

কতিপয় প্রশ্নের সঙ্গে সেলিম মোরশেদ
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য: আপনার গল্প লেখার প্রক্রিয়াটা বলেন। একটা প্লট নিয়ে কদিন ভাবেন? নাকি মাথায় এলেই এক বসাতে লিখে ফেলেন, পরে এডিট করেন?
সেলিম মোরশেদ: প্লট থেকে আখ্যান এবং বিন্যাস—এই প্রক্রিয়াটা কয়েকরকম। কখনো কাহিনি সূত্র থেকে তৈরি হয়। কখনো বিচ্ছিন্ন কিছু বিষয় থেকে গল্পটা চলতে শুরু করে। সাধারণত নিটোল গল্প আমি লিখতে চাই না। প্রথমে কিছু অংশ এক সিটিংয়ে লিখি। পরে এডিট করি।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য: ফিকশনে স্থান আর কালের গুরুত্ব কী? অনেকে মনে করেন এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার মনে হয় মহাশূন্যেও যেকোনো সময় একটা গল্প আবর্তিত হতে পারে, মানে গল্পটা আবর্তিত হতে পারে কেবল চরিত্রকে ঘিরে, পরিবেশ আর সময় বর্ণনা না করলেও গল্প হতে পারে। আপনার কী মনে হয়?
সেলিম মোরশেদ: হ্যাঁ, আপনার কথাটাও সত্য। টাইম এন্ড স্পেসের বিষয়টা নিয়ে অনেক আগে থেকেই আমরাও ভেবেছি। টাইম-সেন্স একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্থান, কাল এবং সময়ের সঠিক বিন্যাস; আবার টাইমকে ভেঙে দিয়েও গল্প আবর্তিত হয়। বিন্যাস এবং এই বিন্যাস ভাঙা— এই দুটো মিলিয়েই আজকের নতুন গল্প। চরিত্রপ্রধান গল্পকে আমি বেশি গুরুত্ব দেই। তবে আবহ দিয়ে ঘটনাপ্রধান গল্প খানিকটা পুরাতন।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য: একটা ফিকশন আউটস্ট্যান্ডিং হতে গেলে তার কী কী উপাদান লাগে?
সেলিম মোরশেদ: ফিকশন আজ বহু ধরনের। বরং একটা ফিকশন থেকে পাঠক যদি নিজে কিছু আবিষ্কার করেন, লেখকের জন্য সেটা কিন্তু প্রাপ্তি।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য: অনেকে মনে করেন কবিদের লেখা ফিকশন ঠিক হয়ে ওঠে না, কারণ তাতে কবিতা বাহুল্য রূপে ঢুকে পড়ে। এই বিষয়ে আপনার মত কী? বোর্হেস বা ওক্টাভিও পাজ বা আমাদের কাজল শাহনেওয়াজের গল্প সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
সেলিম মোরশেদ: অংশত সত্য। তবে যাঁদের নাম আপনি বললেন তাঁদের লেখায় আমার তা মনে হয়নি। এমনকি জয় গোস্বামীর উপন্যাসেও নয়। বাংলাদেশের কবিরা খুব ভালো গদ্য লেখেন। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের নামটি আপনি বলেননি। তার ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’, কবিদের লেখার ভেতর এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বই।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য: হ্যাঁ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ আর জয় গোস্বামীর ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ এই দুটো আমার প্রিয় বই। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, এইবার অন্যকথায় যাই, আমি মনে করি, একটা গল্পে কাহিনিটা ঠিকঠাক বলতে পারলেই বাকি সব বলা হয়ে যায়। কিন্তু অনেক গল্পকারকে দেখি এর বাইরেও তাঁর মতামত, চিন্তা, দর্শন, আদর্শ বা ধর্মমত সংলাপে, ন্যারেটিভে ফাঁকফোকড় করে দু–এক লাইন করে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। এটার দরকার কি আদৌ আছে?
সেলিম মোরশেদ: একসময় কাহিনিভিত্তিক গল্প আমি নিজেও লিখেছি। এখন এই ধারাটা কেন জানি জরুরি মনে হয় না। আমাদের অজান্তে ‘গল্প’ নামটা কোথায় যেন কথাবস্তু বা কথাসাহিত্যে চলে এসেছে। কথাবস্তুর উপজীব্য অনেক কিছুই হতে পারে। আর বিন্যস্ত হবার দিকগুলো নিয়েই তো নতুন লেখকই ভাবেন। সাহিত্য যদি ‘সহিত’ শব্দ থেকে এসে থাকে তাহলে লেখার বিন্যাসে বহু কিছু ঢুকতে পারে। অভ্যস্ত পাঠকের জন্যে অনেক সময় তা পীড়াদায়ক হয়; অনেক সময় আস্বাদনে পাঠক আনন্দিত হয়। ভিন্ন ধারা যদি না থাকে, একসময় অভ্যস্ত পাঠকও তো বিরক্ত হয়ে উঠবেন।
আমাদের অজান্তে ‘গল্প’ নামটা কোথায় যেন কথাবস্তু বা কথাসাহিত্যে চলে এসেছে। কথাবস্তুর উপজীব্য অনেক কিছুই হতে পারে। আর বিন্যস্ত হবার দিকগুলো নিয়েই তো নতুন লেখকই ভাবেন। সাহিত্য যদি ‘সহিত’ শব্দ থেকে এসে থাকে তাহলে লেখার বিন্যাসে বহু কিছু ঢুকতে পারে।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য: গল্প লিখে বই প্রকাশ তো পাঠকের জন্যেই করা হয়। তাহলে ‘ফিনেগানস ওয়েকস’–টাইপের এক্সপেরিমেন্টের দরকার কী?
সেলিম মোরশেদ: এটা বলা মুশকিল।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য: আচ্ছা। গল্পের গতি কেমন করে তৈরি হয়? অনেকের গল্প আমি ব্যক্তিগতভাবে এক টানে পড়তে পারি না, একটু পর পর থেমে যেতে হয়। এটা কেন হয়? এটা কি আমার অক্ষমতা, নাকি লেখকের?
সেলিম মোরশেদ: পাঠক-লেখকের টানাপড়েন থাকবেই। আপনার মতো বিদগ্ধ পাঠকের এ প্রশ্নটা প্রতিটা লেখকের মাথায় থাকা উচিত। আমি নিজেও ভাবব। তবে সাধারণত যাঁরা এ কথাগুলো বলেন; এ বিষয়টি নিয়ে ‘লোক’ ২০ বছর পূর্তিতে আমি কয়েকটা লাইন লিখেছিলাম। সেগুলো তুলে ধরছি।
‘ভাষা একটা জাতির, একটা ভূখণ্ডের হাজার বছরের ঐতিহ্য। উন্নত সত্তার বিধিলিপি। আরো যে ভাষার বর্ণমালায় ছুঁয়ে আছে রক্তের আস্থা। লেখককে পাঠকের কাছে ফেভারিট বানিয়ে নামানো এ কেমন কথা! পাঠকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক শুধু মন ছোঁয়া-হৃদয়ের না, চেতনারও। পাঠক-লেখক সম্পর্ক সবসময় প্রিয়তার না-ও হতে পারে। গ্রহণ-বর্জনে লেখক পাঠক যখন পরস্পরের প্রতিপক্ষ; ক্যাপটিভিটি, টাচি, ক্যাচি— এইসব টার্ম রীতিমতো অভিসন্ধিমূলক। এভাবে পুঁজিসর্বস্ব মিডিয়া পাঠককে অভ্যস্ত করে জিম্মি করে।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য: বুঝতে পেরেছি। আমি অবশ্য গতি বলতে জনপ্রিয়ধারার লেখার যে গতি তা বলিনি, বলেছি লেখার উৎকর্ষের জায়গা থেকে। যেমন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের অনেক ফিকশনই একটানে পড়া যায়, ‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’-এর কথা বলতে পারি কিংবা গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখা, ধরেন ‘মেমরিজ অব মাই মেলানকলি হোর্স’ বা ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’। আচ্ছা, এইবার অন্যপ্রশ্নে যাই, বাঙলাদেশি কনটেম্পরারি ফিকশনের ভবিষ্যৎ কী?
সেলিম মোরশেদ: বিশ্বসাহিত্যের প্রতিতুলনায় আসবে।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য: আপনি একেবারেই তরুণদের লেখা গল্প পড়েন? যদি পড়েন তাহলে তাদের উদ্দেশে কী বলবেন?
সেলিম মোরশেদ: তাঁরা ভালো লেখেন। যথেষ্ট দক্ষ ভাষায়, ঘটনাপ্রধান গল্পই আমি বেশি পড়েছি তাঁদের। বিবরণী ভালো। কিন্তু যাঁদের নিয়ে তাঁরা লিখছেন, আমি শুধু তাঁদের বিষয়ে বলছি; তাঁদের সত্তা অর্থাৎ চরিত্রগুলোর ভেতর থেকে নানামুখী দিক ঠিক বের হয়ে আসে না। অর্থাৎ সত্যিকারের একজন লেখকের এখনও এই বিষয়টি কাজ দেয় যে তাঁর লেখায় চরিত্রের ভেতর থেকে সত্তাটা বের হয়ে আসুক। বাংলাসাহিত্যের কেন বিশ্বসাহিত্যে যতগুলো ধারা আছে, ঘটনাপ্রধান, ইতিহাস-প্রধান, তার ভেতরে বোধহয় চরিত্রপ্রধান লেখাগুলোই মানুষের এবং সেই লেখকের প্রচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রমাণ দেয়।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য: চরিত্রের ভেতর থেকে সত্তাটা বের হয়ে আসুক, এটা ভালো বলেছেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সময় দেয়ার জন্যে।

আরো পড়তে পারেন

