:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
আহ্‌মেদ লিপু

প্রাবন্ধিক

কোথাও মায়া রহিয়া গেল
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

কোথাও মায়া রহিয়া গেল

সহিত থেকে সাহিত্য। দর্শন আমার প্রথম পছন্দ হওয়ায় সাহিত্যিকদের সঙ্গে ‘সহিত-ভাব’ তৈরি হয় আপাত ধীরে, বেশ কিছুটা সময় নিয়ে। দাউদ আল হাফিজের সঙ্গেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

তাঁর সঙ্গে আমার স্মৃতি দুই পর্বে বিভক্ত: আনাবাস অথবা দ্বিধার গন্ধম পূর্ববর্তী আর পরবর্তী। আনাবাস-পূর্ববর্তী দাউদ আল হাফিজের সঙ্গে কোথায় কিভাবে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল মনে নেই। তবে অবহিত ছিলাম দার্শনিক প্লেটো কথিত কবিদের বৈশিষ্ট্য—অগোছালো জীবন, যথাপোযুক্ত পেশার অভাব ইত্যাদি তাঁর ক্ষেত্রেও জারি রয়েছে! আরো পরে জেনেছি, যাপন-জনিত সমস্যায় তিনি ঢাকা-শৈলকূপা, শৈলকূপা-ঢাকা করছেন।

২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে আনাবাস আলোর মুখ দেখে। খায়রুন্নেছা ম্যানশনের দোতলায় অগ্রদূতের অফিসে এর একটি কপি চোখে পড়ে। সদ্য বাইন্ডিং করা। আঠা শুকায়নি। ভেজা। পাতা উল্টাতেই দু লাইনের একটি চমৎকার কবিতা চোখে পড়ে, শেষ স্বীকারোক্তি। ‘বিশালাক্ষি, ছুরি বসালে তুমি আমার বুকে/ অথচ সবাই জানল আমার আত্মহনন বলে’। আরো দু-একটি কবিতা পড়েই নিশ্চিত হলাম তিনি শক্তিমান কবি। হালআমলের মুদ্রণযন্ত্রের সহজপ্রাপ্যতায় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ সহজ। কিন্তু যখন উত্তীর্ণ একটি কবিতা কিংবা সার্থক কয়েকটি পংক্তি রচনা কঠিন সেখানে দু-তিনটি কবিতা পড়েই কাউকে শক্তিমান কবি বলে মনে হওয়া সত্যিই চমকপ্রদ।

দুয়েকদিন পর কাঁটাবন কনকর্ড এম্পোরিয়ামের সামনে তাঁর সঙ্গে দেখা। সিগারেট অফার করলে গ্রহণ করলেন। চা-সিগারেটের আড্ডায় বিশালাক্ষির ছুরি বসানো নিয়ে কিছু বলতে চাইলেন না। জিজ্ঞেস করলেন কাব্যগ্রন্থটি ভালো লেগেছে কি-না। ইতিবাচক উত্তর দিলে জানালেন বইমেলার বহেরাতলায় একবিংশের স্টলে কাব্যগ্রন্থটি পাওয়া যাচ্ছে। এরও সপ্তাহখানেক পর শাহবাগ মোড়ের ডাচ-বাংলা বুথের সামনে দেখা হলে জানতে চাইলেন আনাবাস সংগ্রহ করেছি কি-না। জানালাম, স্টলে কাব্যগ্রন্থটি দেখেছি। তবে সেলসম্যান না থাকায় কালেক্ট করতে পারিনি। তখন তিনি একটি কপি গিফট করলেন। সত্যি বলতে কি, গিফট করার মুহূর্তে তার আদবকেতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমরা যারা লেখালেখি করি তারা প্রায়শই নিজের বই অন্যকে উপহার দিয়ে অভ্যস্ত। তাঁর এটিকেটিভ ম্যানার দুর্লভই।

প্রস্থানের জন্য কেন এমন ব্যস্ততা, দাউদ ভাই? আপনি না বলেন: ‘সবুর, সবর, তিতিক্ষা—এই তিনে মানব জীবন’। সেই আপনিই আরেকটু অপেক্ষা করতে পারলেন না! বলতেন তো—‘এভাবেই চলতে থাক: চলা, বলা, জীবনযাপন, আনন্দ আহরণ, স্রষ্টাতপঃ’। সেই আপনিই থেমে গেলেন! আর প্রস্থানের পথে ছড়িয়ে গেলেন ভীষণ মায়া!

এরপর সম্ভবত আমরা পরস্পর ‘সহিত-ভাব’-এ আবদ্ধ হই। কাছাকাছি সময় তিনি বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা ও ঢাবির কলাভবনে কি যেন একটা প্রজেক্টের কাজে ঢাকায় থিতু হতে চেষ্টা করেন। যদিও এতে তাঁর সাংসারিক প্রয়োজনের কিয়দংশই পূরণ হতো বলে জানতাম। ছেলেমেয়ে দুজন লেখাপড়া করছে, নিজের শরীরও খুব একটা ভালো না, প্রায়শই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়।

তখন আমাদের সান্ধ্য-আড্ডা প্রাত্যহিক ব্যাপারে পরিণত হয়। তিন-চার মাসেই বুঝে ফেলেছিলাম বহুদিন, বহু বছরও হতে পারে, তিনি নিয়মিত লেখার টেবিলে বসেন না। নিতান্ত কেজো প্রয়োজনে অল্পবিস্তর অনুবাদ/সম্পাদনা করেন। একদিন আলাপ প্রসঙ্গে জানালেন, ‘অশ্বস্তি’ নিয়ে তাঁকে কলাভবনে কাজ করতে হচ্ছে! কারণ, তিনি মনে করতেন, অতীতে ইংরেজি বিভাগ তাঁর প্রতি অবিচার করেছে। অনেকটা অভিমান নিয়েই তাই বিভাগ ছেড়েছিলেন।

এসএসসিতে দাউদ আল হাফিজ যশোর বোর্ডের সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিলেন। এইচএসসিতে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ফাইনাল পরীক্ষার সময় প্রচণ্ড জ্বরে ভুগেছিলেন। হাতে তুলে খেতে পারেন না এমন অবস্থা। এক বন্ধু স্কুটার ডেকে তাঁকে পরীক্ষার হলে পৌঁছে দেন। দরিদ্র ঘরের সন্তান দাউদ দাঁড়াতে পারেন না এমন শারীরিক অবস্থায় পরীক্ষা দিতে বসেছেন। কারণ, পরের বছর পরীক্ষা দেওয়া তাঁর বাস্তবতায় বিলাসিতা। টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ যোগাতে হয়, পরিবারকেও কিছুটা সহায়তা করতে হয়। তারপরও উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েও সাহিত্যের হাতছানিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। অনার্সে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে অভিমান করে এমএ না করেই বিভাগ ছাড়েন। আমৃত্যু মনে করেছেন এক্ষেত্রে তাঁর প্রতি অবিচার করা হয়েছে। পরে দীর্ঘ বিরতি নিয়ে মাস্টার্স কমপ্লিট করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

আড্ডায় দাউদ আল হাফিজ, আহমেদ লিপু ও টোকন ঠাকুর।

তার সঙ্গে আলাপে বুঝেছিলাম, অভিমান করে একদিন যে বিভাগ ছেড়েছিলেন ছেলেমেয়ের পড়াশোনা চালানোর পিতৃকর্তব্যের গুরুদায় ছাড়া অন্যকিছু তাঁকে সেই বিভাগে ফেরাতে পারতো না। অ্যাডহক ভিত্তিতে প্রজেক্টের এই কাজ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়তেন। আবার বাস্তবতার অনুধাবন আর স্বল্পসংখ্যক শুভানুধ্যায়ীর প্রেরণায় স্বাভাবিক হতেন।

ম্যাজিক লণ্ঠন ২০১৪-র শেষে, সম্ভবত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে, তাঁকে আড্ডার মুখ্য কবি নির্বাচিত করে। সেই সভায় তাঁর ঢাকার বন্ধু-বান্ধবদের প্রায় সকলেই জমায়েত হয়েছিলেন। তাঁদের প্রায় প্রত্যেককে আলাদাভাবে ডেকে আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। আমার সম্পর্কে অতি-প্রশংসাসূচক বাক্যে কিছুটা বিব্রত হলেও টের পেয়েছিলাম আন্তরিকতার উত্তাপ।

দলীয় রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ দেখিনি, তবে পৃথিবীর তাবৎ ইতিবোধের কবির মতো তিনিও ভেতরে ভেতরে ছিলেন সাম্যবাদী। চে গুয়েভারাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। বহুবার আমাকে কবিতাটি শুনিয়েছেন—

কাস্তে ও হাতুড়িতে অবিচল আস্থা ছিল যার সেই
মহান বিপ্লবী, তোমাদের সেই কমরেড, দোস্ত্ একদা
ব্যক্ত করেছিলেন অনর্গল অনলবর্ষী ভাষায় তার
স্বপ্নের কথা—কার মতো হতে বলবেন তার প্রিয়
দেশবাসী শিশুকিশোরকিশোরীযুবকযুবতীদের—
চে-র মতো হতে বলবেন, চে-র মতো বিপ্লবী,
চে-র মতো স্বাপ্নিক হতে বলবেন।

(চে গেভারা / দাউদ আল হাফিজ)

তিনি পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বামফ্রন্ট-নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কবিতাও অনুবাদ করেছিলেন। ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি, সংখ্যা ৩, ঢাকা ২০০৩-এ তা ছাপা হয়। ম্যাগাজিনটির একটি সংখ্যা তিনি উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর সাম্প্রতিক শৈলকূপা বাসের সময় তিনি অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা চেয়ে পাঠান। পত্রিকাটি ঢাকায় আউট অফ প্রিন্ট হওয়ায় সংগ্রহ করে দিতে পারিনি। এ নিয়ে তার অভিযোগের অন্ত ছিল না।

২.
শেষের দিকে দাউদ ভাই যতটা-না সৃজনশীলতার দিকে তারচে অধিক মননশীলতার প্রতি মনোনিবেশ করেছিলেন। ২০১৫-র প্রথমদিকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের প্রিয় মধুবন ছোট গল্পটি অনুবাদ করেন। পড়তে দিয়ে বললেন অনুবাদ মূলানুগ হয়েছে কি-না জানাতে। বললাম মূল টেক্সট পড়া নাই। তখন তিনি নিজে পড়ে শুনিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেমন হয়েছে? বললাম মন্দ না। মনে হলো উত্তরে তিনি খুশি হননি। একই বছর শেষের দিকে তিনি ওমর আলীর বিখ্যাত কবিতা এদেশে শ্যামলরঙ রমণীর সুনাম শুনেছি-র অনুবাদ করেন। সন্ধ্যার আড্ডায় অনুবাদটি পড়ে শোনান। বলেছিলাম ওমর আলীর কবিতায় কিছু সম্পাদনার অবকাশ থাকে, আপনার অনুবাদে সেই অভাব পূরণ হয়েছে। এতে তিনি যে উচ্চহাসি হেসেছিলেন, তাঁকে পূর্বে এমন কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

দাউদ আল হাফিজ ও তাঁর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ- আনাবাস অথবা দ্বিধার গন্ধমপ্রতিকৃতি : শিশির ভট্টাচার্য্য

২০১৬-তে জি. অরবিন্দের একটি প্রবন্ধের বাংলান্তর করেছিলেন। শিরোনাম ছিল সম্ভবত আমি ও আমার চলচ্চিত্র। পাণ্ডুলিপিতে কিছু ইংরেজি শব্দ ব্র্যাকেটে রেখে দিয়েছিলেন। অনেক সন্ধ্যায় সেইসব ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ কি হতে পারে তা নিয়ে আলাপ করতেন। আমি দু-একটি শব্দ প্রস্তাব করলে তিনি সেই সব শব্দ কখনো কখনো গ্রহণ করতেন। একই সময়ে তিনি শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার নাটকটির বঙ্গানুবাদ সম্পাদনা করেন। নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন মোস্তফা তোফায়েল হোসেন। প্রকাশক ছিল ফ্রেন্ডস বুক কর্ণার। একই প্রতিষ্ঠান টি এস এলিয়টকে নিয়ে লেখা তাঁর একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল। এছাড়াও তিনি শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের নাগরিক সংবর্ধনার বুকলেট শিকড়ে স্বীকৃতি সম্পাদনা করেন। কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত শৈলকূপা পাইলট হাই স্কুলের শতবর্ষ উদযাপনের স্মরণিকাও তিনি সম্পাদনা করেছিলেন।

৩.
একটি কালো রঙের অফিসব্যাগ ছিল তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। বিচিত্র জিনিসপত্র তিনি এতে ক্যারি করতেন। ১৯৮১ সনে তোলা খোন্দকার আশরাফ হোসেনের একটি লেমিনেটেড ফটোগ্রাফ তিনি সবসময় এতে রাখতেন। তাঁর ভাষ্যে এখানে খোন্দকারের কোকড়ানো চুলের ভাঁজ যতটা স্পষ্ট দেখা যায় হালআমলের ডিজিটাল ক্যামেরা্র ছবিতে তা দুর্লভ। এ-প্রসঙ্গে তিনি যা-ই বলুন না কেন আমার অনুমান ভিন্ন। ধারণা করা অসঙ্গত নয়, ডাক্তারি পড়ার সুযোগ হাতছাড়া করা সাহিত্যঅন্তপ্রাণ এক উজ্জ্বল শিক্ষার্থী তাঁর জীবনের স্মৃতিময় সময় ও সেই সময়ের আইডলকে ধারণ করে থাকেন এভাবে। ২০০১-এ বন্ধু সুনীল আচার্যের কঞ্চুকী কাব্যগ্রন্থের একটি ক্রিটিক্যাল অ্যাপ্রিসিয়েশন করেছিলেন শৈলী-র ফেব্রুয়ারি-মার্চ সংখ্যায়। লেখাটির একটি কপি সেই ব্যাগে রাখতেন। একদা জাহিদ হায়দারের সঙ্গে তার ‘সহিত-ভাব’ জন্মায়। জীবন জীবিকার অন্বেষণে জাহিদ হায়দার প্রবাসী হলে তিনি বিদেশ থেকে দাউদ ভাইকে পত্র লিখতেন। এরূপ একটি পত্র তাঁর এতটাই পছন্দ ছিল যে তিনি এর ফটোকপি সঙ্গে রাখতেন। তিনি কতবার যে পত্রটি পড়ে শুনিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। তিনি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের একটি ইন্টারভিউ করেছিলেন The New Nation Magazine-এ Moments With Prof and Poet Khondakar Ashraf Hossain শিরোনামে। এর ফটোকপিও ব্যাগটিতে সর্বক্ষণ থাকতো। এ সবই এক কবির আবেগ আর মায়ার সঞ্চয়।

শেষের দিকে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ তৎপর ছিলেন। ফেসবুকে তার Dawood Al-Hafiz ও দাউদ আল হাফিজ নামে দুটি আইডি ছিল। এছাড়াও তিনি Poetry of Earth শিরোনামের একটি কবিতা বিষয়ক পেইজ চালাতেন। টুইটারেও একাউন্ট ছিল।

মনে পড়ে কাঁটাবন ঢালে ছোট্ট একটি ক্যাফেতে আমরা আড্ডা দিতাম। ক্যাফেটি তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। ২০১৬-র প্রথম দিকে তিনি এখানকার আড্ডার ছবি দিয়ে ফেসবুকের কভার ফটো করেন। আজ খুঁজে দেখলাম তারিখটা ১৯ জানুয়ারি। একই সনের ২৭ সেপ্টেম্বর অন্য একটি আড্ডায় তাঁরই তোলা আমার সস্ত্রীক ছবিতে ‘Neepa Zahan and Ahmed Lipu at today’s rendezvous, Dhaka’ ক্যাপশন দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন।

আমার লেখালেখির প্রতিও ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ নজর। মনে পড়ে, কবিতার রাজপথে ভলতেয়ারের কাঁদীদ নিয়ে লিখেছিলাম। প্রবন্ধটি তাঁর ভালো লাগায় ট্রিট দিয়েছিলেন। কাছাকাছি সময়ে আহমদ ছফার বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস নিয়ে একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখেছিলাম ছোটকাগজ নিউজ প্রিন্টের এক সংখ্যায়। এটিও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। লেখাটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে Yuri Borev-এর Aesthetics, A Text Boook গ্রন্থটির অরিজিনাল রাশিয়ান ভার্সন উপহার দিয়েছিলেন। কেবল এমন মুগ্ধতার প্রকাশ নয়, গঠনমূলকভাবে ভিন্নমতও দিতেন। শেষোক্ত প্রবন্ধে আমি একজায়গায় ইন্ট্রোর পর লিখেছিলাম ‘বলা বাহুল্য’; তিনি জানালেন, সেখানে লেখা উচিত ছিল ‘লেখা বাহুল্য’।

‘আনাবাস অথবা দ্বিধার গন্ধম’-এর ব্যাককভারে তাঁর এপিটাফ।

৪.
এ-হেন দাউদ ভাই শৈলকূপা ফিরে যান আজ থেকে বছর দুয়েক আগে। মাঝেমধ্যে অল্প সময়ের জন্য ঢাকা আসতেন। এ-সময় বোধিদ্রুম হয়ে ওঠে তাঁর অনেকটা অস্থায়ী ঠিকানা। সন্ধ্যায় বোধিদ্রুমে দাউদ আল হাফিজের দেখা মিলতো। এখানে একটি অফিস ফাইলে তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংরক্ষণ করতেন। অনেকেই এখানে তাঁর খোঁজ করতো। কেউ কেউ তাঁর জন্য বই-পুস্তক, বিভিন্ন ডকুমেন্ট, এমনকি টাকা-পয়সাও রেখে যেত। তিনিও খামের উপরে নাম লিখে বিভিন্ন জনের জন্য জিনিসপত্র রাখতেন। সুহৃদ, কবি দাউদ আল হাফিজের সাহিত্য-আড্ডার প্রাণবন্ত মুখ কখনো ভোলার নয়।

শৈলকূপা অবস্থানকালে তিনি ফেসবুক কিংবা মুঠোফোনে যোগাযোগ রাখতেন। এই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ফোন করে বললেন তাঁর দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু চুন্নু মারা গিয়েছেন। বহুদিন বিচ্ছিন্ন থাকার পর ২০১৭-তে তাঁদের যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। দুই বন্ধু তখন ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদে নৌ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ১৫ই জুন ফোন করে জানালেন আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। ফেসবুকে লিখলেন ‘আষাঢ়স্যপ্রথমদিবস’। ৬ই এপ্রিল ফোন করে করোনা-কালের সমস্যা-সংকট জানলেন, জানালেন। ফেসবুকে লিখলেন, ‘য পলায়তি স জীবতি।’

করোনা-কালের প্রথমদিকে তাঁর স্মার্টফোন চুরি হয়েছিল। একটি সাময়িক বিকল্প ব্যবস্থা হওয়ায় খুশি হয়েছিলেন। এই সময় ফেসবুকে তিনি কিছু নতুন কবিতা পোস্ট করতেন। যদিও বলেছিলেন লেখার টেবিলের চেয়ারের একটি পা ভাঙ্গা। তিনি যাঁদের নতুন কবিতা পড়াতে চাইতেন তাঁদের নাম কমেন্ট বক্সে মেনশন করতেন।

মার্চের শেষদিকে ফোনে জানালেন আমার ব্যক্তিকতায় নৈর্ব্যক্তিক গ্রন্থটির অনুবাদের কাজ করোনা কালের মধ্যেই শেষ করতে চান। প্রায়শ পরিভাষার ব্যবহার-সংক্রান্ত কিছু জটিলতা নিয়ে ফোন করতেন। সিদ্ধান্ত হয়েছিল করোনা শেষ হলে ঢাকায় আসবেন। আমরা তখন একত্রে বোধিদ্রুমে বসে সমস্যাগুলো সমাধান করব। কিন্তু হায়! ২৯ জুন সন্ধ্যায় খলিল মজিদ ভাই জানালেন তিনি ইহলোকের মায়া চিরতরে ত্যাগ করেছেন। মুহূর্তেই আমাদের সব পরিকল্পনার স্থায়ী অবসান ঘটলো। তাঁর সব স্মৃতি মস্তিষ্কে ভর করলো। প্রাত্যহিক স্থূল প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিল্পের রস আস্বাদনে আর একত্রে বসা হবে না ভাবতেই মনটা হু হু করে উঠলো। মনে বাজলো, ‘কি ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে’!

দাউদ ভাইয়ের ছেলেটা অ্যাক্যাডেমিক লাইফ শেষে জব মার্কেটে প্রবেশ করেছে। মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। ঢাকার পাশে বসবাসের জন্য এক খণ্ড জমির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে ফুল টাইমার হিসেবে নিয়োগের আশ্বাসও ছিল। তবু প্রস্থানের জন্য কেন এমন ব্যস্ততা, দাউদ ভাই? আপনি না বলেন: ‘সবুর, সবর, তিতিক্ষা—এই তিনে মানব জীবন’। সেই আপনিই আরেকটু অপেক্ষা করতে পারলেন না! বলতেন তো—‘এভাবেই চলতে থাক: চলা, বলা, জীবনযাপন, আনন্দ আহরণ, স্রষ্টাতপঃ’। সেই আপনিই থেমে গেলেন! আর প্রস্থানের পথে ছড়িয়ে গেলেন ভীষণ মায়া!

দাউদ ভাই, চেষ্টা করলাম কোনো রকম বিশ্লেষণ বা মূল্যায়নের ফর্দ তৈরি না করে আপনার সঙ্গে যাপিত সময় আর স্মৃতির অংশবিশেষ তুলে ধরতে। আপনার সাহিত্যিক অবদান কিংবা ব্যক্তিত্বের গড়ন সম্পর্কে ভাবিকাল অনেক কিছুই জানাবে বলে আশা রাখি।

মানুষ বিশ্বকে মানব জগতে রূপান্তরিত করেছে। তাই নিজের নির্জনে সে একাকী হলেও নিঃসঙ্গ নয়, নিঃসম্পর্কিত নয়। তবুও পরকালের ধারণায় তাঁরা সর্বসম্মত ঐক্যমতে পৌঁছুতে পারেননি। ইহকালের মায়া ছিন্ন করে যেখানেই থাকুন না কেন, ভালো থাকবেন।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.