কবিতার ঘর ও বাহির
অক্ষরবন্দী জীবন : বই ধার দিও না এর পর থেকে-
তখন কলেজে উঠেছি, বাসা মনিপুরী পাড়ায়। কবিতা লিখি, মানে যথেষ্ট পরিমাণেই লিখছি তখন। আমার ছোট ভাই রুমিকে বাসায় এসে পড়াতেন আমাদের কলেজেরই দুবছরের সিনিয়র ভাই– আরিফ ভাই। বড় ভাই একদিন আমাকে ডেকে বললেন, “ছন্দ জানো (‘সাঁতার জানো বাবু?’)?” আমার বোধ হয় এমন শ্লাঘা ছিল যে আমিতো ছড়া লিখি না, রীতিমত গদ্যকবিতা লিখি! তিনি খুব সিরিয়াসলি বললেন, “নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাশ’ বইটা আজকেই কিনে পড়তে শুরু কর। খুব সহজভাবে ছন্দ শিখিয়ে দেবেন তিনি।” সেই সাথে পরস্পর সম্পর্কহীন আরেকটা বইয়ের কথাও বললেন– ম্যাকিয়াভেলির ‘দা প্রিন্স’। সেটাও নিউ মার্কেট থেকে কিনে ফেলেছিলাম কিন্তু অনেকবার নাড়াচাড়া করেও দাঁত বসাতে পারিনি। আরিফ ভাই বলেছিলেন এই বই পড়েই জিয়াউর রহমান প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং রাজনীতির শীর্ষে উঠেছিলেন। আমি পরে এক সময় জেনেছিলাম আরিফ ভাইয়ের বাবা জিয়ার আমলে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সামরিক কর্মকর্তাদের একজন। বড় ভাই এখন সরকারি উচ্চ পদে কাজ করেন বলে শুনেছি। একবার তার শংকরের মেসে গিয়ে উপহার পেয়েছিলাম ‘স্বননে’র একটি কপি।
কবিতার ক্লাশ নিয়ে মশগুল হয়ে থাকলাম বেশ কিছুদিন। বইটা পড়ছি আর অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের খেলা খেলি, মূলত অক্ষরবৃত্ত। এ সময় শামসুর রাহমানীয় ঘরানায় প্রচুর কবিতা লিখে পঁচাশি সালের হারুন ডায়েরি ভরে ফেলেছি, কেননা নীরেন চক্রবর্তী পাঠের সাথে রাহমান চর্চার কোনও বিরোধ ছিল না বরং ছিল ঘৃতাহুতি!
কবিতা লিখতে গেলে ছন্দ আয়ত্ত করা প্রয়োজন; প্রয়োজন মাফিক তা ব্যবহার করা যেতে পারে আবার নাও করা যেতে পারে। আবার কোন কোন কবিতাভাষ্য নির্দিষ্ট কোনও ছন্দকেই ডিমান্ড করে, অর্থাৎ বিষয়বস্তুই ফর্মকে চায়। অশিক্ষিত পটুত্ব হলে এই চাহিদা কিভাবে মেটাবেন কবি! তবে ছন্দের দোলায় বেশি দুলুনি হলে কখনো সখনো বক্তব্য প্রধান কবিতার বক্তব্য যায় হারিয়ে; পাঠক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে রেলযাত্রীর মতো।
একে একে শঙ্খ ঘোষের ‘ছন্দের বারান্দা’, নীরেন্দ্রনাথের ‘কবিতার কী ও কেন’, সুভাষ মুখার্জির ‘কবিতার বোঝাপড়া’, পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কবিতার ঘর ও বাহির’ ইত্যাদি বইগুলো পড়তে থাকি। ‘কবিতার ঘর ও বাহির’ বইতে বিশ্বকবিতার দিকপাল আর ব্যতিক্রমী প্রতিভাদের জীবনের এনেকডটস জানতে পারি– র্যাঁবো, ভেরলেন, আপলিনের, এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, নেরুদা থেকে শুরু করে তরু দত্ত কিংবা বুদ্ধদেব বসু। “মৃত্যুর আগের দিন পড়ন্ত আলোর দিকে তাকিয়ে কী ভেবেছিল সুকান্ত”– অরুণ মিত্রের এই মর্মান্তিক প্রশ্ন নিয়েও আছে বিশদ কথা।
এর পরে আরো কবিতা বিষয়ক বই খুঁজি। একে একে শঙ্খ ঘোষের ‘ছন্দের বারান্দা’, নীরেন্দ্রনাথের ‘কবিতার কী ও কেন’, সুভাষ মুখার্জির ‘কবিতার বোঝাপড়া’, পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কবিতার ঘর ও বাহির’ ইত্যাদি বইগুলো পড়তে থাকি। ‘কবিতার ঘর ও বাহির’ বইতে বিশ্বকবিতার দিকপাল আর ব্যতিক্রমী প্রতিভাদের জীবনের এনেকডটস জানতে পারি– র্যাঁবো, ভেরলেন, আপলিনের, এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, নেরুদা থেকে শুরু করে তরু দত্ত কিংবা বুদ্ধদেব বসু। “মৃত্যুর আগের দিন পড়ন্ত আলোর দিকে তাকিয়ে কী ভেবেছিল সুকান্ত”– অরুণ মিত্রের এই মর্মান্তিক প্রশ্ন নিয়েও আছে বিশদ কথা। এই বইতে পেয়েছি কবিতা সম্পর্কে নেরুদার ভাবনা, কীটসের প্রেম, মায়াকোভস্কির উন্মাদনাপূর্ণ জীবনযাপন, ফ্রস্টের সাথে এজরা পাউন্ডের দেখা, রদাঁ–রিলকে সমাচার, র্যাঁবো আর ভেরলেনের পাগলামিপূর্ণ বন্ধুত্ব, আপলীনরের ক্যালাইডোস্কোপের মত বিচিত্র জীবন; এ সব পড়তে পড়তে পৃথিবীর বড় বড় কবিরা খুব আপন হয়ে গেলেন।
ষাটের দশকে ‘কবিতা পরিচয়’ নামে অমরেন্দ্র চক্রবর্তী একটা পত্রিকা বের করতেন– প্রতি সংখ্যায় কয়েকটি কবিতা নিয়ে কয়েকজন আলোচনা করতেন। পরের সংখ্যায় নতুন কবিতা ও আলোচনার পাশাপাশি আগের সংখ্যার আলোচনাগুলোরও ব্যবচ্ছেদ হত। জীবনানন্দ দাশের ‘গোধুলিসন্ধির নৃত্য’ কবিতাটি নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আলোচনার প্রেক্ষিতে পরের সংখ্যায় নরেশ গুহ সুনীলকে এমনভেবে ধুয়ে দিলেন যেনবা সুনীল জীবনানন্দের ওই কবিতার আগামাথা কিছুই বুঝেননি। মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায় আর অরুণকুমার সরকারের পরের সংখ্যার সম্পূরক আলোচনায় জটিল এই কবিতাটির কিছু কিছু মানে বুঝতে পেরেছিলাম। এই বইটি চমকপ্রদ, এখনও প্রিয়। এই বইটিতে ২১ কবির ৪২ কবিতার ৭৪ টি আলোচনা আছে! বইটি সংগ্রহ করেছিলাম চট্টগ্রামের কারেন্ট বুক সেন্টার থেকে।
সে সময়ে আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘কথা ও কবিতা’ বইটি হাতে আসে। কবিতার বই বা গদ্যের বই আলোচনার স্টাইলটা শিখতে পারি আর বাংলাদেশের সাহিত্যের ধারাবাহিকতারও একটা ছবি দেখতে পাই এই বইটি থেকে।
কারেন্ট বুক থেকে আরও সংগ্রহ করেছিলাম দীপ্তি ত্রিপাঠির বহুল পরিচিত ‘আধুনিক বাঙলা কাব্য পরিচয়’– যে বইটা কিছুদিন আগ পর্যন্ত অনেক প্রথাগত আলোচক মানদণ্ড ধরে নিয়ে কাব্য আলোচনা করতেন। অবশ্য আমি বেশি প্রভাবিত হয়েছি অশ্রুকুমার শিকদারের ‘আধুনিক কবিতার দিগবলয়’ পড়ে; এই বই পড়ে তিরিশের পঞ্চপাণ্ডবকে চিনতে পারি (জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী)। এদের মধ্যে অমিয় এমনকি বিষ্ণু দেও কাছে টানলেন না; সুধীন্দ্রনাথ আর বুদ্ধদেবের হাফ ডজন করে কবিতা বাঁধাই করে রাখবার মতো বলে মনে হল, আর জীবনানন্দ? তাকে এখনও খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করি; আমার জীবনানন্দকে, ‘কেউ যাহা জানে নাই কোনো এক বাণী’, কবে খুঁজে পাব কে জানে!