:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মোশতাক আহমদ

কবি, গদ্যকার

‘কথাযন্ত্রী’কে নিয়ে পুরাঘটিত বর্তমান
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

অক্ষরবন্দী জীবন-১৪

‘কথাযন্ত্রী’কে নিয়ে পুরাঘটিত বর্তমান

যিনি আমাকে বলতেন, “রেল লাইন দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় মোশতাক, হাঃ হাঃ হাঃ”; তিনি আর নাই- জীবনের শেষ রেল ভ্রমণে তিনি মৃত্যু পরোয়ানা হাতে করে ছুটছিলেন।

ছিয়াশি সালে চট্টগ্রাম গেলাম উচ্চ শিক্ষার জন্যে; চট্টেশ্বরী রোডের হোস্টেলে বড় ভাইদের খালি করে দেয়া রুমে উঠে উত্তরাধিকারসুত্রে পাওয়া পুরনো বুকসেলফে পেলাম দু’খানা বার্ষিকী আর ক্যাম্পাসে প্রকাশিত দু’খানা নান্দনিক ভাঁজপত্র (‘নিবেদিত পঙক্তিমালা’) – একটি কবি হারিসুল হকের, আরেকটি কবি কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের। জাহাঙ্গীর ভাই, বাসু ভাই আর শাহাদুজ্জামান মুন্না ভাই তখন ছাত্রজীবন শেষ করে শিক্ষানবিশী শুরু করেছেন। সেই সময় থেকেই বাসু ভাই আর মুন্না ভাইয়ের সান্নিধ্যে এসেছি, যোগাযোগ রয়ে গেছে; কিন্তু জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে যোগাযোগটাই শুরু হল পঁচিশ বছর পর- ২০১১ থেকে! হায়, দূর থেকে তাঁকে পড়ে যাওয়াটাই বোধ হয় ভাল ছিল। আমি তাঁর লেখা অনেক পড়ি নাই তবে সাহিত্য নিয়ে তাঁর সত্যবদ্ধতায় মুগ্ধ সদাই, বিশেষ করে যারা পেশাগত জীবনে প্রবলভাবে জড়িয়ে গিয়ে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের মতো নিবিস্টভাবে লেখালেখি করতে পারেন না, তাদের আড্ডায় জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাজ সম্পর্কে এই রকমের সমীহ রয়েছে।

জাহাঙ্গীর ভাই ছিলেন শাহাদুজ্জামান ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, দুজনেই কথাসাহিত্যিক। (‘কথা’র একটি সংখ্যায় দু’বন্ধুর মনোমুগ্ধকর আড্ডা পত্রস্থ হয়েছিল)। এবারের একুশের বইমেলায় তাঁর সাথে আলাপে তাঁদের আরেক বন্ধু, যিনি একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, তাঁর কথা উঠতেই অট্টহাসি হেসে জাহাঙ্গীর ভাই বললেন, “জানো, ও আমাকে বলে কিনা, জাহাঙ্গীর, তুই নাকি কথাযন্ত্রী না কী যেন হইছিস?” তাঁর পরেই বললেন, “আমার কিন্তু এই উপাধিটা খুব পছন্দ হইছে; কথাশিল্পীর চেয়ে কথাযন্ত্রী আরো পাওয়ারফুল শব্দ!”

মেলায় এলেন ১১ তারিখে, সেদিন সময় মেলাতে পারিনি। একুশের আগে আর একবার এলেন চাটগাঁ থেকে সপারিষদ, তখন দেখা হল, দীর্ঘ সময় একসাথে কাটালাম, কফি খেলাম কবি ও শিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্যসহ। তাঁর সফরসঙ্গী আলী প্রয়াস, ফজলুল কবিরী, প্রান্ত পলাশ, আহমদ জসিম প্রমূখ সাথে এল না কেননা তারা তখন সামাজিকতায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল লিটল ম্যাগ চত্বরে। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ভাইও সেবারের বইমেলায়, যতটুকু দেখেছি, দেখা সাক্ষাৎ আর কুশল বিনিময়ের চূড়ান্ত করে গেছেন।

প্রথম দেখা হতেই তিনি জোনাকির স্টল খুঁজছেন বললেন, তাঁর ছোটগল্পের বইটার (জয় বাংলা ও অন্যান্য গল্প) খোঁজ জানাটা জরুরি। আমি ভুল করে নিয়ে গেলাম ঝিনুকের স্টলে। বিরক্ত না হয়ে উনি হাসলেন। আমার সাথে সপারিষদ গেলেন পাঠসূত্রের স্টলে। আমি তাঁর হাতে আমার নতুন প্রকাশিত বইটি দিয়ে ছবির জন্যে পোজ দিতে বললাম। ছেলেমানুষের মতো হেসে আবদারটা রাখতে রাজি হলেন। সেদিন তিনি ‘কমলনামা’র কপিগুলো হাতে পেয়েছিলেন বলেই বুঝি একটু বেশি উদার ছিলেন। অবশ্য আমার সাথে সামনাসামনি দেখা সেই প্রথম; হয়তো তিনি আরো উদার, আরো সরল মনের একজন মানুষ ছিলেন। সেদিন মেলায় ফোনের নেটওয়ার্ক খুব খারাপ ছিল, ফোন জ্যাম হয়েই ছিল বলা যায়। আমাদের ইচ্ছে ছিল শাহাদুজ্জামান ভাইয়ের সাথে একসাথে কিছুক্ষণ কাটানোর; কিন্তু তিনি মাওলা ব্রাদার্সের পাশে টিভি সাক্ষাৎকারে ব্যস্ত থাকায় জাহাঙ্গীর ভাই মাইনুল শহীদের সাথে দেখা করে আবার আসবেন বললেন; আমিও দুয়েকটা বই খুঁজে আবারও আসব বলে বিচ্ছিন্ন হলাম। আমি যথারীতি ফিরে এসে শাহাদুজ্জামান ভাইকে পেয়ে গেলাম। কিন্তু ফোনে আর জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করা গেল না। মেলা শেষের আগের দিন আবার দেখা হয়েছিল। আমার হাতে কিছু বই দেখে সেগুলোর নাম ধাম জেনে নিলেন। জেনে নিলেন আমার পারিবারিক কুশলাদি। সব সময় যেটা বলেন- চট্টগ্রাম গেলে যেন দেখা করি- শেষ কথাটিও ছিল তাই।

জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে যোগাযোগটাই শুরু হল পঁচিশ বছর পর- ২০১১ থেকে! হায়, দূর থেকে তাঁকে পড়ে যাওয়াটাই বোধ হয় ভাল ছিল। আমি তাঁর লেখা অনেক পড়ি নাই তবে সাহিত্য নিয়ে তাঁর সত্যবদ্ধতায় মুগ্ধ সদাই, বিশেষ করে যারা পেশাগত জীবনে প্রবলভাবে জড়িয়ে গিয়ে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের মতো নিবিস্টভাবে লেখালেখি করতে পারেন না, তাদের আড্ডায় জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাজ সম্পর্কে এই রকমের সমীহ রয়েছে।

২০১১-১২  তে আমি কক্সবাজারে ছিলাম চাকুরিসূত্রে। তখন তাঁর সাথে যোগাযোগের পর তাঁর সম্পাদিত ‘কথা’র কয়েকটি কপি কক্সবাজারের বন্ধুদেরকে দিয়েছিলাম। স্থানীয় কাগজের জন্যে  তিনি পাঠিয়েছিলেন আহমদ ছফাকে নিয়ে একটা গদ্য। ‘কথা’র শেষ সংখ্যাটি জানুয়ারিতেই সংগ্রহ করেছিলাম ঢাকা থেকে। মেলায় আমাকে আরেকটা কপি সেধেছিলেন। আহা, নিলে ভাল করতাম, একটা স্বাক্ষরসহ নিতে পারতাম। কমলকুমারকে নিয়ে সাজানো সংখ্যাটি পরে কমলপুরাণের লেখক রফিক কায়সার স্যার আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছেন।

জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে তাঁর ‘পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী’ খুঁজে পড়তে বলেছিলেন; কেননা একদিন কথায় কথায় দৌলতদিয়া পতিতালয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাপ্তাহিক মেডিকেল টিমের সাথে ‘৯৭- ‘৯৮ তে অনেকদিন কাজ করেছি সে কথা জানতে পেরেছিলেন। ওনার সাথে আমার ২০১১-১৩ তে ফেসবুকে অনেক কথা হত। যাহোক, বইটা হাতের কাছে পাইনি। শেষ উপন্যাস ‘হৃদমাজার’ পড়তে পড়তে জানিয়েছিলাম তাঁকে; বলেছিলেন পড়া শেষ হলে জানাতে। আমার আসলে পড়া শেষ হয়নি তাই আর জানানোও হয়নি। তবে জাহাঙ্গীর ভাই সম্পাদিত কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ ‘কথা’র বেশ কয়েকটা সংখ্যা দেখেছি, কথাসাহিত্য নিয়ে তাঁর যেনবা জানবাজি ছিল, আন্তরিকভাবে সম্পাদনা করে গেছেন নিরলসভাবে। আমার এবারের কবিতার বইটি নিয়ে সময় করে লিখবেন বলেছিলেন; কিন্তু সে সময় তিনি আর পেলেন না। কিন্তু আহমেদ শরীফ শুভ ভাই ফেসবুকে আমার ‘ভেবেছিলাম চড়ুইভাতি’ নিয়ে যে আলোচনাটি করেছেন, সেখানে একটি প্যারাগ্রাফে লেখকের সাথে তর্কের ছলে চমৎকার করে পাঠ প্রতিক্রিয়া দিয়ে গেছেন-

আমি তো দেখছি, মোশতাক বিনির্মাণের পক্ষের মানুষ। নিজের বিষয়ে তীব্র বিকল্প-বাসনা তার আছে। কবিতার মানুষই সে। ছন্দজ্ঞান তার প্রবল। টানা গদ্যের কবিতার ভিতরও ছন্দ প্রবহমান।

না, আমি  (ওর কবিতায়) জীবনানন্দ পাইনি। বরং সে সঙ্গ-আনন্দের কবি। উৎপল কখনও কখনও আসে বলে মনে হয়েছে। তাও মোশতাকের আল্লাই ভালো বলতে পারবে হাহাহা।

তবে বিষণ্নতাকে, আরও বেশি করে বললে, নিজের ব্যক্তিত্ব ভেঙে দেখার বাসনা তার আছে। যতিচিহ্নের এক্সপেরিমেন্ট পুরো কাব্যে করলে বরং যুতসই লাগত (আমার সে বইয়ের অধিকাংশ কবিতায় কোনো যতিচিহ্ন ছিল না)

তবে তার কাব্যে খটখটে কিছু আরোপিত তথা শিক্ষিত-করণ ধাঁচের ভারী শব্দ আছে, তা আমায় পাঠ-বিড়ম্বনার কারণ হয়েছে।

এই ক’টা লাইন আমার জন্যে মুক্তোর মতো ঐশ্বর্য।  মেলায় এসেও বলেছেন, “তুমি কবিতার ভেতরে বসবাস করো এতে সন্দেহ নাই; কিন্তু তোমার কবিতায় হঠাৎ করে ভারি শব্দ বা গদ্য এসে যায়। এটা কী উৎপলীয় নাকি বিনয়ী প্রভাব?” আমি সবিনয়ে বলেছিলাম, “এটা আসলে রফিক আজাদীয়! কিন্তু এখন এটা আমারই একটা ঘরানা ধরে নিন।” আমার ছোট গল্প পড়েছেন কীনা মনে করতে পারলেন না। গল্প পাঠাতে বলেছিলেন, পড়ার জন্য। আমার আর গল্প পাঠানো হবে না। জানুয়ারির শুরুতেও একবার ফোন করে বলেছিলেন  চট্টগ্রামে আসতে। আমি হয়তোবা বেঁচে থাকলে আরও চাটগাঁ যাব, কিন্তু তিনি থাকবেন না সস্নেহে ডেকে নেয়ার জন্যে। এইভাবে, আহমাদ মোস্তফা কামাল ধার করে বলি, “একদিন সবকিছু গল্প হয়ে যায়”। বসন্তের এই এলোমেলো মাতাল হাওয়ায় ভেসে আসছে রবি ঠাকুরের গান-

“আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো।

সে চলে গেল, বলে গেল না-
সে কোথায় গেল ফিরে এল না।

সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে,
চাঁদের আলোর দেশে গেছে ”

 

বি. দ্র.

  • ১ –  ‘কথাশিল্পী’ কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে  তাঁর বন্ধু শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাকসুদুল আলম বাসু ভুল করে ‘কথাযন্ত্রী’ ডেকেছিলেন; সেই ভুলটাই শিরোনামে ধারণ করেছি।
  • ২ – কিছু কিছু স্মৃতি এতটাই জীবন্ত যে তা আমার কাছে অতীতকাল নয় কোনোক্রমেই; আমি এইসব স্মৃতিকে ‘পুরাঘটিত বর্তমান’ অভিধা দিতে চাই।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!