শ্রদ্ধাঞ্জলি
কবি ও অমলকান্তি
‘কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি’ এই কথা বলে জীবনদাশের পরের দশকের কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পণ করেছিলেন সকল বাঙলাভাষীকে কবি বানিয়ে ছেড়ে দিবেন। এই ব্রত সামনে রেখে তিনি রচনার করেছিলেন ‘কবিতার ক্লাস’। আমার ছোটোবেলায় মানে গত শতকের ১৯৯২/৯৩ সালে এই বইটা আর খাতাকলম নিয়ে বাবা প্রায় আমার সঙ্গে বসতেন। অবশ্য এর আগেই আমি রাইম লিখি। বাবা বলতেন কেবল অন্তমিল থাকলেই হবে না, মাত্রাটাও ঠিক থাকা চাই। আমি দুইলাইনের পঙক্তি লিখতাম প্রথমে মাত্রাবৃত্তে। বাবা মাত্রা গুনতেন। মাত্রার অমিল হলেই, তর্জনিটা ভাঁজ করে টং করে আমার মাথায় গুতা মারতেন। মনে হতো হাতুড়ির বাড়ি।
তো বাবা আর নীরেন কাকা মিলে মাত্রাটা ঠিকমতো ধরিয়ে দিতে পেরেছিলেন হয়তো। কিন্তু কবি বানাতে পারেননি। জীবনদাশেরই জয় হলো। আমি জানলাম সকলেই ‘কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ জানলাম কেউ আসলে কাউকে কবি বানাতে পারে না। ছন্দ কবিতার ছোট্ট একটা অনুষঙ্গ মাত্র। কবিতা মহাকাশের থেকে বিশাল।
তবে নীরেন্দ্রনাথ আমার লাভ করতে না পারলেও ক্ষতি একটা করেছিলেন সেই কৈশোরেই। তিনি আমাকে অমলকান্তি বানিয়ে ছেড়ে দিলেন পৃথিবীর পথে। তিনি শোনালেন,
‘অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইশকুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসত, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল !
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।’
এখনো অমল হয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছি ধুলায় ধুলায়। না হতে পেরেছি রোদ্দুর, না হতে পেরেছি ডাকঘর।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চলে গেলেন। কিন্তু হায়! আমার মতো অমলকান্তিরাই কেবল রয়ে গেলো।