
গুলজার: সুরভিত কবিতার খোঁজে
এই পথ খুব সহজ তো নয়
যে পথে তুমি হাত ছেড়ে যাও
চলে যাও একা আর কোনো পথে
পাছে দিক ভুলে যাও এই শংকায়
প্রতিটি মোড়ে আমি কবিতা দাঁড় করিয়ে রেখেছি
ক্লান্ত হও যদি —
আর তোমার প্রয়োজন পড়ে,
একটি কবিতার আঙুল ধরে ফিরে এসো!
একটি কবিতা, গুলজার
১৮ অগাস্ট, ২০১৮ তারিখে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত উদযাপিত হলো উর্দু সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি ও লেখক গুলজারের জন্মদিন। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছে ‘জ্ঞাতিজন’ নামের সাহিত্য সংগঠন। মাজহার জীবন, আলতাফ পারভেজ ও জাভেদ হুসেনের উদ্যোগে এবং জাকির হোসেনের সঞ্চালনায় ২০১৪ সাল থেকে প্রতিমাসের যে কোনো একটি শনিবার লালমাটিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে জ্ঞাতিজনের সাহিত্যের আসর। ১৮ অগাস্ট এর ৪৪তম আসরে উদযাপিত হলো কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, গীতিকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা এবং চলচ্চিত্র পরিচালক গুলজারের জন্মদিন। বাংলাদেশে উর্দু ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন জাভেদ হুসেন। মূলত তাঁর উদ্যোগে গুলজারের জন্মদিন পালিত হলো আলোচনায়, গুলজারের জীবনী ও কবিতা পাঠে, গানে ও গজলে।
শুরুতে গুলজারের জীবনী পাঠ করে শোনান অনুবাদক সাবেরা তাবাসসুম। দেশভাগ এবং দাঙ্গার প্রভাব গুলজার’র জীবনে প্রবল। বৈমাত্রেয় ভাই-বোনদের মাঝে অনাদরে বেড়ে ওঠা মাতৃহীন সম্পূরণ সিং কালরা শের-শায়রীর প্রেমে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলার অনুরাগী নিঃসঙ্গ মানুষটি কখনো বন্ধু, গুরু, সহকর্মী কখনোবা কাছের মানুষদের আনন্দ-বেদনার সান্নিধ্যে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন কবি গুলজার।

সংক্ষেপিত জীবনী অংশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতা কী করে প্রভাবিত করেছে গুলজারকে সে প্রসঙ্গে তথ্য উপস্থাপন করা হয়। সেই সঙ্গে কবিগুরুর ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থের চিরায়মনা কবিতাটিকে ভিত্তি করে গুলজার রচিত গানটিও প্রদর্শিত হয় আসরে। এরপর উর্দু সাহিত্যের গবেষক ও অনুবাদক জাভেদ হুসেন আলোচনা করেন উর্দু সাহিত্যে গুলজারের কবিতার গুরুত্ব, গুলজারের কবিতার বৈশিষ্ট্য ও গুলজার পাঠের প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে। গুলজারের কবিতা (গজল, নজম, ত্রিবেণী) থেকে মূলত নজম বিষয়ে আলোচনা করেন আলোচক। উর্দু সাহিত্যে নজম তুলনামূলক ভাবে আধুনিক একটি ফর্ম। ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলে মূলত নজমের সৃষ্টি। নজীর আকবরাবাদী উর্দু নজম’র স্রষ্টা (১৭৫০ / ১৭৬০)।
আলোচক জাভেদ হুসেন উল্লেখ করেন, উর্দু ভাষা ও কবিতার বেড়ে ওঠা শহরে। উর্দু কবিতার মূল ভাব মূলত প্রেমের যে প্রেম মানবিক প্রেমের মরমী প্রেমের সম্মিলনের। কিন্তু নজম দেখা দিল ভিন্ন রূপে। সাধারণ আটপৌড়ে জীবন, গ্রামীণ জীবনের নানা উপকরণ উঠে এসেছিল নজীর আকবরাবাদীর নজম-এ। গুলজারের নজম’র অনেক বিষয়বস্তুও তেমনি সাধারণ অথচ তার কারিগরি মুন্সীয়ানার কারণে তা কবিতা হিসেবে অনন্য হয়ে উঠেছে।
আলোচক জাভেদ হুসেন উল্লেখ করেন, উর্দু ভাষা ও কবিতার বেড়ে ওঠা শহরে। উর্দু কবিতার মূল ভাব মূলত প্রেমের যে প্রেম মানবিক প্রেমের মরমী প্রেমের সম্মিলনের। কিন্তু নজম দেখা দিল ভিন্ন রূপে। সাধারণ আটপৌড়ে জীবন, গ্রামীণ জীবনের নানা উপকরণ উঠে এসেছিল নজীর আকবরাবাদীর নজম-এ। গুলজারের নজম’র অনেক বিষয়বস্তুও তেমনি সাধারণ অথচ তার কারিগরি মুন্সীয়ানার কারণে তা কবিতা হিসেবে অনন্য হয়ে উঠেছে। আলোচক আরো বলছেন উর্দু কবিতার কাব্যেশ্বর বলে খ্যাত মীর তকী মীরের সহজ করে বলবার বৈশিষ্ট্যও পরিলক্ষিত হয় গুলজারের নজম-এ। প্রেম, নারী-পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা, নৈঃসঙ্গ্যের পাশাপাশি ইতিহাস, রাজনীতি, সুফি দর্শন এবং বিশ্বভাবনার সাক্ষাৎ মেলে গুলজারের কবিতায়। এসকল কারণে কাব্যমোদীদের কাছে গুলজারের কবিতা ও সাহিত্য পাঠ অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। এ পর্যায়ে আলোচনার রেশ ধরে গুলজার’র গজল পরিবেশন করেন তসলিম হোসেন।

এর পরের অংশে শুরু হয় গুলজারের কবিতা ও তার অনুবাদ পাঠ। অনুবাদক সাবেরা তাবাসসুম গুলজারের “রাত প্যশমীনে কী” বইটি থেকে কিছু নির্বাচিত কবিতা পাঠ করবার আগে বাংলাদেশের সাহিত্যেও অন্যতম প্রধান কবি রুবী রহমান এবং উর্দু ভাষার কবি শামীম যামানভীর সঙ্গে গুলজারের কবিতার অনুবাদের সম্পর্ক নিয়ে খানিকটা বলেন। এ পর্যায়ে কবি রুবী রহমান গুলজারের কবিতা ও তাঁর বিষয়বস্তু নিয়ে তার অনুভূতি, ভালো লাগার কথা ব্যক্ত করেন। অনুবাদক গুলজারের “রাত প্যশমীনে কী” বইটির অন্তর্ভুক্ত নজমগুলোকে বিষয় অনুযায়ী কয়েকটি পর্বে ভাগ করে সেখান থেকে ১৫টি কবিতা ও তার অনুবাদ পাঠ করে শোনান। এসকল পর্বে রয়েছে দাঙ্গা ও দেশভাগ পর্ব; বিশ্বব্রহ্মা- ও সৃষ্টি রহস্য নিয়ে জিজ্ঞাসা; অস্তিত্ব ও দার্শনিক জিজ্ঞাসা; মানব-মানবীর সম্পর্কের জটিলতা; সামাজিক বৈষম্য, অনাচার, রাজনৈতিক জটিলতা এবং মৃত্যু বিষয়ক ভাবনা।
আসরের এ পর্যায়ে উর্দু কবিতা ও এর অনুবাদ প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখেন কবি নুরুল হক এবং কবিতা পাঠ করেন উর্দু-বাংলা সাহিত্য ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট উর্দু ভাষার কবি শামীম যামানভী। সবশেষে গুলজার পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘ইজাযত’-এ ব্যবহৃত গানের অনুবাদ ও সেটির প্রদর্শনের ভেতর দিয়ে আলোচনা, কবিতা পাঠ ও অনুবাদ পর্ব শেষ হয়।

গুলজারের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব নিঃসন্দেহে গভীর। রবীন্দ্রনাথের যে বইটি পড়ে পালটে গিয়েছিল গুলজারের দৃষ্টিভঙ্গী সেই গার্ডেনারের হিন্দী অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন তিনি ২০১৬ তে। বাগবান বলে এই সংকলনটির প্রথম কপি ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর হাতে তুলে দিয়ে গুলজার বলেছিলেন যে, তাঁর ইচ্ছে, সকল স্কুলে যেন রবীন্দ্রনাথের রচনা পাঠ্য করা হয়। কেননা রবীন্দ্রনাথের রচনায় নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতি রয়েছে। তিনি চান শিশুরা এর সংস্পর্শে বেড়ে উঠুক। গুলজারের ভাষায় গুরু একজনই, টেগোর। রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে জ্ঞাতিজন গুলজারের জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে। জ্ঞাতিজন আয়োজিত গুলজারের জন্মদিনের উদযাপনে অংশ নিয়েছেন কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিল্পশুভাকাঙ্ক্ষী এবং বোদ্ধাগণ। তাদের সকলের প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হলো কবি গুলজারকে।
বাংলাদেশে গুলজার সাধারণ দর্শক-শ্রোতার কাছে পরিচিত গীতিকার হিসেবে। এর বাইরে তাঁর অন্যান্য পরিচয়ের পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যিক পরিচিতি নিয়ে বিশেষ জানাশোনা নেই। তবে আশার কথা, একান্তে অনেকেই গুলজারের কবিতা, গজল, ত্রিবেণী ও ছোটগল্প অনুবাদ করে চলেছেন, প্রকাশ করছেন এবং তারা এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন। গুলজার দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কেবল রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদ করছেন তা নয়, ভারতের ৩২টি ভাষার ৩০০জন সমসাময়িক কবির ৫০০ কবিতা অনুবাদের কাজ করেছেন তিনি। গুলজার এ প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘আই ওয়ান্ট টু মেক আওয়ার পোয়েট্রি ইয়াং এগেইন’।
সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য গুলজার ২০০২-এ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ২০১৬ তে গুলজার স্বল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশে ঘুরে যান। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর নাটক লেখার এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কাজের অনুবাদ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। গুলজারের এত পরিচিতির ভেতর সবচেয়ে কাছের রয়ে গেছে কবিতাই। তাই তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি কবিতাকে ভালোবাসার। এমন মহর্ষির কবিতাকে, সাহিত্য কর্মকে বাংলাদেশের সাহিত্যানুরাগী পাঠকেরা চিনে নিক এই প্রত্যাশা রইল।
আরো পড়ুন-
● গুলজারের কবিতা: স্মৃতিমেদুর বিষণ্ণ আলো
● গুলজারের সাতটি কবিতা

আরো পড়তে পারেন
Content not found!
Please add specific content.