স্মৃতিকাব্য
কাফকার জামা গায়ে সিকদার আমিনুল হক
ঠিক বারোটায় কেউ কাউকে ফোন দেয় কিনা বলা মুশকিল। কেননা যে কোন স্থানে বারোটায় সূর্যের আলো সাম্যবাদী থাকে। আলো বায় সমান সমান। মাঝে মাঝে বারোটায় ফোন দিতেন সিকদার আমিনুল হক। সিকদার ভাইয়ের বারোটার ফোন অদ্ভুত। কানে লেগে থাকে। একদিন ফোনের ওপার থেকে বললেন, আসেন আজকে। বললাম, কই? বললেন, কখনো কি ইতিহাসের মুখোমুখি হয়েছেন। বললাম, ইতিহাস তো রাজার পক্ষে লেখা হয়। প্রজারা ক্ষমতার কলে পদপিষ্ঠ হয়! সিকদার বললেন, না না সাক্ষাৎ ইতিহাস। আসেন আসেন দেখবেন! বললাম, দেখি ইতিহাসের কালো অক্ষর হয়ে উঠি কিনা! তিনি হাসলেন, ফোনে আর কথা নয়। তাহলে কথা কিসে? বাসায় নয়, ঠিক সাড়ে তিনটায় সাকুরায়!
খুব বিচলিত হয়ে উঠি আমি। অপেক্ষা করি মারুফ চিনুর। চিনু ভাই আসলেই জীবনকে ফাঁকি দেওয়া যাবে। জীবন মানে কাজ। ঠিক তিনটায় চিনু আসলেন। বললাম, জীবনের কোন অর্থ নাই। অথচ মুদ্রা দিলেন তিনি। বললাম, সিকদার ভাই ডেকেছেন। চিনু মৃদু হাসলেন। বললেন, বাতাস বোঝার সামর্থ্য নিয়ে ঠিকঠাক বাড়ি ফিরো! বললাম, অর্থের কথা বললে জীবন আমাকে চাপকায়! চিনু বললেন, হিসেব সহজ করো। বস্তুকে ভাবে সঙ্গিন করো। আমার বিনি বাঁধা লম্বা চুল খাড়া হয়ে গেল। আর ঢিলা জামা আরো ঢিলা হয়ে গেল! মনে হলো জীবন এমনি এমনি ঢিলা! চিনুকে বললাম, আজ আর আসব না! চিনু বললেন, ঠিক আছে। আজকের জমা জীবন কাল শোধ দিও!
রাস্তায় বেরুলাম। রিকশায় যাচ্ছি। মাঝে মাঝে দালানের ফাঁকে সূর্য গলে নামছিল। আমি দেখলাম, হেলে পড়া ছায়ায় আমাকে দীর্ঘ দেখায়। খুশি হলাম মনে মনে। আমি অনেকদিন বাঁচবো। শুনেছি মৃত্যুর আগে মানুষের ছায়া ছোট হয়ে যায়। অথচ আমার লম্বা! জীবনের মানে খুঁজতে খুঁজতে কখন যে কাঁটাবন পেরিয়ে গেলাম! দেখলাম আকাশ হেলে গেছে পশ্চিমে। আমি উত্তরাংশের দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি! বাইরের বাদামী আলোর ছটায় মৌ মৌ রূমের ভেতরে দ্যুতির মতো লাগল। কবি একা নীল গ্লাস সামনে বসে আছেন। গ্লাসের ভেতর সাইবেরিয়ান বরফ। তাও কি নীল হীরের টুকরোর মতো ভাসছিল?
রাফকাট চুল, হাতে ব্রেসলেট, চশমার কালো ফ্রেম, সাদা নীল প্রিন্টের শার্ট পরা সিকদার আমিনুল হক। বিষণ্ণ সুন্দর চেহারা চিকচিক করছিল কবির। বললাম, আপনাকে আজ এরিখ ফ্রমের মতো লাগছে! সিকদার বললেন, তাহলে ফ্রানৎস কাফকার কি হবে? আমি হাসলামঃ মেটামরফোসিস হবে! বললেন তিনি, আপনি বেশ মজার! জানেন, জীবন পানির মতো বদলায়। আমি তাকে রূপান্তর বলি! বললামঃ মাঝে সাঝে ব্রেক কষা লাগে। তারপর গ্লাস আর ক্লাসের ব্যবধান! বললেনঃ কেন? বললামঃ কাঁচের ওপারে শেরাটন! কিন্তু ওটা অনেক দূর! কিন্তু কাঁচ আর শ্রেণি দুটোয় ঠুনকো। যে কোন সময় ভেঙে যেতে পারে। বিদ্যুৎ চমকের মতো নড়ে উঠলেন তিনি! এবং বলেন, ওয়েটার! আর ঠিক দশ মিনিট পর নীল গ্লাস কিভাবে লাল হয়ে গেল! দেখি সত্যিই তো!
আমি বললাম, মানুষ ক্রমশ অস্তিত্বহীনতার দিকে যায়। বেনজির বললেন, সেটাই মৃত্যু। বললাম, রাইটার্স ক্লাব আর ঢাকা ক্লাবের মাঝখানে কিন্তু দুটো হাসপাতাল। সিকদার হাসলেন। বললেন, হাসপাতালের মাঝের জায়গা মিস হয়ে গেল। তারপর ফুটপাত। তারপর রাস্তা। তারপর ট্রাফিকল্যান্ড। তারপর রাস্তা। তারপর ফুটপাত।
মিলান কুন্ডেরার মতো এক লোক এসে হাজির। নাক উচু, গোল চোখ, ধবধবে মুখ, হাতের আঙুলগুলো তুলির মতো, বাদামি ফতুয়া গায়ে। সিকদার বললেন, বেনজির এতক্ষণ পর এলে! বেনজির ভাই বললেন, তোমরা মনে হয় রবীন্দ্রনাথেই পড়ে আছো! সিকদার বললেন, আমরা প্রতীকের জগতে আছি। বেনজির বললেন, দানিকেনের জগত থেকে তোমরা বেরিয়ে গেলে! সিকদার আর আমি খানিকটা ধন্ধে পড়ি। দানিকেন নাকি হ্যানিকেন! সিকদার বললেন, ওহ হ্যানিকেন! বেনজির বললেন, না সাইবেরিয়ান! তারপর তিন গ্লাস লাল!
বেনজির বললেন, আধুনিকতার বড় সমস্যা কি? সিকদার বললেন, কেন্দ্র বিচ্যুত হওয়া। বললাম, কেন্দ্রের বাইরে ক্ষমতা কিংবা কেন্দ্র নাই, এটা নিশ্চিত বলা যাবে না। বেনজির বললেন, পাহাড় যত উঁচু হয়, ততই নিঃসঙ্গ হতে থাকে। মানুষের কেন্দ্রও ঠিক তাই। সিকদার বললেন, হাত ছাড়া ঘড়ি তো নিঃসঙ্গ হবেই। কিংবা ধরো খাড়ু। বললাম, সব মেঘ দেখতে একই, কিন্তু বৃষ্টির ফোটা এক নয়। বেনজির বললেন, আধুনিকতার প্রধান সমস্যা মানুষ। প্রকৃতি নয়। সিকদার বললেন, সবই বাতাসের সঙ্গে আলাপ!
গ্লাস ক্রমশ সাদা হয়ে উঠল। দেখলাম দুজন মানুষ ফেরেশতার মতো সহজ হয়ে উঠলেন। দুনিয়ার সব শব্দ এসে গ্লাসে ভর করল। সিকদার বললেন, সার্ত্রের শব্দ মতো একটা কাণ্ড ঘটে গেল। শব্দ মাত্র অস্তিত্বময়। আমি বললাম, মানুষ ক্রমশ অস্তিত্বহীনতার দিকে যায়। বেনজির বললেন, সেটাই মৃত্যু। বললাম, রাইটার্স ক্লাব আর ঢাকা ক্লাবের মাঝখানে কিন্তু দুটো হাসপাতাল। সিকদার হাসলেন। বললেন, হাসপাতালের মাঝের জায়গা মিস হয়ে গেল। তারপর ফুটপাত। তারপর রাস্তা। তারপর ট্রাফিকল্যান্ড। তারপর রাস্তা। তারপর ফুটপাত। আমি বললাম, ক্লাস দেখলেন না। দুজন কবিতার মতো স্নিগ্ধ হাসলেন।
আমি কাফকার কথা ভাবলাম। বেনজির বললেন, পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে নিচের সবকিছু মেটামরফিসিস হয়ে যায়। সবই বিন্দু। বললাম, একটা ব্যাপার আছে। দেখেন বিন্দু গোল। কিন্তু অগণিত বিন্দু সোজা বসালে কিন্তু সরল রেখাই হয়। কিন্তু বেঁকে গেলে বক্রাকার জীবন হয়। জীবন বক্রই। টেনে সোজা করা যায় না। বেনজির বললেন, প্রতীক থেকে বেরুলে মানুষ নগ্ন হয়ে যায়। প্রকৃতির খেলা এখানেই। সিকদার বললেন, তুমি কি টিপুকে চেন? বললেন হ্যাঁ! এলা হি বরষা তো! তোমার লেখায় পড়লাম। সেদিন রঙিন গ্লাসগুলো নাচছিল। আর কেন্দ্র থেকে তিনজন তিন দিকে আকাশ ভাগ করে নিলাম!
সেই থেকে আমি আর মহুয়া তলে যাই না। উম্মাদ উম্মাদ লাগে। লাল নীল হয়ে যায়। হালকা হলুদে নীল সবুজ হয়ে যায়। আমার কাফকার কথা মনে পড়ে। চোখে কেবল মিলান কুন্ডেরার চেহারা ভাসে।
৩১/১/২০১৯
ঢাকা
- ফ্রানৎস কাফকা, জার্মান লেখক
- মিলান কুন্ডেরা, চেক-ফ্রেন্স লেখক
- জ্যঁ পল সার্ত্রে, ফ্রেঞ্চ দার্শনিক ও লেখক
- মারুফ চিনু, ছড়াকার ও সাংবাদিক
- বেনজির আহমেদ, সাংবাদিক ও লেখক