:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মোশতাক আহমদ

কবি, গদ্যকার

চলমান বৃক্ষ ও ’৮৫-র বইমেলা

চলমান বৃক্ষ ও ’৮৫-র বইমেলা

অক্ষরবন্দী জীবন : অবাক জলপান এর পর থেকে-

লাইব্রেরির কথা বলেছি, কিন্তু কেবল একটা জড় লাইব্রেরি কি আর পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে! আমরা আমাদের বইপোকা শিক্ষকদেরও দেখতাম, মুজিবুর রহমান স্যার, শিকদার স্যার, তওফিক হোসেন স্যার কিংবা রফিক কায়সার স্যার ছিলেন চলমান গ্রন্থাগার! সব সময় হাতে কোনো না কোনো বই থাকত তাদের। আমার শুধু নজরুলের আঁকা সেই কার্টুনটা মনে ভাসত- বন উজাড়ের ফলে একটা পাখি তার ছানাকে নিয়ে হরিণের শিঙে বসে আছে- মা এক শিঙে, ছানা আরেক শিঙে; মনে হচ্ছে ওটাই এখন তাদের বাসা। মা তার ছানাকে বলছে, ‘হ্যাঁ বাছা, এটাই চলমান বৃক্ষ!’ চারপাশে এমন চলমান বৃক্ষের মতো চলমান সব লাইব্রেরি ঘুরে বেড়াতে দেখাও বই পড়ার অভ্যাস গড়তে সাহায্য করেছে। এই মুজিবুর রহমান স্যার সিভিকস পড়াতেন, ইংরেজিতেও তার উচ্চতর ডিগ্রি ছিল সম্ভবত।

একবার ‘জাতীয় উন্নয়নে বুদ্ধিজীবীদের চেয়ে শ্রমজীবীদের ভূমিকা বেশি’– এমন একটা বিতর্কে অংশ নেব বলে স্ক্রিপ্ট লিখে রিহার্সেল করতে গিয়ে দেখি হাউসমাস্টার স্যার মুজিবুর রহমান স্যারকে নিয়ে এসেছেন। আমি ঘামছিলাম, কেননা জর্জ এলিয়টের নামে যে উদ্ধৃতিটি আমার স্ক্রিপ্টে আছে, তা আসলে মনগড়া, ভুয়া! স্যার ঠিকই ধরে ফেললেন, রেফারেন্স চাইলেন। মুহম্মদ ছাদিক স্যার ইসলামিয়াত পড়াতেন, তিনি ছিলেন ট্রিপল এমএ; তখন অবশ্য এটা বুঝতে বেশ অসুবিধা হতো যে তিনবার একই ডিগ্রি নেওয়ার প্রয়োজনটাই বা কী! যাহোক, ক্যাডেটদের মধ্যে ছাদিক স্যারের একটা বেস্ট সেলার বই ছিল, নাম ‘পৃথিবী ও সূর্য দুটোই ঘোরে: আল কুরআনের বাণী’– কুরআনের আলোকে ব্যাখ্যা করা। এই বই পড়ে দুর্জন বড় ভাইরা বলতেন, কেবল পৃথিবী আর সূর্যই না, বই পড়তে শুরু করলে পাঠকের মাথাও ঘোরে!

আমার শুধু নজরুলের আঁকা সেই কার্টুনটা মনে ভাসত- বন উজাড়ের ফলে একটা পাখি তার ছানাকে নিয়ে হরিণের শিঙে বসে আছে- মা এক শিঙে, ছানা আরেক শিঙে; মনে হচ্ছে ওটাই এখন তাদের বাসা। মা তার ছানাকে বলছে, ‘হ্যাঁ বাছা, এটাই চলমান বৃক্ষ!’ চারপাশে এমন চলমান বৃক্ষের মতো চলমান সব লাইব্রেরি ঘুরে বেড়াতে দেখাও বই পড়ার অভ্যাস গড়তে সাহায্য করেছে।

ওই বয়সে যত না বই পড়েছি, তার চেয়ে মনে হয় বই দেখতাম বেশি, দেখতে ভালো লাগত। আবার, বড়দের বই- ছোটদের বইয়ের ভেদরেখাটা কোথায়, সেটা না বুঝে, কিংবা কখনো কখনো ‘বড়দের বই’য়ের সহজপ্রাপ্যতা কিংবা ছোটদের বইয়ের অপ্রাপ্যতার কারণে এমন কিছু বইও পড়েছি, যা ওই বয়সে পড়ার কথা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটক এমন একটি বই। বাবা একসময় নাটক-থিয়েটারও করতেন। বাসায় ছিল, পড়ে ফেলেছিলাম এবং আলোড়িত হয়েছিলাম। ‘বিসর্জনে’র ভূমিকায় একটা কথা ছিল–‘আইনের লৌহছাঁচে কবিতা কভু না বাঁচে।’ এই লাইনটা আমার কিশোরবেলার পাণ্ডুলিপির প্রবেশিকা পাতায় উদ্ধৃত করে রেখেছিলাম। এই অভ্যাস দেখেছি আমার ছোট মেয়ের মধ্যেও। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় তাকে দেখেছি মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’ পড়ছে!

ছোটবেলার ঈদসংখ্যা বাদ দিলে মাহমুদুল হক প্রথম পড়ি কলেজজীবনে– ‘জীবন আমার বোন’। চেনা-পরিচিত পরিবেশে এমন ক্যাজুয়াল রচনারীতি ছিল অভাবনীয়। সাহিত্যে সাধারণত সেই জীবনকেই দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম, যে জীবন আমি যাপন করিনি। উপন্যাসে ভাইবোনের খুনসুটি আর রঞ্জু চরিত্রটির অন্যমনস্কতা খুব টেনেছিল। একই সময়ে আবদুশ শাকুরের ‘সহেনা চেতনা’ পড়ে ক্যাজুয়াল রচনারীতির সাথে গদ্যে এমন অনুপ্রাস আর ‘পান’ মিশিয়ে রস সৃষ্টি করা যায়, সেটা তার কাছ থেকে দেখলাম। কলেজজীবনে আরেকটা পছন্দের বই ছিল ই এম ফস্টারের ‘আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’; উপন্যাসটা সিনেমা হয়ে অস্কারের উৎসবে নাম করেছিল জেনে পড়তে বসা। আমার মুভিটা দেখা হয়নি, কিন্তু বই পড়তে পড়তে মুভিটা কল্পনা করে নিয়েছিলাম, ভিক্টর ব্যানার্জিকেও যেনবা বইয়ের পাতায় দেখতে পাচ্ছিলাম! তিনটা বই-ই হারিয়ে গেছে আমার।

’৮৪-’৮৫-তে একুশের বইমেলা আবিষ্কার করে ফেললাম। বিশেষ করে ’৮৫-র বাংলা একাডেমি বইমেলা আমার পাঠকজীবনে এক অনন্য ঘটনা। সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা; কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন রোজ বিকেলেই ঠিক গিয়ে মেলায় হাজির হতাম। কবি-লেখকদের একটু দূর থেকে দেখতাম (এই জড়তা আর কাটেনি)। স্টলের বাইরে টেবিল পেতে মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বই বিক্রি হচ্ছে কিংবা শহীদুজ্জামান ফিরোজও তার কালো মলাটের কবিতার বই ‘আনন্দে না, বেদনায়ও না’ নিয়ে বসে গেছেন টেবিলে কিংবা মাদুরে– এই সব দৃশ্য আমরা আর কোনো দিন দেখব না। একটা ঝোলা কাঁধে পোড়খাওয়া রাজনীতির মানুষ আবদুশ শহীদ তার ‘কারা স্মৃতি’ বইটা ফেরি করে বিক্রি করতেন দেখেছি। আমাকেও একবার সেধেছিলেন একটা বই কেনার জন্য, কিন্তু সে বইয়ের মর্ম কি তখন বুঝি! অনেক পরে শেখ রফিকের ‘খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড’ বইটা হাতে এলে এই কমরেড সম্পর্কে জেনেছিলাম। কিংবা কালো ব্যানারে সাদা অক্ষরে ‘এখানে নির্মলেন্দু গুণকে পাওয়া’ যায় টাঙিয়ে কবি বসে আছেন পাণ্ডুলিপির স্টলে!

সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা; কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন রোজ বিকেলেই ঠিক গিয়ে মেলায় হাজির হতাম। কবি-লেখকদের একটু দূর থেকে দেখতাম (এই জড়তা আর কাটেনি)। স্টলের বাইরে টেবিল পেতে মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বই বিক্রি হচ্ছে কিংবা শহীদুজ্জামান ফিরোজও তার কালো মলাটের কবিতার বই ‘আনন্দে না, বেদনায়ও না’ নিয়ে বসে গেছেন টেবিলে কিংবা মাদুরে– এই সব দৃশ্য আমরা আর কোনো দিন দেখব না।

হূমায়ুন আহমেদকে দেখেছি তার ‘আনন্দ বেদনার কাব্যে’র প্রচ্ছদ বাতিল করে দিয়ে সম্ভবত প্রকাশককে বলছেন, ‘প্রচ্ছদ শিল্পীর নাম হবে ফয়জুল কবির। তার করা ইতালীয় কাহিনি দ্য একসরসিস্টের অনুবাদ বেরিয়েছে ‘সেবা’ থেকে, অন্যদিকে গল্পটিকে নিজের মতো করে লিখে বের করলেন অন্য নাম দিয়ে, অন্য এক প্রকাশনী থেকে। ডানা প্রকাশনী থেকে সংগ্রহ করেছিলাম মুনতাসীর মামুনের ছোটগল্পের বই ‘কড়া নাড়ার শব্দ’ কিংবা হায়াত হোসেনের ‘নাফ নদীর তীরে’। মুনতাসীর মামুন আমাকে অটোগ্রাফ দিতে দিতে আসাদ চৌধুরী এসে তাকে বলছেন, ‘বাউলদের নিয়ে কাজটা তো আর করলেন না!’

ওদিকে তরুণ কবি ফরিদ কবির (যাকে তখন চিনি ছবি আর অটোগ্রাফসহ কবিদের হাতে লেখা কবিতা সংকলনের সুবাদে, সম্পাদকও তিনি) সৈয়দ আল ফারুকের সাথে হাঁটতে হাঁটতে কী আনন্দে ‘এসো শ্যামল সুন্দর’ এই এক কলি গেয়ে কোন বৈকুণ্ঠে উড়ে যাচ্ছেন (পরে জেনেছি, তার প্রথম কবিতার বই ‘হৃৎপিণ্ডে রক্তপাত’ বেরিয়েছিল সেবার), কিংবা ইকবাল আজিজকে কেউ বলছে, মতিহার নিয়ে লেখা আপনার এই কবিতাটা একদিন শ্রেষ্ঠ কবিতার বইতেও রাখবেন। জবাবে কবির মুখভঙ্গি কিছুটা আক্রমণাত্মক ছিল; আমি কবিকে দেখছি ‘কবি দেখা’র মতো করে, কিন্তু আমার বন্ধু আমিনুল বলছে, ‘এইটা কি কবির চেহারা!’ এই বইমেলায় কত গল্প-উপন্যাস আর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধের বই (‘মুখোশ ও মুখশ্রী’ কিংবা ‘উপরকাঠামোর ভিতরেই’) সংগ্রহ করেছিলাম তার সঠিক হিসাব নেই, কিন্তু শামসুর রাহমানের সম্ভাব্য সবগুলো বই-ই মেলা থেকে সংগ্রহ করেছিলাম মনে পড়ে; যেমন ‘শিরোনাম মনে পড়ে না’, ‘যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে’, ‘ইকারুসের আকাশ’ (সব্যসাচী প্রকাশনী) কিংবা ‘টেবিলে আপেলগুলো হেসে ওঠে’ (আফজাল হোসেনের দুর্দান্ত প্রচ্ছদ)।

চলবে…


অলংকরণ : রাজিব রায়

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.