:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
সৈয়দ তারিক

কবি, ভাবুক

খসরু ভাইকে খুন করতে চেয়েছিলাম
আলোকচিত্র: কামরুল হাসান মিথুন। প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

একথা সেকথা

খসরু ভাইকে খুন করতে চেয়েছিলাম

খসরু ভাইকে একসময় আমি খুন করতে চেয়েছিলাম। চলচ্চিত্রবোদ্ধা মুহম্মদ খসরুকে। সত্যিই।

তারুণ্যময় ও উৎকেন্দ্রিক সেই সময়টা আমাদের শাহবাগ যাপনের কাল। পিজির চত্বর, সিলভানাসহ কয়েকটি রেস্তোরাঁ ও সদ্য জমতে থাকা আজিজ মার্কেট ছিল অপরাহ্ণ হতে রাত দশটা-এগারটা পর্যন্ত আড্ডার কাল। মদ্যপান উপলক্ষে যথাস্থানসমূহে মধ্যবর্তী প্রয়োজনীয় সময় অবশ্য কাটিয়ে আসা হতো ছোট-মাঝারি উপদলে। আবার গঞ্জিকাসেবীরা পিজি চত্বরে কিংবা আজিজ মার্কেটের কোনো কোণায় কর্মকাণ্ড সেরে নিত।

খসরু ভাইয়ের সাথে তখনকার তরুণ প্রজন্মের বেশ সখ্য ছিল। সিনেমা বিষয়ক ‘ধ্রুপদী’ ও ‘চলচ্চিত্রপত্র’ সংকলনগুলো সম্পাদনা করতেন। সিনেমা ও শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দিতেন। ছবি তুলতেন। সুযোগমতো সিনেমা দেখার ব্যাপার তো ছিলই। এইসব নিয়ে তরুণেরা তার সাথে সংঘবদ্ধ হতো। অবশ্য তার সাথে প্রায় কারোরই সখ্য দীর্ঘজীবী হতো না। তার ভাষা প্রায়শই খিস্তিময় এবং তিনি উচ্চস্বরে ও সরাসরি কথা বলতে ভালোবাসেন। তাই এদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের একজন আদিপুরুষ ও সংগঠক হলেও তার নিকটজনেরা একসময় তার কাছ হতে সরে পড়তেন।

তিনি সমালোচনা-প্রবণ ছিলেন। লেখক-কবি-শিল্পী-নির্মাতা কেউই তার খরজিহ্বার আক্রমণের বাইরে থাকত না। বড় কঠিন সমালোচক তিনি।

একবার, এটা আশির দশকের শেষ কিংবা নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিককার ঘটনা। শাহবাগের এক রেস্তোরাঁয় তিনি কবিদের তুমুল ধুয়ে দিচ্ছেন। আমি সাকুরা থেকে বেশ পান করে এসেছি, ফলে চিত্ত তখন উত্তেজনাপ্রবণ। আমি ঝট করে বলে ফেললাম, ‘এই যে খসরু ভাই, কবিদের তো খুব গালিগালাজ করতেছেন। আপনে যে এত বছর ফিল্ম সোসাইটি করলেন এতে কোন বালটা ছিঁড়ছেন? একটা সিনেমাও তো বানাইতে পারেন নাই। কবিরা তাও নিজেদের সাধ্যমতো কবিতা লেখে।’

আমার ভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরে সবাই বুঝতে পারছিল যে তখন আমি টাল-মাটাল আছি। খসরু ভাইও চেপে গেলেন।

এর দু-একদিন পর আমি যখন শাহবাগে সিলভানায় বসে কার সাথে কথা বলছি খসরু ভাই এসে ঢুকলেন। সোজা আমার কাছে এসে বললেন, ‘তারিক, তুমি এখন খাওয়া নাকি না-খাওয়া? মাতালগো আমি কিছু কই না। কিন্তু তুমি বহুত সীমা ছাড়াইয়া যাইতেছ। ঠিকঠাক মতো চইলো। এইরকম আবার যদি কর আমি তোমারে…’ আর মনে নাই তিনি ঠিক কী থ্রেট দিয়েছিলেন, তবে তার ভঙ্গি ছিল খুবই আক্রমণাত্মক। সে সময়টা আমি মদ্যপান ছাড়াও নানাবিধ মাদকে অভ্যস্ত ছিলাম। বিশেষ করে নাইট্রাজিপাম গ্রুপের ট্যাবলেট ইউনোকটিন দু-এক স্ট্রিপ সব সময়েই আমার পকেটে থাকত। ওসব খেয়ে আমার স্নায়ুতন্ত্র প্রায়শই চড়া গ্রামে বাঁধা থাকত।

খসরু ভাইয়ের সাথে তখনকার তরুণ প্রজন্মের বেশ সখ্য ছিল। সিনেমা বিষয়ক ‘ধ্রুপদী’ ও ‘চলচ্চিত্রপত্র’ সংকলনগুলো সম্পাদনা করতেন। সিনেমা ও শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দিতেন। ছবি তুলতেন। সুযোগমতো সিনেমা দেখার ব্যাপার তো ছিলই। এইসব নিয়ে তরুণেরা তার সাথে সংঘবদ্ধ হতো। অবশ্য তার সাথে প্রায় কারোরই সখ্য দীর্ঘজীবী হতো না। তার ভাষা প্রায়শই খিস্তিময় এবং তিনি উচ্চস্বরে ও সরাসরি কথা বলতে ভালোবাসেন।

খসরু ভাই তো বলে-টলে চলে গেলেন। আমার ইগো গেল খেপে। এর প্রতিশোধ নিতে হবে। মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, তাকে জাস্ট খুন করে ফেলব। নো অলটারনেটিভ। হি মাস্ট ডাই।

বাসায় ফিরে রাতে ঘুম হলো না। তাকে কীভাবে খুন করব সেই দৃশ্য কল্পনা করতে থাকলাম। আমার সাথে তখন সব সময় একটা এনটি কাটার থাকত। এটা একটা অস্ত্র হিসাবেই সাথে রাখতাম। রাত-বেরাতে পথেঘাটে ঘুরে বেড়াতাম যেহেতু, ওই জিনিসটা একটু আত্মবিশ্বাস জোগাতো। ছিনতাইকারী কেউ এলে এটা দিয়েই ঠেকাতে পারব বলে মনে করতাম।

সিদ্ধান্ত নিলাম, আজিজ মার্কেটে তাকে যখন পাবো, তলপেটে ঢুকিয়ে দেব ব্লেডটা, টান দিব উপরের দিকে। ব্যস, শেষ। দুপুর পর্যন্ত পার করে বিকালে হাজির হলাম আজিজ মার্কেটে। আর একসময় ঠিকই ওখানে এসে হাজির হলেন খসরু ভাই। তার সাথে ছিল হাসান।

আমি পকেটের ভিতরেই এনটি কাটারটি ধরে রেখে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। তখন তো ট্যাবলেট ইত্যাদি খেয়ে আমার চেতনা টানটান হয়ে আছে। তাকে বললাম, ‘এই যে, কালকে আপনে আমারে কী বলছিলেন?’ আমার তাকানো, শরীরের ভঙ্গি আর কণ্ঠস্বর শুনেই তিনি কিছু ঠাহর করে থাকবেন। বললেন, ‘কই? বলতেছিলাম, তুমি কিছু খাইছ-টাইছ নাকি।’ ‘না, আরও কী কী কইছিলেন।’ ‘না, তেমন কিছু কই নাই। তোমার শরীর ভালো না। ঠিকঠাকমতো চলতে কইছিলাম।’ এইসব বলতে-বলতে তিনি হাসানকে নিয়ে দ্রুত সরে গেলেন। আমার আর তাকে খুন করা হলো না।

তবে এইটুকুর পরে আমার সেই হননেচ্ছা প্রশমিত হয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিতে পারি। কয়েকদিন পরে হাসানের সাথে দেখা হলে সে বলল, ‘ওই দিন আপনি কি খসরু ভাইয়ের গায়ে হাত তুলতেন? উনি ভয় পেয়েছিলেন।’ আমি উত্তরটা পাশ কাটিয়ে গেলাম।

খুনের নিয়ত করা, তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ও ঘটাবার স্থানে যাওয়া মানে অপরাধ সংঘটনের দায় অনেকখানি বহন করা। আমি অমন একজন অপরাধী। এবং এ রকম আরও নানাবিধ অপরাধের দায় আছে আমার ঝুলিতে।

এসবের ভার বহন করা তত সহজ ব্যাপার নয়।

১৮.৯.১৮

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.