

ছোটকাগজের ফেরিওয়ালা একজন সেলিম মোরশেদ
‘ছোট কাগজের লেখাই কেবলমাত্র লেখা; প্রকৃত ছোট কাগজে এখন যা লেখা হবে কেবলমাত্র সেটাই লেখা;
আই রিপিট ছোট কাগজের লেখাই কেবলমাত্র লেখা।’
—সেলিম মোরশেদ
স্বাধীনতার পর বাংলাসাহিত্য ষাট-এর বৃত্তে বন্দি যখন আর ত্রিশের দশক অতিক্রম করতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পতিত। তীব্রবেগে সাহিত্যের মাঠ রসাতলে ধাবমান, দৈনিক আর ম্যাগাজিনধর্মী কাগজ ছাড়া সাহিত্যের কোনো নতুন ঠিকানা অনুপস্থিত। শাসনমঞ্চে স্বৈরাচারের দাঁত-নখ খিঁচানো যখন জাতি-রাষ্ট্রকে আঁচড় কাটছে প্রতিনিয়ত। সময়টা তখন আশির দশক। সব অনাচার শেষ হয়েই নতুন সৃষ্টি হয়। আশির দশকেই স্বাধীনতা পরবর্তী নতুন প্রজন্মের নতুন সূর্যের কাল। দৈনিকের পণ্য ওড়ানো থামিয়ে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের কাল, প্রচলিত সাহিত্য কাগজের দুনিয়া ও দৈনিকের বিপরীতে লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজের নতুন যাত্রা। আর সেই সময়ে ওই যাত্রার পুরোধা সেলিম মোরশেদ ও তাঁর সহযোগী সমমনা সাহিত্যিকগণ আমাদের দেশে লিটলম্যাগ মুভমেন্ট-এর প্রথাবিরোধিতা তথা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার চর্চা ও প্রয়োগ ঘটান। কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নায্যতা, এর অনিবার্যতা বিশদ ভাবে তুলে ধরেন তাঁর রচিত ‘পাল্টা কথার সূত্রমূখ’-এ এই বিষয়ক ইশতেহার গদ্যে। কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোনো খণ্ডিত বিষয় নয় বরং তা হচ্ছে প্রচলিত মূল্যবোধ, ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ায় অবস্থিত নান্দনিক ধারণার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন ও আক্রমণ। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থই আমার শিল্পবিশ্বাসকে এমন পর্যায়ে নিতে হবে যেক্ষেত্রে পণ্য সর্বস্ব পত্রিকাগুলি লেখকের জীবনের কোনো পর্যায়ে তাঁর লেখা ছাপার জন্য, তারা (প্রতিষ্ঠান) শেষ সাহসটুকু নিয়েও এগোতে পারবে না।’ বাজারি পণ্য-সাহিত্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, লেখকদের সৃজনশীলতা, চৈতন্যের বিকাশ, নতুন কিছুর পরীক্ষা-নীরিক্ষা-প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করছে। লেখকসত্তার নিজস্ব চিন্তাচেতনার অনুভূতিকে প্রতিবন্ধী করে রেখেছে। অপরদিকে, “প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’, সাধারণত প্রতিবাদমুখর, আনুষ্ঠানিকতা-বর্জিত, প্রাতিস্বিকতায় ভঙ্গুর, অস্থির ও, অস্বস্তিকারক, ছকহীন, ঐক্যহীন, খাপছাড়া, এলোপাতাড়ি ও আয়রনীমূলক।” সুবিমল মিশ্র বলেছিলেন, ‘প্রতিষ্ঠিত শক্তিই প্রতিষ্ঠান’। বাজারি পণ্য-সাহিত্যের লেখকগণ কথাটার মানে না বুঝেই তারা প্রতিষ্ঠানমুখী হচ্ছে অথচ প্রতিষ্ঠিত শক্তির মানে সৃজনশীল ব্যক্তি, যিনি বুর্জোয়া, মুনাফা লোভী, পুঁজিবাদকে না বলে বাজারি সাহিত্যের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে নিজস্ব চৈতন্যের বিকাশ, নতুন কিছুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রবণতাকে নিজেই নিজের বিরুদ্ধে তার সাহিত্যকর্মকে দাঁড় করিয়ে অনিবার্যভাবে আবিস্কারের নেশায় লিপ্ত রয়েছেন।
সুবিমল মিশ্র-র ভাষায়, ‘লোকে যাকে সাহিত্য করা-টরা বলে তেমন কিছুতে আমার আস্থা নেই। চিন্তার মধ্যবিত্ততাকে আমি ঘৃণা করি, যে চিন্তা বৌয়ের ঠোঁটের লিপিষ্টিক দেখে রক্ত প্রত্যক্ষ করে। রবিঠাকুর-টাকুরদের মতো সাহিত্য করিয়েদের লাইনে থাকতে রীতিমত অসম্মানিত মনে হয় আমার। আমি তেমন কোনো লেখা লিখতে চাই না যা পড়ে লোকে আমার পিঠ চাপড়ে বলবে, বাহ বেড়ে সাহিত্য করছোতো হে ছোকরা, আমি চাই লোকে আমার লেখা পড়ে থুথু দিক, আঙুল দেখিয়ে বলুক;— এই সেই লোক যে উপদংশসর্বস্ব এই সভ্যতার ঘাগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দিনের আলোর মতো খোলাখুলি করে দিয়েছে।’
সেলিম মোরশেদ ছোট কাগজ নিয়ে স্বপ্ন-দেখা নিয়ে বলেন— ‘প্রতিটি মফস্বল থেকেই শুধু নয়, প্রতিটি গ্রামে, এমনকি সেই সব গ্রামে যেখানে বিদ্যুৎ যায়নি, অচিরেই আমরা লক্ষ করবো তারা হাতে লিখে সে সব এলাকা থেকে ছোট কাগজ বের করবে, কেননা হারিকেন জ্বালিয়ে তারা কেউ না কেউ কিছু পড়ে, তাদের নিজেদের বহু কথা রয়েছে, সত্যিকারের জীবন তারা জেনেছে, ৩০/৪০ বছর ধরে তাদের কেউ কেউ লিখেছে, নিষ্ঠুরভাবে তাদের লেখা আর পাণ্ডুলিপি বড় কাগজের সম্পাদক, প্রকাশকরা দীর্ঘদিন ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, আমাদের ভালোবাসায় তারা উদ্দীপ্ত হবে। তুমি বলবে ভাষা, আধুনিক-শিক্ষা, দৃষ্টিভঙ্গি এই সবে তারা পিছিয়ে। আমি মানি না। মানুষের জন্য চাই উন্মুক্ত কথা বলার অপরিসীম স্বাধীনতা। আর স্বাধীনভাবে কথা বলার জায়গা। সামান্যতম লজ্জার ভয় না পেয়ে তার অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে যেমন ইচ্ছা তেমন লেখার স্বাধীনতা পেলে, সম্পাদক নামের কাগুজে বাঘ, বুদ্ধিজীবী নামক মুখস্ত বিদ্যার বখাটে আর সেই সব সমালোচক যারা নন্দনতত্ত্ব বোঝানোর জিভ বের করার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু দিয়ে থুতনিতে ঘা দিয়ে ঘ্যাঁচ করে জিভ কেটে দিতে পারলে আজকে সেগুলোকে আমরা বলি কঠিন সাহিত্য সেগুলোকে সবচেয়ে বেশি অনুধাবন করবে সেই জনগণ।’
সকল প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক মোহ কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধী একটি সাহিত্য আন্দোলনকে খানিকটা এগিয়ে নেয়া খুব সহজ নয়। লিটলম্যাগ আন্দোলন আর ছোট কাগজের ফেরিওয়ালা সেলিম মোরশেদ-গং-এর সংঘবদ্ধতা দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিলেন এই জংশন। সাহিত্যের বহু ট্রেন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের আনাচে-কানাচে। যার প্রতিফলন এখনো আমরা যারা ছোট কাগজ করি তারা জানি কতটা এগিয়ে রেখেছিলেন এই যাত্রা।
আশির দশকের প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন বা লিটলম্যাগ-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে বর্তমান প্রজন্ম দৃষ্টিভঙ্গি একে দেখায়, জড়, অর্থব-পঙ্গু, চিন্তার দৈন্যতাই আমাদের ভাবিত করে এবং ভাবিত হই, উত্তর-উপনিবেশিককালে, আমাদের সাহিত্যেও ঔপনিবেশিক প্রেতের অস্তিত্ব বিরোধিতা অনিবার্য কাম্য।মেরুদণ্ডহীন ফরমায়েশি চিন্তায় মধ্যবিত্ত সমাজের সব শ্রেণির মধ্যে এখনও হয়নি সুষম পূর্ণাঙ্গতা। চিন্তার অসংলগ্নতা, ঔপনিবেশিক পর্বে বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতি নতজানু প্রভুর শেখানো আদব-লেহাজ অজান্তেই মগজে তাদের ক্রিয়াশীল। জিরো জেনারেশনেও প্রভুদের বড় করে দেখার বাতিক তাক করে ফেরে আজও, সেজন্য ঘটে যায় সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। তন্ত্রীতে, স্নায়ুতে, মগজে, শিরায়-শিরায় ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য এর একমাত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রথা ভেঙে ফেলা। মানুষকে সচেতন ভাবে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করছে, একা, নিঃসঙ্গ, চিন্তাশূন্য, একরৈখিক, ভোগবিলাসী চরিত্রে। সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি-সচেতনতাহীন ও বিপ্লবের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে তার মনন, একদিনে নয়— আশির আগে থেকে। লিটলম্যাগ মুভমেন্ট অস্তিত্বের এই জায়গাটি বাধা দিতে পরে এখনই, এই মুহূর্ত থেকেই। লিটলম্যাগ সাহিত্যে গতিশীলতার সৃজন প্রথাবিরোধীদের দাঁড়াবার জায়গা। তাই এসো, ভাঙি, আধিপত্যের ফ্রেমগুলোকে চুরমার করি, ধ্বংস করি আধিপত্যের স্থাপত্য, হুলিও কোর্তাসার বলেছিলেন, কে কোথায় আছ, ভাঙো! আর সেই ভাঙার গানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেলিম মোরশেদ, গাণ্ডীবগণ। গত হয়ে যাওয়া ৫০ বছরের ধারণা ভেঙে দিলেন তাঁরা, লিটলরা লিটল ম্যাগাজিনে লিখবেন— দৈনিক পত্রিকার থলে বইবেন, অনাহারে-অনাদরে, চটির শুকতলা খুইয়ে বিজ্ঞাপনের পেছনে ছুটবেন, সম্পাদকদের এবং তথাকথিত বড়দের ফাই ফর-ফরমাশ খাটবেন। তারপর তারা বিগ হবেন বিগ ম্যাগাজিনে। এই ধারণা ভেঙে গড়লেন নতুন এক প্লাটফর্ম। না প্লাটফর্ম না, জংশন। সেই জংশন হবে লিটল ম্যাগাজিনের হাত ধরে তরুণদের সৃষ্টিশীল রচনা প্রকাশের ক্ষেত্র। ওই তরুণেরা হবেন এই ক্ষেত্রের কৃষক যারা তাঁদের রচনা বা ফসল সস্তা পণ্য হিসেবে বিক্রি করবেন না। তাঁরা প্রতিশ্রুত হলেন, চুক্তিবদ্ধ হলেন যে বাইরের কোথাও লিখবেন না, বাইরের কারো আমাদের অপছন্দের লেখা ছাপাব না। এই প্রতিশ্রুতির নেতৃত্ব দিলেন সেলিম মোরশেদ, তারেক শাহরিয়ার, তপন বড়ুয়া। পরে যোগ দিলেন আহমেদ নকীব, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। লেখকগণের মধ্যে শান্তনু চৌধুরী, শোয়েব শাদাব, সাজ্জাদ শরিফ।
সকল প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক মোহ কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধী একটি সাহিত্য আন্দোলনকে খানিকটা এগিয়ে নেয়া খুব সহজ নয়। লিটলম্যাগ আন্দোলন আর ছোট কাগজের ফেরিওয়ালা সেলিম মোরশেদ-গং-এর সংঘবদ্ধতা দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিলেন এই জংশন। সাহিত্যের বহু ট্রেন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের আনাচে-কানাচে। যার প্রতিফলন এখনো আমরা যারা ছোট কাগজ করি তারা জানি কতটা এগিয়ে রেখেছিলেন এই যাত্রা। প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের জন্য পণ্য-সাহিত্যের গড্ডলিকায় বুর্জোয়া চরিত্রকে অতিক্রমণের সড়কটি অত্যন্ত সংকীর্ণ ও কন্টকাস্তীর্ণ, তিরস্কার ও তাচ্ছিল্য জর্জরিত। এই পথে প্রশংসা ও প্রস্তুতি নিদারুণ অনুপস্থিত। নিচে ফাঁদ পাতা খ্যাতি ও গড্ডলিকার ফাঁদ। লোভ-মোহ, নগদ প্রাপ্তির অবিরাম হাতছানি প্রলোভন সৃষ্টিতে উদ্যত। এই অবস্থায় ভণ্ড ও কপট ব্যক্তিসহ অনেকেরই সত্তা বিক্রি হয়, তাই প্রকৃত মৌলিক আস্থাবান লেখক ও সম্পাদক যোদ্ধাকে হতে হয় সংগ্রামশীল, নিরলস যুদ্ধমান, রক্তাক্ত হয় বক্ষদেশ, পৃষ্ঠদেশ নয়, গলায় রক্ত উঠে মৃত্যু—তবু অস্তিত্ব বিক্রয় উপেক্ষণীয়। পথ তৈরি হয় চলতে গিয়ে। সেই পথই তৈরির পথে সামনে এসে দাঁড়ালের সেলিম মোরশেদ। ‘পাল্টা কথার সূত্রমূখ’-এ এই বিষয়ক ইশতেহার গদ্যে লিখলেন কিভাবে এই পথে থাকতে হবে, কারা থাকবেন, কিভাবে থাকবেন আর কিভাবে টিকে থাকবেন, তার জন্য কতটা ত্যাগ করতে হবে। আর সেই পথ ধরেই এই অনলাইন প্রযুক্তির ওয়েবজিন পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এগিয়ে গেছে লিটলম্যাগ-যাত্রা। তবে অনেক ওয়েবজিনও সেই ধারাবাহিকতা বা ইশতেহারের পথেই আছেন। পথিকই পথ সৃষ্টি করে। আর সেই পথে চলে তার অনুসারীগণ। সেই পথের পথিকৃৎ সেলিম মোরশেদ (ভাই)-ই শিখিয়েছেন মন জোগানোর কাজ ছোট কাগজের নয়, তাই আপনাকে মেরুদণ্ডখানি সোজা রেখে হাঁটতে হবে। এই পথ সহজ নয়। লেখা সংগ্রহ, বাছাই, এবং প্রচ্ছদ নির্বাচন, ছাপাখানা সব কিছুতেই ওই ‘নো কম্প্রোমাইজ’ থিওরি এপ্লাই মূলমন্ত্র। তাই পদে পদে বাধা পেরিয়েই কাজটি নিষ্ঠার সাথে করে যাওয়ার মন্ত্রখানিই হোক ছোটকাগজ-কর্মীদের পথচলার ইশতেহার।