জীবন একটা ভয়াল সুন্দর নাম
অরণ্যরাহা
আমাদের অরণ্যের রাহায় যারা তারাবাতি ধরে, সেই সব লেখক, আর সাহসী মানুষের দিশায় আমরা আজন্ম হাঁটি পথ। প্রিয় লেখকেরা দিশাময় ঘাসফুল গন্ধ হয়ে সঙ্গে থাকে। তারা আমাদের ছায়া ছায়া কারুকাজে সূর্যালোক বা পাখির শিস। আর কেউ ফার্স্ট এইড বক্স বাড়িয়ে দেয়। বলে, যারা না বলতেই আসে, আর যাদের বুকে একটা ইস্পাতের খাঁচা নেই, পাখিরা সেখানে ওড়ে আর আকাশ ছোঁয়। তাদের এমন অনেকবার পঙ্গু হয়ে যেতে হয়। বলে, জংলি চিতার কালো দাগবহুল হয়ে গেলে ক্ষতি নাই। জীবন একটা ভয়াল সুন্দর নাম। রাহায় নামলে, সবাই সমান। সবাই মাটিতেই বসে ক্লান্তি খুলে রাখে। মানচিত্র এগিয়ে দেয়। আর জলের রাহা ব্যগ্র খড়ি এঁকে বুঝিয়ে দিতে চায়। এই তাদের ছায়াকে জলে দ্রবীভূত করে দেবার আনন্দ।
তারামণি
আমাদের একজন বোনের শখ ছিল। ঘাড়ে হেলান দেবার মতো আমাদের বোন ছিল না। আমাদের একটা কুয়ো ছিল যার নাম কবিতা। সে তার বক্ষপুট থেকে শব্দের শর খুলে আমাদেরই ফিরিয়ে দিত। আমরা গুরুর কাছে ভাষা শিখি নাই। আমাদের বর্ণমালায় ভুল লেগে থাকে। সেই কুয়োর বিস্রস্ত জল আমাদের বারবার ক্ষমা করে দেয়। এভাবে এভাবে নিজেদের ঘাড় শক্ত হতে হয়। কারণ ইতিহাস আর ভূগোল হাতড়ে তারাপথ দূরবীন হেঁটে আমরা নক্ষত্রফল ভরা তেজী বৃক্ষ দেখলাম। তাদের নিজস্ব প্রতিবেশ ছিল বলে তারা শিকড় তলিয়ে দেয় আগুনের ঘরে আর মুঠিতে মাটিকে জাপটে ধরে। সেই সব বৃক্ষ আমরা মা বাবা, ভাই বোন অথবা এমন সব নাম দিলাম। কালে কালে সেই সব বৃক্ষ অরণ্য হয় প্রত্যন্ত স্থান। আমরা স্নান সেরে, শাড়ি জড়িয়ে, মাটিকে চুমু খেয়ে সেই বৃক্ষের তলে এসে দাঁড়াই। তাঁরা নক্ষত্রফলদের তরঙ্গিণী নাম দিয়ে ভার হালকা করে দেন। তারপর মাটিতে বুনে দেন তারামনি ফুল।
স্বরেখা
মা বলতেন, পায়ের তলায় শালুক থাকে। আর হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় হওয়া যায়। পায়ের তল এত নরম যে মাটিকে চুমু খেতে পারে। আসলে তেমন করে হাঁটতে আমরা জানি না, কিন্তু সেই পায়ের পাতা আমাদের আপন মনে হয়।
আমরা শুনি আমাদের ভাইদের, যারা ঘূর্ণনের কালো বর্তুল দাগ লুকায়নি। তাই কুহক ছুঁয়ে হেঁটে গেছে সমুদ্রের পাড়। সমুদ্র চৌচির যথা তারা বলে, সব ক্ষতর জন্য আমরা ক্ষমা চাই। যাদের প্রশংসা করেছি, যাদের আলো কেটে নিলাম। হয়ত তাহলে আমরা জলতল থেকে বেরিয়ে এসে ডানা ছড়াতে পারি আকাশে।
ভাঙা পাখি সমীপে আমরা দেখি রক্তে আসলে নানা রং শব্দ থাকে, আর জলকণার ভিতর অণুর সম্ভার। আমরা জানি সব পাখির একটা সবুজ নীড় আছে, নিজের জরার কাছে।
কাজলা দিদি অনেক দূর থেকে বলে, নবনীতা পড়োনি? ভালো বাসা একটা ঘর। এর আকার ছিন্ন তালুর রেখা। জলদল, দাওয়া আর ছাউনি। খেজুর গাছ থেকে নেমে আসা সুর।
ঢেউ বোনে জল। কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্য আছে যা আমাদের ছিটকে তোলে, যেমত ডাঙার মাছ। সেই সব কম্পন আমাদের ছুঁড়ে দেয় শূন্যে মহাশূন্যে আর ওজন নিয়ে খেলে। সব ঢেউ আমাদের বুকের ফলকে নিজের নাম লিখে রাখে। আমাদের আপন হয়।
আর তারপর দেখি, সব পাখির ঢেউ ঢেউ খেলা আলাদা। এই কম্পনরেখা আমরা আঁকতে চেয়েও পারি না। আমরা শুধু নাচ ভুলি, নাচ শিখি আর স্বরেখা এঁকে যেতে চাই। চরাচরে দোলাতে চাই সমুদ্রকিরণ।