আনোয়ার হোসেন-এর রচনা
চলচ্চিত্র : আচমকা আলো
নিদ্রামগ্ন প্রাণ।
সুপ্ত আত্মা। ক্ষণিকের প্রবাহে স্বপ্নের আমেজে চলচ্চিত্রের বিরতিহীন গাথার মতো কারোর দুঃস্বপ্নের হঠাৎ ইতি।
ধড়মড়িয়ে নিদ্রাভগ্নে স্বপ্নের সমাপ্তি। চোখ মেলে সকালের কিংবা টেবিল ল্যাম্পের আলোকচ্ছটা-বাস্তবতায় পদার্পণ এবং আচমকা স্বস্তি।
হঠাৎ আলোর এমনই গুণ!
অনাদিকালে, কখনো কোনো মুহূর্তে স্রষ্টা বলিলেন ‘লেট দেয়ার বি লাইট’। সেই BIG BANG-এর মাধ্যমে সৃষ্টির শুরু আর আজ অবধি আলো-আঁধারের লুকোচুরি। প্রস্তরযুগের প্রথম পাথর ঘষা আগুনটি যখন জ্বলল মানুষের মনে, সম্ভবত শিল্পের তখন শিখাও প্রজ্বলিত হলো। কালের প্রবাহে আঁধারের তমসায় জীবনদানের জন্য যুগে যুগে এলেন মনীষীরা।
শূন্য খ্রিস্টাব্দ।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রজ্বলিত তারকা দিক নির্ণয় করল মহামানব যিশুর জন্মকে। ৫০০ বছর পর ইসলামের শেষ নবীকে শান্তি দেয়ার জন্য সচল মেঘ আবৃত করল প্রখর সূর্যকে। এছাড়া প্রাচীন ইতিহাস বর্ণনা করেছে অর্জুন, জিউস কিংবা ফারাওদের অগ্নিবানের আচমকা আলোকবর্তিকাকে। আজ ২০০০ খ্রিস্টাব্দের দ্বারগোড়ায় আমরা শঙ্কিত। না জানি কবে আবার সেই BIG BANG মানুষের খেয়ালিপনায়। পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞে নিমেষে উপেক্ষিত হবে সৃষ্টি, প্রাণ ও প্রাণপ্রিয় চলচ্চিত্র। শুধু চলচ্চিত্রে কেন, জীবনের সার্বিক আলপনায় আলোর ছটা আচমকা আসে বলেই সৃষ্টি তার জাল বোনে।
মায়ের গর্ভে আঁধারের স্বপ্নরাজ্য থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে শিশু পৃথিবীর বাস্তবতার আলোকচ্ছটায় হঠাৎ কান্নায় নিজের অস্তিত্ব হূদয়ঙ্গম করে নেয়। মা-বাবার দুঃখমাখা জীবনগাথায় বস্তির ধূসর কালো কালো ছেলেটির হঠাৎ হাসি সুখের আলোকচ্ছটার অমৃত দান করে।
যৌবনকালে প্রিয়ার টলটলায়মান অশ্রুতে, মধ্যবয়সে প্রথম পাকা চুলের শুভ্রতায় কিংবা শেষ বয়সের অসীমের দিন গণনার দীর্ঘশ্বাসে আসে হঠাৎ আলোর তীক্ষ অনুভূতি।
জীবনের মতো চলচ্চিত্রেও তাই। সেকেন্ডে চব্বিশ ফ্রেমে অপস্রিয়মাণ চলচ্চিত্রের নকশিকাঁথায় মাঝে মাঝে হয়তো আসে হঠাৎ আলোর ঝলকানি, কখনো অনুভূতিতে, কখনো আলোর বাস্তব উপস্থিতিতে, কখনো প্রত্যাশিত, কখনো অপ্রত্যাশিতভাবে। এর ফলে কখনো চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে আলোর দিশারী, জীবনের জয়গাথা। আবার আলোর অপব্যবহারে কখনো সৃষ্টি হয় তমসাচ্ছন্ন অপসংস্কৃতি। এই লেখনীতে এমনই আচমকা আলোর অন্বেষণের প্রয়াস।
জীবনের মতো চলচ্চিত্রেও তাই। সেকেন্ডে চব্বিশ ফ্রেমে অপস্রিয়মাণ চলচ্চিত্রের নকশিকাঁথায় মাঝে মাঝে হয়তো আসে হঠাৎ আলোর ঝলকানি, কখনো অনুভূতিতে, কখনো আলোর বাস্তব উপস্থিতিতে, কখনো প্রত্যাশিত, কখনো অপ্রত্যাশিতভাবে। এর ফলে কখনো চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে আলোর দিশারী, জীবনের জয়গাথা। আবার আলোর অপব্যবহারে কখনো সৃষ্টি হয় তমসাচ্ছন্ন অপসংস্কৃতি। এই লেখনীতে এমনই আচমকা আলোর অন্বেষণের প্রয়াস।
গতানুগতিক আঁধারে আলো
অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকার পর্দায় আলোর উপস্থিতিতেই দানা বেঁধে ওঠে ইমেজ, ফ্রেমে, সিকোয়েন্স এবং চলচ্চিত্র প্রবাহ। এ গল্প বলায় জীবনের গতানুগতিকতার মতো, উপন্যাসের বিন্যাসের মতো আলো-আঁধারে স্বাভাবিক ক্যামেরা রূপ দেয় জীবনকে। কিন্তু জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তের মতো, উপন্যাসের সন্ধিক্ষণের আবেগের মতো চলচ্চিত্রের স্বাভাবিক ইমেজে কখনো কখনো আরোপিত হয় হঠাৎ আলোর উপস্থিতি— কোনো এক নির্দিষ্ট অনুভূতি সঞ্চারিত করার জন্য। এর গতানুগতিক প্রয়োগের সঙ্গে অসচেতন চলচ্চিত্র দর্শকরাও বহুল পরিচিত:
বনরাজির মাঝামাঝি নায়ক-নায়িকার প্রেমের প্রখরতা প্রমাণের প্রয়াস— ক্যামেরা নায়ক-নায়িকার হাঁটাহাঁটি ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখী। গাছ, ডালপাতার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ আলোর বিচ্ছুরণ! সিকোয়েন্সমালার কোনো চরম মুহূর্তে কারোর মৃত্যুর দৃশ্য। দর্শকমনে আবেগ সঞ্চারণের জন্য একইভাবে ঊর্ধ্বমুখী লেন্সের সূর্যের ছটা কিংবা কড়কড় বিদ্যুতের ঝিলিক ধরে রাখার প্রয়াস!
পিস্তল হাতে হত্যাকারী কিংবা অস্ত্র হাতে প্রোটাগনিস্ট। আবছা অন্ধকার শটটিতে হঠাৎ আগ্নেয়াস্ত্রের স্ফুলিঙ্গ। সিকোয়েন্সের প্রয়োজনে রাতের সূচনায় কেউ ঘরের লাইটটি জ্বালাল কিংবা রাতের সিকোয়েন্স শেষে ঘুমাতে যাচ্ছে বলে কেউ টেবিল ল্যাম্পটি নিভাল। হঠাৎ আলো কিংবা হঠাৎ আঁধার। গতানুগতিকতার প্রবাহে এমনিভাবেই আসে প্রত্যাশিত আচমকা আলো।
অপ্রত্যাশিত আচমকা আলো
চলচ্চিত্রায়নের আলোক বিন্যাসে প্রায়ই লক্ষণীয় যে, হঠাৎ আলোক সম্পাতের প্রয়োগ অপ্রত্যাশিতভাবেই আসে। এসব ক্ষেত্রে পরিচালক এবং আলোকচিত্র পরিচালক ছবির কোন সিকোয়েন্সের কোন মুহূর্তে এ উপাদানটিকে সার্থক শিল্পসম্মতরূপে ব্যবহার করেন। এর ব্যবহার আসে সাধারণত ড্রামাটিক প্রয়োগকৌশল রূপে, চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট, ডায়ালগ, অভিব্যক্তি, ক্যামেরা মুভমেন্ট, শব্দ প্রয়োগ এবং এডিটিংয়ের পরিপূরক কিংবা ক্যাটালিস্ট হিসেবে। মনে রাখার মতো চলচ্চিত্রগুলোয় আবার কখনো আচমকা আলো কিছুটা প্রত্যাশিতভাবে এলেও এর ব্যবহারিক প্রয়োগে এত মাধুর্য আর অভিনবত্ব থাকে যে নন্দনতাত্ত্বিকভাবে এর অনুভূতি প্রবণতা অপ্রত্যাশিতের রূপ নেয়। অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্রগুলোয় আলোর এরূপ ব্যবহার চরম উত্কর্ষমণ্ডিত অনেকটা মোপাসাঁর ছোট গল্পের শেষ দুটি লাইন কিংবা কবি শামসুর রাহমানের কবিতার শেষ পঙিক্তগুলোর এপিলগধর্মী বিস্ময়তা নিয়ে।
আমার দেখা মনে রাখার মতো চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে আচমকা আলোর অনেকগুলো সার্থক ব্যবহার দৃশ্যমান ফেলিনির অনবদ্য সৃষ্টি সাড়ে ৮ সাদা-কালো ছবিটিতে। ছবিটি একজন ব্যস্ত চিত্রপরিচালকের আত্মজীবনী-আত্মোপলব্ধিমূলক রিয়েলিটি ফ্যান্টাসির গাঁথুনিতে সমন্বিত। ছবিটির প্রথম সিকোয়েন্সেই পরিচালকের এক স্বপ্ন দৃশ্য। ব্যস্ত শহরের এক ট্রাফিক জামে গাড়িতে পরিচালকের আত্মা কাছের, চলচ্চিত্রের সব চেনাজানা চরিত্রকে ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বগামী তিরোধামে। কিন্তু জীবন এবং মাটিস্পর্শী আপনজনদের হ্যাঁচকা টানে তিনি ধরাশায়ী হওয়ার মুহূর্তে বাস্তবতায় সিকোয়েন্সে দুঃস্বপ্নমুক্ত হলেন আবছা আঁধারে, অধীনস্থ হোটেল শয্যায়। তারপর হোটেলের এক্সক্লুসিভ সুইটের প্রসাধন কক্ষে স্বপ্নভঙ্গের অতিক্লান্তিতে তার আলো জ্বালানোর হঠাৎ অত্যুজ্জ্বল শুভ্রতা পরিচালক ফেলিনিকে, পরিচালকরূপে অভিনেতা মার্সেলো মাস্ত্রিয়ানীকে এবং সর্বোপরি সমস্ত দর্শককে ফিরিয়ে আনে রূঢ় বাস্তবতায়, আচমকা আলোর প্রয়োগে।
আলোর এ এক জয়গাথা এবং পুরো চলচ্চিত্রটিতে এরূপ আরো কিছু আলোর মহাকাব্য। পরিচালকের শৈশব-স্মৃতির সিকোয়েন্সে বুড়ি দাদীমার ঘুম পাড়িয়ে দেয়া আর প্রদীপ হাতে বিড়বিড় করতে করতে আলো-আঁধারে, দেয়াল সিঁড়ি ছবির লুকোচুরি খেলায় প্রস্থান। ক্যামেরার প্রাকশট আর ভান করে পড়ে থাকা শিশুদের হঠাৎ জেগে উঠে আবৃত্তি ‘আসা-নিসি-মাসা’। ‘রাতে ছবিটি জীবন্ত হবে আর সবার দুঃখ-দারিদ্র্যের সমাধান মিলবে’। আচমকা আলোর এমনই ত্রাণকর্তারূপ।
মনে রাখার মতো চলচ্চিত্রগুলোয় আবার কখনো আচমকা আলো কিছুটা প্রত্যাশিতভাবে এলেও এর ব্যবহারিক প্রয়োগে এত মাধুর্য আর অভিনবত্ব থাকে যে নন্দনতাত্ত্বিকভাবে এর অনুভূতি প্রবণতা অপ্রত্যাশিতের রূপ নেয়। অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্রগুলোয় আলোর এরূপ ব্যবহার চরম উত্কর্ষমণ্ডিত অনেকটা মোপাসাঁর ছোট গল্পের শেষ দুটি লাইন কিংবা কবি শামসুর রাহমানের কবিতার শেষ পঙিক্তগুলোর এপিলগধর্মী বিস্ময়তা নিয়ে।
পরিচালকের যৌবনকালের হারেম সিকোয়েন্সের ফ্যান্টাসিতে সাড়ে ৮ চলচ্চিত্রে মার্সেলো মাস্ত্রেয়ানী অপ্সরা পরিবেষ্টিত। একের পর এক সুন্দরী ঘরের আনাচে-কানাচে আবির্ভূত হচ্ছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত ক্যামেরা সঞ্চালন আর হঠাৎ আলোর জ্বলে ওঠা, নিভে যাওয়ার স্বপ্নাবিল চিত্রায়ণের মাধ্যমে। হারেমের মুখরতা যখন শেষ পর্যায়ে, পরিচালকের রূপক এবং সনাতনী স্ত্রী তখন উপসংহার টানলেন। সবার বিদায়। একা শূন্য ঘরে স্থিতিশীল আলোকসম্পাতের মাঝে উনি পার্টি শেষে ঘরকন্নায় মনোনিবেশ করলেন। বললেন, ‘কত কাজ, বাসনকোসন পরিষ্কার করতে হবে, কাপড়চোপড় ধুতে হবে।’ বলতে বলত শূন্য ঘরে লং শটে উনি যখন ঘরের মেঝে পরিষ্কার করতে লেগে গেলেন, তখন ফেলিনির হঠাৎ এক আলোর গোলাকৃতি স্পট লাইট জীবনচক্রের জয়গাথা গাইল কর্মরতা স্ত্রীর ওপর। এ অবাস্তব, আচমকা আলোর প্রয়োগকৌশল ছবিটিকে আশ্চর্যজনকভাবে বারবার বাস্তবতার গভীরে নিয়ে গেছে। এছাড়া ছবির শেষ দিকে মার্সোলো যখন ছবির এক নায়িকার প্রতি তার সুপ্ত প্রেম হূদয়ঙ্গম করলেন, তখন তারা রাতের আঁধারে এক প্রাসাদের দুয়ারে বসেছিলেন। পরিচালক বলছিলেন, আমার মনের মতো ছবিটি আজ পর্যন্ত বানাতে পারলাম না! নায়িকা অভিযোগ করছিলেন, ‘সে ভালোবাসতে জানে না’! এ রকম শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় অ্যান্টিক্লাইমেক্স আনল চরিত্র দুটির ওপর হঠাৎ আলোর ঝলকানি। ছবির প্রডিউসার ইত্যাদির ঘটনাস্থলে হঠাৎ আগমন গাড়ির হেডলাইট। না বলা কথা বলা হলো না।
ছবিটির শেষ দৃশ্যে যখন পরিচালক আত্মহত্যা করলেন এবং এপিলগ টানা হচ্ছে, তখন হঠাৎ এক প্রান্তে পর্দা সরে গেল। পরিচালকের জীবনের সব পরিচিত/পরিচিতা চরিত্রগুলোর আনন্দঘন পদচারণা। যেন জীবনচক্রের মেরী গো রাউন্ড। স্বাভাবিক আলোয় সবগুলো চরিত্রের ধীরে ধীরে প্রস্থান। একই প্রান্তের দিবালোকের শট হঠাৎ উজ্জ্বল রাত হলো আর পরে পরিচালক হয়ে গেলেন বংশীবাদক শিশু। শুধু একটি স্পটলাইট তাকে অনুসরণ করে ফ্রেমের প্রান্তে তমসাচ্ছন্ন পর্দায় ছবির সমাপ্তি।
সাড়ে ৮ ছবিতে এভাবেই আচমকা আলোকে অচেনা দেবতাসম শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়া হয়েছে, জীবনকে জানার জন্য; চলচ্চিত্রকে বোঝার জন্য।
কুরোশাওয়ার অসীম কীর্তি ‘রশোমন’-এ আমরা দেখি পাহাড়ে গাছের তলায় ক্লান্ত ডাকাত শুয়ে আছে। আর ঘোড়ার পিঠে নববধূকে নিয়ে যাচ্ছে তার স্বামী। নববধূর মুখাবয়বে মসলিন স্বচ্ছ পর্দা। ডাকাত-বধূ-স্বামীর এই ত্রৈমাত্রিক উপাখ্যানে ডাকাত বলে যে, সে তো উষ্ণতায় ক্লান্ত ঘুমিয়েই ছিল। হঠাৎ গাছের ফাঁকের রোদ্দুরের ঝলকানিতে যদি তার ঘুমটি ভেঙে যেত, আর সেই বাতাসে বধূটির মুখের আবরণ যদি দুলে সরে না যেত, তাহলে তো তার মনো-আকাঙ্ক্ষা দোলই দিত না ইত্যাদি। আচমকা আলোর এমনই এক মাদকতাসিক্ত গুণ কুরোশাওয়া বন্দি করেছেন ‘রশোমনে’!
প্রেম আর মনস্তাত্ত্বিক কারণে যে রকম হঠাৎ আলোর শৈল্পিক ব্যবহার দেখা যায়, সে রকমই থ্রিলার, পরাবাস্তবজাতীয় চলচ্চিত্রেও পরিচালকরা হঠাৎ আলোকে ড্রামাটিক উপাদান হিসেবে সার্থক ব্যবহার করেন।
এসব ক্ষেত্রে আরেক দিকে চরিত্র এবং অনুভূতির স্কাল্পচার গড়া হয়। ‘আলফ্রেড হিচকক প্রেজেন্টস’-এর এক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে আমরা দেখি এক রাতের ড্রইং রুম। আমরা দর্শকরা স্বাভাবিক আলোয় জানি না খুনিটি কে। মহিলাটি সোফায় বসে এবং পুরুষটি ঘরে হেঁটে হেঁটে কথা বলছে। কোনো এক চরম মুহূর্তে দেখি নিচে রাখা টেবিল ল্যাম্পের ঊর্ধ্বগামী আলোর ঝলক লোকটিকে আচমকা শয়তানের ভয়াবহ রূপে রূপান্তর করল। তিনি একটা কাপড় দিয়ে মহিলাকে শ্বাসরোধ করলেন।
একইভাবে সাম্প্রতিককালের পোল্টারজেইস্ট ছবিটি শুরু হয় গভীর রাতে লম্বা পর্দাভর্তি একটা টেলিভিশন পর্দার ইমেজবিহীন কম্পমান লাইনগুলোতে। ইলেকট্রনিক লাইটের ভাইব্রেশনে দর্শক প্রথমেই ধাক্কা খান। পরের শটগুলোতে দেখি এক উত্সুক শিশুর ক্লোজআপ। টিভি পর্দার আলোর ভাইব্রেশন তার নিষ্পাপ মসৃণ মুখাবয়বে লুকোচুরি খেলছে। দীর্ঘায়িত শটগুলোতে দর্শক প্রত্যাশায় উসখুস করবে। হঠাৎ লং শটে বিকট শব্দ করে টেলিভিশনের পর্দা থেকে এক শুভ্র আত্মা বেরিয়ে আসে।
একইভাবে এক্সরসিস্ট, স্টার ওয়ার্স, ইটি ইত্যাদি সাম্প্রতিক ছবি আলোর হঠাৎ স্ফুরণ চলচ্চিত্র শিল্পের একটি মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
ফেড আউট করে পর্দা কিংবা চরিত্র ইমেজ সাদা করে দেয়া আচমকা আলোর আরেকটি গ্রাফিক প্রেজেন্টেশন। গদারের ‘ব্রেথলেস’-এ বেলমন্ডো পিস্তল হাতে আত্মহত্যা করার সময় কিংবা মধ্য ইউরোপের ‘রাউন্ড অ্যারাউট’ চলচ্চিত্রে মুক্তিযোদ্ধা নািস বাহিনীর রাইফেলের সামনে দাঁড়ানোর সময় আমরা ফেড আউটের শৈল্পিক ব্যবহার হূদয়ঙ্গম করি।
ভারতীয় চলচ্চিত্র
আচমকা আলোর ব্যবহারিক প্রয়োগে, পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্রগুলোর তুলনায় স্বাভাবিক এবং সাংস্কৃতিক কারণেই ভারতীয় স্মরণীয় চলচ্চিত্রগুলো কিছুটা কনজারভেটিভ। প্রায় ক্ষেত্রেই হঠাৎ আলোর ব্যবহার এসেছে প্রত্যাশিতভাবেই শিল্পসুষমায় মণ্ডিত হয়ে। এমনকি দিশারী ‘পথের পাঁচালী’তেও আমরা এ রকম আলোর ব্যবহার দেখি। অপু-দুর্গার ঝমঝমে বৃষ্টিতে ভেজার ধূসরিত সিকোয়েন্সের পরই রাতের ঝড়ের আক্রোশ। প্রদীপ জ্বলছে, জানালার শীর্ণ পর্দা কাঁপছে আর আলো-ছায়ার ভীতিপ্রদ টানাহেঁচড়ায় ভগবান গণেশ টলটলায়মান। এক মৃত্যুদৃশ্যের এ রকম নির্মাণ পদ্ধতি সংযত বিরলতার রূপকাঠি।
ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র মধ্যবিত্তের ব্যথিত কড়চায় সুপ্রিয়া জানালার গরাদের ধারে। তার ভাইয়ের সঙ্গে দারিদ্র্য আর জীবনের জয়গান গাইছে ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি….’ সুপ্রিয়ার ক্লোজআপে ঘটকের জীবনের আশার আলো সুপ্রিয়ার মুখাবয়বে চিক চিক আলোর ছটা পাশের জলাধার থেকে প্রকম্পিত সূর্যের প্রতিবিম্বের শ্রদ্ধাঞ্জলি। আচমকা আলোর এক সূক্ষ্ম নন্দন-তাত্ত্বিক এপিটাফ।
সাম্প্রতিককালের আক্রোশও আমরা দেখি ফিউডাল সমাজে ওম পুরীর অসহায়তা। তার স্ত্রী সমাজের পুরুষকর্তার চরম লালসায় ঘরবন্দি। তার অসহায় প্রতিবাদী চিত্কারে আচমকা আলোর বহুরূপী ভূমিকা। ঘরটির বাইরের লং শটে ভেতরের ঠিকরে আসা আলোকচ্ছটার ভয়াবহতা আর ওম পুরীর জালির ফাঁকে ফাঁকে অস্থিরতায় আলো-ছায়ার বোবা-কান্না।
‘থারটি সিক্স চৌরঙ্গী লেনে’ আমরা দেখি এক দীর্ঘায়িত শটে বৃদ্ধা আঁধারে ঘরে এলেন। অন্ধকারের প্রতিদ্বন্দ্বী কালো বিড়ালটিকে সঙ্গ দিলেন। নড়লেন, হাঁটলেন; আঁধারে ঘরের আসবাবপত্রকে সাথীর মর্যাদা দিলেন। তারপর তিনি কফি বানানোর জন্য একটা ম্যাচের কাঠি জ্বালালেন। অনেক পরে আচমকা আলোয় এটা একাকিত্বের অর্চনা।
তবু মনে পড়ে ‘জীবন থেকে নেয়া’য় কারাবন্দিদের ‘শিকল পরা ছল’ রোলে শৃঙ্খলিত হাত-পায়ের ক্লোজআপে আলোর মূর্ছনা কিংবা ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’তে জয়গুনের রাতের ফ্ল্যাশব্যাক সিকোয়েন্সের পর হঠাৎ সূর্যোদয়ের একটি শট এবং করিম বক্সের বাড়ি থেকে সকালে প্রস্থান।
ঢাকার চলচ্চিত্রে আচমকা আলো ফ্রেমে ফ্রেমে বিরাজমান, কারিগরি অসুস্থতায় প্রতিটি ইমেজে প্রায়ই ‘তারাবাতির’ ফুলঝুরি।
স্বল্পদৈর্ঘ্য ও বিজ্ঞাপনী চলচ্চিত্র
সময় যেখানে সংক্ষিপ্ত, ইমেজ সেখানে মাপা মাপা, সেকেন্ডে কয়েকটি টেকনিকের মাঝে হঠাৎ আলোর শুভ্রতা শূন্যতা ঘোচানোর প্রয়াস প্রায় ডকুমেন্টারি এবং অ্যাডভার্টাইজিং চলচ্চিত্রে।
আমেরিকার এপিক ডকুমেন্টারি ভিয়েতনামের যুদ্ধ নিয়ে রঙিন চলচ্চিত্র ‘হার্টস অ্যান্ড মাইন্ডস’-এর এক অনবদ্য সিকোয়েন্স। এক অবসরপ্রাপ্ত ফ্যান্টম পাইলট। এখন শহরের বাইরে কাঠের কেবিনে বসবাস। স্ট্যাটিক ক্যামেরা মাইকের সামনে বিমান হামলা সম্পর্কে কথা বলছেন। বলছেন, ‘এত শূন্যে আরো এত স্পিডে আমরা বিমান চালাতাম, আর বোমা বর্ষণ করতাম; সেই স্বর্গ থেকে মর্ত্যের ভিয়েতনামে আমাদের আক্রমণের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সরাসরি ধারণা ছিল না’— বলতে বলতে তিনি চুপ করলেন। মাথা নিচু করলেন। স্ট্যাটিক নিস্তব্ধতা। এ স্থানে এডিটিংয়ে হঠাৎ ব্যবহার করা হলো বিমান থেকে তোলা নাপাম বর্ষণের স্টক শট। কমলা-সোনালি আলো আগুনের হঠাৎ ঝলকানি; ভিয়েতনাম পুড়ছে, শিশুরা পুড়ছে। ইন্টারভিউ শটে প্রত্যাবর্তন; ক্যামেরা ধীরে জুম ইন করছে; বৈমানিক কেঁদে ফেললেন।
বোমা বর্ষণের প্রজ্বলিত শটের সঙ্গ অশ্রুশিক্ত বৈমানিকের ওভারল্যাপ মর্মস্পর্শী।
বিজ্ঞাপনী চলচ্চিত্রে হঠাৎ আলোর ঝলকানি বহুল ব্যবহূত। প্রায়ই এটা আসে ঢাকা টেলিভিশনের ফিলিপস এবং ১৫১ সাবানের শেষ আলোকচ্ছটার চমক প্রয়াসে কিংবা কখনো কখনো ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ভাসমান ম্যানহাটনের বুদ্ধিদীপ্ত ঔজ্বল্যে।
এছাড়া নায়িকার অলঙ্কারে-ঠোঁটে কিংবা শহরের বাতিমালার চমকে দেয়া আলোর তারকা সৃষ্টির প্রয়াস তো আছেই। সৃষ্টির আঁধার কি আর আচমকা আলোয় কাটে?
বাংলাদেশ
কী লিখব?
এত আঁধারে কলম চলে না।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সত্যি বলতে কি, আঁধারের মাধুর্যই অনুপস্থিত। দিন-রাত, গ্রীষ্ম-বর্ষা, আনন্দ-দুঃখ সবই উজ্জ্বল। সওদাগর-বানজারানরা সদা সমুজ্জ্বল। তাদের শূন্য মস্তিষ্কের মতো, সাদা-সাদা পকেটের মতো, ভিলেন এবং প্রডিউসারদের ক্রুঢ় দন্তকপাটির মতো। তাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নন্দনতাত্ত্বিক আচমকা আলোর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় না।
তবু।
তবু মনে পড়ে ‘জীবন থেকে নেয়া’য় কারাবন্দিদের ‘শিকল পরা ছল’ রোলে শৃঙ্খলিত হাত-পায়ের ক্লোজআপে আলোর মূর্ছনা কিংবা ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’তে জয়গুনের রাতের ফ্ল্যাশব্যাক সিকোয়েন্সের পর হঠাৎ সূর্যোদয়ের একটি শট এবং করিম বক্সের বাড়ি থেকে সকালে প্রস্থান।
ঢাকার চলচ্চিত্রে আচমকা আলো ফ্রেমে ফ্রেমে বিরাজমান, কারিগরি অসুস্থতায় প্রতিটি ইমেজে প্রায়ই ‘তারাবাতির’ ফুলঝুরি।
উপসংহার
৩ মে, ১৯৮১, রাত ১১টা।
মা হঠাৎ করে মারা গেলেন, শেষ দেখা হয়নি।
হাসপাতাল, বাড়ি থেকে রাত দুটায় ফিরে ঠিকই ঘুম পেল।
রাত ৪টায় ঘুম ভাঙল।
রাতের আঁধারে আমি আর ডলি বারান্দায় নিঃশব্দ বসে আছি, সকালের প্রতীক্ষায়।
নেয়ামত ভাইকে খবর দিতে হবে এবং আগা নবাব দেউড়ী, আজিমপুর ইত্যাদি।
নিজকে নতুন করে জেনে নিজেই অবাক হচ্ছিলাম।
রাত ১১টায় পিজি হাসপাতাল থেকে খিলগাঁওয়ের এক কোনায় ধূসর সকাল পর্যন্ত কান্না আসেনি।
হঠাৎ প্রত্যাশার সূর্য। সকালের প্রথম রোদের একফালি আচমকা আলো বাগানের এক লতা গাছ আলিঙ্গন করল মৃত্যুর আমেজে। কান্নায় ভেঙে পড়লাম। জারজ সংস্কৃতির জন্মধাত্রী ‘পদ্মাবতী’রা তো মা নয়। চলচ্চিত্র যদি মা হয়, তবে কবে আসবে এ দেশের সেলুলয়েডে আচমকা আলোর চোখ ধাঁধানো শুভ্রতা?