:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মাসুদ খান

কবি, গদ্যকার

কবি বিনয় মজুমদার
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

কবি বিনয় মজুমদার

বিশ শতকের ছয়ের দশক। বাংলাভাষায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল কিছু আশ্চর্য ধরনের কবিতা। “ফিরে এসো, চাকা”, “অঘ্রানের অনুভূতিমালা”…। গ্রন্থ দুটি বাংলাকবিতার ধারায় দুই বিরল সংযোজন।

“নিষ্পেষণে ক্রমে ক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে
হীরকের জন্ম হয়, দ্যুতিময়, আত্মসমাহিত।”

তাঁর, কবি বিনয় মজুমদারের, সাধক বিনয় মজুমদারের “ফিরে এসো, চাকা” গ্রন্থটির কথা উঠলে অনিবার্যভাবেই মনে এসে যায় তাঁরই রচিত এই পঙক্তি দুটি। সাতাত্তরটি কবিতা নিয়ে জমে-ওঠা এক স্ফটিক কাব্যগ্রন্থ, সাতাত্তর তলবিশিষ্ট এক হীরকখণ্ড… তার দ্যুতি, তার মহিমা… সাতাত্তরটি কবিতাতল থেকে অনবরত বিচ্ছুরিত-হতে-থাকা বর্ণালীপ্রভা… আর সে-দ্যুতি ও মহিমার নিচে কেবলই মুগ্ধ হয়ে বসে থাকা আমাদের, দীর্ঘ দশকের পর দশক।

আবার অন্য এক দিক থেকে দেখলে মনে হবে, গ্রন্থটির এক-একটি কবিতা যেন এক-একটি আলাদা স্ফটিক। আর পঙক্তিগুলি যেন ওই স্ফটিকের এক-একটি তল। তীব্র চাপ ও তাপের পরীক্ষার ভেতর দিয়ে, কঠোর সংযমের অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে উতরে-আসা এক-একটি কবিতা। অঙ্গার যে প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয় হীরকে, যেন অবিকল সেই প্রক্রিয়া। শব্দে শব্দে অসাধারণ সংহতি, বাক্যের সুদৃঢ় বাঁধন ও গাঁথুনি। কবিতার অবয়ব জুড়ে অবাক-করা ঔজ্জ্বল্য ও বিচ্ছুরণলীলা।

বাক্যের অর্থ বাক্যস্থিত শব্দের ভেতর নিহিত থাকে না, তা থাকে শব্দসমূহের বিন্যাস ও তাদের পরস্পরের অন্বয়ের মধ্যে। এজন্য বলা হয়ে থাকে, বাক্যের অর্থ উৎপন্ন হয় পদ-পদান্তরের মধ্যকার ফাঁকা জায়গা থেকে। কবিতায়ও তেমনি… কখনো শব্দমালার মধ্যকার ফাঁকা জায়গা থেকে, কখনো পঙক্তির মাঝখানকার শূন্যতা ও নীরবতা থেকে উত্থিত হয় কবিতার অর্থ, তার নিহিত ব্যঞ্জনা। বাক্যে ব্যবহৃত শব্দরাজি সেখানে অবতীর্ণ হয় নিছক প্রতীকচিহ্নের ভূমিকায়। ‘শরীরের সবচেয়ে সংরক্ত জায়গা যেমন পোশাকের ছেড়ে-রাখা শূন্যস্থান’, কবিতায়ও তেমনি পঙক্তিগুচ্ছের রেখে-দেওয়া ফাঁকাস্থানগুলিই হচ্ছে সবচেয়ে সংরক্ত, সবচেয়ে ব্যঞ্জনাময়।

আর বিনয় মজুমদারের কবিতা এসবের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর কবিতায়, বিশেষ করে ‘ফিরে এসো, চাকা’-র কবিতাগুলিতে আমরা দেখব কীভাবে শব্দ আর পঙক্তির ভাঁজ থেকে, পঙক্তিগুচ্ছের মধ্যকার শূন্যস্থানগুলি থেকে উত্থিত হয় সৌন্দর্য ও সৌরভ। আর তা কখনো বিজলির মতো, কখনো-বা জ্যোৎস্নার মতো ছলকে-ছলকে বয়ে চলে শব্দ থেকে শব্দে, পঙক্তি থেকে পঙক্তিতে। কবি তার অব্যর্থ শব্দ আর বাক্যরাশি দিয়ে ঘটিয়ে তোলেন নানা জাদুকরি বিন্যাস। ক্রমাগত তৈরি করতে থাকেন জরুরি সব ঘোর ও ঘূর্ণি।

পঙক্তির পর পঙক্তি চলতে থাকে কিছুক্ষণ, অর্থের পরম্পরা, যুক্তির সিলসিলা, সবই অটুট রেখে রেখে। কিন্তু পরক্ষণেই কী যেন হয়, ছেদ পড়ে পরম্পরায়, শুরু হয় উল্লম্ফন, বাক্য তার অর্থসমেত চলে লাফিয়ে লাফিয়ে। এভাবে কখনো বাক্যের পর বাক্য উহ্য করে দিয়ে, কথার পর কথা বাদ করে দিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলে কবিতা। সেখানে কেবল ‘তবু’, ‘অথচ’, ‘ফলে’ (ফলত)… এ ধরনের এক-একটি অব্যয়পদ দিয়ে আপাত-পরম্পরাহারা নানা অনুষঙ্গরাশির মধ্যে তৈরি করে রাখেন আবছা সেতুবন্ধ। তখন, সে-অবস্থায়, সেইসব অব্যয়পদের ওপরই টানটান দাঁড় করিয়ে রাখেন কবিতার গতি, নিশানা ও অবস্থান। এভাবে একটি আবর্তন পূর্ণ হবার পর শুরু হয় অন্য এক আবর্তনলীলা।

‘ফিরে এসো, চাকা’-র কবিতাগুলিতে আমরা দেখব কীভাবে শব্দ আর পঙক্তির ভাঁজ থেকে, পঙক্তিগুচ্ছের মধ্যকার শূন্যস্থানগুলি থেকে উত্থিত হয় সৌন্দর্য ও সৌরভ। আর তা কখনো বিজলির মতো, কখনো-বা জ্যোৎস্নার মতো ছলকে-ছলকে বয়ে চলে শব্দ থেকে শব্দে, পঙক্তি থেকে পঙক্তিতে। কবি তার অব্যর্থ শব্দ আর বাক্যরাশি দিয়ে ঘটিয়ে তোলেন নানা জাদুকরি বিন্যাস। ক্রমাগত তৈরি করতে থাকেন জরুরি সব ঘোর ও ঘূর্ণি।

এভাবে কখনো জাম্পকাট, কখনো এলিমিনেশন, আবার কখনো অনুষঙ্গ থেকে অনুষঙ্গান্তরে অবাধ ভেসে চলা (বিশেষ করে “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা”-য়), এবং বেশিরভাগ সময়ই শান্ত নিস্তরঙ্গ বয়ে চলা, মাঝে মধ্যে অন্তর্লীন ঢেউ ও ঘূর্ণি… এভাবে কবিতার পর কবিতায় বয়ন করে চলেন নানারকম চোরা ফাঁদ, প্রচ্ছন্ন অন্তর্ঘাত, কখনো কখনো তৈরি করেন মোহময়ী সব গোলকধাঁধা।

আর এইসব ঘোর ও ঘূর্ণি, শান্ততা ও নিস্তরঙ্গতা, ফাঁদ ও গোলকধাঁধার রকমারি বিন্যাসের ভেতর থেকে উদ্গীর্ণ হয় একইসঙ্গে আগুন ও আলেয়া, বিচ্ছুরিত হতে থাকে যুগপৎ জ্যোৎস্না ও রোদ্দুর।

কবিতা স্বভাবগতভাবেই বিষয়ীগত, মন্ময়। কবিতা প্রকৃতিগতভাবেই সংশ্লেষণধর্মী। কিন্তু, “ফিরে এসো, চাকা”-র কবি কবিতায় সম্ভব করে তুলেছেন নৈর্ব্যক্তিকতা আর মন্ময়তার এক দুর্লভ সমন্বয়। কবিতাগুলি যেন বিষয় ও বিষয়ীর, তন্ময় ও মন্ময়ের সার্থক সমসত্ত্ব দ্রবণ। সংশ্লেষ ও বিশ্লেষের এক অনাস্বাদিতপূর্ব অন্নব্যঞ্জন। বিনয়ের কবিতা কারুকাজবিরল, কিন্তু অনুভূতিঘন।

“ফিরে এসো, চাকা”-র কবিতাগুলির বিকাশভঙ্গি, তাদের বেড়ে ওঠার ধরনটাই অন্য রকম, অনন্যসাধারণ। কবিতাগুলিতে মাঝে মধ্যেই দেখতে পাব এমনসব বাক্য সচরাচর যাদের আমরা সর্বজনীন সত্য বা শাশ্বতবাক্য বলে জানি। কিংবা দেখতে পাব হয় পদার্থবিদ্যার, নতুবা দর্শনের, অথবা শারীরবিদ্যার কিংবা ভূয়োদর্শনজাত কোনো-না-কোনা তথ্য বা ফ্যাক্ট—

“…নিকটবর্তী এবং উজ্জ্বলতম তারাগুলি প্রকৃতপ্রস্তাবে
সব গ্রহ, তারা নয়, তাপহীন আলোহীন গ্রহ… ”

“সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে…”

“আলোকসম্পাতহেতু বিদ্যুৎসঞ্চার হয়, বিশেষ ধাতুতে হয়ে থাকে।”

“অতি অল্প পুস্তকেই ক্রোড়পত্র দেওয়া হয়ে থাকে।”

“কিছুটা সময় দিলে তবে দুধে সর ভেসে ওঠে।”

“…ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে
পুনরায় কেশোদগম হবে না;”

“বর্ণাবলেপনগুলি কাছে গেলে অর্থহীন, অতি স্থূল মনে হয়
অথচ আলেখ্যশ্রেণি কিছুটা দূরত্বহেতু মনোলোভা হয়ে ফুটে ওঠে।”

“প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাগুলি ক্রমে জ্ঞান হয়ে ওঠে।”

“মুগ্ধ মিলনের কালে সজোরে আঘাতে সম্ভাবিত
ব্যথা থেকে মাংসরাশি, নিতম্বই রক্ষা করে থাকে।”

“…বাতাসের
নীলাভতাহেতু দিনে আকাশকে নীল মনে হয়।”

“মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।”

আর এইসব তথ্যবাচক ভাষ্যকে আবির্ভূত হতে দেখব এমনসব বাক ও বাক্যের পরিবেশে, যে বাক ও বাক্যেরা উৎসারিত হয় কবির গভীর অনুভূতিদেশ থেকে। কবির নিজস্ব রং ও মাধুরী মেশানো নানা মন্ময় (সাবজেকটিভ) পঙক্তিপ্রপঞ্চের আশপাশ দিয়েই বয়ে যেতে দেখব ওইসব তন্ময় (অবজেকটিভ) তথ্যপঙক্তিধারা। মন্ময় ভাষ্যগুলিকে নৈর্ব্যক্তিক ভাষ্যের সঙ্গে কবি বেঁধে দেন নানা নিগূঢ় সম্পর্কে। বেঁধে দেন কখনো উপমা-উৎপ্রেক্ষায়, কখনো-বা রূপকে-প্রতীকে।

কবিতা স্বভাবগতভাবেই বিষয়ীগত, মন্ময়। কবিতা প্রকৃতিগতভাবেই সংশ্লেষণধর্মী। কিন্তু, “ফিরে এসো, চাকা”-র কবি কবিতায় সম্ভব করে তুলেছেন নৈর্ব্যক্তিকতা আর মন্ময়তার এক দুর্লভ সমন্বয়। কবিতাগুলি যেন বিষয় ও বিষয়ীর, তন্ময় ও মন্ময়ের সার্থক সমসত্ত্ব দ্রবণ। সংশ্লেষ ও বিশ্লেষের এক অনাস্বাদিতপূর্ব অন্নব্যঞ্জন। বিনয়ের কবিতা কারুকাজবিরল, কিন্তু অনুভূতিঘন।

ফলে, কবিতায় তিনি যখন “সূর্য পূর্বদিকে ওঠে” কিংবা “জল চিরকাল ঢালুর দিকে গড়ায়” কিংবা “রক্তের রং লাল হয়ে থাকে”… এ ধরনের সরাসরি অবজেকটিভ উক্তিও করেন, তখনও তাদের বিশেষ বিন্যাসের সুবাদে কিংবা প্রতিবেশী পঙক্তিনিচয়ের চরিত্রের আবেশে ওগুলির ধর্মই যায় পাল্টে। নৈর্ব্যক্তিক ভাষ্য রূপান্তরিত হয় সাংকেতিক ভাষ্যে।

মাঝে মাঝে তিনি গূঢ় দার্শনিকের কেতায়, অনেকটা প্রফেটিক ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেন কিছু গভীর উপলব্ধির কথা, আপ্তবাক্যের মতো করে…

“সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও
মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে।’’

‘‘…প্রাকৃতিক সকল কিছুই
টীকা ও টিপ্পনী মাত্র, পরিচিত গভীর গ্রন্থের।’’

“বীজের ভিতরে আছে গুহার লালসাময় রস।”

“প্রকৃষ্ট সময় ব্যয় করার পূর্বাহ্নে সে-সময়
আয় করে নিতে হয়– নানারূপ আয় ও ব্যয়ের
হিসাবের মতো এই সত্যটিও আজ মনে আসে।”

“অতিশয় উঁচু কোনো সৌখিন সৌন্দর্যচিন্তা রূপ হয়ে নাচে।”

“দেহসঞ্চালন হলো ভাবসঞ্চালনমাত্র, অন্য কিছু নয়।”

“মনে হয়, সবচেয়ে বেশি চিন্তাশীল এক অবয়ব ব’লে
খুব বেশি পরিমাণে চিন্তা করে দেয় ব’লে সমগ্র চিন্তার
প্রায় সবই একা-একা যৌনাঙ্গই করে দেয়, করে দিয়ে থাকে
সকল চিন্তাই তার একক অধিপত্যে অবাক করেছে।
যে-কোনো কাহিনী তাই শুধুমাত্র যৌনাঙ্গের আত্মকাহিনীই,
যে-কোনো চিন্তাই তাই এই চিন্তাকারীটির একক জীবনী
হয়ে যায়, হতে হয়, তথাকথনের দোষে যাকে তুমি বলো
অবচেতনার রূপ;”

“রাতের বেলায় সব বেশি-বেশি করে বাড়ে, বড় হতে থাকে
আলো খুঁজে পেতে গিয়ে, আলো ভালবাসে বলে সবই কীরকম
তাড়াতাড়ি করে বাড়ে, প্রায় সব ফুলই তাই রাতে ফুটে থাকে।”

“রমণ না করে কোনো রমণী ও পুরুষের বন্ধুত্ব টেকে না,
খুব বেশিদিন ধরে তাদের বন্ধুত্বভাব কখনো টেকে না।”

“চিরকাল সংজ্ঞা থেকে আমাদের সব জ্ঞান যাত্রা শুরু করে,
হাজার পাঁচেক সংজ্ঞা একেবারে ভ্রান্তিহীনরূপে জানা গেলে
যা-ই চিন্তা করি তা-ই ভ্রান্তিহীন হতে বাধ্য, ভ্রান্তিহীন হয়।
অভিধানগুলি সব সংজ্ঞাপুস্তকের দলে অন্তর্ভুক্ত বই।”

“শতকরা একেবারে একশত ভাগ খাঁটি দর্শনের নাম
সংজ্ঞা অনুসারে ধর্ম…”

“পাখিদের থেকে সব পাখি জন্মে, আলোকের থেকে জন্মে সকল আলোক।”

“…এই মহাশূন্য শুধু
স্বতঃস্ফূর্ত জ্যোৎস্নায় পরিপূর্ণ মুগ্ধ হতে পারে।”

ইত্যাদি…

এইভাবে একইসঙ্গে সংশ্লেষ ও বিশ্লেষ, তন্ময়তা ও মন্ময়তা, চেতন ও অবচেতনের বহুভুজ দ্বন্দ্ব ও শান্তির ভেতর দিয়ে বিকশিত হয় বিনয়ের কবিতা। তাঁর লেখা তাই আমাদের দেয় এক অননুভূতপূর্ব ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা। এ প্রজাতির কবিতা বাংলাসাহিত্যে দুর্লভপ্রায়।

 

(লেখাটি ২০১০ সালে কবি অরবিন্দ চক্রবর্তী সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘মাদুলি’ বিনয় মজুমদার সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশ করা হল।) 

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.