একথা সেকথা
ঠাকুরের মোনাজাত
১.
আশির দশকের শুরুর দিক। বাংলা একাডেমিতে রবীন্দ্রস্মারক কোনো অনুষ্ঠান। কথা বলছেন কবি আসাদ চৌধুরী। তিনি জানালেন, তাঁর পিতা জায়নামাজে বসে ‘গীতাঞ্জলি’ হতে পাঠ করে মোনাজাত করতেন। কথাটা বেশ মন কেড়েছিল। কারণ হলো, মুসলিম সমাজকে যেভাবে দেখে আসছিলাম তা ছিল ধর্মীয় চর্চার ক্ষেত্রে বেশ রক্ষণশীল। সুফি ঘরানার উদার ও সমন্বয়ধর্মী চর্চা সম্পর্কে তখন আমার ধারণা ছিল না। সুতরাং জায়নামাজে বসে হিন্দু (ব্রাহ্ম) রবীন্দ্রনাথের রচনাকে যে এবাদতের আবহে ব্যবহার করা যায় তা জেনে আমি অবাক হয়েছিলাম।
আসলে এত অবাক হবার কিছু ছিল না। কারণ রবীন্দ্রনাথের পূজা-পর্যায়ের গানগুলো সাধারণত ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনাসঙ্গীত হিসাবেই রচিত হয়েছিল, যে ব্রাহ্মসমাজ ছিল একেশ্বরবাদের একটি ঘরানা। আর, এইসব গানের, অন্তত বেশ কিছু গানের, মৌল ভাবধারা ইসলামের বা যে-কোনো ধর্মেরই ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উপরন্তু, পিতা দেবেন্দ্রনাথের প্রণোদনায় রবীন্দ্রনাথ বাল্যকাল থেকেই সুফি-সাহিত্যের সাথে পরিচিত ছিলেন। পারস্যে ভ্রমণকালে হাফিজের সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলির কাছে তিনি নিজেকে সুফি কবিদের উত্তরাধিকারী বলেই পরিচয় দিয়েছিলেন।
সুফি ভাবধারার সাথে ‘উপনিষদ’ ও বৈষ্ণব ভাবধারার সাযুজ্য রয়েছে। আসলে সকল আধ্যাত্মিক ভাবধারার মধ্যে অন্তর্লীন সম্পর্ক আছে। ধর্মের বাহ্যিক কাঠামো, আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি ও মোল্লা-পুরুত-পাদ্রীর মধ্যে যতই বিভেদ-বিভাজন থাকুক, ধর্মের যে অন্তর্নিহিত ও মরমি ভাবধারা সেখানে গভীর ঐক্য ও পরস্পর বিনিময়যোগ্যতা বিরাজমান। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মবোধের প্রধান উৎস ছিল ‘উপনিষদ’-এ বর্ণিত সেই এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মকেন্দ্রিক ভাবধারা, যে-ব্রহ্ম সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ধারণ করে আছেন এবং যিনি সকল সত্তার সারাৎসার। সেই চিন্ময়, আনন্দময় ও প্রজ্ঞাময় সত্তার উপলব্ধিকে ভিত্তি করে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার বিচিত্র বিকাশ ঘটেছে।
সাধারণভাবে আমরা মনে করি স্রষ্টা বিশ্বজগতের ওপারে কোথাও অদৃশ্যলোকে বিরাজমান। ধরা-ছোঁয়ার অতীত সেই সত্তা আমাদের জন্য কিছু বিধান দিয়েছেন আর আড়াল থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁর বিধান মানলে পরকালে পুরস্কার, না মানলে শাস্তি : এমনটাই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু সুফির কাছে আল্লাহ প্রেমময়। তাঁর সাথে মানুষের সম্পর্ক আশেক আর মাশুকের। আর তাঁর অবস্থান মানুষের হৃদয়েই; ‘আরশাল্লাহ কলবুল মোমিনিনা’— অর্থাৎ, মোমিনের হৃদয়েই আল্লাহর আরশ। এই হৃদয়স্থিত পরমের কথাই রবীন্দ্রনাথের গানে পাই আমরা বার বার : নানা বর্ণনায়, নানা ভাবানুষঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথের পূজা-পর্যায়ের গানগুলো সাধারণত ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনাসঙ্গীত হিসাবেই রচিত হয়েছিল, যে ব্রাহ্মসমাজ ছিল একেশ্বরবাদের একটি ঘরানা। আর, এইসব গানের, অন্তত বেশ কিছু গানের, মৌল ভাবধারা ইসলামের বা যে-কোনো ধর্মেরই ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উপরন্তু, পিতা দেবেন্দ্রনাথের প্রণোদনায় রবীন্দ্রনাথ বাল্যকাল থেকেই সুফি-সাহিত্যের সাথে পরিচিত ছিলেন। পারস্যে ভ্রমণকালে হাফিজের সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলির কাছে তিনি নিজেকে সুফি কবিদের উত্তরাধিকারী বলেই পরিচয় দিয়েছিলেন।
মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
একেলা রয়েছ নীরব শয়ন পরে
প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।
তবে দায় কি একা প্রিয়তমের? শুধু তাকেই জেগে উঠতে হবে? না। ভক্তের দায় আরও বেশি।
নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা
ভক্ত সেথায় খোলো দ্বার— আজ লব তার দেখা।
অর্থাৎ, প্রেম দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে, চর্যা দিয়ে নিজেকে উন্মুক্ত করতে হবে, যেন দেখা মেলে প্রিয়তমের। কিন্তু কী থেকে মুক্ত করতে হবে? উত্তর দিচ্ছেন কবি :
আপনারে দিয়ে রচিলি রে কী এ
আপনারই আবরণ
খুলে দেখ দ্বার অন্তরে তার আনন্দ নিকেতন।
আমরা আমাদের অহংকেন্দ্রিক, বাসনাতাড়িত, প্রতিক্রিয়াপ্রবণ মনের দ্বারা আচ্ছাদিত। রবীন্দ্রনাথ একে বলেছেন ‘ছোট আমি’। এই ছোট আমির অবস্থান হতে ‘বড় আমি’ অর্থাৎ চেতনার প্রজ্ঞা-ও প্রেমানন্দময় উচ্চস্তরে উত্তরণকেই তিনি মনুষ্যত্বের সাধনা বলে মেনেছেন।
কিন্তু আমাদের অন্তরের সেই পরমকে যে আমরা দেখি না বা উপলব্ধি করি না তার বড় কারণ হলো, আমরা তাকাই বাইরের দিকে, দেখি বহির্জগত, নিজের ভিতরের দিকে তাকাই না।
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাই নি তোমায় দেখতে আমি পাই নি।
বাহির পানে চোখ মেলেছি,
আমার হৃদয়-পানে চাই নি।
তবে তিনি কেবলই কি অন্তরের অধিবাসী? বাইরে কি তার কোনো অবস্থিতিই নাই? তা হলে তিনি পরিব্যাপ্ত অসীম হলেন কীভাবে? যার অন্তর পরমের স্পর্শ পেয়েছে সে বহির্লোকেও তাঁর প্রকাশকে দিব্যি দেখতে পান।
এই তো তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ
এই যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরণ।
আর, এই পরম কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিকই নন, সবার সাথেই তাঁর সম্পর্ক অনন্য; আর, সেই উপলব্ধির ভিতর দিয়েই ভক্ত সর্বজনীনতার আস্বাদ নেন।
বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেই সাথে যোগ তোমার সাথে আমারও
নয়তো বনে নয় বিজনে নয়তো আমার আপন মনে
সবার যেথায় আপন তুমি হে প্রিয়,
সেথায় আপন আমারও।
এইভাবে পরমের উপলব্ধি ব্যক্তির নিজস্ব আত্মিক মুক্তি যেমন দিচ্ছে তেমনি তাকে আত্মকেন্দ্রিকতার গণ্ডি ভেঙে সর্বজনীনতার মধ্য দিয়ে একত্বের অনন্য উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর, এই যে প্রক্রিয়া ও উপলব্ধি, এটি সর্বজনীন ধার্মিকতা। এখানে কোনো সাম্প্রদায়িক বিভেদ নাই। এখানে কোনো হিন্দু-মুসলমান নাই। এক সর্বধর্মীয় ভক্তিময় প্রার্থনাগীতি এইগুলো।
যে-কোনো উত্তীর্ণ শিল্পের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তাতে যে-বক্তব্য বা আদর্শ রয়েছে তার সাথে সম্পর্কহীন এমনকি তার বিরোধী হয়েও মানুষ তা উপভোগ করতে পারে। ঠাকুরের গানের সুর ও বাণীর ভাব যে আবহ তৈরি করে সেটুকুই শিল্পরস উপভোগের জন্য যথেষ্ট। ঠাকুরের মোনাজাত তাই যেমন নির্বিশেষে সকল ভক্তজনকে অন্তর্ভুক্ত করে, তেমনই অভক্তজনের কাছেও পৌঁছে দেয় অলৌকিক আনন্দের সম্ভার।
২.
প্রার্থনা শব্দটিই জানায়, এখানে চাইবার কিছু আছে। দুনিয়ার মানুষ নানাবিধ চাহিদাবোধে আকীর্ণ। প্রভুর কাছে উপাসনার মাধ্যমে এইসব অভাব-অভিযোগ-কামনা-বাসনা পেশ করে তারা। ‘বেদ’-এর মন্ত্রে-মন্ত্রে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন বৈদিক দেবতার কাছে ধন-বল-সম্পদ-বিজয়-শত্রুনিপাত-যশ ইত্যাদি নানাবিধ চাহিদা ব্যক্ত করা হয়েছে। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও আছে একই ধরনের স্তোত্র-আয়াত ইত্যাদি। ঠাকুরের জাগতিক প্রার্থনা কী?
বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়,
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা
দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।
আত্মমর্যাদাবান মানুষের প্রার্থনা এমন হওয়াই তো সম্ভব।
ঠাকুরের আর্তিময় কিছু প্রার্থনাগীতির উদ্ধৃতি দিচ্ছি। এগুলোর কোনো ব্যাখ্যাই দরকার পড়ে না। স্বমহিমায় এরা উদ্ভাসিত।
১. প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরও আরও আরও দাও স্থান।
২. ভুবনেশ্বর হে
মোচন কর বন্ধন সব মোচন কর হে।
প্রভু মোচন কর ভয়
সব দৈন্য করহ লয়
নিত্য চকিত চঞ্চল চিত কর নিঃসংশয়।
৩. আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার
চরণধূলার তলে
সকল অহংকার হে আমার
ডুবাও চোখের জলে।
৪. আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য কর দহন দানে।
৫. ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা
প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে।
কিন্তু শুধু আকাঙ্ক্ষাই নয়, পূজা-পর্বে তার কিছু গান আছে প্রেমের মহিমা প্রকাশক, কিছু পরমের ঐশ্বর্যজ্ঞাপক, কিছু গানে তাঁকে পাবার আকুতি, কিছু বিস্ময় প্রকাশক, কোনো গানে নিজের দৈন্যের প্রকাশ। জগত ও জীবন সম্পর্কে গূঢ় উপলব্ধির প্রকাশ আছে কিছু গানে। ভক্তিমূলক গানের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ এইসব গান। বাণী ও সুর মিলে পাঁচ হাজার বছরের ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার নির্যাস রয়েছে ঠাকুর-বিরচিত এইসব পদাবলিতে। আর, যে-কোনো ধর্মের অনুসারী ভক্তের প্রার্থনায়-এবাদতে এইসব গান প্রাসঙ্গিক হবার বিভুতিসম্পন্ন।
এখানে একটি জিজ্ঞাসা থাকে। তবে কি ঠাকুরের গান কেবল বিশ্বাসীর জন্যই? যারা কোনো ধর্ম বা স্রষ্টায় ইমান রাখেন না তাদের জন্য কি এগুলো নয়?
যে-কোনো উত্তীর্ণ শিল্পের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তাতে যে-বক্তব্য বা আদর্শ রয়েছে তার সাথে সম্পর্কহীন এমনকি তার বিরোধী হয়েও মানুষ তা উপভোগ করতে পারে। ঠাকুরের গানের সুর ও বাণীর ভাব যে আবহ তৈরি করে সেটুকুই শিল্পরস উপভোগের জন্য যথেষ্ট। ঠাকুরের মোনাজাত তাই যেমন নির্বিশেষে সকল ভক্তজনকে অন্তর্ভুক্ত করে, তেমনই অভক্তজনের কাছেও পৌঁছে দেয় অলৌকিক আনন্দের সম্ভার।