গন্ধ
শৈশব থেকেই এই এক সমস্যা না সুবিধা আমি জানি না— কোনো গন্ধই নাকে লাগে না। কবরস্থানের পাশে বাড়ি। কতো লাশ শেয়াল টেনে তুলেছে, লাশ পচা গন্ধে পুরো গ্রাম জড়ো হয়েছে, সব গন্ধ আমার ঘরে প্রথম ঢুকলেও আমি টের পাইনি। পৃথিবী নির্গন্ধ হলে মন্দ হয় না। নিঃশ্বাস নেয়া ছাড়া এই নাকটা আর কোনো কাজে লাগেনি। বলা চলে— অন্ধনাক। পারফিউমের সুগন্ধ কোনোদিন নাক স্পর্শ করেনি। ফুলের রঙ আর গড়ন চোখ বুঝে, ত্বক বুঝে— নাক নয়। ছোটবেলায় বন্ধুরা চোখ বেঁধে যে খেলাটা খেলতো সে খেলায় আমি মানুষের গু পর্যন্ত নাকে লাগানোর শিকার হয়েছি।
আমার বান্ধবী সোফি একবার বুকের ভেতর থেকে রুমাল টেনে এনে বলেছিলো— বলতো এটা কিসের গন্ধ। আমি বলতে পারিনি। এটা অবশ্য মাধ্যমিকের গল্প। উচ্চমাধ্যমিকে ববি, আমরা বব ডিলান বলে ক্ষেপাতাম যাকে, ওর বগলের নিচে আমার নাক চেপে ধরে বলেছিলো, শালা গন্ধকানা, নারী শরীরের গন্ধও পাস না; দেখ নারীদের ঘ্রাণ কতো উগ্র হয়, শুকে দেখ। অবিশ্বাস্য হলেও আমি কোনো গন্ধ পাইনি।
পৃথিবীর সব মানুষকে আমার গন্ধরাজ মনে হলেও নিজেকে চিরকাল গন্ধফকিরই মনে হয়েছে। অথচ আমারও ইচ্ছে সব গন্ধের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য খুঁজি। গন্ধের প্রকৃত গন্ধ বুঝি। পাইনি কোনোদিন।
বলে রাখি, একটা খুন আমি ইতোমধ্যে করে ফেলেছি। বেশি নয় মাসতিনেক হবে। লাশটা কার পরে বলছি।
আমি গন্ধশূন্য মানুষ হলেও তো আর অনুভূতিশূন্য মানুষ নই। আমারও রক্তের ভেতর খেলা করতে পারে বাসনা আর কামনার লাল হিমোগ্লোবিন। এটা একটা মেয়ে জানবে না? জানা তো উচিত।
বলে রাখি, একটা খুন আমি ইতোমধ্যে করে ফেলেছি। বেশি নয় মাসতিনেক হবে। লাশটা কার পরে বলছি।
গত আট বছরে সে আমায় তেরো বার ঠকিয়েছে। তেরোটা পুরুষের সাথে মিলিত হয়ে বুক ফুলিয়ে সগর্বে বলেছে সেসব গালগল্প। এবং সে আমার স্ত্রী ছিলো। না, পৌরুষের দাম্ভিকতা আমার অত্যুত্তম। এর জন্য দায়ী আমার গন্ধশূন্য নাক। তার আফসোস, তার শরীরে সঞ্চারিত গন্ধের কোনো মূল্যই সে পায়নি। তাই তাকে হত্যা করি।
কাজটা মন্দ করেছি একথা নির্মোহে বলা চলে। এটাও নির্দ্বিধায় বলা যায়— কতোটা মর্মাহত হলে একজন স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করতে পারে।
এখন সে আমার ঘরেই আছে। আমার সাথে, আমার বিছানায়।
এই তো সেদিন তার পচা লাশের ভেতর থেকে তার কঙ্কালটা তুলে আনি। কালো-পচা-বিগলিত দুর্গন্ধের ভাগাড় থেকে তুলে আনলেও আমার নাকে কোনো গন্ধ লাগেনি। কঙ্কালটা নিয়ে পুকুরে গিয়ে এমনভাবে ধুই যে প্রতিটি হাড় ধবধবে পরিষ্কার হয়ে যায়।
এখন সে আমার ঘরেই আছে। আমার সাথে, আমার বিছানায়। সশরীরে নয়, সকঙ্কালে।
এবার বলি— আমার স্ত্রীর নাম ববি।
কিন্তু কঙ্কালের ভেতর থেকে প্রতিরাতে আমার নাকে একটা গন্ধ লাগে। গন্ধটা দারুণ। এটা ঠিক নারীদেহের ঘ্রাণ কীনা জানি না। কেননা এই একটা গন্ধ ছাড়া আমি তো পৃথিবীর আর কোনো গন্ধ পাইনি।
১১ এপ্রিল ২০২০, নরসিংদী