:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি, চিত্রশিল্পী

কবিতার বিষয় যা খুশি হতে পারে, টুথপেস্ট অথবা জিওপলিটিক্স: ওমর শামস

কবিতার বিষয় যা খুশি হতে পারে, টুথপেস্ট অথবা জিওপলিটিক্স: ওমর শামস

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য: কবিতার কথায় জীবনানন্দ দাশ যে কল্পনা প্রতিভার কথা বলেছেন তাকে আপনি কীভাবে দেখেন? মানুষ মাত্রই তো কল্পনা করতে পারে। একজন সাধারণ মানুষ আর একজন কবি বা লেখকের কল্পনা করার প্রক্রিয়া কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ওমর শামস: সাধারণ মানুষ অনেক কিছুই কল্পনা করতে পারে কিন্তু তার কল্পনা কবিতা রচনার প্রক্রিয়ায় কাজে লাগে না, সে লাগাতেও পারে না।

চিন্তাশক্তি এবং জীবনের অভিজ্ঞতা থাকলে, কাব্য ঐতিহ্যর আহরণ থাকলে কল্পনা প্রতিভা, অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে কবিতা সৃষ্টি করতে পারে কেউ কেউ। এই প্রতিভা শুধু কবির থাকে, সবার নয়। নিরেট কাব্যবিকীরণেই নয়, কল্পনা নতুন চিন্তাসঙ্গ তৈরি করতে পারে, মনকে ঘুরিয়ে আনতে পারে, ভাবনার প্রতিধ্বনি ঘটাতে পারে—মানে ব্যঞ্জনা তৈরি করতে পারে। চিত্রকল্পের উদ্ভাবন কল্পনার দ্বারাই সম্ভব। বোদলেয়ার-এর কবিতাবোধের পরে একথা এখন সুপ্রষ্ঠিত যে, যা বলার তা অপ্রত্যক্ষভাবে চিত্রকল্পের মাধ্যমেই বলতে হবে কবিতায়। কবিতায় গন্ধ, স্পর্শ, রং সকল ইন্দ্রিয়ের সম্যক সমাহারে বিস্তার কল্পনার দ্বারাই সম্ভব। বাস্তব অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এমনকি অধীত জ্ঞান চরিতার্থ কবিমানসে কল্পনার দেশলাইয়ে মুহূর্ত জ্বলে ওঠে; চিত্রকল্পে, ইন্দ্রিয়সমাহারে এক আচ্ছন্ন রূপ-ধ্বনির সৃষ্টি হয়, সেই ধ্বনিতে যুক্ত হয় বিভিন্ন বোধ ও ছবির সমাগম—প্রতীপ, বিপ্রতীপ সঞ্চার (association). এই রাসায়নিক আগুনেই কবিতার জন্ম হয়।

এক এক কবির কল্পনা প্রতিভার প্রয়োগে ভিন্নতা থাকতে পারে অবশ্যই। কিছু কবি-কবিতা-ইতিহাসের তথ্য দেয়া যেতে পারে।

ইংরেজ কবি শেলি যুক্তি এবং কল্পনার প্রসঙ্গ তুলে কল্পনাকে অধিক গুরুত্বের অধিকার দিয়েছিলেন। কোলরিজ কল্পনাকে দুই স্তরের (fancy, imagination) ভেবে-চিন্তে কবিতা রচনার প্রক্রিয়ারও ইঙ্গিত করেছিলেন। কল্পনাই কবির চিন্তা, চিত্রকল্প, সমূহ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গ, সূক্ষ্ণ ধ্বনি সঞ্চালন করে সেই রচনা করতে পারে যার পাঠোদ্ধারে ‘willing suspension of disbelief’ সম্ভব। ফরাসি কবি ভালেরি কবিতা কল্পনা/রচনার প্রক্রিয়ার বিশদ আলোচনা করেছেন The Art of Poetry বইতে। জীবনানন্দ দাশ কল্পনা এবং কাব্য রচনার প্রক্রিয়ার যতোটুকু আভাষ দিয়েছেন, তা এই—‘খণ্ড-বিখণ্ডিত এই পৃথিবী, মানুষ ও চরাচরের আঘাতে উত্থিত মৃদুতম সচেতন অনুনয়ও এক এক সময় যেন থেমে যায়,—একটি পৃথিবীর অন্ধকার-ও-স্তব্ধতায় একটি মোমের মতন যেন জ্বলে ওঠে হৃদয়, এবং ধীরে ধীরে কবিতা-জননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায়।’… ‘নীহারিকা যেমন নক্ষত্রের আকার ধারণ করতে থাকে তেমনি বস্তু-সঙ্গতির প্রসব হতে থাকে যেন হৃদয়ের ভিতর; এবং সেই প্রতিফলিত অনুচ্চারিত দেশ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে ওঠে যেন, সুরের জন্ম হয়; এই বস্তু ও সুরের পরিণয় শুধু নয়, কোনো কোনো মানুষের কল্পনা-মনীষার ভিতর তাদের একাত্মতা ঘটে—কাব্য জন্ম লাভ করে।’

নির্ঝর: কবিতার কোনো সংজ্ঞা আছে আপনার কাছে, কিংবা কোনো নিজস্ব কবিতাবোধ?

ওমর: ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যং’—এটা কবিতার আদি সংজ্ঞা। এই চরিত্রায়ণ এখনো টিকলেও, কাব্য গতিষ্ণু, মানে ‘ডাইনামিক’ তাই কবিতাবোধ পালটে যায়। কালে, ইতিহাসে। আসলে প্রত্যেক মহৎ কবির কবিতার ধারণা তার নিজস্ব। কবিতার দায়িত্ব মানুষের জীবনের কোনো অচিহ্নিত তলকে আবিষ্কার করা। প্রেম তো আদি বিষয় কিন্তু প্রেমকেও নতুন চাহনিতে নিবদ্ধ করতে হবে। নব আবিষ্কার, অতএব কবিতার বিষয় হচ্ছে প্রথম শর্ত যা অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, জ্ঞান, কাল থেকে জেগে ওঠে। এবং এই অবলম্বন ঘিরেই কবিতার ক্রাফটসম্যানশিপ—উপমা-চিত্রকল্প, ধ্বনি-শ্রুতিকল্প, ভাষা, সঙ্গত যতো অনুষঙ্গ লতিয়ে-জড়িয়ে ওঠে এবং কবিতাকে সুষমা দেয়। কারো ধারণা আছে যে, কবিতার বিষয় লাগে না—প্রথম লাইন হলেই হয়। প্রথম লাইনও অভিজ্ঞতার অন্তস্থল থেকে উদ্গত হয়। অনেকে বলেছেন, ভাষাই কবিতা। জাঁ পল সার্ত ‘What is Literature’ বইতে লিখেছেন, ‘ভাষার জন্ম থেকেই কবিতার জন্ম।’ আমি একমত নই। প্রথমে জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বোধ। বোধের অনুভূতিতেই আগুন যার মধ্যে অন্য সব—চিত্রকল্প, শ্রুতিকল্প, ভাষা, সুর, অনুষঙ্গ গলে রসায়নে একটি কবিতার বাকি কাজ সম্পন্ন করে। এই ক্রিয়ার প্রধান কারিগর কল্পনা। এমনকি লেখা শেষ হবার পর কবির বার বার মকশ, সেও কল্পনার কাজ। কিন্তু তখন সে অবচৈতন্যের নয়, সুস্থির চিত্তের। একই কথা অন্যভাবে বললে, আমি কনটেন্টের গুরুত্ব দিচ্ছি। ফর্ম কবিতার ঐতিহ্যবাহিত হয়ে আসছে এবং কবিতা রচনার প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত হচ্ছে।

কবিতার বিষয় যা খুশি হতে পারে, টুথপেস্ট অথবা জিওপলিটিক্স। কবিতা মাত্রাবদ্ধ হতে পারে, গদ্যেও হতে পারে। কিন্তু তার সংগীত থাকে।

নির্ঝর: কবিতার ক্রাফ্টমেন্টশিপের যে-ব্যাপারটা বললেন দেখা যায় সেটা অনেকেই পারে না, অভিজ্ঞতাকে কল্পনা প্রতিভার বর্ণিল ডানা দিয়ে উড়ানোর ব্যাপারটার কথা বলছি। দেখা যায় কবিতাকে বানাতে গিয়ে হয়ে গেছে ছন্দোবদ্ধ শব্দের খেলা, অনেকটা তাসের ঘরের মতো। একটু হাওয়ায় বা স্পর্শে ধসে পড়লো। এরা আপনার কী মনে হয়, কেন পারে না?

ওমর: কবিতা কী, সে সম্পর্কে ধারণা হতে সময় লাগে। অনেকের হয় না। অনেকে সাম্প্রতিকতা দিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে যায়।

কারো ধারণা আছে যে, কবিতার বিষয় লাগে না—প্রথম লাইন হলেই হয়। প্রথম লাইনও অভিজ্ঞতার অন্তস্থল থেকে উদ্গত হয়। অনেকে বলেছেন, ভাষাই কবিতা। জাঁ পল সার্ত ‘What is Literature’ বইতে লিখেছেন, ‘ভাষার জন্ম থেকেই কবিতার জন্ম।’ আমি একমত নই। প্রথমে জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বোধ। বোধের অনুভূতিতেই আগুন যার মধ্যে অন্য সব—চিত্রকল্প, শ্রুতিকল্প, ভাষা, সুর, অনুষঙ্গ গলে রসায়নে একটি কবিতার বাকি কাজ সম্পন্ন করে। এই ক্রিয়ার প্রধান কারিগর কল্পনা।

নির্ঝর: আধুনিক কবিতা বলতে আপনি কি বোঝেন?

ওমর: আধুনিক কবিতা বলতে তিনটে চিন্তা চালু আছে:

  • বোদলেয়ার-এর কবিতা কর্ম এবং চিন্তাভিত্তিক আধুনিকতার ধারণা।
  • আভা গার্ড (avant garde) বা বিভিন্ন ‘ইজম’–এর ধারা—সুররিয়ালিজম, দাদাইজম, ফভিজম–বাহিত আর জারিত আধুনিকতার ধারণা।
  • বৃহত্তর ইতিহাস-সামগ্রিক ধারণা: সতেরো শতক থেকে বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি এবং ফলিত প্রয়োগ থেকে theory of knowledge-এর থেকে যে ধাক্কা এসে লাগলো ভিন্ন শিল্প মাধ্যমেও, তার থেকে জনিত ‘আধুনিকতা’র ধারণা।

আধুনিক কবিতার দুটো ডানা—

  • জীবন-প্রকৃতি–সমাজ-ইতিহাস-এর বিবর্তন উদ্ভূত অঙ্গ।
  • কবিতার প্রকরণ (technique)-এর পরিবর্তন ও উদ্ভাবন থেকে অঙ্গ।

গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস, নিউটন-এর নিরীক্ষাভিত্তিক বিজ্ঞান ধর্মবিশ্বাসকে দুর্বল করে দিলো। আর ডারউইন এসে তো থিওলজি প্রায় নির্মূল করে দিলেন। আমি ইন্টেলেকচুয়াল প্রদেশের কথা বলছি, গণ-মানসের নয়। এতে করে, খ্রিস্টিয়ানিটি এবং রেনেসাঁ জগতের শিল্পকলার ভিত নড়ে-সরে গেলো। চিত্রকলার মধ্যেও, ধর্মীয় মিথের চরিত্র রূপায়নের বদলে পৃথিবীর রক্তমাংসের মানুষ চিত্রায়নে মনোনিবেশ ঘটলো।

দান্তের মধ্যে মানুষের মনের সংকট পাওয়া যায় কিন্তু স্বর্গ, নরক, খ্রিষ্টীয় মিথ টেকানো মুশকিল হয়ে পড়লো বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও যুক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সেই জন্য, বোদলেয়ার-এর মানুষ সংশয়াপন্ন মানুষ—কিন্তু পৃথিবীতে, নগরের নরকে। তিনি উদ্ধার পেতে চান মানুষী স্বকর্মে, শিল্পে এবং পালিয়ে যেতে চান জনতা ও জরা থেকে দূরে কোন নিরক্ষীয় দ্বীপে, অনন্তে তা যেখানেই হোক।

আঠারো শতক থেকে বিজ্ঞানের যে-ফলিত প্রয়োগ ঘটলো জগৎ ও জীবনে—শিল্পবিপ্লব, নগরে জন-সমাগম, প্যাস্টোরাল জীবনযাত্রার ধীর অবলোপন, যন্ত্র-শ্রমিক জীবন, পুঁজি-ট্রেড-বাণিজ্যের বিকাশ, ঔপনিবেশিকতা, বিপ্লব, যুদ্ধ, প্রকৃতি কী করে কাজ করে তার রহস্য উন্মোচন—বিশ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয় কবিতার উপজীব্য হতে লাগলো। বিষয় বৈচিত্রের সঙ্গে-সঙ্গে কবিতার প্রকরণেরও ভিন্ন-ভিন্ন উদ্ভাবন হলো। আধুনিকতার প্রথম পর্ব রোমান্টিসিজম। কিন্তু এর মধ্যে প্রকৃতি প্রেম (ওয়ার্ডস ওয়ার্থ, কিটস), কিছুটা বিজ্ঞান বিরোধিতা (ব্লেক), এবং আবেগ বিলাস (কিটসের নাইটেঙ্গল) ছিলো। এই পর্ব কিছুটা সান্দ্র, পরিশোধিত হয়েই বোদলেয়ার থেকে আধুনিক চিন্তার শুরু। কিন্তু সে পথের পথিক বহু এবং নিজস্ব—নিজস্ব চলনের। হুইটম্যান, ভালেরি, রিলকে, ইয়েটস, লোরকা, নেরুদা, হিকমত, জীবনানন্দ, দারবিশ—প্রত্যেকের আধুনিকতার চরিত্র আলাদা।

উপরের ‘বুলেট’ পয়েন্টগুলোর মধ্যে, তৃতীয়টিই প্রধান এবং যেহেতু বোদলেয়ার-এর নিজস্ব ধারণা বিজ্ঞানের সামাজিক ফলাফলের জন্যই সম্ভব হয়েছিলো, তাঁকেও ঐ তৃতীয় তত্ত্বের আওতায় ফেলা যায়। নির্বেদ বা ennui–এর ব্যাপারটি অবশ্য তাঁর নিজস্ব মানসিকতার ভূগোল। দ্বিতীয় ‘বুলেট’ পয়েন্ট—সুররিয়ালিজম, দাদাইজম, ফভিজম—এগুলো মূলত টেকনিকের বিকাশে সাহায্য করেছে, যার শেষ ধাক্কা, ম্যাজিক রিয়ালিজম।

যারা—‘কবিতার বিষয়বস্তু (তার প্রণোদনার সারকেন্দ্র) পাল্টায় না, পাল্টায় শুধু প্রকাশভঙ্গী। …যথার্থ নতুন কবি তার নিজের ভঙ্গীটি আবিষ্কার করেন মাত্র’—এই মতে বিশ্বাসী, তাঁরা ইতিহাসের সঙ্গে মানুষ ও সমাজের, গ্লোবাল সমাজের বিবর্তন এবং সাহিত্যে তার বিকীরণের অবহেলা অজান্তেই করেন।

নির্ঝর: এইবার বাঙলা কবিতার ঐতিহ্য নিয়ে আপনার ধারণা কী তা একটু বলেন।

ওমর: রবীন্দ্রনাথ-এর পিছনে আর নাই গেলাম। রবীন্দ্রনাথ একাই ব্রিটিশ রোমান্টিক কবি-গোত্রের তুল্য। তা ছাড়া পয়ারের পরের বাঙলা ছন্দ পুরোটাই তাঁর তৈরি। মোটা দাগে তাঁর বিশাল রচনায় দুটি প্রক্রিয়া পাই আমি:
১. বিষয়ের মধ্যে একটি উপনিষদীয় সুর—বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে পরম পুরুষের (ব্রহ্মা) বাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে, যার সঙ্গে সুর মেলালে প্রকৃত কবিতা রচিত হয়। ‘জীবনকথা’ এবং ‘মানুষের ধর্ম’ নিবন্ধে এই সূত্র তিনি পর্যাপ্ত করে বলেছেন। এই দিয়েই তাঁর রচনামালার মধ্যেকার সুতোটিকে ধরা যায়।
২. কবিতার রূপ/ফর্মকে সব সময় একাদিক্রমে বিকাশ করেছেন পয়ার থেকে গদ্য কবিতা অবধি। বৃষ্টি ঋতুরই কত রূপের কবিতা আছে তাঁর। আমি নিজে রবীন্দ্রনাথের একটি ফর্ম উপভোগ করি এবং ইউনিক ভাবি, তা হচ্ছে গীতাঞ্জলি/গীতবিতানের প্রেম-প্রকৃতি-পরমপুরুষ সমন্বিত কাব্যগীতি, যেমন ‘আজি শ্রাবণ ঘন গহন মোহে’, ‘আমারে তুমি অশেষ করে’, ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে’। কাব্যগীতির এই ধারা কিন্তু পুরনো, কবির, তুলসীদাস, মীরা বাহিত ধারণা। কিন্তু বাঙলায় তাঁর ভাষা, স্তবকায়ন, সুর-প্রয়োগায়ন একটি বিশিষ্ট রূপ করেছে। ঠিক চিত্রকল্প নয় কিন্তু ‘হৃদয় রক্তরাগে’, ‘সন্ধ্যা স্বপনবিহারী’জাতীয় যৌগিক সমাহারকে ইউনিক ব্যবহার করেছেন—‘প্রদীপ ভেসে গেল অকারণে’।

এই রাবীন্দ্রিক বলয়ের মধ্যে থেকেও নজরুল একটা অন্য সুর গাইতে পেরেছিলেন। তার পরের বড় দাগ ৩০-এর কবিরা। বাঙলায় এঁরা আধুনিক কবিতার স্রষ্টা। তারপর ৪০ থিতিয়ে ৫০-৭০-এর কবিরা। তার পরের কাল।

নির্ঝর: তিরিশের কবিদের উপর আলোকপাত করেন?

ওমর: ‘চার রাজা’, নামে আমার একটি রুবাই আছে ‘বাবরের পদ্ম অশোকের চাকা’ গ্রন্থে তিরিশের চার কবিকে নিয়ে। গদ্যে না বলে, বরং কবিতাটি উদ্ধৃত করি:

বাকশিল্পে শব্দই মর্মর ইষ্টক, সুধীন্দ্রনাথ, স্থপতির মতো ব্রত ওঁর ব্যঞ্জনায়;
চূড়া থেকে খাদের নামায়, লয়তন্ত্রী বিষ্ণু দে—ছন্দ, বাণী, সুর গেঁথে প্রজ্ঞায় মেলায়।
পরম নিভৃতি আর চরম পরিশ্রমে নিজস্ব নির্বাণ পান বুদ্ধদেব। জীবনানন্দে শুনি
শিশিরের পা’র ধ্বনি, প্রেম তবু অপ্রেম, দ্বিধাপন্ন ইতিহাস, চিত্ররূপময়তায়—কল্পপ্রতিভায়।

সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব এবং জীবনানন্দ’র কবিতার চারিত্র উল্লেখ করে। চার লাইন তাই পঞ্চম কবি অমিয় চক্রবর্তীকে টানা যায়নি। এঁদের সঙ্গে সমর সেন এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়কেও সমগ্র করা দরকার। আমাদের তিরিশের কবিরা প্রায় একই কালের ১৯২৯-এর স্প্যানিশ কবিগোত্রের (আলবের্তি, লোরকা, আলেইহান্দ্রে, দামাসো আলন্সো, সালিনাস, গিয়েন) মতো রচনা, উদ্ভাবন এবং শক্তির প্রাবল্যে। এঁরা আধুনিক, আধুনিকতার যে-সংজ্ঞা উপরে দিয়েছি সেই পরিচয়ে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে ফর্মের কবি। এ-দুজনের ছন্দ রবীন্দ্রনাথ যা করেছেন তার থেকেই উদ্ভূত। তার উপরে যা বাড়ানো যায়, দক্ষতা দেখানো যায় তা তাঁরা করেছেন। কাব্যের বিষয় ও বোধ রবীন্দ্রোত্তীর্ণ। বুদ্ধদেব তাঁর শেষ পর্বে বোদলেয়ার, রিলকে দিয়ে আক্রান্ত, সঙ্গে-সঙ্গে দক্ষ গদ্য কবিতা লিখেছেন। বোধ, বিষয় এবং শৈলীর ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ অবশ্যই সবচেয়ে গভীর। তাঁর ভাষা, সুর-লয়, ইতিহাসবোধ, বিচিত্র বিষয়, ব্যক্তিগত এবং সমাজগত এমনকি গ্লোবাল দৃষ্টি তাঁকে মহত্তর মাত্রা দিয়েছে। আমি রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দকে মহৎ কবি বলতে রাজি। আমার ‘কেন শুদ্ধতম’ গ্রন্থে আমি বলেছি, ‘জীবনানন্দ’র বোধ এবং কবিতা-বিকাশের বিস্তৃতি আমি তাঁর কালের ইউরোপীয় কোনো কবির কাছে পাই না।’

একটা কথা মনে রাখা দরকার, রবীন্দ্রনাথের কবিতা রচনা উপনিষদীয় পরমপুরুষের ধারণা দিয়ে একইসূত্রে সংগ্রথিত। জীবনানন্দ ১৮-২০ শতকের বিজ্ঞানবোধ বাহিত হয়ে এসে কোনো একাত্মবোধের নয়, পাহাড়ের ওপারের আলোক তিনি দেখেননি। যা দেখেছেন তা স্বচক্ষে বরিশালে, কোলকাতায় এবং অধীত জ্ঞানের মাধ্যমে।

নির্ঝর: তিরিশের কবিদের পরের কবিরা মানে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত কবিদের সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

ওমর: সুভাষ মুখোপাধ্যায় মার্ক্সবাদী কবিতার উদ্যোগী ছিলেন, যদিও তিনি ৩০ গোত্রেরই। তবে তাঁর প্রেমের কবিতা, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’-ই আমার প্রিয়। এ বাদে কথ্য ভাষায় তাঁর কিছু ‘anti-poetry’ আছে। সমর সেন, ৩০ গোত্রেরই, এলিয়টীয় ধাঁচের গদ্য কবিতা শুরু করেছিলেন। বেশিদিন লেখেননি।

পঞ্চাশের শেষ থেকে বাঙলাদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, পরে সমাজ-রাজনীতি এদেশের কবিতাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। পুরোধা শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদ। প্রেম নিয়ে সবাই লিখেছেন। রাহমানের স্মরণীয়তা মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা সংক্রান্ত কবিতায়, আল মাহমুদের ‘ফসলের সুষম বণ্টনের’ এবং ‘সোনালি কাবিন’-এর কবিতায়। পরিবার-আত্মীয় স্বজন-গ্রাম নিয়ে মাহমুদের কবিতার স্বাদ স্বতন্ত্র এবং সফল। শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান এবং হুমায়ুন আজাদ নিজের নিজের স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। তবে প্রত্যেকেরই স্মরণীয় কবিতার সংখ্যা সীমিত। রফিক আজাদ এবং নির্মলেন্দু গুণ, আমার বিচারে, কালের তাড়নায় স্লোগান-উচ্চকিত ‘marvellous minor poets’.

কলকাতায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, উৎপল কুমার বসু এঁরা এবং অন্যান্যরা ৫০ থেকে কয়েক দশকের প্রতিভূ। শক্তি, আমার মনে হয়, র্যাঁ বোর নজির ধরে তাৎক্ষণিক অবচেতনের প্রকাশের চেষ্টা করেছেন, সুনীল লিরিক, ফর্ম ছেড়ে কথ্য ভঙ্গিতে নাটকীয়তা আনার পক্ষপাতী ছিলেন।

উত্তরাধুনিকতা কী জিনিস আমি বুঝি না। তবে এই থিওরি আমি পড়েছি। তাতে বিশ শতকীয় সব সাহিত্যিককে ঢোকানো যায়। কিছু তরুণ এপার-ওপারের—নিরর্থ বাক্যের কোলাজকে উত্তরাধুনিকতা বলে চালিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছেন, ঠিক কোট দিতে পারছি না, তবে মর্ম এই—যা কিছু বোঝা যায় না, তাই দিয়ে কবিতার কোনো মানে নেই।

নির্ঝর: আপনি বহুকাল বিদেশে। উত্তর ৩০ বাঙলা কবিতার প্রেক্ষিতে অন্য ভাষার কবিতা নিয়ে কিছু বলেন।

ওমর: আমি ১৯৭২ সনে আমেরিকায় আসি। কিছু ইংরেজ কবি এবং লোরকা, রিলকে, বোদলেয়ার এঁদের সঙ্গে পরিচয় দেশে থাকতেই ছিল। ১৯৭৩-৭৪-এ আমি নেরুদা এবং সেসার ভায়্যেহ’র কবিতা পড়া শুরু করি এবং মুগ্ধ হয়ে যাই।

এলিয়ট, পাউন্ড, ইয়েটস-এর কবিতা-ধারাটার পরিচয় বেশি ছিল বাঙালি কবিদের মধ্যে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে সভ্যতার নেতি এবং স্খলন ঘটছে, এই বোধ আর ‘Tradition and Individual Talent’ প্রবন্ধের কাব্যতত্ত্ব শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমানের ওপর ছায়া দিয়েছিল। তিরিশের কালে সমর সেন, বিষ্ণু দে তাড়িত ছিলেন। বিষ্ণু দে কবিতার শৈলী নিয়েছিলেন এলিয়টীয়, বোধ নয়।

ফরাসি কবিতার বোদলেয়ার, র্যাঁ বো, মালার্মে, ভালেরির ঐতিহ্য। এলিয়ট, ইয়েটস উভয়েই ফরাসিদের কাছ থেকে ধার করেছিলেন। বিশ শতকী জার্মান কবিতার পুরোধা রিলকে। ইতালিয়ান, গ্রিক, পোলিশ, রাশান, জাপানি সব ভাষারই আধুনিক কবি এবং কাব্য ছিল। এঁদের বিস্তৃত বিবরণ বাদ রাখলাম। তুর্কি কবি নাজিম হিকমত। পর্তুগিজ কবি পেসোয়া।

১৯২৭-এর স্প্যানিশ কবিগোত্রের (লোরকা, আলেইহান্দ্রে, সালিনাস, দামাসো আলনসো, গিয়েন, থেরনুদা) বড় রচনা এবং অবদান ঘটে। এবং প্রায় সঙ্গেই লাতিন আমেরিকায় উইদোব্র, পাবলো নেরুদা, সেসার ভায়্যেহ, হোর্হে লুইস বোরহেস-সহ নব্য কবিদের নতুন চেতনা ও শৈলীর কবিতা আসে। পাবলো নেরুদা হুইটম্যান, বোদলেয়ার, র্যাঁ বোর ডিকশন মিশিয়ে এক নতুন কণ্ঠস্বর তৈরি করেন যা এলিয়টীয় সংশয়, বিষাদ, আয়রনির থেকে আলাদা। ভঙ্গীতেও, বিষয়েও। তারুণ্যের প্রেম, বিদেশে নিঃসঙ্গতা, স্পেনের গণযুদ্ধে মুক্তিকাম্যতা, লাতিন আমেরিকার জাতিসত্তা, ক্যাপিটালিজমের বাণিজ্য ও অমানবিকতার বিরুদ্ধতা, জীবনযাপনের তুচ্ছ জিনিশ ইত্যাদি তাঁর কাব্যবিষয়। এবং তিনি বিচিত্র ক্রাফটম্যানশিপে এসব লিখেছেন। তিনি বলেছেন, কবিরা দুই জাতের—এক দল দরজা-জানালা বন্ধ করে লেখেন, অন্যরা খুলে লেখেন। তিনি দ্বিতীয় দলের, আর রিলকে প্রথম গোত্রের।

নির্ঝর: এতোক্ষণ যা জিজ্ঞেস করেছি, তা আসলে পটভূমি তৈরির জন্য। মূলত আপনার কবিতা নিয়েই বেশি জিজ্ঞাসা। এবার সেগুলোয় আসছি। আপনার কখন থেকে মনে হলো যে আপনি আপনার সমসায়িকদের থেকে আলাদা কাব্যভাষা তৈরি করবেন?

ওমর: পরিকল্পিতভাবে ভাষা আলাদা করবার কথা ভাবিনি। আগে দেখা, দেখা মানে শুধু চাক্ষুষ ইন্দ্রিয়জ দেখা না—ব্যক্তি, সমাজ, ইতিহাস, অতীত, স্মৃতি, জ্ঞান—সব দেখার থেকে যদি কোনো বোধ আসে, যদি জীবনের অনাবিষ্কৃত কোনো সংবিৎকে মনে নাড়াচাড়া করা যায় তা থেকে কবিতার মোমবাতি জ্বলে ওঠে। সেই মুহূর্তেই কবিতাটির ধ্বনি এবং ভাষা জেগে ওঠে। কবিতা কী, এই চিন্তাটি অন্য সমসাময়িকদের থেকে আমার পৃথক, তাই ভাষাও আলাদা।

নির্ঝর: আপনার কবিতা লেখার শুরু ষাটের শেষ থেকে। প্রথম বই বের হয় আপনার ৩৭ বছর বয়সে। এর মধ্যে আপনি পাকিস্তান দেখেছেন। যুদ্ধ দেখেছেন। যুদ্ধ পরবর্তী ক্ষমতার রদবদল, কু, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড-সহ সামরিক শাসন হয়েছে দেশে। কিন্তু এইসবের সরাসরি কোনো প্রভাব আপনার প্রথম বইটার কবিতায় পড়তে দেখি না। কেন?

ওমর: কথাটা প্রকৃত সত্য নয়। উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে। আমার প্রথম বইয়ের কবিতা—‘আগন্তুক’ (মুক্তিযুদ্ধ-হানাদার সৈন্যর গ্রাম আক্রমণ), ‘জ্যা-হীন-তীর’ (রাজাকার, সে আমাদের মধ্যেকার-ই); ‘তদন্ত’ (নন-জুডিশিয়াল হত্যা); ‘ডিনার টেবিল’, ‘ক্ষুধা’ (দুর্ভিক্ষ), ‘বীথিদের বাড়ি’, ‘হাত’ (শ্রেণিবৈষম্য)। আমার স্টাইল আলাদা। আমি প্রত্যক্ষভাবে স্লোগান টাইপে বলি না যেমন ‘ভাত দে হারামজাদা’, ‘সব শালাই কবি’ ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ ইত্যাদি। অবশ্য আমার এই কবিতাগুলো তেমন পড়া হয় না, প্রকাশ্যে পড়া হয় না। কারণ ঠিক আমি জানি না।

নির্ঝর: প্রচ্ছন্নভাবে এসেছে সেটা বুঝেছি। আপনার সময়কার দেশের বেশিরভাগ কবির কবিতাই স্লোগানধর্মী ছিলো, তাই কথাটা বলা। আর আপনার কবিতা প্রকাশ্যে পড়া না হওয়ার পেছনের দুটো কারণ হতে পারে। প্রথম কারণ হচ্ছে আপনি দেশের বাহিরে থাকেন, ফলত দেশে আপনার উন্মতবেষ্টনি নাই। যেটা অকাল প্রয়াত নব্বইয়ের কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর জীবদ্দশায়ও হয়েছে। আর দ্বিতীয় কারণ হতে পারে প্রচ্ছন্ন কথা আমজনতা বোঝে না। যাইহোক, এইবারের প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের কথা বাদ দিলাম, পৃথিবীর অনেক বড় বড় কবির কবিতাও অনেক সময় দেখা গেছে স্লোগানধর্মী আর স্পষ্টভাবে প্রতিক্রিয়া হয়ে উঠেছে। তো সেইসব রাজনৈতিক কবিতাকে আপনি কী চোখে দেখেন?

ওমর: অনেক সময় সামাজিক, রাজনৈতিক কারণে স্পষ্ট প্রতিক্রিয়ার কবিতার দরকার হয়। কিন্তু সময় সুস্থির হলে, কবিতার শিল্পগত দিকও দেখতে হবে। এটা আর্টস ফর আর্টস সেক দৃষ্টি নয়। প্রতিবাদী কবিতায়, তদুপরি বাম-রাজনৈতিক অভিলাষের কারণে এই উচ্চাবচতা হয়। নেরুদারও স্টালিন প্রশস্তির কবিতা আছে। কিন্তু নাজিম হিকমত, সেসার ভায়্যেহ, নেরুদার ভালো কবিতা আছে যেখানে প্রতিবাদ শিল্পিত। এমন কি ম্যাজিক রিয়ালিজম বলা যায়। বিমূর্তভাবে প্রতিবাদ আরও শক্তিশালী। একটা ছবি দিয়ে বোঝাই। দাভিদ সেকুইরিয়স-এর যুদ্ধবিবাদী ছবি—

Echo Of A Scream by David Alfaro Siqueiros.

প্রত্যক্ষ ট্যাঙ্ক-বিমানের চেয়ে গভীর এবং শক্তিশালী। জিনিসটা মনে ঘুরপাক খায়। জলের মতো না হয়ে ঝড়ের মতো হলেও, সে যদি ঘুরে ঘুরে কথা বলে তাহলে তার সার্থকতা বেশি।

নির্ঝর: আচ্ছা। শিল্পিত প্রতিবাদের ছবির ভাষা জানলাম, আপনার কবিতা পড়ে কবিতার উদাহরণও পেলাম। এইবার বাঙলাভাষার বাইরের কারো কবিতা থেকে মানে যাদের নাম বললেন নাজিম হিকমত, সেসার ভায়্যেহ, নেরুদার কোনো কবিতার একটা উদাহরণ যদি আনেন তবে কবিতার পাঠকদের ব্যাপারটা বুঝতে আরো সহজ হয়।

ওমর: এই উদাহরণে বোঝা যাবে যে আমাদের কবিতা কোথায় যেতে হবে। এর আগে আমি প্রতিবাদী কবিতায় স্লোগানটাইপ না বলে বিমূর্তভাবে বলা নিয়ে বলেছি, আমার নিজের কবিতায় চিত্র-শ্রুতিকল্পের মিশ্র রূপ নিয়ে বলেছি, পুরো কবিতাটিকেই কল্পচিত্রে প্রকাশের কথা বলেছি—এই সূত্রকে স্পষ্ট করার জন্য আমি সেসার ভায়্যেহ’র একটি কবিতার উদাহরণ টানতে চাই। কবিতাটির নাম, ‘জনতা’, যা স্পেনের ডিক্টেটরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কালে ১৯৩৭-এ লেখা হয়েছিলো। কবিতাটি সংকট, আশার থেকে লেখা—মৃতের জেগে ওঠা, অনেকটা কাফকার মেটামরফোসিস-এর মতো কল্পনায়। এই কবিতাকে আমি বলি যাদু-বাস্তবতার কবিতা এবং যা টেকনিকালি বোদলেয়ার-এর চিত্রকল্পস্তনিত কবিতার ধারণা থেকে আরেক ধাপ উপরে উত্তীর্ণ হয়েছে। Paul O’Prey-এর ইংরিজি অনুবাদ ‘Mass’ থেকে কবিতাটি ‘জনতা’ নামে বাঙলায় ভাষান্তর করে দিলাম—

যখন যুদ্ধ হলো শেষ এবং সৈনিক হলো মৃত,
একজন মানুষ তার কাছে এলো, আর বললো:
‘ম’রো না, তোমাকে এতো ভালোবাসি।’
কিন্তু মৃতদেহ, হায়!, ম’রেই চললো।

দুজন তার কাছে এলো, আবার বললো:
‘আমাদের ছেড়ে যেও না! সাহস! ফিরে এসো জীবনে!’
কিন্তু মৃতদেহ, হায়!, ম’রেই চললো।

কুড়িজন কাছে এলো, একশো, এক হাজার, সহস্র,
চিৎকার ক’রে: ‘এতো ভালোবাসা মৃত্যুর মুখে এতো অসহায়!’
কিন্তু মৃতদেহ, হায়!, ম’রেই চললো।

কোটি কোটি লোক তাকে ঘিরে ধরলো
একই অনুরোধ: ‘থাকো, ভাই।’
কিন্তু মৃতদেহ, হায়!, ম’রেই চললো।

তারপর সারা পৃথিবীর লোক তাকে ঘিরে ধরলো,
মৃতদেহ তাদের দিকে তাকালো—আর্ত, করুণ;
ধীরে–ধীরে উঠে বসলো; প্রথম মানুষটিকে
জড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো…

নির্ঝর: এইবার ব্যাপারটা আরো সহজ হলো। এইবার বলেন কবিতার চিরন্তনতা বিষয়ে আপনার ধারণা কী? জীবনানন্দ দাশ তার কবিতার কথায় যে-চিরন্তনতার বিপক্ষে কথা বলেছেন তা কথা বলছি না। বলছি যেইসব উপকরণের ব্যবহার একটা কবিতাকে চিরন্তন করে, যেমত জীবনানন্দ দাশের কবিতা বা এলিয়টের কবিতা বা বিনয় মজুমদার বা ভাস্কর চক্রবর্তী বা আবুল হাসানের কবিতা বা অন্য অনেকের কবিতা আমরা নিয়মিতই পড়ি। কিংবা আপনি যে স্মরণীয় কবিতার কথা বললেন। আবার অনেকের কবিতা দরকারে মানে কোনো লেখার কাজে, রেফারেন্সের প্রয়োজনে পড়ি। এইসব ব্যাপার কেমন করে হয় বলে আপনার ধারণা?

ওমর: রবীন্দ্রনাথের চিরন্তনতার চিন্তা উপনিষদ থেকে। আধুনিক কবিতায় সেটা নেই। চিরন্তনতার জন্য কবিতার কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং নেই। টাইমের সঙ্গে জীবন পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনের মধ্যেও যা সারবত্তা হয়ে টিকে থাকে এবং জীবনের অনাবিষ্কৃত দিকের উদ্ঘাটন- এর মধ্যেই কবিতার টেঁকসইয়ের সত্য বা তথ্য।

নির্ঝর: আপনার কবিতায় প্রায় সময় একটা আশাবাদের ব্যাপার দেখা যায়? সেটা কেন? আশাবাদ ছাড়া কি কবিতা হতে পারে না?

ওমর: মানুষের জীবন আশা-নিরাশা নিয়ে। অতএব কবিতায় উভয়েই থাকবে। কিন্তু আমরা তো বাঁচতে, টিকতে চাই। আমরা কি চাই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাক, মারী বা বোমায় সব বিনাশ হয়ে যাক? আমরা ইতিহাসের, টাইমের মানবতাবাদী পরিণতি চাই না?

নির্ঝর: আমি মনে করি কবিতার শুরু নাই, কবিতার শেষ নাই। কবিতা মানুষের অন্তর্বর্তীকালীন যাপনের একটা মন্ময় অবস্থাকে প্রকাশ করবে, তার সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আড়াল, যন্ত্রানুষঙ্গ, আভরণ হিশেবে সময়চেতনা প্রচ্ছন্নভাবে আসবে। আপনার কী মনে হয়?

ওমর: অভিজ্ঞতা ছাড়া শিল্প বা সাহিত্য নেই।

নির্ঝর: কনটেম্পরারি কবিতায় উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে বলেন।

ওমর: উত্তরাধুনিকতা কী জিনিস আমি বুঝি না। তবে এই থিওরি আমি পড়েছি। তাতে বিশ শতকীয় সব সাহিত্যিককে ঢোকানো যায়। কিছু তরুণ এপার-ওপারের—নিরর্থ বাক্যের কোলাজকে উত্তরাধুনিকতা বলে চালিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছেন, ঠিক কোট দিতে পারছি না, তবে মর্ম এই—যা কিছু বোঝা যায় না, তাই দিয়ে কবিতার কোনো মানে নেই।

নির্ঝর: কবিতা প্রকাশের মাধ্যম হিশেবে ইন্টারনেটের জগৎকে আপনি কীভাবে দেখেন?

ওমর: অসুবিধা নেই। যার যা পারার করুক। টাইম হচ্ছে আদি ঝাড়ুদার। ইংরেজি, অন্য ভাষায় অনেক শেখার জিনিস আছে ইন্টারনেটে, যেমন পোয়েট্রি সাইটগুলি।

নির্ঝর: আধুনিক গদ্যে বা ফিকশনে কাব্যিকতাকে অনেকেই নঞ্চর্থক দৃষ্টিতে দেখেন। এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

ওমর: নেতির কিছু নেই। কী হয়েছে সেটাই বিচার্য। ইলিয়াসের উপন্যাসে কাব্যিক গঠন আছে, ভাষার বিভিন্ন স্তর আছে, সেগুলোকে বিভিন্ন অবস্থান, চরিত্র, প্রেক্ষিতে তিনি বৈচিত্র্য ও বিস্তারে ব্যবহার করেছেন। সহজ একমুখী কাজ নয়।

নির্ঝর: জালাল উদ্দিন রুমি কিংবা ফরিদ উদ্দিন আত্তার বা হাফিজ বা এ জাতীয় সুফি কবিদের কবিতার মূল্যায়ন আপনি কীভাবে করবেন?

ওমর: রুমি, আত্তার, হাফিজের কবিতা পড়েছি। মূল ভাষা না জানার কারণে যা লাভ করেছি তা আবছা। এরা সবাই ছন্দে লিখেছেন, কিন্তু পড়ছি গদ্য অনুবাদে। তবে এরা, বিশেষ করে রুমি কবিতার মধ্যে জন্তু-জানোয়ার, রূপকথা সব কিছুই ব্যবহার করেছেন, যা আমার কাছে শক্তিশালী মনে হয়েছে—অনেকটা যাদু বাস্তবতার মতো। এদের তো একটা সুফি দর্শন আছে, ইশক। তা ছাড়া মানবতাবাদী এবং কোনো বিশ্বাসের বিরোধী নন। আত্তারের ‘মান্তিক-উত-তার’ একটা মারভেলাস রূপক-প্রতীক, রচনা। টেকনিকালি, ফার্সি, আরবি কবিরা চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবিতা প্রকাশের আইডিয়া জানতেন, যা ২০ শতকে এসে আমরা ফরাসি কবিদের থেকে আবার ভালো করে জেনেছি।

নির্ঝর: নিবেদিত কবিতার ব্যাপারটা কী যেমত আপনি কাউকে কোনো কবিতা উৎসর্গ করলেন এটা মানুষ কেন করে বা আপনি কেন করেন, আর কবিতার বাণীর সঙ্গে সেই ব্যক্তির সম্পর্ক-এর জায়গা কতোটুকু? আর এই জাতীয় কবিতাকে আমার মনে হয় কবিতার শুদ্ধতার বিরোধী।

ওমর: যদি কারো লেখা থেকে, সেটা প্রকাশিত বইয়েই হোক বা ফেসবুকেই হোক, আমার মাথায় কবিতার আইডিয়া আসে তাহলে আমি সেই কবিতাটি তাঁকে উৎসর্গ করি। এটি কৃতজ্ঞতা জানানোর প্রক্রিয়া।

নির্ঝর: কাউকে নিয়ে কবিতা লেখার বিষয়টা বলেন। আপনার একটা কাব্যগ্রন্থই আছে আপনার বন্ধুবান্ধব আর কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের নিয়ে কবিতা লিখেছেন এই স্মরণ বা বর্ণন কবিতা দিয়ে কেন করা লাগবে? তার সম্পর্কে তো গদ্য লিখলেই হয়। নাকি আপনার পূর্ববর্তীরা করেছেন বলেই আপনি করেছেন। যেমত বিনয় মজুমদার প্রমুখ। এক জীবনদাশ নিয়েই আপনার তিনচারটা কবিতা দেখলাম।

ওমর: ব্যক্তি বিশেষ কবিতার বিষয়। রবীন্দ্রনাথের কালে এভাবে লেখা হতো, ‘হে জগদীশ চন্দ্র, উদিলে পূবাকাশে সূর্যসম।’ জীবনানন্দ দাশের কবিতায় অনেক চরিত্রের নাম আছে। তবে পরিচিত সুবিনয় মুস্তফিকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন। বোদলেয়ারের কবিতা আছে ‘লে ফারেস’ যাতে রুবেন্স, লিওনার্দো, রেমব্রাঁ ইত্যাদি চিত্রকরদের সারার্থ নিয়ে লিখেছেন। মালার্মের প্রণতি (ওমেজ) অ্যালান পো, বোদলেয়ার‌ ভেরলেন, ভাগনার, শাভানেজ-এর প্রতি একটি করে সনেট আছে। অতএব, এই বিষয় পুরনো। কাজ সহজ নয়, চরিত্রর নির্যাস, কোনো বিশিষ্টতা বার করতে হবে। ব্যাপারটা কমলালেবুর মতো না, যে ছাল তুললেই মাংস। ব্যাপারটা কাঠবাদামের মধ্যে থেকে শাঁস বার করা। আবুল হাসান কবিতায় কবির চারিত্র, হুমায়ুন কবির কবিতায় কবির বাসনা এবং মৃত্যু—অনেক আছে, একেকভাবে। দুটো বড় কবিতায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ফেদেরিকো ফেলিনি-তে তাঁদের আত্মজীবনীকে কবিতার ফরম্যাটে আটকাবার সংকল্প আছে। এই টপিকটাই একটা বিশদ ব্যাপার।

নির্ঝর: বেশ বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা, কবিতা শুরুর আগে অন্যের কোটেশন কেন থাকতে হবে? এইসব ছাড়া কবিতা লিখলে আমার মনে হয় কবিতার একটা স্বতন্ত্র জায়গা দাঁড়ায়। নাকি আপনার পূর্ববর্তীরা করেছেন বলেই আপনি করেছেন? যেমত এলিয়ট, বোর্হেস প্রমুখ।

ওমর: অনেক কবিতার বিষয়ই (অনেক রুবাই কবিতার) কারো বক্তব্য দিয়ে উদ্দীপ্ত। সে-ক্ষেত্রে কোটেশন না থাকলে পাঠক ধরতে পারবে না।

কবিতায় অপ্রভাবিত বলে কিছু নেই, বলেছেন পাবলো নেরুদা। অতএব প্রভাবকে কে কেমনভাবে হজম করে সেইটেই সূক্ষ্ণতা। আমি যখন কবিতার দালান তৈরি করি, তখন জমি, ইট, পিলার, রুয়া, বাটাম, লোহা, দরোজা, জানালা সব আমার। প্রভাব শুধু সিমেন্টের মধ্যে। তার মশলা আর বিভাগের মধ্যে প্রভাব গোলানো।

নির্ঝর: আপনাকে যদি ৭০ দশকের কবি ধরি, তবে ৩০ দশক থেকে ৭০ দশকের কবিদের কবিতা সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে আপনার কবিতায় ইউনিক কোন ব্যাপারটা এসেছে বলে আপনি মনে করেন। বই ধরে ধরে, আঙ্গিক ও বিষয়, রিলেটিভ টু ট্রাডিশন বলবেন। যদিও এই বিষয়টি আপনার ক্রিটিকদেরই বলার কথা, তথাপি আপনার মনে করাটা এইখানে জানতে চাইছি।

ওমর: ইয়েটস বলেছেন, ‘কবিকে তাঁর নিজের কবিতার ব্যাখ্যা করা অনুচিত’। ব্যাখ্যা করবো না, শুধু কাঠামোয় ইঙ্গিত দেব:

  • বিষয়বস্তুতে টাইমকে ধরা শুধু বাঙলাদেশ নয়, গ্লোবাল পটভূমিতে—ইতিহাস, জিওপলিটিক্স, টেকনোলজিকে বিধৃত করে। বাঙলাদেশের ৬০-৭০ এর কবিরা লোকাল ঘটনাকে ধরেছেন। ইতিহাসের ব্যাপারটা জীবনানন্দে ছিল, আছে। আমি আমার কালকে ধরার প্রয়াস নিয়েছি।
  • ফর্মে—স্তবকায়িত মাত্রায় লিখেছি, ফ্ল্যাট গদ্য কবিতাও লিখেছি।
  • গদ্য থেকে মাত্রায় যাওয়া, মত্রা থেকে গদ্যে ফিরে বিস্তার করা আমার অনেক কবিতায় আছে। এ জিনিশ ক্লাসিকাল সংগীতে আছে, যার থেকেই অনেকটা অটোমাটিকালি আমার কবিতায় এসেছে। কিন্তু ব্যাকরণ অনুযায়ী এটা মানা।
  • আমার কবিতার ধ্বনিচারিত্রর (শ্রুতিকল্পের) নিজস্বতা আছে।
  • বিষয়ের বিচিত্রতা।
  • শুধু ঘটনা বা আবেগ থেকেই নয়, জ্ঞান থেকে কবিতা রচনা। উদাহরণ পরে দেব।
  • কিছু কবিতা যা চিত্রকল্প উত্তীর্ণ করে পুরোটাই ইমাজিনেশনে, অনেকটা ম্যাজিক রিয়ালিজমের মতো।
  • ‘বোধিবৃক্ষতলে’ বইতে শিল্পের প্রতিক্রিয়া, প্রেম, প্রধানত যুদ্ধ ও তার পরবর্তী অবস্থা।
  • ‘খোয়াবনামা’ বইতে বিদেশ থেকে দেশের আর্তি, নিউইয়র্ক এবং বাঙালির বাঁচার স্বপ্ন।
  • ‘সত্তুরের মিছিল’ বইতে বক্রোক্তির কবিতা, অ্যান্টি-পোয়েট্রি।
  • ‘রিলকের আসা যাওয়া’ বইতে প্রধান কবিতা ভালো প্রেমের কবিতা রচনার মুস্কিলতা এবং ৭ মাত্রার কবিতা।
  • ‘কৃতি-প্রতিকৃতি এবং অন্যান্য কবিতা’ বইতে বিভিন্ন মানুষ চরিত্রর কবিতা।
  • ‘ইন্টারনেট গায়ত্রী’ বইতে বিজ্ঞানের পথে মুক্তি এবং বিবিধ প্রসঙ্গ।
  • ‘বাবরের পদ্ম অশোকের চাকা’ বইতে বিভিন্ন বিষয়ে রুবাই রচনা।
  • ‘নিউ ইয়র্কে যিশু’ বইতে প্রধান কবিতা জিওপলিটিক্সে, প্রগতি সত্ত্বেও মানুষের দৈন্য, সংকট—বাঙ্গালীর নৃতাত্ত্বিক বিকাশ, অস্তিত্ব, সম্ভাবনা।
  • ‘ও ওমর ও বোরহেস’ বইতে শিল্পীর আত্মজীবনীর কাব্যরূপ এবং বিবিধ প্রসঙ্গ।
  • ‘হাইব্রিড মুরগি’ বইতে প্রধান কবিতায় বাঙলাদেশের রাজনৈতিক সংকট, জনগণের দুরাবস্থা এবং অন্যান্য বিষয়।

নির্ঝর: এর আগের প্রশ্নের করোলারি হিশেবে, আপনার কবিতায় যে উৎকর্ষ, তার সূত্র কী? যেমত আপনার প্রথম কবিতার বই ‘বোধিবৃক্ষ তলে’ যেটা ১৯৮৪ সালে প্রকাশ হয়, তার ৩ বছর পরেই দ্বিতীয় কবিতার বই ‘খোয়াবনামা’ (১৯৮৬)। প্রথম বই থেকে দ্বিতীয় বইয়ে যে উত্তরণ তা বেশ চোখে পড়ার মতো নির্মাণকৌশল, শব্দের ব্যবহার ইত্যাদির, কিন্তু এরপরেও আপনার ‘হাইব্রিড মুরগি’ (২০১৪) পর্যন্ত প্রতিটা কবিতার বইয়ের কবিতাই মনে হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ধরন একটা ক্ষেত্র পর্যন্ত। এইটা কীভাবে? এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু আশা করছি।

ওমর: আগের উত্তরে আমি বিষয়ের কথা বলেছি। এবার প্রকরণ দিয়ে বলবো। ফর্মে ছন্দ দিয়ে—অক্ষর, মাত্রা, স্বরবৃত্তে যা হতে পারে তা প্রায় হয়ে গিয়েছে। আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ কৃতিত্ব সত্বেও টেকনিকালি ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত, যা রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন। ‘বৈদেহী বিচিত্রা আজি সঙ্কুচিত শিশির সন্ধ্যায়’, সুধীন্দ্রনাথ-এর ১৮ মাত্রা। বিষ্ণু দে-সহ বহুজন লিখেছেন। সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরানের গহীন ভিতরে’ ১৮ মাত্রা। বিষয় ও ভাষা ভেদে পৃথকীকরণ। আর ১৪ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত—রবীন্দ্রনাথের ‘একই গাঁয়ে’ এও এক স্ট্যান্ডার্ড মাপকাঠি। অনেকেই এই লিখে খ্যাত, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের গুলো ক্লাসিক। শহীদ কাদরীর ‘অসঙ্গতি’, জয় গোস্বামীর ‘সৎকার গাথা’ আদতে এক জিনিশ। একালে ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশে এই জাতীয় স্ট্যান্ডার্ড ছন্দকরণে খুব কম লেখা হয়। কেননা যা হবার হয়ে গিয়েছে। লাতিন কবিদের দেখেছি, আলেকজান্ড্রাইনে (১৪ সিলেবলের স্টাইল) শুরু করেছে কিন্তু পরে ভেঙে গদ্যের মতো চলে গেছে।

আমি ফর্মে লিখেছি, যেমন প্রথম বইয়ের ‘ক্লান্ত মনীষা’, টেকনিকালি। বেশি লিখিনি, তবে চর্চা করেছি যে আমি পারি। অন্যদিকে, প্রথম বইয়ের প্রথম কবিতা, ‘পার্থিব বসবাস’ এভাবে শুরু হয়েছে,

আমি মাটি হবো।
কেননা স্তরে-স্তরে
ফসিল আছে
গুল্ম আছে
বৃক্ষ আছে
পাখি আছে
পাতা আছে,
হাওয়া আছে,

এই চলনটা ‘আছে’ ক্রিয়াপদের পুনরাবৃত্তি গদ্যে, ঠিক টালির ডিজাইনের মতো। এরপরেই, ‘সমীর শোনেনি যার মৃদু স্নান গান, তেমনই নদী আছে।’ ৮+৬+৬=২০ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত। ধ্বনির দিকে একটা সরগমের প্যাটার্ন গড়াতে গড়াতে শেষে সুরের লম্বা ফ্রেজে শেষ হচ্ছে। গদ্য থেকে মাত্রায় যাচ্ছে। তারপর আরও ৪ লাইন চিত্রকল্পিত গদ্য হয়ে:

ডাইনোসোরাস, ব্রন্টোসেরাস, ডিপ্লোডকাস
লুপ্ত হলো বারংবার—
অভ্র আছে;
পেট্রোলিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, রুবিডিয়াম,
অসংযত গ্লেসিয়ার।

সম্পূর্ণ অন্য ধ্বনির অক্ষরবৃত্ত বা দ্রুত পড়লে মাত্রাবৃত্ত। আবার গদ্য থেকে মাত্রায়। শেষ দুলাইন মাত্রাবৃত্তে। ‘সমারূঢ় পিণ্ড হতে খাদ্য ঝলসালো/আমি চলিষ্ণু চিরগতি চতুর্ময় আলো’। এই ধরনের চলনে নতুনত্ব এবং বৈচিত্র্য পাওয়া যায়। ধ্বনির উচ্চাবচতা অথচ হোঁচট নেই। এই প্যাটার্ন বিষয়ের চাহিদায় আমার অনেক কবিতায় এসেছে (খোয়াবনামা, ঘরে ফেরা, স্বপ্নের ফেরিঅলা ইত্যাদি)।

নিরেট গদ্য কবিতা যেখানে প্রয়োজন, আছে। ‘প্রজেশ রায়’, কবিতা দমকা হাওয়ার মতো:

আমি প্রজেশ রায়ের কথা বলতে এসেছি।
হে বাঙলার বুজর্গ, প্রজেশ রায়কে আপনাদের মনে নেই।
আপনারা কি তাঁকে চেনেন? জানেন?
চিনতেন?
জানতেন?
কোন স্তবক কি আপনাদের উচ্চারণে আছে তাঁর?
বটেই! কেননা প্রজেশ রায় চার দশক আগে ম’রে গিয়েছে।

আমাদের ভাষায় কথ্য থেকে প্রমিত’র মধ্যে অনেকখানি দূরত্ব। এই বিচিত্রতার সমাহার আমার লেখায় আছে, কিন্তু একেবারে ডায়ালেক্টে লিখিনি। মনে হয়েছে, সেটা গদ্যের কাজ। ধ্বনি শ্রুতিকল্প নিয়ে বিস্তৃত বললাম কেননা আমার কবিতায় তার বিচিত্রতা আছে—চিত্র এবং শ্রুতিকল্প কীভাবে যৌথ সমাহারে সার্থক হয় তার বিবিধ নমুনা আছে।

নির্ঝর: ক্লাসিক কবিতার বৈশিষ্ট্য কী? আপনার কোন কবিতাগুলিকে আপনি ক্লাসিক বলবেন?

ওমর: রুমি, শেক্সপিয়র, র্যাঁ বো, জীবনানন্দ—এঁদের ক্লাসিকের এক এক রকম বৈশিষ্ট্য। তবে তাঁদের আমরা এখনও পড়ি, এতকাল পড়ি—এই কারণেই তাঁরা ক্লাসিক। কেন ইত্যাদি লিখতে গেলে ডিগ্রিপ্রাপ্য থিসিস হবে, অন্তর্দীপ্তি বাড়বে না। ক্লাসিকত্ব নয়, আমি টেকসই মনে করি, অন্তত একাধিকবার পড়ে ক্লান্তি আসবে না, এমন কয়েকটি কবিতার নাম বলবো—
‘তদন্ত’ (বিচারবহির্ভূত হত্যা), ‘খোয়াবনামা’ (মানুষের স্বপ্ন), ‘মাছ’ (প্রেমের ঐশ্বর্য), ‘সঙ্গীত’ (মউসিকির রুহুদারী), ‘রিলকের আসা যাওয়া’ (প্রেমের কবিতার মুস্কিলতা), ‘বিব্রত বর্ণমালা’ (টেকনোলজির প্রগতি আর আমাদের পিছুটান), ‘অন্ধকারে লাফ’ (বাসনা), ‘নিউইয়র্কে যিশু’ (বর্তমানের মানুষ জিওপলিটিক্সের চক্রে), ‘স্বপ্নের ফেরিঅলা’ (বাঙালির সত্তা), ‘হাইব্রিড মুরগি’ (রাজনৈতিক সংকট), ‘স্তন্যপান’। এগুলো আমার পছন্দের। অন্যদের অন্য কিছু ভালো লাগতে পারে।

নির্ঝর: এই মধ্যে বেশিরভাগ কবিতা আমারও পড়তে ভালো লাগে। আচ্ছা, আপনি তো বিজ্ঞানী। দীর্ঘদিন নাসায় কাজ করেছেন। বিজ্ঞান, মহাকাশ ‍বিজ্ঞান এইসব আপনার কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে? যদিও আপনার কবিতায় বিজ্ঞানকে সরাসরি দেখা যায় না, প্রচ্ছন্নভাবে কদাচিৎ এসেছে কখনো শব্দে বা সিঙ্গল ইমেজে। এই বিষয়ে বলেন।

ওমর: ‘ইন্টারনেট গায়ত্রী’ এবং ‘বিব্রত বর্ণমালা’ এই দুই কবিতার বিষয় প্রত্যক্ষভাবে বিজ্ঞান ও বাঙালি। অন্যান্য কবিতায় ইমেজারিতে, প্রসঙ্গে এসেছে। অনেক রুবাই কবিতার বিষয় বিজ্ঞানজড়িত। বিজ্ঞান যেহেতু ইতিহাসে মানুষের অস্তিত্ব ও প্রগতির ব্যাপার, বিষয় হিসাবে তাকে ফেলানো যাবে না। এ নিয়ে অক্টাভিও পাজ-এর চমৎকার প্রবন্ধ আছে।

নির্ঝর: আমি নিজে যেহেতু খানিকটা লিখি। আমি কখনোই কবিতায় এমন কোনো শব্দ ব্যবহার করি না, যেটা ফুটনোট দাবি করে। আপনার কবিতায় ব্যাপারটা বেশি দেখা যায়। এইটা কেন? এটা না করলেই কি নয়। এইটা পাঠককে ডিসঅ্যাপয়েন্টটেড করে বলে আমার মনে হয়েছে একজন পাঠক হিশেবে।

ওমর: বিষয়ের জটিলতায়, পাঠককে ধরিয়ে দেবার জন্য।

নির্ঝর: অন্যদের উপমা বা শব্দবন্ধ বা কোনো পঙক্তি বা বাক্যাংশ নিজের কবিতায় ব্যবহার না করলেই কি নয়? যেখানে আপনি নিজেই তা আরো ভালোভাবে বানাতে পারছেন। অন্যদের কিছু দেখলে প্রথমেই তাদের কথা মনে পড়ে। যেমত আপনার কবিতায় ‘খড়ের গম্বুজ’ এই শব্দবন্ধ দেখে আমার আল মাহমুদের কথা মনে পড়েছে। হুমায়ুন আজাদের কবিতায় ‘খড়ের গম্বুজ’ পড়েও আমার মাহমুদের কথাই মনে পড়েছিলো প্রথমে। কারণ এটা আমি প্রথম পড়ি তার কবিতায়। এটা আপনি কেন করেন? আপনার পূর্ববর্তীরা করেছেন বলেই আপনি করেছেন। যেমত আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ।

ওমর: শব্দ কারো সম্পত্তি নয়। জীবনানন্দ দাশ অনেক শব্দ ব্যবহার করেছেন কথ্য ভাষার থেকে, অনেক শব্দবন্ধ যা তাঁর আগে ব্যবহৃত হতো না। লোকে বলে জীবনানন্দ’র শব্দ। সুধীন দত্ত অনেক তৎসম শব্দ তৈরি করেছেন। এগুলো ব্যবহার মানেই অনুকরণ নয়। কথা হচ্ছে, কন্টেক্সট কী, কী অন্যান্য শব্দের সমাবেশে সেটা লাগানো হয়েছে। ‘খড়ের গম্বুজ’, একটা কবিতার নাম দিয়েছি। এর সঙ্গে মাহমুদ-এর কবিতার কিছুই নেই। আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক ঘটনাকে সাততলা এক মিনারের বিভিন্ন থাকে ক্রমিক সাজানো হয়েছে। আসলে এটা ইয়েটস-এর টাওয়ার কবিতার প্যাটার্নে। বুদ্ধদেব বসু ‘আমার মিনার’ লিখেছেন একই স্ফুলিঙ্গ ধরে। ঘটনা বলি। আমার ‘খোয়াবনামা’ কবিতার শুরু: নক্ষত্রর তলে কেউ জেগে নেই/জেগে নেই কেউ আজ রাতে।/ সবাই ঘুমোয় ঢের—/স্বনিদ্রায় সব্বাই স্বপ্নে বিভর’। খালিকুজ্জামান ইলিয়াস শুনে বললো, ‘ঢের’—ঢের, জীবনানন্দ। সবাই অচেতন ঘুমোচ্ছে, এই ফ্যাক্টের ৮ মাত্রা দরকার আমার। অচেতন সব্বাই ঘুমে, আরও কিছু করা যায়, কিন্তু লয় শ্রুতিতে ফিট করে না। আমি বললাম, অসুবিধা নাই,— ‘অঢেল সবাই ঘুমে’। বলেছিলাম ১৯৮৬ সালে। কিন্তু এখনো ছাপায় পাল্টানো হয়নি।

নির্ঝর: শব্দ অবশ্যই কারো সম্পত্তি নয়। আমি অবশ্য ওইঅর্থে শব্দের কথা বলিওনি। আমি মূলতই বলতে চেয়েছি অন্যের ব্যবহৃত বা বানানো শব্দের কথা নয়, বলতে চেয়েছি অন্যের বানানো শব্দবন্ধ, ফ্রেইজ, মেটাফোর ইত্যাকার বিষয়ের কথা। যাইহোক, কবিতার ক্ষেত্রে কোন কোন কবি আপনাকে বেশি প্রভাবিত করেছে বলে আপনার মনে হয়?

ওমর: কবিতায় অপ্রভাবিত বলে কিছু নেই, বলেছেন পাবলো নেরুদা। অতএব প্রভাবকে কে কেমনভাবে হজম করে সেইটেই সূক্ষ্ণতা। আমি যখন কবিতার দালান তৈরি করি, তখন জমি, ইট, পিলার, রুয়া, বাটাম, লোহা, দরোজা, জানালা সব আমার। প্রভাব শুধু সিমেন্টের মধ্যে। তার মশলা আর বিভাগের মধ্যে প্রভাব গোলানো। আমি যেসব দেশি, বিদেশি কবিদের উল্লেখ করেছি তাদের প্রভাব আছে আমার চিন্তায়, কিন্তু কীভাবে কোন ডিটেইলে তা বলা মুশকিল। আবার অনেক কবিতা আছে যেখানে কোনো হাওয়াই লাগেনি, পুরোটাই স্বয়ম্ভূত, যেমন ‘সঙ্গীত’, ‘স্তন্যপান’।

নির্ঝর: ৩০ দশকের পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ কেমন করে অর্জুন হয়ে উঠলেন বলে আপনার মনে হয়? অন্য চারজনকে তো আমরা তার মতো চর্চা করি না। কালে ভদ্রে, গবেষণা বা রেফারেন্স হিশেবে পড়ি বা উল্লেখ করি। কী প্রক্রিয়ায় জীবনদাশ এমন চিরকালীন হয়ে গেলেন? অথচ তার জীবদ্দশায় বুদ্ধদেব ছাড়া অন্যকেউ তাকে ওই অর্থে স্বীকারই করতো না। সুধীনদত্ত তো তাকে কবিই মনে করতেন না, আপনার কী মনে হয় এটা ঈর্ষাপ্রসূত আচরণ নাকি, অজ্ঞতাবশত। অজ্ঞতা তো হতেই পারে না, কারণ সুধীনদত্ত বেশ শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। আপনি তো জীবনদাশকে নিয়ে একটা গ্রন্থই রচনা করেছেন, ‘কেন শুদ্ধতম’। তো সেই বইয়ের আলোকে বা আরো নির্দিষ্ট করে যদি আপনি এই বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করতেন তাহলে ব্যাপাটার একটা সমাধান আসতো।

ওমর: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ফর্মের কবি। রবীন্দ্রনাথ-এর স্টাইলকে আরও ফাইন করেছেন>বিষয় আলাদা। জীবনানন্দের ঢিলে লয়ের কবিতা তার ভালো লাগেনি। রবীন্দ্রনাথেরও না। জীবনানন্দ তার লয়/সুর (বিলম্বিত)+বিষয়ের বিচিত্রতা+টাইম/ইতিহাস-এর জন্য ইম্পরট্যান্ট। প্লাস বাঙালি রূপসী বাঙলায় মাতাল।

নির্ঝর: আপনার সমসাময়িক বাঙলাদেশি কবিদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

ওমর: আমার সমসাময়িক, কাল ধরে ধরে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান, হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে একালের মাসুদ খান, সোহেল হাসান গালিব ইত্যাদি। আমি এখনো লিখি। ৮ জন কবি, ৬০-৭০-এর, নিয়ে বিশদ লিখেছি পঞ্চাশের পরে বইটিতে। যেহেতু নিজের কথা বলেছি এখানে, জীবিত সমসাময়িকদের নিয়ে এখানে আর বলবো না। অন্যত্র বলা যাবে একদিন।

নির্ঝর: আপনার কবি হয়ে ওঠার কাহিনি বলেন।

ওমর: স্কুলের খাতায় লেখা শুরু, কিন্তু প্রকাশ করিনি। ৬০-এর দশকের শেষের দিকে প্রকাশ শুরু। আহসান হাবিব আমার প্রবন্ধ (আর্ট সমালোচনা) ছেপেছিলেন, কবিতা ছাপেননি। ১৯৭২ সালে ফিজিক্স পড়তে আমেরিকা চলে যাই। নাসা, বেল ল্যাব-এ চাকুরি। কিন্তু পাশাপাশি কবিতা লিখেছি। দেখেছি, শুনেছি, পড়েছি, ভেবেছি, লিখেছি, কেটেছি, লিখেছি। কীভাবে? সদুত্তর মুশকিল। ১৯৮৪-তে প্রথম বই ‘বোধিবৃক্ষতলে’। প্রেসে থাকতেই পাণ্ডুলিপি পড়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রিভিউ করেছিলেন। কবি আহসান হাবিব বই দেখে, পড়ে খুব খুশি হয়েছিলেন।

সব শেষে একটি ছবি দিয়ে আমার অপারগতার কথা বলতে চাই। ছবিটি দেখো:

এই তো আমাদের ৭০ শতাংশ মানুষের জীবন, অস্তিত্ব, হতাশা, সংকট, যন্ত্রণা, আশা, উদ্দীপনা, সংগ্রাম—চুলো আর আঘাত-জর্জরিত অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়ি তার প্রতীক। এটাই রিয়ালিটি। এই রিয়ালিটি নিয়ে যে-অনুভূতি তাই নিয়ে কবিতা লিখতে চাই। কিন্তু হয় না, প্রত্যক্ষ বললে কবিতা হয় না। কবিতা রিয়ালিটির আরেক রূপ। এটাই আমাদের রূপ, অথচ কবিতায় তাকে ধরতে পারি না। এই অস্তিত্ব ধরার জন্য যে যাদু তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি।

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য: আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ সময় দেয়ার জন্যে। কবিতার সঙ্গে থাকুন। এই শুভ কামনা।

ওমর শামস: তোমাকেও ধন্যবাদ।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.