:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মেহেদী হাসান মুন

লেখক, চলচ্চিত্র সমালোচক

খাজা মেরে খাজা : গানে গানে সমর্পণ!

খাজা মেরে খাজা : গানে গানে সমর্পণ!

মরুভূমির প্রান্তরে বসে আছেন জালালুদ্দিন তার সভাসদদের নিয়ে, ভেতরে তার নবপরিণীতা রাজপুত স্ত্রী যোধা কান্না দিয়ে যেন মরুতে ঝড় নামাতে ব্যস্ত। সামনে বালুতে একটি পাটিতে বসে আছেন ধিকর্‌ জপে ব্যস্ত ১৭ জন সূফী সামাজান দরবেশ। সুরে তাদের মইনুদ্দিন চিশতীর প্রশংসাদীপ্তি, এ আর রেহমানের জাদুময়ী কণ্ঠে গেয়ে ওঠে তারা- খাজা মেরে খাজা…

খাজা আমার খাজা,
মনে তুমি আবেশিত,
শাহ্‌দেরও শাহ্‌ তুমি
আলীরও প্রশংসিত।
খাজা আমার খাজা,
মনে তুমি আবেশিত,
আশাহীনদের আশা দেয়ায়
তুমিও যে প্রশংসিত।

মইনুদ্দিন চিশতী ইলতুতমিশের আমলে যখন ভারতীয় উপমহাদেশে এলেন ধর্ম প্রচারের জন্য তখন থেকেই খুব জনপ্রিয় ধর্মীয় সত্তা হিসেবে বিকশিত হতে লাগলেন। নিজামউদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরুরা সেই ধারাকেই সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই খাজা মইনুদ্দিন চিশতী এখনো দারবিশদের মনে আবেশিত, তাদের কাছে সব শাহ্‌ এর চেয়ে বড় শাহ্‌ তিনি, যিনি আলী (রাঃ) এর প্রশংসা পাবার যোগ্য। আশাহীনরাও তাঁর কথা স্মরণ করে আশা লাভ করে তাই তো তিনি সকলের প্রিয় খাজা।

রেহমান চিশতীর মাজারে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে যাওয়া আসা করেন। তাঁর সেই ভক্তি, সে শ্রদ্ধা, খাজার সাথে সেই আত্মিক যোগাযোগের যে আর্তি সেটিই যেন প্রকাশ পেয়েছে তার গানে। খাজার প্রশংসা করে গানটি লিখেছিলেন কাশিফ, রেহমানেরই দূরসম্পর্কের ভাই। কোন সিনেমায় দেয়ার জন্য নয় বরং নিজেই শোনার জন্য বানিয়েছিলেন গানটি। কিন্তু আশুতোষ আসলেন রেহমানের কাছে যোধা-আকবর নিয়ে। জালালুদ্দিনের গল্প শুনতে গিয়ে রেহমান টের পান জালালুদ্দিনের মাঝেও খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর প্রভাব প্রচণ্ড, খোদার সাথে আত্মিক সম্পর্ক জালালুদ্দিন গড়তে চেয়েছেন বারংবার। স্ক্রিপ্টে জালালুদ্দিনের সে সূফীবাদের প্রসঙ্গ আনতেই রেহমান তাকে তার গানটি দিয়ে দেন। আশুতোষ এতো খুশি মনে হয় অনেকদিন হন নি।

রেহমান চিশতীর মাজারে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে যাওয়া আসা করেন। তাঁর সেই ভক্তি, সে শ্রদ্ধা, খাজার সাথে সেই আত্মিক যোগাযোগের যে আর্তি সেটিই যেন প্রকাশ পেয়েছে তার গানে। খাজার প্রশংসা করে গানটি লিখেছিলেন কাশিফ, রেহমানেরই দূরসম্পর্কের ভাই। কোন সিনেমায় দেয়ার জন্য নয় বরং নিজেই শোনার জন্য বানিয়েছিলেন গানটি।

তোমার দরবারে খাজা
আউলিয়াও যে ঝুঁকে চায়,
তুমি খোদার খুব কাছের যে তাই
তুমি হয়ে মোস্তফার (দেখানো) পথ পাই।
খাজা আমার খাজা,
মনে তুমি আবেশিত।
শাহ্‌দেরও শাহ্‌ তুমি,
আলীরও প্রশংসিত।

খাজা মেরে খাজা গানে আশুতোষ চেয়েছিলেন এ আর রেহমানের সঙ্গিতের সাথে তিনি যেন সুবিচার করতে পারেন। খোলা প্রান্তরে আকবর সভাসদদের নিয়ে বসে গান শুনছেন সূফীদের, এতো সরলীকরণ করা যাবে না কারণ এর পেছনের চিন্তাটা আশুতোষের অনবদ্য ছিল। তিনি এক গানেই ফানাহ্‌ এর তিনটি স্তরকে দেখিয়েছেন, জালালুদ্দিনকে গানশেষে বাকাহ্‌তে নেয়ার চেষ্টাও করেছেন। ফানাহ্‌ বলতে মূলত বোঝায় নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহ্‌পাকের অস্তিত্বকে নিজের মাঝে আবিষ্কার করে নেয়াকে। নিজেকে ত্যাগ করে, নিজের শরীরকে মাধ্যম বানিয়ে আত্মার সাথে খোদার সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করানোকে। এজন্য শরীরের মৃত্যুর আগেই নিজেকে বিসর্জন দিতে হয়, সকলপ্রকার আত্ম অহম, গরিমা থেকে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে হয়। ফানাহ্‌ এর তিনটি স্তর

  • ফানাফি শায়েখ- যেখানে অন্বেষণরত আত্মা তার মুরশিদকে (শিক্ষক, গুরু) ভালোবেসে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার মতো অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে।
  • ফানাফি রাসূল- যেখানে অন্বেষণরত আত্মা মহানবী (সঃ)কে ভালোবেসে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার মতো অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে।
  • ফানাফিল্লাহ- যেখানে অন্বেষণরত আত্মা আল্লাহ্‌পাককে ভালোবেসে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার মতো অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে।

এই তিনটি স্তর আত্মা পার করে আসলে সে বাকাহ্‌ লাভ করে যেখানে সে আল্লাহ্‌পাকের সাথে এক হতে পারে। উপরক্ত গানেও আমরা দেখি জালালুদ্দিনকে আল্লাহ্‌র নূরের আলোতে উদ্ভাসিত হতে। সিনেমার ইতিহাস থেকে দেখা যায় জালালুদ্দিনের মানবিকতা; তার আত্মিক পরিশুদ্ধিকেও আমরা দেখতে পাই আরও পরে গিয়ে। মূল ইতিহাসের সাথে যেহেতু অনেক দ্বন্দ্ব থাকে ফিকশনালাইজ কাজে সেহেতু এই জালালুদ্দিনকে বাকাহ্‌প্রাপ্ত হতে দেখে দর্শক অবাক হয় না। যে সম্রাট দেশের কল্যাণের জন্য হিন্দু রাজপুত কন্যাকে বিয়ে করে, ধর্ম কারও ওপর চাপিয়ে না দিয়ে মানবিক হয়, তাকে নূরের আলোয় উদ্ভাসিত দেখলে মন আর্দ্র হয়।

সামাহর সে নাচে সামাজানরা উঠে দাঁড়িয়ে চাঁদের মতো ঘুরতে থাকেন, যিনি শেখ থাকেন তিনি সূর্যের মতো মাঝখানে বসে থাকেন তাদের কেন্দ্র করে। ডান হাত থাকে স্বর্গের দিকে তাক করা আর বাম হাত মাটির দিকে। প্রত্যাশা একটাই এই মাটি থেকে যেন স্বর্গে যেতে পারে আমাদের আত্মা।

এরপরই গানে দেখা যায় দারবিশদের দু হাত ওপরে তুলে ধিকর্ তোলা নাচ, যে নাচে সঙ্গী হয় জালালুদ্দিনও। আশুতোষ তৈরি করেন সেলুলয়েডে আত্মিক এক পরিশুদ্ধির অনন্য মাত্রা, সামাহ যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয় আমাদের। সামাহ কী এটি জানতে আরেক জালালুদ্দিনের কথা জানতে হবে। জালালুদ্দিন রুমী এই পুরো আনুষ্ঠানিকতা অর্থাৎ সামাহকে বিবৃত করতে গিয়ে বলেন-

‘তাদের জন্য এটি সামাহ এই পৃথিবীর জন্য, অন্য পৃথিবীর জন্যও,
যেখানে তাকে যেতে হবে। আরও বেশি তাদের জন্য যারা বৃত্তাকারে নাচছে সেখানে,
যার মধ্যে দিয়ে তারা খুঁজে নিচ্ছে তাদের নিজস্ব ক্বাবা।’

একদিন জালালুদ্দিন পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তখন তিনি শুনতে পান স্বর্ণকাররা স্বর্ণে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিচ্ছেন আর বলে উঠছেন- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এর ফলে এক অদ্ভুত সিম্ফনি ছড়িয়ে পড়েছিল যেন তার চারপাশে, এক ঐশ্বরিক পরিবেশ। আবেশে জালালুদ্দিন অজান্তেই হাত উপরে তুলে নিলেন এবং বৃত্তাকারে সে সুরের তালে ঘুরতে লাগলেন। একটা সময় গিয়ে তার মনে হল তিনি যেন নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছেন খোদার কাছে, পেয়েছেন আত্মার পরিশুদ্ধি আর নাচশেষে যখন আবার নিজের শরীরে ফিরে আসলেন তখন যেন নিজেকে এক বদলে যাওয়া মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করলেন।

সামাহর সে নাচে সামাজানরা উঠে দাঁড়িয়ে চাঁদের মতো ঘুরতে থাকেন, যিনি শেখ থাকেন তিনি সূর্যের মতো মাঝখানে বসে থাকেন তাদের কেন্দ্র করে। ডান হাত থাকে স্বর্গের দিকে তাক করা আর বাম হাত মাটির দিকে। প্রত্যাশা একটাই এই মাটি থেকে যেন স্বর্গে যেতে পারে আমাদের আত্মা। চার সালাম দিতে হয় এই নাচে। প্রথম সালামে আল্লাহ্‌কে এক মানতে হয়, দ্বিতীয় সালামে বিশ্বাস আনতে হয় তাঁর অধিষ্ঠানে, তৃতীয় সালামে নিজেকে সমর্পণ করতে হয় তাঁর কাছে আর চতুর্থ সালামে শেখকেও উঠে এসে যোগ দিতে হয় যেন পরিপূর্ণ সমর্পণ করে চাঁদ-সূর্য সকলেই একসাথে। গানের মাঝেও আমরা দেখি শেখকে কেন্দ্র করে সামাজানদের বৃত্তাকার নাচ ও পরে শেখের ভূমিকা জালালুদ্দিন নিয়ে নেয় এবং আসন থেকে উঠে যুক্ত হয় তাদের সাথে। নিজেকেও সাধারণের কাতারে নামিয়ে সমর্পণ করে একমাত্র শক্তিমান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের দরবারে।

এভাবেই খাজা মইনুদ্দিন চিশতী হয়ে খাজা মেরে খাজা গানটি ছুঁয়ে ফেলে আলী (রাঃ), জালালুদ্দিন রুমী, জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর এবং সূফীবাদের সকল তত্ত্ব ও রসকে। এ আর রেহমানের শ্রদ্ধাবনত কণ্ঠ, আশুতোষের অসামান্য চিত্রায়ন ও সমর্পণের পরিপূর্ণতায় এই গান হৃদয়ে স্থান গড়ে নেয় নিশ্চিত।

শুনুন – Khwaja Mere Khwaja

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.