চলচ্চিত্রের কাহিনী (পর্ব-১)
চলচ্চিত্রিক মানসিকতা : সিনেমা, দর্শক ও পরিচালক (পর্ব-২) এর পর থেকে-
একটি প্রচলিত অভিযোগ- “কি আর সিনেমা বানাবো ভাই, ভাল কাহিনীই তো পাচ্ছি না।” অথবা “এবার ঈদের নাটকগুলা দেখছেন, একটাতেও ভাল কাহিনী নাই। কি যে সব বানাচ্ছে আজকাল।” অভিযোগের ২য় অংশ মানে, ‘কি যে সব বানাচ্ছে আজকাল’ টুকু সত্য হলেও ভাল কাহিনী সংক্রান্ত অভিযোগটুকু বোধ করি সত্য নয়। কিন্তু এটা মানুষকে বোঝানো বেশ কঠিন একটা ব্যপার।
ফেসবুকের কল্যাণে তরুণ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মাঝে আমার সামান্য কিছুটা পরিচিতি তৈরী হয়েছে। সে সুবাদে ফেসবুকের ইনবক্সে এবং পথে-ঘাটে অনেক আগ্রহী তারণ্যকে আমার ফেস করতে হয়। জানি ‘ফেস করতে হয়’ বাক্যটা অনেককেই আহত করবে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই কথাটা সত্য। একটু ব্যখ্যা দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
একবার এক ছেলে বলল, “ভাইয়া আমার কাছে ভাল ভাল কিছু কাহিনী আছে, আমার বন্ধুরা বেশ ভাল অভিনয় করে। একটা ক্যামেরাও আছে। আমি একটা শর্ট ফিল্ম বানাতে চাই। আমাকে শুধু পরিচালনার কায়দা কানুনটা বুঝে নিতে হবে। আপনি যদি একটু গাইড করতেন।” তাকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম “পরিচালনা শিখতে গেলে লাইট ক্যামেরা সেট কালার কম্পোজিশন এডিটিং ইত্যাদি সব বুঝতে হবে। সেটা এক দিনের ব্যাপার না। তুমি যদি সত্যিই শিখতে চাও তো আমার স্কুলে ভর্তি হতে পারো।”
ছেলেটি উল্টো বুঝল। ভাবল আমি তাকে বিনা পয়সায় শেখাতে চাইছি না। আমি একজন অর্থ লোভী পিশাচ টাইপের মানুষ। জ্ঞান বিতরনের মহৎ উদ্দেশ্য আমার নেই। যদিও এই মহত্ব দেখানোর দায়িত্ব কেউ আমাকে দেয়নি, তারপরও বাংলাদেশের মধ্যে সব থেকে কম পয়সায় কোর্স করানোর সিদ্ধান্তটা জ্ঞান বিতরনের উদ্দেশ্য থেকেই এসেছিল। আমি শুধু আমার অফিস ভাড়া যেন দিতে পারি সেইটুকু পারিশ্রমিকই নিয়ে থাকি। আমার বাবা দেশের প্রাক্তন জমিদারদের একজন হলে হয়ত সেটাও নিতাম না। যাহোক, আলোচনার এক পর্যায়ে ছেলেটি বিরক্ত হয়ে বলল “ভাল সিনেমার জন্যে ভাল কাহিনীটাই তো আসল।” যেহেতু সিনেমা বানানোর আসল বিষয়টা সে জেনেই গেছে তাই তাকে আর জ্ঞান দিয়ে কি লাভ। চুপ মেরে যাওয়াটাই এক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ।
আরেকটা ঘটনা বলি, কয়েকজন তরুণ উৎসাহ নিয়ে আমার কাছে হাজির হল। তাদের ধারনা খুব শিঘ্রি তারা সাংঘাতিক কোন একটা সিনেমা বানাতে যাচ্ছে। তারা সবাই মিলে বেশ খেটেখুটে একটা দারুণ কাহিনী দাঁড় করিয়েছে। এখন সেটা তারা আমাকে শোনাতে চায়। আমার কাজ হল গল্পটা শুনে যদি কোন প্লট হোল থাকে সেটা ধরিয়ে দেয়া। এই প্লট হোল শব্দটার সাথে আমি অবশ্য অনেক পরে পরিচিত হয়েছি। মফস্বল শহরের যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমার বেড়ে ওঠা সেখানে কাহিনীর ফাঁক ফোকড় বা যুক্তিহীনতা শব্দগুলোই ব্যবহার হত।
কাহিনী অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে ‘কাহিনীই প্রধান’ একথাটা কেবলমাত্র উপন্যাসের ক্ষেত্রে সত্য। একটি উপন্যাসের জন্যে দরকার ভাল একটি কাহিনী, সেই সাথে সেটাকে ভাল ভাবে উপস্থাপন করা। এই উপস্থাপনের জন্যে দরকার ভাল বর্ণনা ও ভাল সংলাপ বা ডায়লগ। আর কাহিনীর আকর্ষণীয় একটি অবকাঠামো। মানে কাহিনীটাকে শুরু থেকে শেষ এভাবে লিখবেন নাকি শেষ থেকে শুরু অথবা এলোমেলো ভাবে লিখবেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যা কিছু পড়তে হয়, মানে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, এমন কি গরুর রচনাও ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলো সত্য।
যাহোক, আমি তাদের কাহিনীর প্লট হোলগুলো ধরিয়ে দিলাম। সে সময় আমি নাটক সিনেমার জগৎ থেকে বিভিন্ন কারণে র্নিবাসিত। তাই আগ্রহী কিছু তরুণ পেয়ে বলা যায় আমি অতি আহ্বালাদিত। নিজে থেকে জানতে চাইলাম ক্যামেরা কে চালাবে? লাইট কি ব্যবহার করবা? কোথা থেকে ক্যামেরা ভাড়া নিচ্ছ? জানা গেল তাদেরই মধ্যে একজন ক্যামেরা চালাবে, যে কিনা একটি ডিএসএলআরের মালিক। তবে সে আগে কখনও ভিডিওগ্রাফি করেনি। এবার অবাক হলাম। তাদের বোঝানের চেষ্টা করলাম টেকনিক্যাল জায়গাগুলোতে প্রফেশনাল লোক ব্যবহার করা উচিৎ। তারা ভেবে বসল তাদের সাথে কাজ করে আমি আমার বেকারত্ব ঘোচাতে চাইছি। সুতরাং চুপ মেরে গেলাম। তারা তাদের কাহিনী নিয়ে বিদায় হল। এমন অনেক উদাহরণ আছে কাহিনীকে মহাগুরুত্ব দেয়ার।
কাহিনী অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে ‘কাহিনীই প্রধান’ একথাটা কেবলমাত্র উপন্যাসের ক্ষেত্রে সত্য। একটি উপন্যাসের জন্যে দরকার ভাল একটি কাহিনী, সেই সাথে সেটাকে ভাল ভাবে উপস্থাপন করা। এই উপস্থাপনের জন্যে দরকার ভাল বর্ণনা ও ভাল সংলাপ বা ডায়লগ। আর কাহিনীর আকর্ষণীয় একটি অবকাঠামো। মানে কাহিনীটাকে শুরু থেকে শেষ এভাবে লিখবেন নাকি শেষ থেকে শুরু অথবা এলোমেলো ভাবে লিখবেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যা কিছু পড়তে হয়, মানে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, এমন কি গরুর রচনাও ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলো সত্য।
এবার আসা যাক মঞ্চ নাটকে। এখানে কাহিনী থাকছে। সংলাপ থাকছে। কিন্তু বাদ পড়ে যাচ্ছে বর্ণনার ঘনঘটা। সে জায়গাটা দখল করে নিচ্ছে নায়ক নায়িকার অভিনয় শৈলী, কস্টিউম, মেকআপ ও সেট। থার্ড থিয়েটারে অবশ্য সেট ও কস্টিউম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সুতরাং বলা যায় অভিনয়টাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ভাল কাহিনীর মঞ্চ নাটককে শুধু মাত্র বাজে অভিনয়ের জন্যে মানুষকে আমি অপছন্দ করতে দেখেছি। এমন কি কাহিনী যদি অতি উচু মার্গের হয় তো সেখানে ভাল অভিনয় বলা যায় রীতিমত ফরজে আইন।
আমি যে থিয়েটারে মানুষ হয়েছি সেখানে আশির দশকের জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কার পাওয়া বেশ কয়েকজন অভিনেতা ও নাট্যকার রয়েছেন। শুধু তা-ই নয় বাংলাদেশে নাট্য উৎসবের ধারণাটুকু আমার নাট্যগুরুর কাছ থেকেই এসেছে। তিনি এখন বয়োঃবৃদ্ধ হলেও জীবিত। তাদের মত যোগ্য ব্যক্তিদের রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী মঞ্চায়ন করা যাবে কি যাবে না এই নিয়ে মিটিংয়ের পরে মিটিং করতে দেখেছি। কারণ একটাই, রক্তকরবীর মত নাটকে নিম্নমানের অভিনয় হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। শেষ পযর্ন্ত থিয়েটারের তরুণ সদস্যদের লম্বা একটা ওয়ার্কশপ করানো হয়, সেই সাথে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে সিনিয়র অভিনেতাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রক্তকরবী সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়। দূর্ভাগ্যবশতঃ আমি তখন ঢাকায় অবস্থান করায় এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞের অংশ হতে পারিনি।
মঞ্চে একজন পরিচালকের মাস্তানি শো শুরু হওয়ার আগ পযর্ন্ত। শো শুরু হলে মাস্তানিটা চলে যায় অভিনেতাদের হাতে। তারা ভাল পরফর্ম করলে শো হিট। আর না করলে পরিচালকের উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে চুল ছেঁড়া ছাড়া কোন গতি নেই। কিন্তু চলচ্চিত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। চলচ্চিত্রে শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত মাস্তান একজনই, আর সে হচ্ছে পরিচালক। আর এই কারণেই ফিল্মকে বলা হয় ডিরেক্টরস মিডিয়া।
প্রশ্ন হল, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী কি স্বয়ং ভাল কোন কাহিনী নয়, যে তাকে ভাল নাটকে পরিণত করতে একদল ভাল অভিনেতার প্রয়োজন পড়ল। একথা পাগলেও বলবে না যে রক্তকরবীর কাহিনী খারাপ। বস্তুত সারা জীবনে আমি যতগুলো নাটক পড়েছি বা দেখেছি তার মধ্যে রক্তকরবীর অবস্থান অবশ্যই ১ থেকে ৫ এর মধ্যে। তাহলে?
উপন্যাস এবং নাটকের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্যটা হল, উপন্যাসে যখন বলা হয় নায়িকা লাল রঙের শাড়ি পরেছে। তখন পাঠক তার মত করে সেই লাল রংকে ভেবে নেয়। কারো কাছে সেটা রক্ত লাল তো কারো কাছে সিঁদুর লাল। কারো লালে হালকা হলুদের মিশেল রয়েছে তো কারো লালে রয়েছে ফিকে ভাব। শুধু রংই নয়, পাঠক নায়িকার শরীরের কাঠামো কি হবে সেটাও নিজের মত করে কল্পনা করে নেয়। কিন্তু নাটকে বিষয়টা ভিন্ন। আপনাকে সেখানে জলজ্যান্ত একটি মেয়েকে লাল শাড়ি পরিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। সেই মেয়ের শারীরীক কাঠামো বা শাড়ীর রং থিয়েটার হলের সব র্দশককে মুগ্ধ নাও করতে পারে। বিষয়টা আসলে এখানে এসেই জটিল আকার ধারণ করছে।
বলা হয়ে থাকে, যে নাটক পড়তে ভাল লাগে, সেই নাটক দেখতেও ভাল লাগবে তার কোন মানে নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্ক্রীপ্ট পড়তে মোটেও ভাল লাগছে না, কিন্তু নাটক হিসাবে র্দশক সেটা দেখে অবিভূত, এমন নাটকের সংখ্যাই বেশী। কারণটা আর কিছু না, নাটকের স্ক্রীপ্টে কাহিনীর বর্ণনা নেই, শুধু ডায়লগ রয়েছে। আর মঞ্চায়নকৃত নাটকটিতে ডায়লগের সাথে সাথে রয়েছে অভিনেতার অভিব্যক্তি, যা র্দশককে কাহিনীর মাঝে ঢুকতে সাহায্য করছে। মোট কথা, উপন্যাসে ভাল একটা কাহিনীর সাথে পাঠককে সম্পৃক্ত করে ভাল বর্ণনা আর নাটকে র্দশককে সম্পৃক্ত করে ভাল অভিনয়। ভাল বর্ণনা নেই তো ভাল উপন্যাস নেই, ভাল অভিনয় নেই তো ভাল নাটক নেই, তা সে কাহিনী যতই ভাল হোক, যায় আসে না।
এবার আসা যাক চলচ্চিত্রে। মঞ্চে একজন পরিচালকের মাস্তানি শো শুরু হওয়ার আগ পযর্ন্ত। শো শুরু হলে মাস্তানিটা চলে যায় অভিনেতাদের হাতে। তারা ভাল পরফর্ম করলে শো হিট। আর না করলে পরিচালকের উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে চুল ছেঁড়া ছাড়া কোন গতি নেই। কিন্তু চলচ্চিত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। চলচ্চিত্রে শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত মাস্তান একজনই, আর সে হচ্ছে পরিচালক। আর এই কারণেই ফিল্মকে বলা হয় ডিরেক্টরস মিডিয়া। বলে রাখা ভাল সেরের উপরে যেমন সোয়া সের থাকে, তেমনি ডিরেক্টরের উপরে কেবল আরেকজন মানুষ ছড়ি ঘোরাতে পারে। সে হল প্রোযোজক বা প্রডিউসার। হাজার হোক টাকা যার শেষ মাস্তানি তো তারই হবে।
চলবে…
অলংকরণ : রাজিব রায়