একথা সেকথা
উন্মেষ সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ
উন্মেষ সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ। বাম ঘরানার (চীনপন্থী) একটি সংগঠন। সপ্তাহে একদিন, সাপ্তাহিক ছুটির দিনের আগের সন্ধ্যায়, বসতো তার সাহিত্য আসর। এটি আগে-পরে অন্যত্রও অনুষ্ঠিত হয়েছে, তবে আমি ৮২ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছর নিয়মিত ও পরে অনিয়মিত যেতাম, সবটাই পেয়েছি উয়ারীতে– বলধা উদ্যানের কাছে : প্রথমে হরপ্পা নামের একটি প্রেসে, যার মালিক ছিলেন মহসিন শস্ত্রপাণি এবং অতঃপর একটি দপ্তরে, সম্ভবত কোনো বিজ্ঞাপনী সংস্থা, কবি সমুদ্র গুপ্তের অনুজ তরঙ্গ গুপ্ত ছিলেন যার অধিপতি।
এই আসরে প্রথমবার যাই কবি পল্টু বাসারের সাথে। এখানে গিয়ে কতজনের সাথেই না পরিচয় হয়েছিল। মহসিন শস্ত্রপাণি, সমুদ্র গুপ্ত, মুনীর সিরাজ, মতিন বৈরাগী, কাজি মনজুর– এরা তখন উন্মেষের কর্তা ও প্রধান সাহিত্যিক। আরও আগে থেকেই তাদের রচনার সাথে পরিচিত হয়েছি সাপ্তাহিক বিচিত্রার মাধ্যমে, প্রগতিশীল ধারার কবি-লেখক হিশেবে তাদের নাম জেনেছি কোনো-কোনো প্রবন্ধের মাধ্যমে। আবৃত্তিশিল্পী কামরুল হাসান মঞ্জুকে প্রথম দেখি এখানেই, একটি গল্প লিখেছিলেন তিনি (হয়তো আরও লিখে থাকবেন, ঠিক জানি না), পড়েছিলেন এই সভায়। আবদুল মান্নান ভাই (সেই বয়স্ক শিশু), রমেন্দ্রনাথ দাদা (অমায়িক নিষ্পাপ ধরনের মানুষটি, নামটি ঠিক লিখেছি তো!), অমিত হাবিব (এখন সাংবাদিক, তখন কবিতা লিখতেন), রমেশ শীল, বৈকুণ্ঠবিহারী রায়, সালাদিন আহমেদ, শফিকুল (এখন আমেরিকায় থাকেন), আসরার মাসুদ, সাজ্জাদ কবির…আরও কত জনা। সাহিত্যিক ছাড়াও কোনো-কোনো ব্যক্তিত্ব– যেমন, রাজনীতিক নূরুল হুদা মির্জা, আবৃত্তিশিল্পী তারিক সালাউদ্দীন মাহমুদ– এমন কেউ-কেউ অতিথি হয়ে আসতেন।
সাহিত্য সভাটি হতো বেশ উত্তেজনামদির। লেখাপাঠ হলে চা-পর্ব, তারপর সবাই পঠিত লেখাগুলোর ওপর আলোচনা করতেন। অনেক লেখা হতো বেশ সমাজ-রাজনীতিপ্রবণ, কিন্তু প্রকরণগত দিক দিয়ে দুর্বল। ওদিক থেকে কাজী মনজুর এবং এদিক থেকে আমি এ-বিষয়ে চাঁছাছোলা কথা বলতাম। ওদিক-এদিকের ব্যাখ্যা হলো, কাজি মনজুর তো বাম ঘরানারই মানুষ, কিন্তু আমি ততদিনে মার্কসপন্থী ভাবাদর্শের ঘোর কাটিয়ে আধুনিকবাদী হয়ে উঠেছি– তিরিশের ঘরানা, বিশেষতঃ বুদ্ধদেব-সুধীন্দ্রনাথের ইসকুলেই আমার তখন অন্তর্ভুক্তি, বলা যায়।
তবুও, এই সভার সদস্যদের সাথে কেমন এক আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল। সমুদ্র দা তো কবেই চলে গেছেন (আরও কেউ-কেউ, যেমন মান্নান ভাই)। অন্যদের সাথে যোগাযোগ প্রায় নাই, বা কারো-কারো সাথে নামকা ওয়াস্তে। ফেসবুকে এসে কয়েকজনকে পেয়েছি, মিথষ্ক্রিয়া কম হলেও। মাঝে মাঝে মনে পড়ে : সবুজবাগ হতে বিকালে হেঁটে হেঁটে উয়ারীতে যাওয়া, তুমুল আড্ডা, মধ্যবর্তী চা-টা, তারপর আড্ডা শেষে রাতের বেলা আবার বাসায় ফেরা। একটা নেশার মতো ছিল ব্যাপারটা।