চলচ্চিত্র ঠাকরে ও কিছু প্রসঙ্গ
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর ‘ঠাকরে’ দেখলাম। ১৯৯২ সালে ভারতের অযোধ্যায় অবস্থিত ষোড়শ শতকে নির্মিত বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা আমাদের দেশে খুব বড় একটা ঘটনা ছিল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, ভারতেও এটা অনেক বড় ঘটনা ছিল। এই ঘটনায় ভারতের প্রধান শহরগুলোতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। মুম্বাই ও দিল্লী শহরে প্রায় ২০০০ মানুষ মারা যায়।
বস্তুত, শুধু মসজিদ নয়, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা বা যেকোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস বা আক্রমণকে সারা বিশ্বেই বড় মাপের ইস্যু বলে বিবেচনা করা হয়।
১৯৮৪ সালে ভারতের অমৃতসরে অবস্থিত শিখ সম্প্রদায়ের সব থেকে পবিত্র তীর্থস্থান স্বর্ণ মন্দিরে ব্লাক ক্যাট কমান্ডো পাঠিয়ে তাদের শীর্ষ ধর্মীয় নেতা ভিন্দ্রানওয়ালেকে হত্যা করাও বিশ্ববাসীর জন্যে অনেক বড় একটা নিউজ ছিল।
আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশের ১৫০০ বছরের পুরনো জোড়া বৌদ্ধ মূর্তি ২০০১ সালে যখন তালেবান সরকার ভেঙে ফেলে সেটাও আর্ন্তজাতিক ভাবে আলোচনার বিষয় হয়।
এই তালিকা আরো লম্বা করা যায়। তবে আমার আলোচ্য বিষয় যেহেতু চলচ্চিত্র ‘ঠাকরে’ তাই অযথা আর তালিকা লম্বা না করি। আশা করছি আমার পয়েন্টটা আপনারা ধরতে পেরেছেন। আমি মুসলমান বলে বাবরি মসজিদকে নিয়ে অতি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি, এমনটা যেন কেউ দাবী করতে না পারেন তাই মুসলমান সম্প্রদায়ের পাশাপাশি আরো দুটো সম্প্রদায়ে ঘটনাও তুলে ধরলাম, যার মধ্যে একটিতে আক্রমণকারী মুসলমানরা। তিনটি ঘটনারই নিউজ লিংক নিচে প্রদান করলাম।
পুরো চলচ্চিত্রটিতেই বোধ হয় পরিচালক কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন, কি দেখাবেন আর কি দেখাবেন না, তাই নিয়ে। শুরুতেই নির্মাতা বাবরি মসজিদের কথা এনেছেন, যাতে করে দেশের এবং দেশের বাইরের সকল দর্শক বুঝতে পারে কে এই ঠাকরে। কিন্তু এর পরেই তিনি তার কাহিনীর গতি পালটে ফেলেছেন। হয়ত সমসাময়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতে গেলে এমনটা করতেই হয়। ইন্ডাস্ট্রিতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হবে তো।
যাহোক, আমরা মূলতঃ বাবরি মসজিদের ঘটনা জানি। বিজেপিকে জানি। পি ভি নরসিমহা রাওকে জানি। কিন্তু কয়জনে বাল কেশব ঠাকরে বা বালাসাহেব ঠাকরে সম্পর্কে জানি? এই চলচ্চিত্রটি একটি বায়োগ্রাফী। তাই সেখানে ঠাকরে সাহেবের সকল কর্মকাণ্ডই উঠে আসবে। এসেছেও তাই। মারাঠাদের বঞ্চনা ও তার প্রতিবাদ চমৎকার ভাবে উঠে এসেছে। ঠাকরে সাহেবের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন বিস্তারিত ভাবে উঠে এসেছে। আসেনি শুধু আলোচিত বাবরি মসজিদ ইস্যুর বিস্তারিত।
পুরো চলচ্চিত্রের শুরুতে কয়েক জনের মুখে বাবরী মসজিদের প্রসঙ্গ এসেছে। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ইস্যুতে ঠাকরের আজ বিচার হবে, বিচারে কি হবে, এই বিষয়ে তাদের আলোচনা করতে দেখা যায়। এরপর চলচ্চিত্রের মাঝে মাত্র ২/৩ মিনিটের জন্যে উকিলে সাথে কথোপোকথনে বাবরি মসজিদের কথা উঠে আসে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ৫/৬ সেকেন্ডের একটি ক্লিপ দুই কি তিনবার দেখানো হয়। ব্যাস, পুরো দুই ঘন্টার চলচ্চিত্রে মাত্র এটুকুই বাবরি মসজিদ ঘটনার স্ক্রিন টাইম।
বলতে পারেন, কাহিনী তো ঠাকরেকে নিয়ে, বাবরি মসজিদ নিয়ে নয়। কথা সত্য। প্রশ্ন হচ্ছে, শাহরুখ খান অভিনীত অশোকা সিনেমা নিয়ে তবে এত সমালোচনার ঝড় উঠেছিল কেন বলতে পারেন? অথবা অলিভার স্টোন নির্মিত আলেকজেন্ডার কেন সেই ভাবে দর্শক সমাদৃত হয়নি?
কারণটা আর কিছুই না। এই বিশ্ব অশোক এবং আলেকজেন্ডার, দুজনকেই ‘দি গ্রেট’ হিসাবে চেনে। ইতিহাসে সব শাসক গ্রেট হতে পারেন নাই। এই উপমহাদেশে মাত্র দুজন গ্রেট উপাধি পেয়েছিলেন। একজন আকবর, আরেকজন অশোক। অশোক গ্রেট হয়েছিলেন তার সমাজ সেবার জন্যে। মানবতার উদাহরণ হিসাবে তিনি পৃথিবীতে আলোচিত। কিন্তু অশোকা চলচ্চিত্রটিতে মহান হওয়ার আগে, বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার আগে, অশোক কি পরিমাণ রক্ত লোলুভ একজন শাসক ছিলেন তাই দেখানো হয়েছে। এবং সব শেষে শুধু ধারাভাষ্য আকারে বলা হয়েছে এরপর থেকেই অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মানব সেবায় ব্রতী হন। অর্থাৎ যে অশোককে আমরা মানব সেবার জন্যে চিনি, তার বায়োগ্রাফী কেবলই খুন খারাবীতে ভরপুর। দর্শক বিষয়টা নিতে পারেনি।
অপর দিকে আলেকজেন্ডার আমাদের কাছে গ্রেট, কারণ সে দিগ্বিজয়ী বীর। এমন বীরের বায়োগ্রাফী তৈরী করেছেন একজন যুদ্ধ বিরোধী চিত্র পরিচালক। ‘বর্ন অন দা ফোরথ অফ জুলাই’ তার আলোচিত ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী একটি চলচ্চিত্র। আলেকজেন্ডার-এ পরিচালক অলিভার স্টোন দেখিয়েছেন যে একের পর এক এই দেশ দখল করার পিছনে মূল কারণ ছিল সম্রাটের মানসিক দূর্বলতা। তিনি খুব ভয় পেতেন। সেই ভয়কে কাটানোর জন্যই তার বাইরের এই শক্ত আবরণ। নিজের কাছেই নিজেকে সাহসী প্রমাণ করার জন্যে তিনি লাগাতার যুদ্ধ করে গেছেন।
অশোকের প্রথম জীবনের ঘটনা সত্য। হয়ত আলেকজেন্ডারকে নিয়ে যে বিশ্লেষণ, তাও সত্য। কিন্তু এই দুই জনের যে মীথ, তার সাথে চলচ্চিত্র দুটির বক্তব্য যায় না। তাই এত সমালোচনা। ঠিক একই কথা ঠাকরে চলচ্চিত্রটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে বাবরি মসজিদের কারণে ঠাকরে আলোচিত সেই বাবরি মসজিদকে সাধ্যমত পাশ কাটিয়ে যাওয়ায় বায়োগ্রাফী হিসাবে চলচ্চিত্রটির কাহিনী খুবই দূর্বল প্রতিয়মান হয়েছে।
মিলখা শিংয়ের বায়েগ্রাফীতে তার কৌশোরে ঘটনা প্রাধান্য পেয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটা দৌড়কে বাদ দিয়ে নয়। আজাহারউদ্দিনের বায়োগ্রাফীতে যাই থাকুক বা না থাকুক তার ক্রিকেট ব্যাটিংয়ের ঘটনা অবশ্যই থেকেছে। একই ভাবে সঞ্জয় দত্তের বায়োগ্রফীতেও ব্যক্তিগত নানান বিষয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র এবং অস্ত্র মামলাকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ সঞ্জয় দত্ত এই দুই বিষয়েই আমাদের কাছে পরিচিত এবং আলোচিত। কিন্তু বাল কেশব ঠাকরের বায়োগ্রাফীতে বাবএই মসজিদ ইস্যু প্রায় নেই বললেই চলে। এটি চলচ্চিত্রটির সব থেকে বড় দূর্বলতা।
পুরো চলচ্চিত্রটিতেই বোধ হয় পরিচালক কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন, কি দেখাবেন আর কি দেখাবেন না, তাই নিয়ে। শুরুতেই নির্মাতা বাবরি মসজিদের কথা এনেছেন, যাতে করে দেশের এবং দেশের বাইরের সকল দর্শক বুঝতে পারে কে এই ঠাকরে। কিন্তু এর পরেই তিনি তার কাহিনীর গতি পালটে ফেলেছেন। হয়ত সমসাময়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতে গেলে এমনটা করতেই হয়। ইন্ডাস্ট্রিতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হবে তো।
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী তো অসাধারণ অভিনয় করেছেনই। বাকিরাও চমৎকার অভিনয় করেছেন। কারিগরি ভাবেই চলচ্চিত্রটির তেমন কোন ত্রুটি আলাদা করে চোখে পড়ে না। বরং চলচ্চিত্রটির ভিজুয়াল বেশ উপভোগ্য। কাহিনির এই সব ফাঁক ফোকরগুলো বাদ দিলে এক কথায় ‘ঠাকরে’ পরিচালক অভিজিৎ পানসের চমৎকার একটি নির্মাণ।
ট্রেইলার দেখতে: Thackeray
তথ্যসূত্র:
- পরিকল্পনা করেই বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছিল [ বিবিসি ]
- অপারেশন ব্লু স্টার: যেভাবে স্বর্ণ মন্দিরে ঢুকেছিল ভারতীয় সেনা ট্যাঙ্ক [ বিবিসি ]
- তালেবানের ধ্বংস করা বুদ্ধমূর্তি ফিরল আফগানিস্তানে [ এনটিভি অনলাইন ]