায় এবং মননে স্বাধীন। যিনি নিজস্বতা জারি রেখে চলচ্চিত্র করেন এবং কারও সাথে কোনো আপস করেন না। আপসহীন মনোভাবই স্বাধীন চলচ্চিত্রকারের স্বরূপ। আর এই রূপ খুব কঠিন একটি বিষয়। বাস্তবে আপসহীন মানুষ একটা ধারণা কেবল। কারণ আমাদের রাষ্ট্র এবং যে পুঁজিময় সমাজে আমরা বসবাস করি, সেখানে আপস খুব নিত্য বিষয়। আপস করি না, এমন কথা যত সহজে বলা যায়, ঠিক ততটা সহজ নয়। নিজের অগোচরে মানুষ প্রতি মুহূর্তে আপস করতে থাকে।

আমি মনে করি, স্বাধীন চলচ্চিত্রকার হলেন একধরনের মনোভাব পোষণকারী ব্যক্তি, যিনি চিন্তায় এবং মননে স্বাধীন। যিনি নিজস্বতা জারি রেখে চলচ্চিত্র করেন এবং কারও সাথে কোনো আপস করেন না। আপসহীন মনোভাবই স্বাধীন চলচ্চিত্রকারের স্বরূপ। আর এই রূপ খুব কঠিন একটি বিষয়। বাস্তবে আপসহীন মানুষ একটা ধারণা কেবল। কারণ আমাদের রাষ্ট্র এবং যে পুঁজিময় সমাজে আমরা বসবাস করি, সেখানে আপস খুব নিত্য বিষয়।

কোনো চলচ্চিত্রকার যদি ভাবেন এফডিসি ঘরানার বাইরে থেকে নিজস্ব পুঁজিতে এমন গল্প বলব, যেখানে কেবল তাঁর মনোভাব প্রকাশিত হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা যদি তাঁর চলচ্চিত্রে আমাদের বাজারচলতি সব উপকরণ হাজির দেখতে পাই, তবে তাকে স্বাধীন চলচ্চিত্রকার বলা যায় না। স্বাধীন চলচ্চিত্র এমন একটি স্বয়ং অস্তিত্ব যে তা যেকোনো প্রিজম দিয়েই দেখা যাক, তাতে একটি নিজস্ব অবস্থান খুঁজে পাওয়া যাবে। কারও মতো নয়। স্বাধীন চলচ্চিত্র নিজের মতো হয়। সেভাবে বলতে গেলে আমরা স্বাধীন চলচ্চিত্রের আকাঙ্ক্ষা জারি রাখতে পারি। কিন্তু নিশ্চিত করে বলা মুশকিল যে আমরা স্বাধীন চলচ্চিত্র পেয়ে গেছি।

‘আহত ফুলের গল্প’ ছবির একটি দৃশ্য।

আশির দশকের বিকল্প চলচ্চিত্র আর এখন নেই। বিকল্প চলচ্চিত্রের আন্দোলনও এখন জারি আছে এমনটা বলতে পারি না।  কোনো একটি চলচ্চিত্রকে বিকল্প বলার ক্ষেত্রে বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের যেসব শর্ত ছিল তা আজ বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের চলচ্চিত্রে খুঁজে পাওয়া প্রায় কঠিন হয়ে পড়েছে। আর সময় এখন বিকল্প চলচ্চিত্রের নয়ও। সময় এখন স্বাধীন চলচ্চিত্রের। আর সেই স্বাধীন চলচ্চিত্রের পথের যাত্রা হয়ত রাজধানী থেকে শুরু না-ও হতে পারে।  এই যাত্রা দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকেই হতে পারে।  কারণ, রাজধানী যতটা স্বাধীন ভোগে ঠিক ততটা পরাধীন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের জাঁতাকলে। তাই স্বাধীন চলচ্চিত্রের যাত্রা এবং যাত্রার জন্য উপযুক্ত মননের মানুষ রাজধানী না-ও পাওয়া যেতে পারে। হয়তো এই পথ কোনো এক গ্রামে রচিত হচ্ছে রোজ…হয়তো কোনো এক গ্রামের টঙ দোকানে আজ স্বাধীন একজন চলচ্চিত্রকার পুরো বিকেল আড্ডায় খুঁজে চলেছেন তাঁর চিন্তা প্রকাশের যথাযথ দৃশ্যমালা। আমরা আশা রাখছি আমাদের সমগ্র বাংলাদেশে। চলচ্চিত্র আর কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক কোনো শিল্পতৎপরতা নয়।  আমাদের আনন্দের গল্প এটাই!

ফিরে আসি চলচ্চিত্রকার অন্তু আজাদের গল্পে।  অন্তু আজাদের চলচ্চিত্র ‘আহত ফুলের গল্প’-এর অনেক অভিনয়শিল্পী এবং কলাকুশলী আমাদের খুব নিকটজন। সবাই খুব ভালোবেসে কাজ করেছেন…তাঁরা একটি মহত্তম চলচ্চিত্রের জন্ম দিয়েছেন, এমনটা আমি বলছি না, কিন্তু তাঁরা চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁদের ভালোবাসার জন্য কাজ করেছেন। অনেক মানুষ নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে বলেই আজও বাংলাদেশে ভালো চলচ্চিত্রের আশা জাগরিত আছে…চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসাকে তাই আমি খুব মূল্যবান মনে করি…আর এই ভালোবাসার কদর করি…

আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা অন্তু আজাদের সাফল্য কামনা করছি। আশা করি ‘আহত ফুলের গল্প’ মানুষের ভালোবাসা এবং কদর পাবে। সকলের কল্যাণ হোক… চলচ্চিত্রের জয় হোক!

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.