:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
ফাউজুল কবির

কবি

কবিতা বিষয়ে একান্ত আলাপ এবং কবি জিললুর রহমানের ‘মেলে না উত্তর’
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

পত্র নিবন্ধ

কবিতা বিষয়ে একান্ত আলাপ এবং কবি জিললুর রহমানের ‘মেলে না উত্তর’

প্রিয় জিললুর রহমান, ভালোবাসা।
এ এক আশ্চর্য সময় করোনা সময়। জীবনের জন্য অথবা মৃত্যুর জন্য কী সমূহ সর্বগ্রাসী বিচ্ছিন্নতা। ওরান শহরের প্লেগতাড়িত একটি সমগ্র বছরের নগর জনকুণ্ডলায়নের বিভীষিকাময় সংগ্রাম ধৈর্য আর ভালোবাসাময় জীবন ও বিচ্ছিন্নতার নির্মম বিবরণ আমরা ক্যামুর কাছ থেকে জেনেছি। হায় মানব ভাগ্য—নিয়তি ও প্রকৃতি।

রাত্রি ও দিনের সুদীর্ঘ সময় ঘুমে ও নির্ঘুমে কাটিয়ে জেগে উঠলাম কিছুক্ষণ আগে—বিকেলে। এবং দেখলাম আপনার কবি হৃদয়ের সৃজন ও স্বপ্ন-বেদনার এক অসাধারণ জগৎ— নাম যার ‘মেলে না উত্তর ‘ (২০ ০৪ ২০)। চিত্তের মুগ্ধতায় আর টান্-টান সচেতন স্নায়ু নিয়ে পাঠ করলাম। পাঠ করে নিজেই বলে উঠলাম— যাকে চেনার তাকে চিনে ফেলেছি— ভালোবেসে–ভালোবাসিয়াছি। আপনি জানেন এবং আমিও কিছুটা জানি – কবিতা শুধু নির্মাণের বিষয় নয়— নির্মাণের অধিক কিছু অদৃশ্য করণ-কৌশল ও করণলীলা কবির স্নায়ুতে অস্তিত্বে কাজ করে। জানি- সেটা শুধু বোধ নয় বোধের অতীত এক মানসমনন ক্ষমতা – যা কবিরা সাক্ষাৎকার ও আত্মপরিচয়কে কবিতার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করেন।

আমি কখনো কখনো বোকার মতো কবির ভেতরে – অন্তর্চিত্তে শব্দ ও ধ্বনির এবং বাক্য ও বচনের অতিক্রান্ত একটা কিছু খুঁজি যা তার অন্তর্লোক-অন্তর্জগত যাকে বলি প্রজ্ঞাসাধনের শিল্পিত লীলার জগৎ। কিছু কিছু সময় আছে প্রহরের লগ্ন আছে– যাকে বলি লৌকিকের অলৌকিক মুহূর্ত। কবির আত্মমগ্নতা ও আত্মলগ্নতার ভেতরে তারই চেতনার অজ্ঞাতে কখনো কখনো কিছু দুর্লভ সময় দ্বীপের মতো জেগে ওঠে — তখন কবি জানেনই যে– তিনি মৎস্যগন্ধাকন্যাকে মহত্ব দানের প্রত্যাশা জানাচ্ছেন। মহৎ কবিতার ইতিহাসে ভালো কবিতার ইতিহাসে এমন ঘটনা কী ঘটে না? অবশ্যই ঘটে। আবার যে কবিতাটি আমার কাছে উৎকর্ষে মহত্ত্বের দাবি করে – স্মরণের দাবি জানায় সে কবিতাটিই আরেকজন পাঠক অথবা কবির কাছে সে দাবিতে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে না। কবিতা বা শিল্পের রহস্য এখানেই। অনেকের কাছে আমার একথা প্রেরণা মনে হতে পারে—আবার কারও ভালো না’ও লাগতে পারে। কিন্তু আমি আমার চেতনলোকের প্রতিমা ও অপ্রতিমার আজ্ঞা নিয়েই চলি। মার্কিন কবি হুইটম্যান বা এমিলি ডিকিনসনের কথাই ধরুন— তাঁদের কেউ কাউকে চিনতো বা পড়ার সুযোগ ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু সম্ভাবনার অমরত্ব বা অমরত্বের সাধারণ সম্ভাবনা তাদের চিত্তের ভেতরেই কখনো ঘুমে কখনো জাগরণে বা শিল্পের স্বপ্নে জেগেছিলো আমাদের কালে ভেসে আসার জন্য। যেমন ভেসে আসে – ভ্রমণের পাল তোলে দূর অতীত থেকে কালিদাস–হোমার–সফোক্লিস–গ্যাটে এবং আমাদের কাছাকাছি কালের বিপুল-বিশাল-মহৎ সুন্দরের রবীন্দ্রনাথ। বলতে পারি কোলরিজ শেক্সপীয়র দান্তে লরেন্স ফ্রস্ট এলিয়ট বোদলেয়ার ল্যুইস এবং অনেক স্মরণীয় কবির কথা। যাক ওসব আলোক ঝলকিত কবি-শিল্পীদের কথা।

কবিতা কোন জায়গাটিতে কবিতা হয়ে উঠছে—তিন ভুবনের বেদনা নিয়ে জেগে উঠছে — জীবনকে ভাষার দর্শনময়তায় অথবা দর্শনের সুর ও মমতায় স্পর্শ করেছে একথা কবিও অনেক সময় জানেন না—বিশ্বস্ত কবিদের কেউ কেউ জানেন হয় তো বা। মহৎ ও অভিজ্ঞ মুচি হাঁটা দেখলে বুঝতে পারেন— কোথায় ভদ্রলোকের পায়ে লাগছে অথবা কেমন নির্ভার—সহজ জুতার ব্যক্তিত্ব নিয়ে হাঁটছে।

আপনি জানেন একটা সংশ্লেষকে – একটা সমৃদ্ধ বাক্যবদ্ধ চিন্তনকে নানাভাবে বিদ্ধ করে—বিশেষ করে কাব্য বা চিত্রশিল্পে বিভিন্ন কৌণিক দিক থেকে দৃশ্যটিকে দেখে আরেকটি নতুন সিদ্ধান্ত বা নতুন সংশ্লেষ নির্মাণ করা যায়। এবং সেটা করাই তো কবির কাজ। নতুন শব্দ তৈরি করেন বড় মাপের কবিরা। তারা ক্ষমতাশালী নিঃসন্দেহে। নতুন শব্দের নির্মাণ বা তৈরির চেয়ে শব্দকে নতুন অর্থায়ন—শব্দের মধ্যে নতুন জীবনবোধ সঞ্চারণ এবং ভাব ও ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করাই কবির মহত্তম কাজ। এ ব্যাপারে আমার দুর্বলতার কথা জেনেও কথাটা অসংকোচে বলে ফেললাম। সকলের কাছে নয়—কারো কারো কাছে সত্য ও ভালোবাসার অসংকোচ প্রকাশের সুযোগ নেয়া যায়। আমার একটা মন আছে—পাখি স্বভাব আছে—আমি বিস্মিত হতে জানি—খুঁটেখুঁটে মহত্ত্বের দানাদার শস্যগুলোর সন্ধান করতে আনন্দ পাই। আমি এ-ও জানি কবিতা মন্ত্রবিশ্বাসে পঠন-পাঠনের বিষয়-আশয়। শ্রুতি ও তার একটি অবশ্যমান্য অভিজ্ঞান। তবে সুখ ও আনন্দের মধ্যে আপনি কতটুকু পার্থক্য করবেন আমি জানি না। কোনো কোনো কবিতা আছে আমি পড়ে সুখী হই – কোনো কোনো কবিতা পড়ে আমি আনন্দিত হই এবং দীর্ঘ সময় আত্মস্থ ও সমাধিস্থ থাকি—কবির চেতনা আকাশে—তখন আকাশকেই দেখি শুধু — কোনো নক্ষত্র দেখি না। একটা কথা গোপনেই বলি — যদিও অনেকবার আমার স্বপ্নের কথা ব্যক্তিগত আরাধ্যের কথা আপনাকে এবং অন্য কবিদের কাউকে না কাউকে ব্যক্তিগত আলাপসালাপে বলেছি— কবিতার মহত্ত্বকে আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি জানি, এবং মহৎ কবিতাকে ধরতে ও চিনতে পারি, এবং আলিঙ্গন ও চুম্বন করতে জানি। কিন্তু এখনো মহৎ কবিতা লিখতে পারি না — আগুন ছিনিয়ে এনে দান করে বলতে পারি না — আমি আগুনের কবি। সমুদ্রমন্থন করে বলতে পারি না আমি জলের কবি। আমি সেই কবি—স্বর্ণময় ব্যর্থতাকে চিরকাল বয়ে বেড়াবার জন্যই আমার জন্ম। তবু এমার্সনের সেই বিখ্যাত উক্তি বলতে ভালো লাগে। ‘There is no true eloquence unless there is a man behind the speech’’. এবং গদ্যে কথা বলতে আমার ভয় লাগে— কারণ আলস্য আমার বড় সম্পদ। গদ্যে কথা বলতে শ্রম ও সাধনা লাগে। ভাবনাকে চাষ করতে পারে যে — তাকে হতে হয় ভালো কৃষক — তা আমি হতে পারিনি। আর আব্রাহাম লিংকন তো আমাকে বহু আগে সাবধান করে দিয়েছেন– বলেছেন– এমনকি ‘Extemporaneous speaking should be practiced and cultivated’. ফলে আমি আর গদ্যের প্ররোচনায় প্রলোভিত হই না। আর বলতে গেলে লোভনের শক্তি আর বয়সও হারিয়েছি। তবে এ কথা মানি — স্রেফ গদ্য না হলেও — ভালো চমৎকার বাছাইকৃত চেতনার সম্মোহনী যাদুময় গতিময়তার উৎকৃষ্ট গদ্য—যা আত্মার কাব্যিক প্রেরণায় ঊর্ধগামী হয়ে উঠে তা শ্রেষ্ঠ কবিতার রূপময় ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়ায়—বলে ওঠে আমিই সুন্দর আমিই সত্য আমিই কবিতা।

এতক্ষণ যা কীর্তন করলাম আপনাকে লক্ষ্য বা উপলক্ষ করে নিজের ধারণা ও বিশ্বাসের কথাই প্রকাশ করলাম। অর্থাৎ নিজের বাদ্য নিজে বাজানো। তবু মাঝে মধ্যে উপলক্ষ পেলে লজ্জা ভাঙ্গে। এবার আমি আপনার সুন্দর ‘মেলে না উত্তর’ কবিতাটির পাঠপরিভ্রমণ
ও পাঠপরিক্রমণ কীভাবে করেছি ও দেখেছি সে বিষয়ে একটা চিন্তনছবি দেখাতে চাই।

মেলে না উত্তর।। সূচনা
প্রথম দিনের সেই সূর্য থেকে রবিঠাকুরের কাল শেষ করে
কতদূর হেঁটে গেছে শতবর্ষ ধরে মানূষের সরব মিছিল

তারপর ?
বারবার মনে শুধু একই প্রশ্ন উসকানি দেয়—কে যে আমি

তারপর?
কতো গালগল্প যুগেযুগে সবুজ শ্যামল স্রোতস্বী নহর আর

কোথাও আমার নেই যথাযথ স্থান তবু ঠাঁই খুঁজে খুঁজে ফিরি।

তারপর?
আকাশের আসমানী ওজোনের রূপটুকু একদিন ঝরে যাবে।

তারপর ?
কোকিলের সাথে বেশ কথা হলো বসন্তের হামের…

তারপর?
যারা যায় চিরতরে যায় রূপকথা ছড়াতে ছড়াতে দূরে
কোনোদিন দেখা আর পাবে না তো কেউ এই বনে

তারপর?
ভবিতব্য ভূতের নেপথ্যে চলি আর ভাবি বসে বসে — মেলে না উত্তর।

জিললুর রহমান। [ছবি: সংগৃহীত]

হাজার বছর আগে পূর্ণিমার রূপখানি কেমন ছিলো? হয়তোবা কোনো প্রস্ফুটিত গভীর সুন্দর আর মদালসা নারীর মতো। সেই রূপ আজ আর নেই। কোথায় গেলো? হারিয়ে গেছে? এই পৃথিবীতে একদিন সবুজ শ্যামল নদীরা যে বহমান ছিলো জলের তরঙ্গে, স্রোতে আর নিবিড় সঙ্গীতে— তারা আর নেই। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রতিরক্ষাব্যুহ—আকাশের আসমানী ওজোনের রূপটুকুও একদিন হয়তো হারিয়ে যাবে। বাংলার যে বসন্ত—যার প্রধানতম অস্তিত্বের ঘোষণাকারী কোকিল— জীবন ও যৌবনের প্রতীক তার সাথে কবির আলাপ হয় — সে আলাপ যৌবনের ভালোবাসা ও হৃদয়বৃত্তির নয়—আলাপ হয় বসন্ত রোগের – মৃত্যুর। যারা — মানবমানবীরা জীবনের স্বপ্নের নক্ষত্র আকাশের রূপকথা খৈ ছড়াতে ছড়াতে চলে গেছে দূরে-বহুদূরে হৃদয়ের নাগালের বাইরে—তারা আর ফিরবে না কখনো। কেন ফিরবে না? ফেরার পথ নেই উপায় নেই – বাংলাদেশ নামক যে বনের হৃদয় জীবনের সবুজ-হলুদ আনন্দপ্রচ্ছদে মানবেরে কোলে নিতো — সমুদ্র গভীর ভালোবাসার আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখতো — সে উদার প্রকৃতি আজ মুমূর্ষু মৃত। জীবনানন্দের সেই বাক্যটির মতো আরেক মিনিটের জীবন ভিক্ষা করছে। অথবা ‘ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে’—যেমনটি বলেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ। কার ছায়া? জীবনের নারী ও পুরুষের ছায়া — জীবনের ছেলেমেয়েদের ছায়া। জীবনের হৃদয়ের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা ও সজীবেরা—প্রজাপতি জোনাকিরা নিরুদ্দেশ আজ। মানবের-মানুষের জীবন ও প্রকৃতির ভবিষ্য ও ভবিতব্য আজ অনাকাঙ্ক্ষিত ভূত ও প্রেতের দখলে। না — এ চিত্র বাংলাদেশ নামক কোনো অসাধারণ দেশের নয় শুধু— এ ছবি সমগ্র পৃথিবীর — মানব নিয়তির মানব ভাগ্যের। তবে আমরা কি অবস্থান করছি নির্মম বাস্তব ও মানস অনিকেতে? হয় তো বা তাই। এই তীব্র-তীক্ষ্ণ অস্তিত্ব কাঁপানো বেদনাবোধের চিত্রিত ক্যানভাসই দেখি আমরা কবি জিললুর রহমানের ‘মেলে না উত্তর’ কবিতায়। এসব নৈরাশ্যের কথা নয়, কবিকল্পনা নয় — শব্দ ও বোধের আলিঙ্গনে আঁকা কাব্যিক বিশ্বজনীনতার কথা। সাধুবাদ কবির অবশ্যই প্রাপ্য। তবে মনে হতে পারে কেউ কেউ বলতে পারেন কবি ইচ্ছা করলে কবিতাটিকে আরো উৎকৃষ্ট করে তোলার জন্য খানিকটা সম্পাদনার আশ্রয় নিতে পারেন। নাম মনে পড়ছে না এ মুহূর্তে — তবে পৃথিবীর বড় কবিদের কেউই বলেছিলেন উৎকৃষ্ট কবিতার বা শিল্পের কিছু খুঁত থাকাটাই উৎকৃষ্টের পরিমিত লক্ষণ। যেমন মুখের তিল — নিশ্চিত খুঁত — কিন্তু সুন্দরকে আরো সুন্দর করে তোলে।

মানুষ পৃথিবী জন্ম ও মৃত্যু জীবনের আনন্দ ও বেদনার রহস্য নিয়ে মানুষের কবির শিল্পীর জিজ্ঞাসা চিরকালের। জিজ্ঞাসা আছে বলেই মনুষ বোধ ও শিল্প চিন্তক প্রাণী। রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বলেছিলেন— প্রথম দিনের সূর্য / প্রশ্ন করেছিল / সত্তার নতুন আবির্ভাবে / কে তুমি / মেলে নি উত্তর।/ বৎসর বৎসর চলে গেল / দিবসের শেষ সূর্য / শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল / পশ্চিম সাগর তীরে / নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় / কে তুমি / পেল না উত্তর।

উত্তর মেলে না বা মেলেনি বলেই ‘রূপ-নারাণের কূলে’ জেগে উঠতে হয় কবিকে এবং বলতে হয়— ‘সত্য যে কঠিন / কঠিনেরে ভালোবাসিলাম / সে কখনো করে না বঞ্চনা/ আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন, / সত্যের দারুণ মুল্য লাভ করিবারে / মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।’
তারপরও মানব মনে কবি মনে জন্মের ঋণের কথা স্মরণে আসে স্মৃতিকে জাগায় — তাই রবীন্দ্রনাথ ‘জন্ম’ কবিতায় উচ্চারণ করেন —‘রূপহীন জ্ঞানাতীত ভীষণ শকতি / ধরেছে আমার কাছে জননীমুরতি।’ সকল কষ্ট অবিশ্বাস যন্ত্রণা ও বেদনার ভেতরেও রবীন্দ্রনাথের ধীশক্তির উপর আস্থা রাখাই আমাদের জন্য হয়তোবা শ্রেয়।

হাউসম্যান বলেছেন— ‘কবিতা কথিত বিষয় নয়, বিষয়ের কথন’। হাউসম্যান আরও বলেছেন— ‘পাঠকের বোধে লেখকের অভিজ্ঞতার একটা সমদোলা সৃষ্টি করা কবিতার বিশিষ্ট কাজ’। আর কোলরিজকে যদি প্রজ্ঞার মান্যতা দেই ‘কবিতা সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয় যখন সম্পূর্ণভাবে না বুঝে তাকে সাধারণভাবে বোঝা হয়।’ কোলরিজের এ কথাটি আমার মনে ধরে, ভাল লাগে।

প্লেখানভ বলেছিলেন ‘শিল্পী তার বক্তব্য প্রকাশ করেন চিত্রকল্পে; সাংবাদিক কিংবা আইনজ্ঞ তাঁর চিন্তাচেতনা প্রকশ করেন বিতর্কমূলক প্রকাশের মাধ্যমে’। আর যদি শিল্পবোদ্ধা রাসকিনের কাছে যাই তিনি এরকম একটা গল্প শোনান। রাসকিন বলেন— কোনো কুমারী তার হারানো ভালোবাসার জন্য গান গাইতে পারে বা কবিতা লিখতে পারে। কিন্তু একজন কৃপণ ধনী তার হারানো অর্থের জন্য শোক বা বিলাপ করতে পারে—তা গান বা কবিতা হয়ে ওঠে না। এখানেই শিল্পের ভিত্তি বা মর্মবস্তু কথা বলে। আর কেউ যদি ফ্লবেয়ারের কথায় বিশ্বাস করতে চান— তা হলে শুনুন— ফ্লবেয়র বলছেন ‘লাম্পট্যের চেয়ে কাব্যিক আর কিছু নেই’ অথবা ‘শিল্প হলো অপ্রয়োজেনের অন্বেষা’

না — এ চিত্র বাংলাদেশ নামক কোনো অসাধারণ দেশের নয় শুধু— এ ছবি সমগ্র পৃথিবীর — মানব নিয়তির মানব ভাগ্যের। তবে আমরা কি অবস্থান করছি নির্মম বাস্তব ও মানস অনিকেতে? হয় তো বা তাই। এই তীব্র-তীক্ষ্ণ অস্তিত্ব কাঁপানো বেদনাবোধের চিত্রিত ক্যানভাসই দেখি আমরা কবি জিললুর রহমানের ‘মেলে না উত্তর’ কবিতায়। এসব নৈরাশ্যের কথা নয়, কবিকল্পনা নয় — শব্দ ও বোধের আলিঙ্গনে আঁকা কাব্যিক বিশ্বজনীনতার কথা।

এবার একটু কবিতা সংশ্লিষ্ট ভিন্ন কথায় আসি। ভালো কবিতা চেনার জন্য— আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছি — বোধ হয় মুচিদক্ষতা লাগে। এ কথায় কেউ রাগ করবেন না — এটি একান্ত ব্যক্তিগত বোধ ও মত। কেন কথাটি বলছি? উক্তিটি কার মনে নেই — কোনো মহৎ ব্যক্তির যে হবে এতে সন্দেহ নেই। মনে আছে বলে উদ্ধৃত করছি [ভুল হলে ক্ষমা করবেন]‘No man knows so well where the shoe pinches as he who wears it’. কবিতা কোন জায়গাটিতে কবিতা হয়ে উঠছে—তিন ভুবনের বেদনা নিয়ে জেগে উঠছে — জীবনকে ভাষার দর্শনময়তায় অথবা দর্শনের সুর ও মমতায় স্পর্শ করেছে একথা কবিও অনেক সময় জানেন না—বিশ্বস্ত কবিদের কেউ কেউ জানেন হয় তো বা। মহৎ ও অভিজ্ঞ মুচি হাঁটা দেখলে বুঝতে পারেন— কোথায় ভদ্রলোকের পায়ে লাগছে অথবা কেমন নির্ভার—সহজ জুতার ব্যক্তিত্ব নিয়ে হাঁটছে। কবিতাকে যেভাবেই চিহ্নিত করি না কেন— যতই ক্ল্যাসিক কথাটি বলি না কেন— বা সুর ও কাব্যের যৌথ লাবন্যের ‘টুইন গডেসেস’ বলি না কেন— কবিতা মূলত ব্যক্তি ও কাল বিশেষের একটি অসাধারণ বোধযোগ্য অথবা খানিক বোধযোগ্য অথবা আত্মিকতার পরিমাপে বোধযোগ্য এক CEREBRATION। মহৎ কবিতা বোধ হয়, না বোঝাকে বোঝার অবিরাম প্রচেষ্টা। অথবা বোঝাকে নিজের মতো করে একটি নিজস্ব ভাষ্য রচনা করার বোধমুখই কবিতা। আনন্দের যতটা অর্থবহ অর্থ হতে পারে অথবা দুঃখ যতটা বেদনার রূপ নিতে পারে—ছবি ও অছবি আঁকতে পারে কবি ও কবিতার প্রকার ও ধরন ততটাই। আমার মনে হয় ‘Outward theorizer’ এর চেয়ে কবির ‘inner POET’ যখন শিল্পাত্মায় বড় হয়ে ওঠে, তখনই কেউ বলে উঠতে পারে— আমি কবি।
যদিও এ আলোচনা এবং কথা-বলা খুব একটা সম্মান ও মর্যাদা আকর্ষী নয়— দীর্ঘকালের পঠন-পাঠন ও তথাকথিত শিক্ষকতা পেশার দৌলতে প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনের কথা বলার অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেছে। হয়তোবা কেউ একথাও বলতে পারেন সাহিত্য তো অপ্রয়োজনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সে কথাকে মান্য করেই বলছি আমেরিকান কাব্যের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম গদ্য কবিতাটি ১০টি বাক্যে রচনা করেছিলেন আব্রাহাম লিংকন — যার নাম ‘গেটিসবার্গ স্পীচ’। বিষয়টিকে তুল্যমূল্যে বিচার করা যেতে পারে আরেক মহান রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক কাব্যিক ভাষণটিকে। লিংকন তার কালে একটা অসাধারণ উক্তি করেছিলেন—‘Broken eggs can not be mended’ অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি অকবিতাকে কবিতা বানানো যায় না। [যদিও আজকের যুগে কৃত্রিম ডিমও বানানো যায় নাকি। আর আইকা দিয়ে ডিম জোড়া লাগানোর কাজটাতো ব্যবসায়ীরা হরহামেশাই করছেন।]

যাক সত্যিকার কবিকে চেনার-জানার এবং চিহ্নিত করার কবি ও কাব্যবোদ্ধার অভাব হবে না কখনো। শুধু সময়ের বিষয় হয়ে অপেক্ষা করতে হয়। এমিলি ডিকিনসন খৈয়াম হাফিজ রুদকী কবীর রজ্জব রুমী দান্তে সফোক্লিস হোমার জীবনানন্দকে এবং ভবিষ্যতের-পৃথিবীর মহৎ কবিদের জানার জন্য কবি ও বিদ্বানের অভাব ঘটবে না। এবং Esoteric sips of sacramental wine এর কবিদের বোঝার জন্য ফীটজেরাল্ড কোলম্যান বার্কসদের মতো মহৎ চিন্তকেরা জন্মায়।

আমার অগোছানো কথাগুলিকে শেষ করতে চাই — ছোট্ট কবিতাংশটি দিয়ে—
”PERCEPTION OF AN
OBJECT COSTS
PRECISE THE OBJECTS ”.
এরকম বার্তাটিকে মান্য না করলে সত্যিকার কবির সংসার চলে না— চলতে পারে না। আমার মনে হয় কবিতাটি ডিকিনসনেরই [বোধ হয়]

অনেক কথাই বলা হলো। এখন নির্মম করোনা সময়। কথাদের চেয়ে মানবের জন্য সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রার্থনা মানবিক ও মঙ্গলের ধ্যানই উত্তম।

ফাউজুল কবির
২২ ০৪ ২০২০

 

মেলে না উত্তর
জিললুর রহমান

প্রথম দিনের সেই সূর্য থেকে রবিঠাকুরের কাল শেষ করে
কতো দূর হেঁটে গেছে শতবর্ষ ধরে মানুষের সরব মিছিল,
আজ সেই মিছিলের লেজের ডগায় নড়া চড়া করে যাই
বারবার মনে শুধু একই প্রশ্ন উসকানি দেয়, কে যে আমি!
কোথা হতে এসে কোথা চলে যাই প্রতিদিন, ভবিষ্যৎ
আমাদের ভূতের আবর্তে টেনে লয়ে যায়, কেন জানি নাই…

কতো গালগল্প যুগে যুগে সবুজ শ্যামল স্রোতস্বী নহর আর
সুখাদ্য পানীয় ফল ইত্যাকার লোভের সাথে অপরূপা হুর
পরীতুল্য রমণীর কথা, জন্ম জন্মান্তরে বলেছে ছলনাকারী।
তার সাথে নরকনন্দনে কতো বিচিত্র অগ্নিরূপ বিদঘুটে
প্রাণী কিংবা লকলকে সর্প আর কিলবিলে বিছাদের গান—
কোথাও আমার নেই যথাযথ স্থান তবু ঠাঁই খুঁজে খুঁজে ফিরি।

জানি লাল নীল কালো গোলাপেরা একদিন ছড়াবে না ঘ্রাণ
হয়তো নতুন কোনো পুষ্পদল অথবা ফুলহীন পাতার বৃক্ষ,
নতুন নতুন করে জন্ম নেবে যেমনটা যুগে যুগে বদলেছে রং,
আকাশের আসমানী ওজোনের রূপটুকু একদিন ঝরে যাবে।
জানি একদিন নতুন কালের গর্ভে মানুষের চিহ্ন থাকবে না
তবু মন আনচান করে ধুকপুক করে বুক, এতো এতো কাল
চলে গেল দিবসের প্রথম কী শেষ সূর্য দেয়নি উত্তর কিছু
বারবার মন শুধু প্রশ্ন করে কে রেখেছে মানুষের এই মিথ্যা নাম

কোকিলের সাথে বেশ কথা হলো বসন্তের হামের আড়ালে,
কথা হলো পরিযায়ী পাখিদের সাথে, এমনকি বৃক্ষশাখে বসে
যে দোয়েল নিত্য ডাকে তারও প্রশ্ন ডেকেছে মানুষ সে কে?
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা হাতিদের দল বলতে পারেনি,
বনের গভীরে ত্রস্ত চলা হরিণ শাবক বলে, আমরা তো জানি
লেজ হারা কিছু দুষ্টু বানর তোমরা, কেবল অনিষ্ট করো প্রকৃতির…

কোথা থেকে কিভাবে এমন হলো, একথা যে জানতো সে
চলে গেছে মহাকালে হাজার বছর আগে পূর্ণিমার রূপখানি
একবার কাছ থেকে দেখে নেবে বলে, তারপর ফেরেনি তো;
যারা যায় চিরতরে যায় রূপকথা ছড়াতে ছড়াতে যায় দূরে,
তারপর কোনোদিন দেখা আর পাবে না তো কেউ এই বনে।
রানার তবুও ছোটে তবু ভোর হয়ে আসে তবু সূর্য ওঠে পুবে
ভবিতব্য ভূতের নেপথ্যে চলি আর ভাবি বসে বসে — মেলে না উত্তর

রাত ১০:৫৬
২০ এপ্রিল ২০২০

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.