:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
গৌতম মিত্র

কবি, প্রাবন্ধিক

জীবনানন্দের রবীন্দ্রনাথ
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

জীবননামা - ৪

জীবনানন্দের রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের কাছে জীবনানন্দ দাশ ‘ভিড়ের ভিতর হারিয়ে’ যাওয়া মানুষই হয়তো থেকে গেলেন চিরকাল।

সমসাময়িক আর কোনও কবির ভাগ্যে এতটা অবজ্ঞা জোটেনি। শুধু চিঠির কথাই যদি ধরি, রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে চিঠি লিখেছেন ১৩৭, সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে ৩৮, বুদ্ধদেব বসুকে ৩৬, বিষ্ণু দে ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে ৮ টি করে। অথচ জীবনানন্দ দাশের কপালে জুটেছে মাত্র ২টি চিঠি, তাও যতটুকু না লিখলে ভদ্রতা বজায় রাখা যায় না।

তাছাড়া এঁদের কাউকে কাউকে কথায় কথায় ‘সার্টিফিকেট’ দেওয়া, পান্ডুলিপি এডিট করা, টেঁকে করে নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ, পায়ের কাছে বসিয়ে ছবি তোলা— এগুলো তো আছেই।

অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ হয়তো শেষ অবধি বরিশাল যাননি কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের সূত্রে দাস পরিবারের সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের নিশ্চয় কোনও যোগাযোগ ছিল। মা কুসুমকুমারী দাস রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে থেকে পড়েছেন, বাবা সত্যানন্দ দাস-ও কলকাতা থেকে পড়াশোনা করেছেন। অশ্বীনিকুমার দত্ত তো বরিশালেরই মানুষ। তাছাড়া লেখার জোরেই তো জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথের প্রতিস্পর্ধী।

যে দু’টো চিঠি লিখেছেন তা খুব দায়সারা ভাবে। একটিতে ভাষা নিয়ে ‘জবরদস্তি’র কথা বলেছেন অন্যটিতে ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ’-এর কথা।

অথচ জীবনানন্দ যে দীর্ঘ দুটি চিঠি রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন তাতে তাঁর নিজের কাব্যদর্শন অনেকটাই প্রতিফলিত হয়েছে। বলেছেন লেখার ‘অশান্তি’ ও ‘আগুন’- এর কথা। অকপটে জানাতে পেরেছেন, নিজের জীবনের ‘তুচ্ছতা’ থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রদীপ্তি’ র ব্যবধানের কথাও।

জীবনানন্দ কাউকে রেওয়ায়ত করেননি। নিজের মা বাবা স্ত্রী কাউকে নয়। নিজেকও নয়। একে যদি নিহিলিস্ট বলেন কেউ বলতে পারেন। আমরা তো জানি জীবনানন্দের মতো পরম আনন্দে জীবনের ভাঁজগুলো আর কেউ একটা একটা করে উন্মোচন করেননি।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ডামাডোলে জীবনানন্দও তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখে ফেললেন। এবং ৩ টি। ‘পরিচয়’, ‘পূর্বাশা’ ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামে একটি সঙ্কলনে সেগুলো প্রকাশিতও হল। ১৯৪১-এ। অবশ্য ১৯৩০-৩১ ও ১৯৫৪-তে জীবনানন্দ ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে আরও দুটো কবিতা লিখেছিলেন।

জীবনানন্দ দাশের কবিতার যে ধাত তার সঙ্গে যেন এই ৫ টি কবিতা খাপ খায় না। ‘সৃষ্টির প্রথম নাদ’, ‘তোমার বিভূতি, বাক্-বেদনার থেকে উঠে নিলীমাসংগীতি’ যেন জীবনানন্দের নয়।

প্রবন্ধও লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। সেখানে সত্যিই কোনও যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। বরং রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে নিজের কথাগুলোই তো বলতে চেয়েছেন। ‘মহাকবিকে’ এড়িয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য জেনেও তো লেখেন ‘এখন ব্রহ্ম না থাকার মতো, আত্মা অমর নয়, আত্মা খুব সম্ভব নেই’

রবীন্দ্রনাথ একটি ক্ষমার অযোগ্য অন্যায় করেছিলেন। ‘বাংলা কাব্য সংকলন’ (শ্রাবণ ১৩৪৫)-এ জীবনানন্দ দাশের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটির প্রথম ও পঞ্চম স্তবক সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে ও অষ্টম স্তবকের প্রথম চার পংক্তি বাদ দিয়ে ছেপেছিলেন। এর থেকে বড় অপরাধ হয় না।

রবীন্দ্রনাথকে পাঠানো জীবনানন্দের চিঠি।

যদিও এটা ১৯৩৮-এর ঘটনা, রবীন্দ্রনাথের এই মোড়ল স্বভাব জীবনানন্দ টের পেয়েছিলেন অন্তত ১৯৩২-এ। মিচেল ফুকো কথিত ‘পাওয়ার’-এর যে বলয় তার শীর্ষে তিনি রবীন্দ্রনাথকে রেখেছেন। ‘ঠাকুর-দেবতা’র বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন তাঁর কোনওদিনই হয় না। তাঁর নভেলের পান্ডুলিপি উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কী মন্তব্য করছেন তা দেখলে শিহরিত হই। লিখেছেন:

‘…বিড়ি যেমন একটা সুর; নবজীবনের অমৃতলোক, ইহজীবনের শান্তি, কাইসারলিং-শান্তিনিকেতন-জীবনের ঋতু-উৎসব নাচগান, দার্জিলিং -জীবনের হিমালয় ও দেবদারুর বৃহত্তর ভারতজীবনের ব্যাপ্তি বিশ্ববীণার সমগ্রতা ও তা দিয়ে গরিব সাহিত্যিকদের আচ্ছন্ন করে ফেলবার প্রয়াসও যেমন একটা সুর।’

লিখেছেন :
‘…সত্তর বছর টিকলেই যথেষ্ট; অজস্র বই লেখা হবে, নাম হবে, অনেক টাকা হবে, ইউরোপ-আমেরিকা দেখব-নোবেল প্রাইজ পাব, একজন মেয়ের জায়গায় হাজার মেয়ের প্রেম পাব—মেয়েদের ভালবাসার চিঠি নিয়ে ছিনিমিনি খেলব—বুড়ো হব—জয়ন্তী হবে—আমার নামে ছেলেরা কবিতা লিখবে, আমার গোল্ডেন বুক হবে—সমস্ত নোবেল লরিয়ট আমাকে কাঁধে নিয়ে চেয়ার করবে…’

কার কথা বলা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে? শুধু এতটুকু উল্লেখ করি, নভেলের পান্ডুলিপি লেখা হচ্ছে আগস্ট ১৯৩২ আর গোল্ডেন বুক অফ টেগোর প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সত্তরতম জন্মদিনে, ১৯৩১।

জীবনানন্দ কাউকে রেওয়ায়ত করেননি। নিজের মা বাবা স্ত্রী কাউকে নয়। নিজেকও নয়। একে যদি নিহিলিস্ট বলেন কেউ বলতে পারেন। আমরা তো জানি জীবনানন্দের মতো পরম আনন্দে জীবনের ভাঁজগুলো আর কেউ একটা একটা করে উন্মোচন করেননি।

ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে একটি কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করবেন। আমরা জানি কোনওদিনই তা করে উঠতে পারবেন না। করলে জীবনানন্দ আর জীবনানন্দ হয়ে উঠতেন না।

জীবনানন্দ আসলে যা তা। একতিল বেশি বা কম নয়। এমনই আতুর, অবুঝ, অবৈধ। পাসপোর্টহীন। বারবার সীমান্তগুলো ভাঙছেন।

৪ বৈশাখ ১৪২৬

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.