অক্ষরবন্দী জীবন : দ্বিতীয় পর্ব
কবিদের হাত থেকে -১
কবিদের হাতে থেকে যে বইগুলি উপহার হিসেবে পেয়েছি তা নিয়ে আরব্যরজনীর গল্প লিখা যায়, কিন্তু সেই সাধ্য কী আর আছে! বইগুলো মিলেছে অ-মূল্যে, অর্থাৎ উপহার হিসেবে। সবার বই নিয়ে একবসাতে আলোচনাও সম্ভব না, অগত্যা প্রতারক স্মৃতির সাথে সন্ধি করে যাঁদের কথা আগে মনে পড়ল তাঁদের কথাই বলা যাক।
সেবার প্রথমবারের মত বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হবে; আমি তখন ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসুচিতে কাজ করি, আমরাও যোগ দিতে চাই, সেই সূত্রে ফরিদ কবিরের বারডেমের অফিসে যাওয়া। উনি তো শুরুতেই আমাকে ‘মধুমেহ’ পত্রিকা ধরিয়ে দিলেন! আমার একটা পুস্তিকা আলগোছে বের করে সামনে দিতেই স্বরূপে আবির্ভূত হলেন। তারপরের আলাপ আলোচনায় আমার সঙ্গী অঞ্জনদার সন্দেহ হল আমরা যেন কত যুগের পরিচিত। উপহার দিলেন তাঁর ১০ টি কবিতার একটা ভাঁজপত্র, গুপু ত্রিবেদী অলংকৃত; কিন্তু ভাঁজপত্রের শিরোনাম মনে পড়ে না। ‘বারান্দার গল্প’ কবিতাটি মনে ধরে গেল। কবিতাটি মাথায় থাকতে থাকতে আমি লিখে ফেললাম ‘হাওয়া বদলের কবিতা’।
এজাজ ইউসুফী চট্টগ্রামের লিরিক গোষ্ঠীর প্রাণভোমরা। ইলিয়াস সংখ্যা আর উত্তর আধুনিক কবিতা সংখ্যা প্রকাশ করে লিরিকের তখন খুব নামডাক। আমার কবিতা আর গদ্যও ছাপা হয়েছিল লিরিকে। মাঝে মাঝে চকবাজারের সবুজ হোটেলের লিরিককেন্দ্রিক সবুজ আড্ডায় যেতাম; সন্ধ্যা থেকে বেশ রাত অবধি চলত সেই আড্ডা, হোটেল বন্ধ হয়ে গেলে পাশের সোবহানিয়া এক্সরে ক্লিনিকের সামনের উদাস চত্বরে গড়াত আড্ডা। আসতেন হাফিজ রশীদ খান, হাবিব আহসান, সোহেল রাব্বি, জিললুর রহমান, খোকন কায়সার, পুলক পাল, সাজিদুল হক, আহমেদ রায়হান, শ ম বখতিয়ার আরো অনেকে। লিরিক ছাড়াও সুদর্শন চক্র, সমুজ্জ্বল সুবাতাস আরো নানা কাগজের সুতিকাগার এই আড্ডা। জীবিকার টানে পড়া শেষ করে ঢাকা চলে আসি। সে সময়েই এজাজ ইউসুফীর প্রথম কাব্য ‘স্বপ্নাদ্য মাদুলি’ বের হয়। আমাকে সেই উদাস চত্বরের এক শুক্কুরবারের আড্ডায় বসে ‘একজন তীক্ষ্ণ তরুণ’ তকমাসহ বইতে লিখে দিলেন। এজাজ ভাই একদিন আড্ডায় হাহাকার করে বলেছিলেন, “আলেকজান্ডার ৩৩ বছর বয়সে বিশ্ব জয় করে, আর আমি কী করি!”
জিললুর রহমান তাঁর এ যাবত প্রকাশিত পাঁচটি বইই (পঞ্চস্বর) আমাকে দিয়েছেন। কবিতার বই ‘অন্য মন্ত্র’ আর ‘শাদা অন্ধকার’ দিয়েছেন একাধিক সংখ্যা। আমরা ক্যাম্পাসজীবনের সমসাময়িক। তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে অন্য পরিসর প্রয়োজন। আবার বেশি বলতেও ভয়, পারস্পরিক পিঠ চুলকাচুলকি বলে ভাবতে পারেন। তাঁর প্রথম কাব্য ‘অন্য মন্ত্র’ আর প্রবন্ধের বই ‘অমৃত কথা’র ফ্ল্যাপ লেখক এই অধম। আমার ‘মেঘপুরাণ’ আর ‘ভেবেছিলাম চড়ুইভাতি’র ফ্ল্যাপ লিখে দিয়েছেন তিনি।
গত সহস্রাব্দের শেষ সন্ধ্যাবেলা, আমি যখন চাটগাঁর কবিতাময় জীবন থেকে অনেক দূরে, ময়মনসিংহ শহরে চাকুরীজীবীর জীবন কাটাই, শীত সন্ধ্যায় আমি বাস্তবিকই ভেসে গিয়েছিলাম পুলক পালের ‘শূন্য পাঠ’ কবিতার বইটি হাতে পেয়ে!
একবার চট্টগ্রাম বেড়াতে গিয়ে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় গেছি। ওরা কথায় কথায় প্রতিবেশী শিল্পী দম্পতির কথা তুলতেই কৌতূহলবশত নামদুটো উদ্ধার করলাম– খালিদ আহসান আর আইভী আহসান। খালিদ ভাই আমাদের কলেজ বার্ষিকীর কাজ করেছিলেন, সেই সূত্রে এক সময় ঘনিষ্টতা ছিল। আমি ওনার সাথে দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করলাম। দেখা হতে আমাকে তাঁর কাজ দেখালেন। ডিজিটাল কাজ, দেখতে সুন্দর। কিন্তু আমার চোখে লেগে আছে তাঁর কাজীর দেউরির পৈতৃক বাড়িতে বসার ঘরে টাঙানো কাজ সিঁদুর রঙের ক্যানভাস- ‘বাসনা’; আমি এখনও সেই ছবির প্রতিরূপ একে ফেলতে পারব, এমন মনে হয়। যাহোক, খালিদ আহসানের কবি পরিচয় বেশি মানুষ হয়ত জানেন না, শুধু প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবেই জানেন। তিনি আমাকে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘শীতের কফিন থেক উৎসারিত মানিপ্ল্যান্ট’ উপহার দিলেন। নিজেই করেছেন প্রচ্ছদ আর ভেতরের কাজ। সে কী কাজ! আমাকে ‘কাফকার জামা’র প্রোডাকশনের কথা মনে করিয়ে দিল। খালিদ ভাই আরো অনেক পরে আমাকে তাঁর ‘পৃথিবীর শিরা উপশিরা’ বইটিও কুরিয়ার করে পাঠিয়েছিলেন।
উত্তর আধুনিকতার অন্যতম তাত্ত্বিক, কবি, চিত্রশিল্পী অঞ্জন সেন ঢাকা এলে কেন যেন আমাকে আগাম খবর দিয়ে রাখেন। প্রথম দেখা হয়েছিল সেই লিরিক-যুগে ১৯৯৩ তে, চট্টগ্রামে। সে সময় আমরা তাঁর উত্তর আধুনিকতার সূত্র, তত্ত্ব পড়ে আন্দোলিত হয়েছিলাম। অঞ্জন সেন তার লেখা, বই ইত্যাদি আমাকে ইমেইলে পিডিএফ ভার্সন পাঠান মাঝে মধ্যে। ২০১০ এ দেখা হল খোন্দকার আশরাফ হোসেনের বাসায়। উপহার দিলেন সচিত্র কবিতার বুকলেট ‘সহজ কমল কথা’। ২০১৩ তে দেখা হল বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে, উপহার পেলাম কবিতার বই ‘ভাণ্ড – বেভাণ্ড’। এ বছর টিএসসিতে আড্ডা হয়েছিল সারা বিকেল-সারা সন্ধ্যা। বই আনেন নাই, কিন্তু তুমুল আড্ডার পরে বইয়ের জন্য আর কোনো খেদ ছিল না। মনে হচ্ছিল অঞ্জন সেন বুঝিবা পলিয়ার ওয়াহিদ, জাহিদুর রহিম কিংবা রাব্বী আহমেদের সমবয়সী কেউ। সেদিনের একটা গল্প খুব মজার। অঞ্জন সেন গেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি। শক্তি বিছানায় বসা, অনেক টাকার তাড়া সামনে। সম্ভবত কোনো প্রকাশক দিয়ে গেছেন। শক্তি বললেন, অঞ্জন এই টাকাগুলা ধরো তো। অঞ্জনদা অস্বীকৃতি জানালে উনি রেডি হয়ে টাকাসহ বের হয়ে ট্যাক্সি ধরলেন। অঞ্জনদাকেও নিলেন ট্যাক্সিতে। দুম করে ট্যাক্সিওয়ালাকে উত্তরবঙ্গের এক দূরবর্তী জেলার নাম বললেন! অঞ্জন সেন প্রমাদ গুনলেন; কিছুদুর গিয়ে ট্রাফিক বাতি জ্বলতেই দরোজা খুলে ভোঁ দৌড়। শক্তি সে যাত্রায় সাথে করে অঞ্জন সেনেরই এক বন্ধুকে নিয়ে গেলেন। পাঁচ দিন পরে সেই বন্ধু কাহিল হয়ে ফিরল আর ফিরেই জ্বর!
গত সহস্রাব্দের শেষ সন্ধ্যাবেলা, আমি যখন চাটগাঁর কবিতাময় জীবন থেকে অনেক দূরে, ময়মনসিংহ শহরে চাকুরীজীবীর জীবন কাটাই, শীত সন্ধ্যায় আমি বাস্তবিকই ভেসে গিয়েছিলাম পুলক পালের ‘শূন্য পাঠ’ কবিতার বইটি হাতে পেয়ে!