জল দেখে ভয় লাগে
“আমরা যেখানে যাবো শুনেছি সেখানে নাকি নেই
বাঁচার মতন জল, জলস্রোত, বর্ষণ হবে না”
১৯৮৬’র জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রামে গেলাম উচ্চ শিক্ষার জন্য। চিটাগাং নিউ মার্কেট অর্থাৎ বিপণী বিতানে আগের বছর গিয়েছিলাম প্রথমবারের মত, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষের ছুটিতে, কাকার আমন্ত্রণে; সেবার পতেঙ্গায় গিয়েছি। এস্কেলেটর আর ফালুদার আকর্ষণে এবারেও প্রথম গন্তব্য নিউ মার্কেট। উল্লেখ্য, ছোটবেলা থেকেই জানা ছিল চিটাগাং নিউ মার্কেটের চলন্ত সিঁড়ির কথা; বাংলাদেশে আর কোথাও তখন এমনটি ছিল না।
নিউ মার্কেট গিয়ে ‘বইঘর’ থেকে একটাই বই কিনেছিলাম মনে পড়ে- ‘আল মাহমুদের কবিতা’, সবিহ-উল আলমের প্রচ্ছদে। আল মাহমুদ, ‘যার প্রতিটি শব্দই অনিবার্য’। তখন আমার শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর নির্মলেন্দু গুণে ভেসে যাবার সময়- আবুল হাসান আর রফিক আজাদ আসবেন কিছুদিন পর। এই মাহেন্দ্রক্ষণে আল মাহমুদ এলেন, যাঁর ‘সোনালি কাবিনে’র দু একটা কবিতা পড়া হয়েছিল নিপুণ পত্রিকায় কিংবা কিছু উদ্ধৃতি পাঠ করা হয়েছে হেথায় হোথায়। কবির কোনো বই তখন পর্যন্ত পড়া হয়নি। আমি প্রবলভাবে ভেসে গেলাম– সমুদ্র নিষাদ, কবিতা এমন, প্রত্যাবর্তনের লজ্জা ( ঢাকা–চট্টগ্রাম ট্রেন মিস করেছিলাম সে সময়ে একবার, জীবনে একবারই, টিকেটটা এক বান্ধবীর কেনা ছিল- তার কাছে এখনো ৭০ টাকা ঋণী আমি), ব্রে (খেলাটা তখন মাত্রই শিখেছি), শোনিতে সৌরভ, আসে না আর ইত্যাদি কবিতার জাদুকরী ঘোরে দিনরাত কাটে, এক আশ্চর্য সম্ভার বালিশের পাশে কিংবা রেল স্টেশন থেকে কেনা বেতের শেলফে রেখে স্বপ্ন দেখি।
কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিয়েছি, সমুদ্র শহরে থাকছি বলে দু তিনবার পতেঙ্গার সৈকতে গিয়েছি তখন, আল মাহমুদও এখানে কিছুদিন ছিলেন বলে জানি; কবিতা লিখছি– আল মাহমুদের কিছু কিছু লাইন মাথায় ঘুরে– সোনালি কাবিনের অবিস্মরণীয় অনেক পঙক্তি ছাড়াও ‘কতদূর এগোলো মানুষ! /কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে‘ কিংবা ‘ভোলো না কেন ভুলতে পারো যদি/ নিয়াজ মাঠে হাঁটার দিনগুলি’, ‘অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল‘, কিংবা ‘অগ্রজের কাতর বর্ণনা’ কিংবা ‘সুকন্ঠি কবুল করো, এ অধমই তোমার মরদ’ (জর্জ মাইকেলের গান শুনছি পাশাপাশি– আই’ম ইয়োর ম্যান!) আর অবশ্যই ‘জল দেখে ভয় লাগে’ এই শব্দগুচ্ছের প্রণোদনায় একদিন লিখে ফেললাম ‘ভয়ভীতি’ শিরোনামের কবিতাটি। ১৯৮৯ সালে আমার প্রকাশিত প্রথম বইতে এই কবিতাটিই ছিল সর্ব কনিষ্ট। ক্যাম্পাসের প্রথম বর্ষকে সব রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনই (ছাত্র লীগ, ছাত্র সমাজ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র শিবির) নবীন বরণ দিয়েছিল, আর সবাই একটা করে স্যুভেনিরও প্রকাশ করেছিল যে যার সাধ্যমত। প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা সবার স্মরণিকাতেই লেখা দিবে, এটা দূষণীয় কিংবা শাস্তিযোগ্য অপরাধও ছিল না। আমি কবিতাটি মাহমুদ প্রভাবিত মনে করেছিলাম বলেই কি শিবিরের স্যুভেনিরে দিয়েছিলাম!
এই মাহেন্দ্রক্ষণে আল মাহমুদ এলেন, যাঁর ‘সোনালি কাবিনে’র দু একটা কবিতা পড়া হয়েছিল নিপুণ পত্রিকায় কিংবা কিছু উদ্ধৃতি পাঠ করা হয়েছে হেথায় হোথায়। কবির কোনো বই তখন পর্যন্ত পড়া হয়নি। আমি প্রবলভাবে ভেসে গেলাম– সমুদ্র নিষাদ, কবিতা এমন, প্রত্যাবর্তনের লজ্জা (ঢাকা–চট্টগ্রাম ট্রেন মিস করেছিলাম সে সময়ে একবার, জীবনে একবারই, টিকেটটা এক বান্ধবীর কেনা ছিল- তার কাছে এখনো ৭০ টাকা ঋণী আমি), ব্রে (খেলাটা তখন মাত্রই শিখেছি), শোনিতে সৌরভ, আসে না আর ইত্যাদি কবিতার জাদুকরী ঘোরে দিনরাত কাটে।
মাহমুদ চর্চাটা আরেকটু জমে ওঠে আরেক মাহমুদ – বন্ধুবর তিতাস এর সংস্পর্শে এসে– যার ব্রাউন মলাটের কবিতা আবৃত্তির খাতা থেকে আল মাহমুদের আবৃত্তিযোগ্য কয়েকটা কবিতা পড়তাম ওর অভিজাত-শৈল্পিক হাতের লেখার আকর্ষণে!
আমার ছাত্রজীবনে ‘আল মাহমুদের কবিতা’ বইটি ছাড়া তার আর কোনো রচনা পড়িনি বললে ভুল হবে- ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’ আর ‘কবির আত্মবিশ্বাস’ পড়ে আমি তাঁকে ত্যাগ করতে যাচ্ছিলাম, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবিতাটি পড়ে নির্দ্বিধায় ইউ টার্ন করলাম। লুকিয়ে টুকিয়ে তার সাক্ষাৎকার পড়ে রাগ হত মনে মনে, কেননা তিনি কবিতায় বা জীবনে যে পথের সন্ধান পেয়েছেন তাতে আমি তাকে পথভ্রষ্ট মনে করেছি। পরবর্তীতে পড়েছি কবির অনবদ্য শৈশব স্মৃতি ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ আর তিনটি গল্পের বই ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘আল মাহমুদের গালগল্প’ আর ‘গন্ধবণিক’। আরেকটি গল্পের বই ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’ পড়বার আগ্রহ এখনো আছে। এই হচ্ছে আমার গোপন বা প্রকাশ্য আল মাহমুদ চর্চা।
আঠারো বছর বয়সে লেখা আমার সেই ‘ভয়ভীতি’ কবিতাটি ছিল এই-
ভয়ভীতি
যে পাহাড়ে করেছি উদযাপন
জীবনের প্রথম জল
সেখানে চাইনা যেতে আমি আর,
প্রাচীনা সে পাহাড়ের সীমানা হোক
তামাদির দখল।
দ্বৈতসত্তার দ্বিতীয় যে-নদী
আপন নয় যেন সেও
আড়াআড়ি পার হয়ে যাই কতোবার
অথচ কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে সামনে যেতে ভয়,
যেন দেও দানো আর অদেখা শ্বাপদ
আগলে রয়েছে জলপথ।
সমুদ্রের কাছে পারি না আমি সহজ হতে একবার,
বিশাল তার কাছে গেলে সব স্বপ্ন মনে হয়;
আড়াআড়ি বয়ে যাই একা অপ্রতিভ নদী
আজন্ম সমুদ্রভীতি আমার।